প্রীতি পঞ্চায়েত

   
 বরাক উপত্যকা বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের হাইলাকান্দি অধিবেশনে সঞ্চালক বিল্বদল দেব তার স্বাগত ভাষণে সবার শেষে উল্লেখ করে রঞ্জন সেন এর নামএবং প্রধান অতিথিকে ডাকেও অন্তিম পর্বে । রঞ্জন তাতে কিছু মনে করে নি । বাকি যারা তার সঙ্গে সভায় বসেছিল তাদের বেশির ভাগই কলকাতার ঢাকার সিলেটের স্বল্পখ্যাত বুদ্ধিজীবী । মন্ত্রী আর প্রশাসনিক প্রধানরা ঘিরেছিলেন 
রঞ্জনকে । রঞ্জন সেন তো ঘরের ছেলে । বিল্ব তাকে সম্মান জানিয়ে বলে, রঞ্জনদার ঘরে ফেরা । মহানাগরিক হয়ে যাওয়া রঞ্জন সেনকে একটু সুক্ষ্ম খোঁচায় বিদ্ধ করার প্রচেষ্টা । হবে হয়তো, কথার মারপ্যাচ কত রকমেরই হয়ওসব কেয়ার করে না রঞ্জন, ডাউনমার্কেট কথাবার্তায় থাকে না সে । শ্রীচৈতন্যের মতো বাংলা সাহিত্যবাসরে রঞ্জন সেন এর রাগ দেখে নি কেউ, এট লিস্ট তার উত্তরাশ্রমে । অলওয়েজ লাভারবয় ভাবমূর্তি । শুধু প্রেমের গল্প লিখলেই হবে না, ইমেজটাও ঠিক রাখতে হয় । বলতে হয়, মেরেছিস কলসির কানা তা বলে কী প্রেম দেব না । তবে, যাদের বই বিক্রি হয় না, যারা হিংসুটে, ওরা বলে বড্ড বানিয়ে লেখে লোকটা । এত সাজুগুজু করে পরিপাটি করে নৌকা ভাড়া করে, সেন্ট পারফিউম মেখে কী করে যে অপেক্ষা করে থাকে প্রেম । সাগর পাহাড় বরফ জলে একই ভালবাসার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর । ইস্তাম্বুলের হিপোড্রোমে মিশরের রাজা তুতমোসিসের সঙ্গে এত কী সখ্য । ইতিহাস না জানলেও চলে । তবু বিশাল ওবেলিস্কের তলায় মার্বেলবেদিতে বসেও মেকিং চালিয়ে যেতে হয় । প্রেমের হয়ে ওঠা । এসব নাকি ভ্রমণকাহিনির পাঞ্চ, পাঠকের সঙ্গে তঞ্চকতা, ব্যক্তিগত ভ্রমণকথা কেন পাঠককে জানাতে হবে । রঞ্জন হাসে, ব্যাটারা বীজপুর লালগড় আর খাসপুর ছাড়া তো বেড়ায় নি কোথাও । আর বানিয়ে গল্প লেখার কথাটা তো সেন্ট পারসেন্ট হিংসে । কে বানিয়ে লেখে না, বানাতে হয়, তাল ফল তো আর ঐ উঁচু থেকে বড়া হয়ে নামে না, চাঁদপুরের জেলেনৌকোয় ভাপা হয়ে ধরা দেয় না রুপোলি ইলিশ । তালের বড়া যেমন বাঙালি গৃহবধূর ঘরের শিল্প, সর্ষে নয় কচুশাক নয় কাচকলা নয় স্রেফ কালোজিরে ফোড়নের ইলিশকোলও দক্ষিণ বাংলার অমৃতপদ । স্বাদে যোটক না মিললেও মন্দারমনির রূপোর গৌরাঙ্গ পদ্মাবতীর সঙ্গে অতুলনীয় হয় না । রান্না আর রন্ধনশালাটাই আসল, কুচুটেপনা নয় । নিন্দুকের দলটাই ওরকম । রঞ্জন সেন এর মুণ্ড চাই, কিংশুক পলাশ বিধান সুসময়রা সেই সত্তর থেকে বৈচিত্রহীন একটা গল্পই লিখে চলেছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, এনামে ওনামে । একশটা ক্যামেরা দিয়ে একই দৃশ্য বারবার ঘুরে ফিরে দেখাচ্ছে হিন্দি সিরিয়েলের মতো । পাঠশালার মাস্টার মশাই আর গ্রামের বিডিওর পেডিগ্রি বলে তো কিছু নেই মনের ঝাল ছাড়া । টাটা হাউসের কর্তা হতে পারে, হোমসেক্রেটারি হতে পারে মহাকরণে, একজন লেখক চাইলে কতকিছু হতে পারে । শিথিল বাঙালি কিছুই হবে না । কে বা কারা খালাসীটোলার বাংলা, চাষী শ্রমিকের বিড়ি আর ইনটেলেকচুয়াল হওয়ার চারমিনার ধরিয়ে চলে গেল বিটলেমি করতে মার্কিন মুলুকে । লাকিস্টাইক আর গোলোয়াজ ফুঁকে যখন ফিরে এলো তখন দেশের বিড়ি আর চারমিনার হয়ে গেছে জাতীয় ধূমসুনীল গাঙ্গুলি তো এমন কথাই লিখে গেছেন স্মৃতির জীবনীতে । তার উপর আছে পরিপাটির ব্যাপার, রঞ্জন অনেকবার বলেছে বিগহাউসের সিকিউরিটি খুব কড়া, আটকে দিলে আর কী করা । একটু ধোপদুরস্ত কাপড় পরলেই কিন্তু ঢুকতে দেয়, দাড়িটাড়ি কামালে, চুলে একটু শ্যাম্পু দিলে । শুনবে না কিছুতেই, পুলিশের মাইনে যে কিছুতেই বাড়ে না । পরিশ্রম করতে হবে যে । একই দৃশ্য চলবে না, দৃশ্যান্তরে যেতে হবে । ভেনিস না যেতে পারো খাজুরাহো যাও, বসফরাস না যাও পক ঘুরে এসো আঙ্করভাট না যাও গৌহাটির উমানন্দ ঘুরে এসো । শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে তার আয়ের অধিক কিছু দেখাও, স্বপ্ন দেখাতে কার্পণ্য করলে চলবে না । গ্রামের সবজিখেত খাটা পায়খানায় সে বিস্তর দেখেছে গরিবি । বিলাসের আভাস দাও, রুলেটের মার্বেলে ছুঁড়ে দাও সব পাওয়ার ম্যাজিক । তিন কোঠার স্লটে যদি লেগে যায় তাহলে যে ঝনঝনাঝন । না হলেও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই কিছু, খাব থো আর খোব থা হয়ে যেমন আছো তেমন থাকো লিটল ম্যাগাজিন নামের ঝাণ্ডিমুণ্ডার দান আঁকড়ে । হারলে বড় জোর ছত্রিশটাকার ঘড়ি যাবে, পঁচিশ টাকার লণ্ঠন যাবে, হ্যাজাক গেলে গায়ে লাগবে, সাইকেলটাও বড় প্রিয় । বৌ যাওয়ার আগে ভাগ্য উল্টোপাক পেয়ে যাবে চিন্তা নেই । তত্ত্ব বিশারদরা যে ম্যাজিক করবে, বলবে সাংস্কৃতিক ইতিহাস, বলবে বিনির্মাণ, উত্তর-ঔপনিবেশিক ইত্যাদি, আরো জমবে যখন বলবে লৈঙ্গিক বৈশিষ্টে উজ্জ্বল । যৌনতার প্রতিবেদন বললেও শ্লাঘা হয় । রঞ্জন সেন ওসব তত্ত্ব ফত্ব বোঝে না, টাকা কামাতে হলে যা করার তাই করে, সে স্বপ্ন বিক্রি করে । পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত কলকাতার নাগরিক জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুখের উপকরণ খোঁজে দিয়েছে পাঠককে । দক্ষিণাপণ ডলি বসুর চায়ের দোকান থেকে শুরু হয়েছিল যে প্রেম তাকে পত্রে পুষ্পে বিকশিত করে নিয়ে গেছে সিগরি বরিস্তা আরসালান সামপ্লেস । কলকাতার বাইরেও ঘুরেছে, বরানগর পেনেটি সোনারপুর পানিটেংকি থেকে বিশ্বভারতীর সুবর্ণরেখা পুরুলিয়ার সাহেববাঁধ পর্যন্ত । তবে ঘুরে ফিরেই শিলচরে তার শিকড় ছুঁয়ে এসেছে মহিমালয় কিংবা ননীদার চায়ের দোকানে । ইদানীং বিদেশভ্রমণের সূত্রে বৈচিত্রময় হয়েছে তার প্রেম । হাজার ডলার ব্যয় করে তুলুজ লোত্রেকের উইন্ড মিল  এর কার্নিভাল দেখেছে উদ্দাম ক্যানক্যান নাচের তালে শতবছরের মুলারুজ আবিষ্কার করেছে সেইন নদীতে মোচার খোলায় দুলেছে দুজনে । শিল্পটিল্পও হয়েছে কম নয় । লুভ্রতে একদিন কাটিয়ে দু তিনটে তো স্টোরি বনতা হ্যায় । পাশেই পুরনো দুনিয়ার জীবনঘর লণ্ডন, যুবরানি ডায়নার দেশ । কথায় আছে লণ্ডনে বিরক্ত হলে মানুষের জীবনও অসহায় হয়ে পড়ে । আডাই মাইলের শহরে জীবনের সমস্ত উপকরণ ঢেলে দিয়েছে রোমানরা । অ্যাংলো স্যাকসন না বলে রোমান বলায়ও রাগ করেছে অনেকে । ইস্তাম্বুলের হাগিয়া সোফিয়া মসজিদে বাইজানটাইন চার্চের কারুকর্ম খুঁটিয়ে দেখায়ও গোঁসা । না গেলে ওসব দেখা যায় না বিষমতা । কার্স নামে কোনো শহর আছে কিনা জানে না রঞ্জন, ওটা টুকলি করেছে পামুক থেকে । নিন্দুকেরা ধরতেই পারেনি ।
            
    তবে হ্যাঁ, রঞ্জন সেন এর মুদ্রাদোষও আছে । নামের পাগল মানুষটা, মিনি নামটা ভাল লাগল বলে ছাড়তেই পারে নি এক জীবনের সাহিত্যকর্মে । বৌ ভাবে সে মিনি, যার সঙ্গে ফস্টিনস্টি সে ভাবে হিরোইন । ওদের নাম দিলেও আপত্তি থাকার কারণ নেই, রঞ্জন সেন এর নায়িকা হতে কে না চায় । কবিতা লেখা বুলবুলি শেখ ফেসবুকে লিখে দিলো রঞ্জনের নাম নিয়ে । রঞ্জন ভণ্ডামি করে নি, বলেছে হবে হয়তো । আসলে, তখন বুলবুলিটা বেশ চনমনে, আপার হাউসে আনাগোনা হাই-সোসাইটি, একটি পার্শ্বচরিত্রে ছিল মন্দ না, তখন তো রঞ্জনের ফসল তোলার দিন । তবে এসব ক্ষণকালের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না রঞ্জন । স্থান নাম নিয়েও অধিকারবোধ কাজ করে তার । যেমন ইদানীং হয়েছে বসফরাস । তিনটে গল্পে তিনদিক থেকে দেখিয়েছে প্রাচী প্রতীচীর জলপানি ওয়াটার । একবার বিশাল তোপিকাপি প্রাসাদ থেকে ইউরোপ গামী রাশিয়ান রণতরীর মিছিল, আরেকবার গ্র্যাণ্ডবাজারের চাতাল থেকে । এতদেশ ঘুরেছে রঞ্জন কিন্তু এই কাপালিকার্সির মতো বাজার দেখে নি কোথাও । কলকাতার নিউমার্কেট নিয়ে প্রাচীন গর্ব খান খান হয়ে গেছে তার । কী নেই শহরের কেন্দ্রস্থলের এই বাজারে, একটা বাজারে চার চারটে মসজিদ মিনার সহ, ভাবা যায় । আতরের বাজার থেকে সমুদ্র প্রণালীর সংযোগ কারী সেতুগুলিও দেখায় কী অসাধারণ । আর একবার, নৌকো করে বেড়িয়েছে মায়াবী সুনীল জলে, সঙ্গে নীলনয়না গ্রীক সুন্দরী লুবলুবা হায়াৎ । যে মেয়ে কিছুতেই নিজেকে ইউরোপীয় বলবে না, বলে সে উজ্জ্বল এশিয়াবাসী । তবে সংস্কৃতির পূর্বপশ্চিমের এই মিলনজল,দুইমহাদেশের বিভাজনকারি পানিরাশি রঞ্জন সেন এর রক্তের ভিতর খেলা করেছে অনেকদিন ।




দুই  
  অলকানন্দা সেনকে ইতিহাস বুঝিয়েছে রঞ্জন । ভূগোলের গ্রীস আথেন্স কনস্টান্টিনোপল বুঝিয়েছে । ইতিহাস কী করে ভূগোলের নাম পাল্টে দেয় শুনিয়েছে । অটোমান সুলতানরা মন্দ ছিল না, মুসলমান খৃস্টান পাশাপাশি থেকেছে । বসফরাসের ওপারে টিলার উপর ইহুদিদেরও রেখেছে অবজ্ঞায় । ধর্মযুদ্ধ, ক্রুসেড হয়েছে একটার পর একটা, আর পরিণতিতে জয়ীপক্ষ বাক্সবন্দী করে ইস্তাম্বুল থেকে তাড়িয়েছে সব বিধর্মী । এত যুদ্ধবিগ্রহের পরও রঞ্জন সেনএর প্রিয় শহর ইস্তাম্বুল । প্রিয় জল বসফরাস । প্রিয় সেতু ঢোপিকাপি সেতু । আর প্রিয় মানবী, পাশে পাশে থাকার মিনি । অলকানন্দার কী আনন্দ, ভ্রমণের সুখ এমন রোমান্টিকতায় লিখতে পারে তার মানুষ, পাশে যখন থাকে কিছুই বুঝা যায় না । বিদেশে গেলেই শুধু নামীদামী মদের বোতল কেনে আর খায় আকণ্ঠ । খালি বোতলে লাগেজ ভর্তি করে ফেরে বাড়ি, সাজিয়ে রাখে সেলার ঘরে । তখন সদ্যসদ্য বিয়ের পর খুব শখ ছিল চুমু খাওয়ার, মদমুখে চুম্বনে কোন টেস্ট পায়নি মিনি তাই একসুখ মাইনাস । একটা বিয়োগ করলে যদি সব প্লাস হয়, মিনি মেনে নিয়েছে তার বর্ণিল মানুষকে প্রেমের বিয়ের রঞ্জনও বিয়ের পরপর বলেছে, এত বড় নামে ডাকা যাবে না । বলেছে,
--- তোমায় একটা ছোট মিস্টি নামে ডাকব এবার থেকে ।
--- আমাকে তো সবাই নন্দা ডাকে, ছোট নামইতুমি এত বড় করে কেন ডাকো ?
--- ওটাও ডাকতে হয় । যখন ঝগড়া করব, রাগ হবে তখন তো আর মিস্টি নামে ডাকব না । তখন বলব চিৎকার করে, চুপ করো অলকানন্দা
--- আর চুপ করে যাব ?
--- আমার মিনি চুপ করে যায় ।
--- গল্পের মিনি আর আমি কি এক ?
--- হ্যাঁ, তুমিই আমার মিনি । তোমাকে ডাকব ।  

তিন  
 রঞ্জন সেন অথর নিয়ে তখন মিনি মুগ্ধ । তাই মিনি ডাকলে জবাব দেয়, পরিচয় করিয়ে দিলে হাসে । পাঠক সম্পাদক প্রকাশক সবাই জানে রঞ্জন সেন এর মিনিকে । এমনকি তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামও চেনেবিয়ের আগে অনেকবার গেছে দেউলিটি । মিনিদের দেশের বাড়ি সামতাবেড়ে গ্রামের নয়ানজুলিতে বসে বসে মাছও ধরেছে বর্ষার দিনে । শরৎচন্দ্রের প্রতিবেশী বাড়ির মেয়ে বলেই হয়তো সূত্রপাত প্রেমের । সুখের আক্ষেপে মিনিকে বলেছে,
--- শরৎবাবুর নাতনি হয়ে, সাহিত্যিক রঞ্জন সেন এর স্ত্রী হয়েও দুছত্তর লিখতে শিখলে না । হেলাফেলা কেটে গেল সারা বেলা ।
--- বেলা এখনও শুরুই হয় নি গো মশাই । যদি বলো, পার্সিয়ান মাছের কাবাবটা তাহলে নামিয়ে রাখি । চপার ছেড়ে পেন নিই হাতে ?
--- না না রান্নাটাই চলুক । আমার লেখার পড়াটা শুধু ছেড়ে দিও না । মাহি কাবাব যেমন নার্গিস এসকানাজ না কি যেন একটা মুরগির ঝোল কিন্তু তোমার হাতে খেলে ভাল ।
--- তোমার হাতে যেমন খুনসুটির ছোটগল্প । তাই না ? লিখতে না পারি লেখাতে তো পারি প্রিয় । ইরান ইরাক তুরস্ক আর ইউরোপের সেদ্ধ খাবার খাইয়ে কেমন একটা নধর লেখক বানিয়েছি বলো ? শরৎ চাটুয্যের গ্রাম সম্পর্কিত নাতনিটি না হলে বাংলা জগতে কে জানতো বলো রঞ্জন সেন দ্য গ্রেটকে ?






চার
  তাও কী ঠিক । হয়তো তাই । রঞ্জন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না এলে হতো না কিছুই । বরাক উপত্যকা তো স্বপ্নের দেশ, স্বপ্ন দেখার দেশ । আর স্বপ্ন দেখার অভ্যাস মানুষকে অলস করে । সাজানো স্বপ্নকে বাস্তবে নিয়ে আসতে, চাই বেরিয়ে পড়া । তালুক ছেড়ে মুলুক ফেলে বেরোতে না পারলে সোনাবাড়িঘাট বেসরকারি স্কুলের প্রিন্সিপাল হওয়া যায় বড়জোর, কিংবা মাকুন্দা দিবা কলেজে বাংলার অধ্যাপক । রঞ্জন সেন তার জীবনকে ফর্মুলা ওয়ান এর চালকের মতো দৌড় করিয়েছে । তুলনামূলক সাহিত্যের এমএ আর হোমিওপ্যাথির এমবিবিএস নাকি এক ঠাট্টা করার মুখোমুখি সাহস কেউ দেখায় নি, তার নাগালও কেউ পায় নি । সাংবাদিক হয়ে সাহিত্য করেছে । সাহিত্য করতে করতে ব্যবসা করেছে, সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসায়ী অথর হয়েছে । ক্যানভাস বড় করে এঁকেছে । শেকড় বাকড় উপড়ে ফেলে স্যাণ্ডি স্টর্ম হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশ বিদেশ । কিন্তু রঞ্জন সেন তো এমন ছিল না, শিলচর ছেড়ে নড়তে চাইত না । বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে যেতে চাইত না কোথাওগরমের ছুটি পূজোর ছুটিতে ছোটমাসি মেজোমাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েও প্রতিদিন এনভেলাপে নীলুকে চিঠি লিখেছে । ফিরে আসার পর দীপাল দিলু প্রতীক নীলুরা বলেছে, তোর চিঠি জমিয়ে রেখেছি রে, ভ্রমণ কাহিনি ছেপে বের করব কলকাতা থেকে । অন্যজন বলেছে, আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে নিয়েছি । বলেছে, একটা প্রেমের উপন্যাস লিখে দে না চিঠি গুলো দিয়ে । বলেছে, কী করে তোর এত প্রেম হয়ে যায় রে যেখানে সেখানে যখন তখন । ডিমাপুর কোহিমা শিলং ইম্ফলে । লুংলে গিয়েও পেয়ে গেলি শাড়িপরা আগাথাকে । ঢপ না সত্যি । বিভ্রান্ত বন্ধুদের দিকে মায়াবী হাসি ছড়িয়ে ননীদাকে বলেছে স্পেশাল চাফি দিতে, চায়ের সঙ্গে সামান্য কফির গুঁড়ো ।  



পাঁচ   
 বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার  কবছরেই টিন আর যৌবনের ক্রসরোডে বেশ কিছু প্রেম প্রেম খেলার ঠিকানা রঞ্জন রেখেছে কলকাতার দুর প্রবাসে । গল্প তখন জমছে মনে মনে । গোডাউন ভরা কাঁচামালের স্টক । মিনির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বেরয় ফিনিসড প্রোডাক্ট । মিনির নামে গল্প লেখার শ্রীগণেশ । ভরপুর ভালবাসার সন্ধিসময় । মিনি পড়ছে এক একটি গল্প আর আপ্লুত হয়ে ভেবেছে এতো তারই কথা, তাদের কথা । তারই শাড়ি, শাড়ির পাড়কথা । মিনি বলেছে,
--- আমি তো তোমাকে এমন কথা বলিনি কখনও । শিলং পিকে যাইনি, ভুটিয়া মন্দিরেও যাই নি । তবে গেছি রুমটেক মনেস্টারি,  তবে তুমি যেমন লিখেছ, ওমন পত্পতানো পতাকা দেখেছি । আবার তুমি পাশে নেই বলে উদাস হয়েছে মন ।
রঞ্জন তার ভুবনমোহন হাসি দিয়ে বলেছে,
--- ভালবাসা পেলে জেনো সব হয় । তোমার শাড়ির পাড়ের কল্কারাও কানে কানে কথা কয় তখন । কাছে থাকতে ডাকে ফিসফিসিয়ে ।
--- আমারও জানো এমন হয় । একটা আকাশী রঙের টেরিলিন শার্ট দেখেছি শুধু । মিস করিনি, ভুল হয় নি । তোমার দেখা পেয়েছি কলেজের ক্যান্টিনে 




ছয়  
  মিনি রঞ্জনে আর রঞ্জন সেন মিনিতে ছেয়ে গেছে । রঞ্জনও তাই পিরিতি মহব্বতের গল্প লেখা ছাড়তে পারে নি । তবে যত সময় এগিয়েছে তত হিসেবি হয়েছে । পরের দিকের লেখায় তেমন বুনো গন্ধ নেই আর । যেমন ছিল কপিলদেবের উদয়কালীন ছক্কায়, ছিটকে দেওয়া স্টাম্পের বিস্ফোরণে । এরপর সব কেমন নিয়ম বাঁধা রোমান্টিকতায় ছেয়ে যায় । কী জানি কী । প্রতিষ্ঠার বিড়ম্বনা হয়তো । মাপা শটে খেলতে গিয়ে ছক্কা তেমন হয় না, রোমান্টিক হয়, স্টেডি হয় । একে একে সব এসে জড়ো হয় লেখার রন্ধননলায়, তত্ত্বের দারুচিনিও যোগ হয় । নিম্নবর্গ নারীবাদ যৌনতা বিনির্মাণ যাদু সব কিছুর ঘেঁট হয় একটা দুটো । পাঠক থেকে প্রাবন্ধিকের টেবিল গিয়ে পড়ে হোম ডেলিভারির প্যাকেট । ছোটগল্প লিখতে লিখতে মনে হয় এবার একটা বড় আকাশ হোক । ক্যানভাসটা বড় চাই । সবাই কেমন নভেল লিখে ফেলেছে টপাটপ । এমএ শাজাহান একটাও ছোটগল্প না লিখে শুধু উপন্যাসের বেস্টসেলার এখন । বারোটা করে উপন্যাস দিয়ে সমগ্র বের করেছে আকাশ পাবলিশার্স । রঞ্জন সেন তাই মনস্থ করে এবার উপন্যাস লিখবে মারকাটারি, পঞ্চাশের এই প ড়ন্ত বেলায় ।




সাত   
  সব মানুষেরই পরিণত বয়সে শেকড়ে ফেরার একটা ইচ্ছে হয় । কেউ লেখে আত্মকথা, যে তত বিখ্যাত নয় লেখে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস । তা বলে কী রঞ্জন সেনও লিখবে গতানুগতিক স্মৃতির সুড়সুড়ি । নৈব নৈব চ । তবে শেকড়-দেশকে উপজীব্য করে লেখাই যায় একটি উপন্যাস । মেইডেন নভেল । তাজ বেঙ্গলের মোগলসরাই জংশনে বসে রঞ্জন সেন ইন্টারভিউতে এসব কথা সাজিয়ে বলছিল মিত্রা পাণ্ডবকে । দৈনিক আকাশের জন্য মশলাদার সাক্ষাৎকার দিতে দিতে । রঞ্জন সেন এই মেয়েটিকে খুব পছন্দ করে । বেশ একটা ঢলে পড়ার ভাব আছে, কিন্তু পড়ে না । খুব প্রফেশনেল রঞ্জন সবে একপাত্র মার্টিনি গলায় ঢেলেছে, একটু রঙিন মধ্যযৌবনের কথা ও প্রীতিকথা, তখনই সে তার বহুব্যবহৃত সংলাপ ভেঙে খোলা চোখে ছুঁড়ে দেয় মিত্রার গায়ে । বলে,
---ভারি সুন্দর তো ?  রঙটা কী পিংক ?
--- না ডেমসন ।
--- মানে ?
    রঞ্জন সেন মিত্রার থ্রি কোয়ার্টার সেল্ফ ফেব্রিকের জামাটা পছন্দ করে । প্যানেলড স্কার্টটাও দারুণ । আসলে মহিলাটি একটি আস্তো প্যাকেজ । পঁয়ত্রিশ বছরের ফ্রিসাইজকে নামিয়ে রাখে পঁচিশ বছরে, এটলিস্ট দশ বছরের গ্রেস । তাই রঞ্জন সেনও আর একটু এগোয় । বলে,
--- আমি অপছন্দ করি । আই ডোন্ট লাইক ।
--- ইয়েস স্যার ।
   মিত্রার মুচকি হাসিকে সম্মান জানিয়ে রঞ্জন সেন বলে,
--- আমার সামনে বসে, এই জংশনে, একজন অতিসুন্দরী যুবতি এক মাতাল লেখকের বকবক শুনছে, এ হয় না । দুপাত্রের পর সামনের জন একটু ফ্লার্টি না হলে কী হয় । নেশাটা বেশ জমেছে, আর একপাত্র কী এলাউ করবে টেকো বুড়ো ? তোমার এডিটার ?
--- অন্য কিছু নেবেন স্যার ?
--- নো, মাতাল গন্ধের কিছু চলবে না । বাইরে বেরোলে সবাই শোঁকে । তুমি নেবে ? বলো ? আদারওয়াইজ আমার অর্দ্ধেক আকাশ ঢেকে দেব নৈঃশব্দ্যে
--- সে আমার জানা আছে রঞ্জনদা । ড্রিংকস এর পর আপনি খুব সুইট হয়ে যান । তখন শুধু মুচকি হাসি । ওতেই হবে আমার । লিখে নেব বাকি অর্দ্ধেক ।
--- তুমিও ভারি মিস্টি ডিয়ার । খাবে না ? এ জেম অফ এ ড্রিংক । এই একটা মাত্র জায়গায় তুমি রিয়্যাল মার্টিনি পাবে, রিয়্যাল অলিভ । একেবারে তোমার মতো, নেশা বাড়িয়ে দেয় । আচ্ছা আমি খাওয়ালে খাবে তো ?
--- আপনি কেন ?
--- আমি আরো দুটো নেব ফোকটে । এবার কিন্তু মধুগন্ধে ভরা ।
--- নিন না, আপনার জন্য সব দেবে আকাশ ।
--- রিয়্যালি ? ভিকিরি পেয়েছো রঞ্জন সেনকে । আমি খাওয়াবো বলেছি, খাওয়াবো ।
--- অগত্যা ।
--- গুড বালিকা । তা হলে ঐ কোনের টেবিলে কোট টাই পরা ভাতের দলাটিকে ডিস্টার্ব করে আসতে হবে । পারবে ? ডোন্ট ওয়ারি, যেমন র‍্যভিশিং আউটফিটে আছো সুন্দরী, আজ তোমারই দিন । যাও না, ওর নাম শিবনাথ পুরকায়স্থ, শিবু, আমার দেশিভাই । নিউজ চ্যানেল চালায় । প্রিন্ট মিডিয়ায়ও কি একটা আছে ডেইলি । শিলচরের নাম শুনেছ ? বরাক ভ্যালি, সেই নদীর হাঙর, এখন হুগলিতে খাবি খাচ্চে । বলবে, রঞ্জন সেন ওয়ান্টস,
--- কী বলব স্যার ?
--- রঞ্জন সেন ওর সঙ্গে বসতে চায় । বাকিটা আমি করব, যাও ।
    শুধু জায়গা বদল । এরপর মিত্রা পাণ্ডবও মেরে দেয় দুই পেগড্রিংকসের পর মিত্রার ফর্সা মুখের রং বদলায়, হয়ে যায় টকটকে লাল । হয় আরো বেশি ইয়ে । রঞ্জন সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পায় না । মিত্রাকে ধরেও রাখতে পারে না, টাকিলা খাইয়ে ওকে নিয়ে চলে যায় শিবনাথ তার চ্যানেলে । রঞ্জনের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে যায় আর এক পাতিমাল, যশোময় পালকে । শিলচর স্কুলের লাস্ট বেঞ্চার যশ এখন ঘ্যামা পাবলিক । যশ রঞ্জনকে আশ্বাস দেয় । বলে,
--- ডোন্ট ওয়ারি । আমার কাছে আছে গুরু ।
--- কী আছে ?
--- তোর বালক বেলা । শিবুটাতো ইডিয়েট, তোর লাভার ভাগিয়েছিল, এখানে এসেও শালা...  
--- অ্যাই, তুই কেরে ? মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজশিবনাথ আমার বেস্টফ্রেন্ড । আর লাভার কী ? বস্তাপচা কয়েন । কার কথা বলছিস ?
--- কেন শিবুর বউ, নাউ ওয়াইফ অরুন্ধতী । গভটগার্লসের পেছনদিকে চার্চের বাগানে কম লাইন মেরেছিস ?
--- ওহ্‌ শিট, আবার সেই ফিলদি ল্যাঙ্গুয়েজ, হোয়াট ইজ ইট যশ ?  
--- তুই ভুলে গেছিস ? সত্যি মনে পড়ে না অরুন্ধতীর কথা ? আমাদের তরণী বাওয়া ?
--- আবার ভাষার গোলমাল । তরণী ইজ নট ইউজড ইন কলোকুয়েল ।
--- ঠিক আছে । মনের দুঃখে আমার সাইকেলে ডাবল কেরি করেছিস বরাক নদীর পারে, গান গেয়েছিস ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে । ভাঙা রেকর্ডের মতো একটি লাইনই গেয়েছিস বারবার । ভুলে গেলি ? চাতলার পাশে শামপুর গ্রাম মনে পড়ে ? মোহনবাঁশিদার নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে গেলামমাছ ফাছ ফালতু, তুই শুধু বিলাপ করে গেলি অরুন্ধতী নিয়ে । মোহনবাঁশি পাটনি আমার বাবার রায়ত, আমাদের খাইয়েছিল আনাতেলে ভাজা মাছ । আমার সাইকেলের ঝুড়িতে ছিল নাগাপট্টির বাংলা ।
--- বাংলা ?
--- ওই আরকি, আসাম এক্সাইজ । কিছু একটা নিয়ে গেছি, সিংহমার্কা ব্র্যান্ডিও হতে পারে, এতদিনের কথা । কিছু তো হেজি হয়ে গেছে । মোহনবাঁশিদার বৌকেও ভুলে গেলি ? কাঞ্চন বৌদি, বলেছিলি  অরুন্ধতীর মতো দেখতে ।
--- অ্যাই শালা, বৌদিকে নিয়ে ইয়ার্কি ? যশ এর বৌ নিয়েও কিছু বলবি না ।
--- ওকে । চাতলা হাওরের ধীবরদের দুঃখে কাতর হয়ে সেদিন কী বলেছিলি মনে আছে ?
--- নো । মাল খেলে আমার কিছু মনে পড়ে না । লুপ্ত সময়ে আমি ফিরে যাই না ।
--- আমি যে দোস্ত লস্ট টাইমেই থেমে আছি । এখনও সময় পেলে মাঝে মাঝে যাই মোহনবাঁশিদার বাড়ি । তোদের পরিত্যক্ত উইন্ডো থেকে আকাশ দেখি হাওরের জল দেখি ।
--- তুইতো প্রিন্ট মিডিয়ায় আছিস । বাপের কাগজের মালিক ।
--- ডেইলি পেপার চালালে মন্ত্রী সান্ত্রী হাতে থাকে । মাল কামানো যায় দেদার ।
--- আমি মুতব ।
--- কোথায় মুতবি । ফাইভস্টারে যে কোথায় টয়লেট, মাল খেলে বুঝা যায় না ।
--- আমি তোর মালের উপরে মুতব ।
আট
 মুতব বলেই চলে এসেছিল রঞ্জন । আসলে ওর তখন মনে হয়েছে যশ মানুষটা একটু ইতর । রঞ্জন মেয়েদের সম্মান করে, অ্যাডমায়ার করে, ভালগারাটি একদম পছন্দ করে না । অবশ্য ভেবে দেখলে রাগটা ওর যশোময়ের উপর যতটা তার থেকে বেশি শিবনাথের উপর । কেমন দুপাত্র নেশায় ভুলিয়ে মিত্রাকে নিয়ে চলে গেল ড্যাঙড্যাঙিয়ে । যশোময় তারপর লেজার টাইমে তার পুরনো একজিমা খামচে দিলো আবার । অরুন্ধতীর মতো এক সাধারণ কিশোরী নিয়ে কোনো লড়াই নেই তার কোনো কালে । তবু শিবু কেন যে জয়ী ভাবে সবসময় । আর মিত্রা পাণ্ডবকে নিয়ে চলে যাওয়াও কী জয় । ফুশ্‌, সাতজন্মের কর্ম নয় শিবনাথ পুরকায়স্থর । যতই হও মিডিয়া ব্যারণ, মিত্রা কে চেনো নি চাঁদু, আমের বড়ার মতো চুষে ফেলে দেবে । হ্যা, মিত্রা থাকলে বাতাসে একটা যৌনতা থাকে, এয়ারি সেক্স হারানোর দুঃখ হয়েছে তার । আর যশোময় পাল, শিলচরের মালদার হলেও ম্যান্টেলিটি খারাপ । লোয়ার মিডলক্লাস । একলাইন বাংলা বলতে পারে না ঠিকঠাক । সে আবার রঞ্জন সেন এর ক্লাসমেট । তবে একটা শুদ্ধ কথা বলেছে, ওকে উস্কে দিয়েছে ধীবর কথায় । কৈবর্ত বলতে পারত, মাইমল মাছুয়া পাটনি দাশ বলতে পারত । বলে নি ।





নয়
  বাড়িতে এসে একপ্রস্ত বমি করে রঞ্জন । একটু বেশি হয়ে গেলে যা হয় । শিবুটার বড় ফুটানি । মিত্রার সামনে কেমন নেগলেক্ট করে গেল । বলে কিনা,
--- টাকিলা ফাকিলা ছাড়, সোজা বিলিতিতে নেমে আয়, আমরা যেমন খাই, ব্ল্যাকডগকালো কুত্তা ।
   বলেই চলে যায় মিত্রাকে নিয়ে । জবাব দেওয়ার সময় না দিলে আর কী করা । মিনির কাছে মাফ চেয়ে নেয় রঞ্জন । বলে,
--- আর খাব না বাইরে । আমাদের ভালবাসার কসম । এবার কিছু খেতে দাও
--- কী খাবে ? রুটি না ভাত ?
--- ধীবরপোড়া ভাত । আছে ?
বলে,
--- না । আজ শুধু কাব্যপাঠ করব । সুনীল গাঙ্গুলির কবিতা পড়ব, নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম..., কী যেন দিলাম, ভুলে গেছি । জীবনানন্দের কবিতাটা কেমন বলো, চুল তার কবেকার..., আচ্ছা কুসুমকুমারীর কবিতার বই আছে আমাদের, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে... । মিত্রা পাণ্ডবের কবিতার বইটা বের করো, নৈঃশব্দ্যের বন্দনা... ।
   বমিটমি করলেও হ্যাংওভার থাকে না রঞ্জন সেন এর । মিনির মতো বৌ থাকলে পরিচর্যা হয় । বেশ ফুরফুরে সকাল হয় এককাপ গ্রিন টি খেয়ে দুজন পরে নেয় নীল রঙের ট্র্যাকস্যুট আর সাদা নাইকি স্নিকার । বেরিয়ে পড়ে প্রার্তভ্রমনে । পাতি বাঙালির মতো লেকের ধারে কিংবা হর্টিকালচারে যায় । ছুটির দিনে যায় গোচারণ, সকাল থেকে সন্ধ্যে বাগানবাড়ি । নারকেল চারায় গোবর সার দিতে দিতে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বিস্তর বকাবকি করে রঞ্জন, নতুন লেখার পায়তারা শোনায় মিনিকে । বলে,
--- আমাদের সঞ্জীবটা কেয়ার টেকার হিসেবে মন্দনা, কী বলো ?
--- মন্দ কে বলল ?
--- না, ভাবছি এবার একটা উপন্যাস লিখব নিম্নবর্গ নিয়ে ।
--- সঞ্জীবকে নিয়ে ? চাটুয্যে বামুন ?
--- একটা নাম ঠিক করেছি, বলব ?
--- জানি ।
--- কী জানো ?
--- ধীবর বিবরণ ।
--- অ্যাঁ, কী করে জানো ? কাউকে বলিনি তো ? নিজেকেও কী বলেছি ? তুমি যে দেখেছি অন্তর্যামী ।
--- তা নয় । আমার মনের কথা ভাঙিয়ে গল্প লিখলে সারাজীবন, তোমারটা জানব না ?
--- ইমাজিনেশনটা আছে । তবে কাউন্ট কম, সেন্ট পারসেন্ট নয় । ধীবর বিবরণ কোন উপন্যাস নাম হয় না । পাঠক নেবে না । ধীবর কথা হতে পারে ।
--- প্রেমের উপন্যাস তো হবে ? ধীবরটি কে ? আবার মিনি ?
--- না মিনি একটু আরবান হয়ে যাবে । কাঞ্চন হলে কেমন হয় ? কাঞ্চনমালা । মোহনবাঁশিদার বৌ ।
--- কাঞ্চন মাঝে মাঝে, ডাক নামে মালা মন্দ না । রাগলে কাঞ্চনমালা । গায়ে মাছের আঁষটে গন্ধ থাকবে ?
--- একটু থাক না, ওটা ইউ এসপি । পরে পুষ্পগন্ধা করে দেওয়া যাবে । লেখক তো সব পারে । মি. ব্যাস পারলে আমিও পারব ।
--- দেশ এ দিয়ে দাও ধারাবাহিক । চাতলা ধীবরী ।
--- এতসব জানো ? চাতলাও জানো ? যা জেনেছো জেনেছো, নামটা মন্দ না । চাতলার হাওর নিয়েই লিখব, তবে একটা কনফ্যুশনও আছে । চাতলা শব্দটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে জানি না ।
--- চাতলা তো চাতল থেকেই হওয়া উচিত । তোমার ছোটমামী উঠোনকে বলে চাতল ।
--- তাই তো ? বিশাল এক উঠোনের মতো জলাশয়থ্যাংক ইউ মামী । আর হাওর ?
.--- কামিনী কুমার রায় এর লৌকিক শব্দকোষ কনসাল্ট করতে পারো । হাওর মানে সাগর হতে পারে, সায়র । আর তোমাদের দেশেও তো শালাকে হালা বলে । চাতলা হাওর আমি দেখেছি বর্ষায়, প্রায় সাগর হয়ে যায় ।
--- তথ্য যোগানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে । এক চাঁড়ালের ধন লুণ্ঠন করতে তোমার দেওয়া নামটাই ফাইন্যাল ।



দশ
 রঞ্জন সেন যশো পালের টাকায় মূত্রত্যাগের কথা বলেছে মদের ঘোরে । মিনির মুখেও ধীবর কথা তথা চাতলা ধীবর লেগে যেতেই বদলে গেল মতটা । যশকে বলতেই সেও রাজি । বলে,
--- তুই লিখবি ? আমার কাগজে ? শিলচরে ? কামব্যাক স্টোরি ? একটা হাইপ তুলতে হবে গুরু । রঞ্জন সেন লিখলে আর কোন দৈনিক ধারে কাছে থাকবে না আমার । ওকে, চলে আয় শিলচর, টিকিট পাঠাচ্ছি দুজনের । সঙ্গে থাকা খাওয়া গাড়ি ফ্রি ।
--- তোর ফ্রিতে আমি মু... । ওকে, কত দিবি ?
--- চেক একটাও পাঠিয়ে দেব ।  






এগারো
    মিনি রঞ্জনের দাম্পত্য আর ভালবাসা এখন বাংলা সাহিত্যের মিল ও বুন । এক জীবনে উদ্দাম প্রেমের সব চাঞ্চল্যকর উন্মোচন । পাঠক মনোরঞ্জনী গল্পকথার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা । গল্পের বরাত পেয়েই রঞ্জন মিনিকে বলেছে চলো । মিনিও রেডি তৎক্ষণাৎ । ব্যগ্যার কম্বিনেশন তালায় নম্বর মিলিয়েছে সাত আট নয় । সেন মশাই এর এস ফর সেভেন ইফর এইট এন ফর নাইন । মিনির যে ধ্যানজ্ঞান সবই তার পতি, তার লাভগুরু একেশ্বর মহারাজ । বলে দ্বিতীয় পুরুষের দিকে মুখ তুলে দেখেনি জীবনে । রঞ্জনের সব জানে মিনি, মিনি বিশ্বাস করে নেশার ঘোরে মানুষ অকপট হয়, সত্যিকথা বলে । আর রঞ্জন তো দিনের শেষে স্ত্রীর কাছে একবার কনফেশন দেয় । তাই রঞ্জন রাতের বেলা যা যা বকে তাই মিলিয়ে সুখের সংসার সাজায় । রঞ্জন বুদ্ধি করে মিত্রা পাণ্ডবের কবিতার বইএর কথা পর্যন্ত বলে । বলে না শুধু পঞ্চাশ বছরের ম্যান আর পঁয়ত্রিশ বছরের ছুঁড়ির লংড্রাইভ বৃত্তান্ত বকখালি কোলাঘাট ডায়মণ্ড হারাবার, সাকুল্য তিনবার । ওসব স্ত্রীকে বলার বিষয় নয় । বরং শিবনাথ পুরকায়স্থর সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া, মিত্রার হাইজ্যাক হওয়ার গল্পটা হাইলাইট করেছে । বলেছে বোকাচাঁড়াল যোশময়ের কথা । মাথামোটা প্রৌড় বললে এজ মিরাকল হয় । মিনিকে বলে,
--- চলো । যাই শিলচর । তোমার মথুরাপুরি । একটা শর্টট্রিপ দিয়ে আসি ।
   মিনির অরাজি হওয়ার কিছু নেই । রঞ্জনের স্বদেশ হলেও মিনির কেউ নেই বরাক উপত্যকায় । তবে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে তার ভালই লাগে । শ্বশুর বাড়ির দেশে যেতে কার না হাউস হয় । প্রথমবার যখন শিলচর যায় বিয়ের পর রঞ্জন খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে উল্টোপাল্টা কথা দিয়ে । বলেছে,
--- যাবে ? এখনও ভেবে দেখ ? ভাষা ভিন্ন রুচি ভিন্ন । শনবাঁশের বাড়িঘর । সাপ আর বাঘ শেয়ালের উৎপাত । কাঁচা টয়লেট । মুখের কথাও কাঁচা । কই যাইতা কিতা খাইতা, ভালা নি আর  অয় অয় ।
--- অসমীয়া তো ? হিন্দিতে চালিয়ে দেব, রাষ্ট্রভাষা । কিছু বাংলা কিছু ইংলিশ বাকিটা হিন্দি কদিন আর থাকব ।
--- তাও তো কথা । ওখানকার খাদ্য আলাদা, কচুমচু খায় সিদল শুঁটকিও খায় । মোচাকে থোড় বলে কুমড়োকে ডিংলা সিমকে উরি । সংস্কৃতিও আলাদা রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে গায় ভাল, গাজির গানও গায় । হজরত মহম্মদের মেয়ে, মেয়ের জামাই আর নাতিদের নিয়ে দুঃখের জারি গানও গায়
--- শিলচরে কী সব মুসলমান ?
--- থার্টি পারসেন্ট তো হবেই । তবে কলকাতার মতো দুর্গোৎসব হয় পাড়ায় পাড়ায় । পয়লা বৈশাখেও নববর্ষ হয়, মিলাদ হয় ইদ হয় । আর উনিশে মে ।
--- উনিশে মে ?
--- ভাষা আন্দোলনের দিন । এগারো জন শহিদ হয়েছিল মাতৃভাষার জন্য ।
--- মাতৃভাষা তো অসমীয়া ।
--- না, বাংলা । আমরি বাংলা ভাষা । বাংলার মাটি বাংলার জল ।
--- তার মানে অসমীয়া ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ।
--- না । কোন ভাষার বিরুদ্ধে কেন হবে আন্দোলন ? অসমীয়া একটি সমৃদ্ধ ভাষা । বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত রুখতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন । শুরুর দিনেই এগারো জন শহিদ হয় । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন সংগ্রামকথা কেউ শোনে নি ।
--- আমিও তো শুনিনি । একুশ ফেব্রুয়ারি জানি ।
--- আমাদের এক প্রথিতযশা লেখকও বলেছেন এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ।
--- কে তিনি ?
--- আছেন এক প্রগতিশীল ।



বারো
   বরাক উপত্যকায় গিয়ে মিনি অবাক হয় । এ যে ঘরের ভিতর ঘর । এক ভারতবর্ষের মধ্যে আর এক বাংলা, নিখাদ বাংলা । মিনির ভাল লাগে তার শ্বশুরবাড়ির দেশ । গ্রামীন সারল্যে ভরপুর মানুষের মন । সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাসের ভিতটা বড় মজবুত । তাই এবার আর ভয় দেখায়না রঞ্জন । বলে,
--- এবার দেখবে হাওরের পূজো ।
--- দুর্গাপূজা, এই শ্রাবন মাসে ?
--- না, তিনি মা মনসা, হাওরের অধীশ্বরী, তিনি জলদেবী । তার পুজোয় আছে বৈচিত্র, ওঝাগান হয় সারা মাস ধরে, নাচও হয় । নৌকো পূজো হয় গ্রামের বাড়িতে ।
--- নৌকা পূজা । এও শুনিনি ।
--- চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙা ডুবেছিল, আবার ভেসেছিল । তাই নিয়ে পূজো । 
--- ভেরি ইনটারেস্টিং ! কিন্তু সবইতো পূজাপাঠ, স্টোরি কোথায় ?
--- নৌকো ডুবেছিল তাই স্টোরি, ভাসতেও আনন্দের গল্প । লখিন্দরের ঢলানি সর্পদংশনে বিয়ের রাতে, বেহুলার নৌকো ভ্রমণের ঘাটে ঘাটে স্টোরির পর স্টোরি, আলাদা আলাদা আখ্যান । নৌকো থাকলেই প্রেম । জিয়ানি । মনে নেই ইস্তাম্বুল ? বসফরাসের কিন্নাবোট, নীলনদীর ফালুক্কা, ডাল লেকের শিকারা । এবার চাতলায় গিয়ে হারিয়ে যাওয়া নাও নৌকোয় ।
--- কোথায় হারাবে ? সব তো খোলা মেলা ।
--- না ম্যাডাম । দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া । নলখাগড়ার ঘন বন দেখোনি হাওরের জলে ? কত ডাকাতের আস্তানা ওখানে ।
--- ওরে ব্বাস । যাব না তাহলে ।
--- কিচ্ছু হবে না, ব্যাসদেব আছি না, কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দেব । আমি নয় চোখ বুঁজে শুয়ে থাকব ভেলায়, তুমি বেহুলা হয়ে বয়ে নিয়ে যাবে ।
--- যাব না । সর্পদংশনে মৃত পতি নিয়ে যাওয়ার শখ নেই আমার ।
--- ওকে, উপমা উঠিয়ে নিলাম । মৎসগন্ধাই বহাল থাকুক ।





তেরো
  যশোময়ের কথা মতোই চলে সব কিছু । করিৎকর্মা ধনবান পুরুষ বটে কলেজের লাস্ট বেঞ্চার । শহর শিলচরের ধনপতি, দুদুটো চা বাগানের মালিক, ক্রীড়া প্রশাসনের কর্তা এবার বিসিসিাআই পদাধিকারীর হয়ে যাবে রাজ্যসভার এমপি হবে । হাফলং পাহাড়ের নীচে ওর চা বাগানে থাকার ব্যবস্থা করেছে সহপাঠী রঞ্জন সেন এর । সাততারায় দুরাত্তির থেকে একঘেয়ে লাগে রঞ্জন মিনির । না বলে পালিয়ে যায় । ফেরার পথে রঞ্জন সেন মিনিকে বলে,
--- চা বাংলোর ছোটগল্প শেষ, এবার শুরু আসলি উপন্যাস ।
--- এর পরেও আসল আছে নাকি ?
--- আছে আছে গো স্ত্রীরত্ন । কাঞ্চনমালার দেশে নিয়ে যাব এবার ছদ্মনামে । মালা হবে মিনি ।
--- মানে চাতলা ধীবরী ?
--- রাজকন্যেও হতে পারো, মহারানিও । একটা রাজত্ব পাওনা আছে কালীদহের পারে ।
--- কালীদহ ?
--- হ্যাঁ, হাওর ডহরই আমাদের মনসামঙ্গলের কালীদহ । আর বরাক নদী গাঙুড় । ঐ চাতলাপারে আছে আমার মাতুলবাড়ি । দাদুর সম্পত্তি ভোগদখল করছে অকর্মা ছোটমামা । বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর সোনার খনি, এখন কয়েক কোটি টাকার প্রপার্টি । ভাগ চাইব ।
--- তোমার আর সম্পত্তির কী দরকার
--- সম্পত্তি পেলে ছাড়ব কেন ? আপাতত মামার বাড়ির আতিথ্য । ভয় নেই, মামী খুব কেয়ারিং, বিশাল বিশাল বেডরুম আছে, কমোড বাথরুম ।
   মিনি হাসে । ভেবে পায় না রঞ্জন সেন হঠাৎ কেন এত এক্সাইটেড । মামার বাড়ির গল্প শোনাচ্ছে মিনিকে । যে বাড়িতে মিনি কয়েকবার থেকে গেছে । রঞ্জনের কিসের এত উত্তেজনা কে জানে । যশোময় পালকে কাত করা, না কি মামার সম্পত্তির লোভ, না উপন্যাস লেখার আনন্দে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে । বয়সে ছোট হলেও রঞ্জনের ছোটমামীর সঙ্গে সখীর সম্পর্ক মিনির । ছোটমামাও রঞ্জনের বয়সী, বন্ধু । মামী ও ভাগ্নে ভাগ্নে বৌকে  পেয়ে খুব খুশি । রঞ্জনকে বলে,
--- ঘি খাবে ?
--- বচুড়ি দিয়ে জাউভাত খাব মামী ।
--- ক্ষীরের সন্দেশ খাবে ?
--- ‘সুখে থাকো’ ছাঁচটা আছে ?
--- আছে ।
  মামা বলে,
--- কী মাছ খাবি বল ? পুঁটি মকা টেংরা ? পাবদা চিতল বোয়াল ? যা খাওয়ার আজই বলে দিতে হবে । ওয়ান উইক ডেট নেই ।
--- আমি পালাচ্ছি না । একমাস থাকব ।
--- থাক না । কাল বাজারবার ধোয়ারবন্দে । আসবে জোড়াপাঁঠা । হরিণের মাংসের বরাত নিয়ে গেছে নুনুয়া । বনরুই হাঁস মুরগি কাঠুয়া আর ভেড়ার মাংস আসবে বাগবাহার থেকে ।
--- উরিব্বাস । হাই কলেস্টরেল, হাই প্রোটিন, হাই ক্যালরি ।
--- সব প্রটেকশন নেওয়া আছে । বার্ণ করার ব্যবস্থা আছে, অনুপান আসবে জন স্মিল থেকে ।
    ছোটমামার সঙ্গে ষড় হয় যশোময়ের । মামার বন্ধু ভাগ্নেরও ক্লাসমেট । চলে আসে মামার ডাকে, ডিকি থেকে নামে জোড়া বাক্সের জনিওয়াকার । হরিণের মাংস খেয়ে আক্ষেপ করে যশ । বলে,
--- মামীমার হাতের পায়বার মাংসের স্বাদ ভুলতে পারি না ।
   রঞ্জন সেন বুঝতে পারে যশোময় দিদিমার কথা বলছে । সম্পর্কে বড় হচ্চে, মামার বন্ধু হওয়ার সুবাদে । যদিও যাওয়ার আগে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে একান্তে ।
--- শোন, তোকে নিয়ে আমার অনেক প্ল্যান আছে, পরে বলব । আপাতত, মিত্রা আসবে দুএকদিনের মধ্যে । এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেবে তোর, ফটোগ্রাফারও পাঠাব ।
--- কে মিত্রা ?
--- মিত্রা পাণ্ডব ইয়ার । শিবু যে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাজের জংশন থেকে ।
--- হাইট দেখেছিস ? গাণ্ডু । চাঁদে হাত দিতে চাস ? দুটো চা বাগান আর দুটো রুরেল ডেইলির মালিক হলেই সব ছোঁয়া যায় না । আই সেইড, আগেও বলেছি তোর প্ল্যানে আমি মুতি শালা ।




চৌদ্দ
 ড্রিংকস করলেই রঞ্জনের হিসি পায় আর তখন যাকে সামনে পায় তার মুখটাই দেখে । যশকে এই নিয়ে দুবার ইনসাল্ট করে রঞ্জন । যশ ওসব নিয়ে ভাবে না, রঞ্জনের করিগেন্ডামের অপেক্ষাও করেনি, ঝিমলি কে পাঠিয়ে দেয় পরদিন । মেয়েটিকে দেখে অবাক রঞ্জন, বরাক ভ্যালিতে এতো স্মার্ট শাড়িপড়া সাংবাদিক থাকতে পারে ভাবে নি । কথার আর শরীরের দ্যুতিতে আলোকিত উষ্ণ হয়ে ওঠে ছোটমামার বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে মেঘলা দুপুর । মেয়েটি বেশ অকপট । বলে,
--- আমার নাম স্মৃতি দাস চৌধুরী । স্যার বললেন ডাক নাম বলতে, বললাম ঝিমলি । টাইটেল দিলেন পাণ্ডব । নিইনি, যদিও স্যার ডাকেন ঝিমলি পাণ্ডব । মিত্রা পাণ্ডবের কবিতার খুব ভক্ত তিনি ।
--- তোমার স্যার খুব রসিক পুরুষ, নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি ।
--- স্যার আমার গার্জেন, গুরুজন ।
--- আমি ওসব হতে পারি না । একটু কম হলে ভাবা যেত ।
--- আপনি শিলচর ছিলেন ছেলেবেলায় ?
--- স্যার বলবে না ? সম্বোধনহীন প্রশ্নের জবাব দেব ? ওকে, কলেজ জীবনেও ছিলাম । চাকরি করেছি জুবিলি স্কুলে ।
--- লেখালেখি শুরু করেন নি তখনো ?
--- সলতে না হলে প্রদীপ জ্বলবে কী করে ? প্রস্তুতি ছিল ।
--- নোট নেবে না ? কী করে লিখবে ?
--- আমি আপনাকে দেখিয়ে যাব । মনে থাকবে সব । স্যার বলেছিলেন আপনি পত্রিকা বের করতেন ধারকর্জ করে । স্যারের প্রেসে তিন সংখ্যার ছাপা খরচ বাদ পড়ায় নদীর পারে যাওয়া ছেড়ে দেন ।
--- প্যার মে কভি কভি হাফ সোল হলে ভুলে যায়, ব্যবসায় চোট হলে ভোলে না পাতি বিজনেসম্যান । ঘুরপাক খায় তিনশো টাকায় । নদীর পারেই ছিল প্রেস এখন যেখানে আছে একজ্যাক্ট লোকেশন । হরিসাধন পালের তিনশো টাকা এখনও দিই নি, দেব না । বলে দিও পুত্রধন যশোময় পালকে ।
--- ভারতী কমলা এই দুটোই তো ছিল বইএর দোকান, অনেক দেনা করে বই কিনেছেন ?
--- বই কিনেছি পয়সা দিইনি, তো কী হয়েছে ? ফালতু বই সব বটতলার স্বপন কুমার আর মোহন সিরিজ, কিরীট রায় ।জোকস এপার্ট, ওরকম করেছি বলেই শিখেছি । ঐ ধারের সলতেটাই সত্যি, নইলে আর কেন সাক্ষাৎকারের পিছনে ছোটা এই ধীবরগ্রামে ?
--- আপনি তো পাঠকপ্রিয় লেখক । নাগরিক প্রেমের গল্পে সিদ্ধহস্ত । গঙ্গার পারে ভিক্টোরিয়ার গোয়ার ডোনা পাওলায় আন্দামানে ইস্তাম্বুলে ভেনিস নীলনদের পারে এক প্রেমিকা সম্বল করে টইটুম্বুর প্রেমের গল্প লিখেছেন । এক নায়িকা মিনি । জনপ্রিয়তা হারানোর ভয় ছিল না ? শিলং কোহিমা নুংলেতেও মিনি । মিনি কী বৌদি ?
--- আমার স্ত্রীর নামও মিনি ।
   মিনি সেন এর সঙ্গে কথা বলে খুব খুশি ঝিমলি । মিনিও খুশি, ইমপ্রেসড । রঞ্জনকে বলে,
--- মেয়েটি তোমার ফ্যান । সব গল্প পড়েছে । অবাক হয়ে গেছে, শুধু ছোটগল্প লিখে, এক নায়িকাকে নিয়ে কেউ এত জনপ্রিয় হতে পারে দেখে । বলেছে কী করে হয় ?
--- প্রশ্ন হিসেবে ইন্টারেস্টিং । তোমার জবাব ?
--- বলেছি বিখ্যাত হতে রাজ্যও লাগে না রাজকন্যাও না । শুধু বুদ্ধিচক্রে মেধাকে শান দিতে হয় । শৈশব থেকেই পড়াশোনা করেছে রঞ্জন সেন । বাঙালির পেটেন্ট-কেনা কুঁড়েমি ছেড়ে ব্যবসা করেছে, সংসার সামলেছে, প্রেম করেছে, লেখালেখি করেছে প্রেম নিয়ে, এক নারী নিয়ে তবে না রঞ্জন সেন ।
--- আর বালিকার প্রত্যুত্তর ?
--- সে তো মুগ্ধ । তবু একটা আশাভঙ্গ কোথাও আছে, কল্কাপাড়ের গল্পটা নিয়ে কনফিউসড । সে নাকি অন্য, অপর এক নারী কথা ।
--- বলেছে ? গল্পকারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে স্মৃতি থেকে । অ্যাকস্ট্রা স্মার্ট । আদারওয়াইজ মেয়েটি ভাল । বিউটিফুল ।
--- তাও দেখেছো ?







পনেরো
  বেফাঁস হয় না রঞ্জন সেন । সুন্দরী যুবতিকে তার পছন্দ লুকিয়ে রাখে । এই প্রথম কোন শাড়িপরা যুবতিকে তার ভাল লাগে । আসলে লেখার সময় রঞ্জন অন্যরকম, শাড়িপরা বঙ্গললনার প্রসংশক । কিন্তু ব্যাবহারিক জীবনে শাড়িকে আনস্মার্ট ভাবে, সুন্দর পরিচ্ছদ মানে না । বোকা বোকা গ্রেসলেস কাপড়ের বাণ্ডিল । পঁচিশ বছরের শিলচরি মেয়েটি কিন্তু রঞ্জন সেনকে উত্তেজিত করে । ঝিমলি দাস চৌধুরীর শাড়ির পাড়ে কল্কা দেখে অভিনিবেশেহুবহু তার গল্পের নায়িকা, কুড়ি বছর আগের লেখা গল্প আবার লেখা হচ্চে । রঞ্জন কল্কাময়ীকে বলে,
--- ওগো মেয়ে, তোমার শাড়ির পাড়গুলো বড় বাঙময় । কথা বলছে, হাঁটছে পাশাপাশি । হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে এ ওর গায়ে ।
--- না, এত প্রগলভ নয় আমার পরিধান । ওদের তো আপনি ছুটি দিয়েছেন অনেক কাল আগে, অন্য এক মিনি কাহিনিতে ।
--- সেই উল্টো পাঁচের মতো নক্সাদার শাড়ির গল্প ? ও তাই ফিরে পড়ার প্রস্তুতি ? না ফিরে লেখা ? রচনা আবার ? বাট, স্যরি সুন্দরী, ও গল্প তোমার বৌদিকে নিয়েও নয়, তোমাকে নিয়েও নয় । মিনি সেন তাঁতের শাড়ি পরে খুব কম । গল্পটা নাগাদেশের এক ছোট জনপদের, নাম লুংলে । ছোটমেশো ডাক্তার, বাঙালি নয় নাগা খৃস্টান, মেশোর ভাইঝি, আমার থেকে বড়ই হবে শহরটাতো ছোটো, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ, মেঘলা সারাদিন । সুতীর শাড়িতে আগাথাদিকে দারুণ লেগেছিল সেদিন । ঐ একদিনই মনে গেঁথে যায় । কথা বলা কল্কার গল্পটা বিয়ের পরপরই লিখে ফেলি, মজার কনফিউশন, তাই না ? আমার কিন্তু এরকম রোমান্টিক থাকতে ভাল লাগে ।
--- আমারও ।
    আমারও কথাটাই ক্যাচ করে নেয় রঞ্জন সেন । মোক্ষম মুহূর্তে একবার চোখাচোখিও হয় দুজনের । রঞ্জন ভাবে ঠকিয়ে দিল না তো যশ । ইন্টারভিউটা করিয়ে নিল মাগনা । ঝিমলিকে বলে,
--- তোমার স্যারকে বলো চেকটা পাঠিয়ে দিতে । রঞ্জন সেন ফ্রিতে টক দেয় না ।
   ঝিমলি চলে যেতেই যশোময়কে টেলিফোন করে । বলে,
--- তোর জেরক্স কপিটা বেশ ঝক্‌ঝকে । বলতে পারিস এবার পাণ্ডব অনেকটাই মিত্রার মতো । গুড, কাজের মেয়ে । অনেক এগিয়ে যাবে, ভাল জার্নালিস্ট হবে ।
--- ওয়া ! ফোঁটা না পড়তেই বর্ষণ শুরু ? অকারণ প্রসংশা করার মানুষ নও বাবা তুমি ! লেট মি সি ।   




ষোলো

  নিজের ইন্টারভিউ পড়ে চমকে যায় রঞ্জন সেন । এত সব তথ্য তো তারও জানা ছিল না । রীতিমতো গবেষণা করে লিখেছে ফুল পেজ প্রতিবেদন । ঝিমলি নিজে এসে দিয়ে যায় কপি । এর মধ্যেও একবার এসেছে কনফার্ম করতে, দেখিয়ে যেতে প্রুফ । রঞ্জন কিছুই দেখেনি, একঘণ্টা তাকে দিয়ে গেল ভরপুর । মিনিকেও থার্টি মিনিটস । ফটোগ্রাফার ভবতোষ ছবি উঠিয়েই চলে যায় । কপি দেওয়ার দিন উৎসব হয়, ছোটমামা খুশিতে গোটা মুরগির রোস্ট রেঁধে খাইয়ে দেয় ঝিমলিকে । রঞ্জন আবার যশোময়কে টেলিফোনে জানায় ভাললাগা । বলে,
--- তোর জেরক্স কপিটা সত্যি ঝকঝকে । দারুণ রিক্রুট । রঞ্জন সেন সংলাপ রিপিট করে না ।
   কী জানি কী ছিল যশোময় পালের মনে । দুম করে স্থায়ী সম্পাদক ছাঁটাই করে ঝিমলি দাস চৌধুরীকে করে দেয় এডিটার ।
   যশ রঞ্জন সেনকে টেলিফোনে দেয় খুশখবর । বলে,
--- রবিবার ঝিমলি পাণ্ডবের নতুন অ্যাসাইনম্যান্ট, তোর উপন্যাসেরও শুরু । বড়াইল ভিউতে দুটো অকেশন সেলিব্রেট করতে পার্টি থ্রো করছি । তোর জন্য থাকছে স্পেশাল টাকিলা ।
--- ককটেল পার্টিতে রঞ্জন সেন টাকিলা ফাকিলা খায় না । ড্রাই মার্টিনি উইথ অলিভ গানর্সিং হলো ককটেলের কিং । কেন য়্যু অ্যফোর্ড ?
--- ওকে বস । চিফ গেস্টের অনারে তাই হবে ।
   পার্টিতে ঝিমলি একটু বেশি ইনডিফারেন্স দেখিয়ে ফেলে, বেশি সতি । রঞ্জন সেন এর এসব ফিমেল নখড়া পছন্দ নয় । ঝিমলিকে নিয়ে যায় পার্ক রোডের দিকের ব্যালকনিতে । বলে,
--- হোয়াট ইজ দিস ? নিয়মভঙ্গ করেছ । কেন ?
--- নিয়ম ? মিনস ?  
--- ককটেল পার্টিতে এসে কেউ একাদশী করে ?  
--- সত্যি বলব ?
--- বলবে ।
--- আপনার ভয়ে ।
--- স্ট্রেঞ্জআমাকেও কেউ ভয় করে ?
--- করি, আমি করি । একটা অপরাধ বোধও কাজ করেছে । সেদিন পৌঁছে দিতে চাইলেন, না করলাম ।
--- কোনদিন ? কবে ?
--- শাড়ির কল্কাগুলো ডাকছে বলছিলেন । আমি এড়িয়ে গেলাম ।
--- গুড, ভেরিস্মার্ট, বুঝতে পেরেছিলে ? চলো আজ পৌঁছে দিয়ে আসি টুক করে ।
--- হবে না । ধরা পড়ে যাব । গাড়ি স্যারের, ড্রাইভার কোম্পানির । কী ভাববে ?
--- কে বলেছে তোমায়, গাড়ি আমার মামার, আমি ড্রাইভ করে এসেছি । ওকে, রিক্সায় যাই চলো ।
    মেয়েটি বুদ্ধিমতী । বুঝতে পারে মালের ঘোর ধরেছে রঞ্জন সেন কে । উৎসাহের উৎসও ধরতে পারে হয়তো । কথা দেয় অন্য একদিন একটা ড্রাইভে বেরোবে, ভেরি লং । শনবিল ঘুরিয়ে আনবে ।   




সতেরো

   শনবিল ভ্রমণ বেশ জমে যায় । বরাক উপত্যকায় শুধু জলাভুমি । চাতলার হাওর আর বকরির হাওর ছাড়াও যে বিশাল জীবন এক জীবনঘেরা জলের দেশ আছে দেখা হয় নি রঞ্জনের । শনবিলের নাম শুনেছে, ভূগোলবইএ পড়েছে, দেখা হয়নি স্বচক্ষে । জলকে ঘিরে যে এতবড় জনপদ হয়, এ যে না দেখেছে তার চোখই থাকবে অতৃপ্ত । মিনি জল দেখে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে পৌঁছেই নৌকো খুঁজেছেভাগের ডিঙি নৌকোয় কী করে বসবে এতজন । কর্ণধার আলু মিয়া আরো কয়েকজন মাতব্বর জুটিয়ে বলে, চলুন । বিরক্ত এবং শংকিত মিনি বলে আগে গ্রাম ঘুরে দেখি তারপর তো জলভ্রমণ । জল দেখা আর হয় না এ যাত্রা, রঞ্জন গল্পে এবার বাদ পড়ে নৌকো । মিনি বলে শ্রীপুর গ্রাম দেখবে । শিলচর আসার পর একটা ব্যাপার মিনির খুব ভাল লেগেছে । শহরে একটা সাহিত্যের পরিবেশ দেখেছে প্রানবন্ত । কবি আছে কথাসাহিত্যিক আছে প্রাবন্ধিকও আছে । আসলে ঝিমলির উৎসাহেই এত জানা । বলেছে,
--- আমাদের শহর হলো কবির শহর । সুনীল শক্তির প্রিয় কবিদের বাস । তবে মফস্‌সলের সব গুনের সঙ্গে একটা গুণ আমাদের বেশি । শিলচরে কথাসাহিত্যেরও একটা ঐতিহ্য আছে উজ্জ্বল । উৎকৃষ্ট ছোটগল্প উপন্যাস লেখা হচ্ছে ।
--- এখানে জীবনের ওঠাপড়া বেশি ? টানাপোড়েন ?
--- তা আছে । জীবন বড় মহার্ঘ এখানে, আবার খুব সমৃদ্ধ মানুষের মনোরাজ্য । বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সম্মেলনে গড়ে উঠেছ বৈচিত্রময় লোকসংস্কৃতিও । আর ছোটগল্প উপন্যাস তো জটিল জীবনেরই প্রতিফলন । কথা সাহিত্য জীবনকে সহজভাবেও দেখতে জানে । দেখার চোখ আর শক্তিমান কব্জি আছে বলেই প্রত্ন খননে বের করছে লেখক জীবনের সহজ আর জীবনের জটিলতা ।
--- ঠিক । পৃথিবীতে এত এত পাওয়ারফুল লেখক আছেন, তারা কিন্তু জীবন অতিরিক্ত জীবন দেখেই সমর্থ হয়েছেন । এখানকার কোন লেখকের নাম শুনিনি আমি । বরাক উপত্যকার গল্প সম্বন্ধে আলাদা ভাবে কোনো অবয়ব এখনও গড়ে তোলতে পারিনি । আমার পাঠও খুব কম । তুমি যা পড়িয়েছ মনিমুক্তো, সেই সম্বল ।
--- নাম না শুনলেই কী বৌদি সব মিথ্যা হয়ে যায় ? দেশভাগ মিথ্যে হয় ? শিলচর শহরে চারভাগের তিনভাগ মানুষই বাস্তুহারা । দেশের মাটি তো দুভাগ করা যায়, কিন্তু মানুষের মন কতখণ্ড হয় কেউ জানে ? সে কাজ ছোটগল্পকারের, আপনাকে পড়াব এক আশ্চর্য আখ্যান । এক মহিলা গল্পকারের লেখা ‘উজান’ নামের ছোটগল্প ।





আঠারো
  উজান পড়েই মিনির শনবিল দেখার উৎসাহ । দোহালিয়া আনিপুর রামকৃষ্ণনগর হয়ে ফেরার বুদ্ধিটা ঝিমলির, আর মিনিও অতি উৎসাহে বলে শ্রীপুর যাবে । গল্প চরিত্রের খোঁজে অলীক বাস্তবের হাতছানি মিনিকে বিবশ করে দিয়েছে । উজান গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া যে বাস্তব কল্পনার সীমা এমন করে মুছে দেবে মিনি ভাবে নি । মিনি এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে, বরাক উপত্যকার জলমাটিতেও যে এমন লেখা সম্ভব কল্পনা করেনি ছোটগল্পটির কেন্দ্রে রয়েছে নববসতির এক গ্রাম শ্রীপুর । গ্রামের স্মৃতিকথা আছে আখ্যানে, সেই স্মৃতির মধুর উপস্থিতি গল্প শরীর কে মেদুর করে রাখে পাঠকালে স্নেহময়ী এক মহিলার খোঁজে বাঁশের বেড়ার উপর দিয়ে উঁকি দেয় মিনি । যদি দেখা হয়ে যায় লালপাড় শাড়িতে চওড়া করে সিঁদুর আঁকা এক গ্রামবৃদ্ধার । শ্রীপুর গ্রামটি অবিকল একটি গ্রামের মতোই, গ্রামের মেয়ে মিনির সব গর্ব খর্ব হয় । আসলে তাদের সামতা গ্রামতো শুধু নামেই আটকে আছে, নইলে শহরের সঙ্গে কোন ফারাক নেই । গল্পের গ্রামের ভিতর যেন স্নেহ মমতার এক অপার ভাণ্ডার পেয়ে যায় মিনি, যাদুর পরশ বুলিয়ে যায় গ্রামবাসী মাসীমা কাকীমা বৌঝিরা । হাড়ির কানা পায়ে ঠেলে বালিকারা খেলেছে এক্কা দোক্কা । মিনি ঘ্রান নেয় শ্রীপুরের, ঘ্রানে খোঁজে ঠিকানা । রঞ্জন সেন মিনির এই ভাবান্তর পড়তে পারে, মনে পড়ে যায় তার প্রথম সিলেট স্মৃতি । মায়ের জন্মভূমির খোঁজে দাড়িয়াপাড়ার এবাড়ি ওবাড়ি উঁকি দিয়ে খুঁজেছে অসহায়ের মতো । দিঘীর পারে তার মাতৃগৃহ এখন কোথায় কেউ বলতে পারে না । সহচর কবি মোস্তাক বলে, দাদা এখন গোটা দাড়িয়াপাড়াই হয়ে গেছে আপনার মায়ের বাড়ি । মিনির খুশি খুশি মনখারাপের উৎসে চলে যায় ঝিমলিও । বলে,
--- কাকে খোঁজছেন বৌদি ?
--- আমার অন্ধমামা আর মামী চারুশশী ।
--- মামার নাম ক্ষিতীন্দ্রমোহন ? আপন মামা ?
--- আপন থেকেও বড় ।
--- গল্পকারকে নিয়ে এলেন না কেন দেখিয়ে দিত বাড়ি । ‘নোটবুক’ পড়েছেন ?
--- চিঠি বুড়িকে চেনো ঝিমলি ?
--- চিনি গো চিনি ।
--- ঠিকানা জানো ? জানো কোথায় যায় চিঠি ?
--- ধুলিয়াখাল, রতনপুর পো গোপায়া সিলেট ।




উনিশ

 রঞ্জন সেন এসব পড়ে নি ‘সমান্তরাল’ এর গল্প । রঞ্জনের মতো শীর্ষেন্দু সমরেশ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ আর রঞ্জন সেন, জীবিত লেখকদের মধ্যে এরাই এখন বেস্ট সেলার । এরাই দৃশ্যমান, বাকি কিছু নেই । হ্যাঁ, সত্তরের কিছু লেখক মিলে একটি বারোয়ারি ছোটগল্প লিখেছিল শ্রমিক কৃষক আদি নিম্নবর্গদের নিয়ে । একটা আকাশেই ওরা দেখেছিল নিম্নমধ্যবিত্ত চোখের ধূসর নীল । সেই আকাশটাই ওরা প্রাণভরে ব্ল্যাকওয়াশ করে যাচ্ছে ডাল ভাত আলুপোস্ত আর আলু ভাজা ডাল ভাত করে । সাবালকত্বহীন ওসব ন্যালাখ্যাপা লেখা রঞ্জন সেন আর পড়েনি, পড়বেও না । তবে বরাক উপত্যকায় বেশ কয়েকবার গল্পকারের বই সে দেখেছে খুব পপুলার, বিক্রিও হয় বারোমাস বইমেলায় । কক্ষপথ কোষাগার পু ঘোষ আরশি নগরের রূপকথা সুখগাছের গল্প ঈশানের যাযাবর, উপন্যাসের খোঁজে শরাইঘাট একটি প্রেম কাহিনী স্বপ্নের সীমানা ছুঁয়ে । বেশ তাগড়া স্টোরিটেলার সব ।  
        যশোময়ের এডিটার মেয়েটি মিনিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে রঞ্জন সেনকে ভুলেছে । ইচ্ছে করেই কী । সে যাই হোক, মেয়েটি সত্যি ভাল, ভেরি গুড গার্ল । যশকে বার দিতে সে ঝিমলিকে মিত্রা পাণ্ডবের জেরক্স কপি বলেছে । ভুল, সত্যি নয় মোটে । ঝিমলিই ওরিজিনেল, মৌলিক, সিঙ্গল পিস । রঞ্জন সেনকে শিকড়ে ফিরিয়ে আনতে প্রাণপন করছে । মাটির ঘ্রানে জড়িয়ে রাখছে, বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, বইপত্র দিয়ে সাহায্য করছে । সবচে’ বড় কথা ওর সঙ্গে সময় স্পেণ্ড করতে তার ভাল লাগে । রঞ্জন ভেবে দেখেছে মেয়েটি ডিফারেন্ট, মিত্রা পাণ্ডবের মতো আহ্লাদি নয় এপারেন্টলি, চালাক নয় তেমন কম্পারেটিভলি । সেক্সুয়্যালিও যথেষ্ট উত্তেজক । মিনিকে এসব কথা বলা যায় না, সন্দেহ করে । হাজারো প্রশ্নে জানতে চায় উত্তেজক মানে কী । সব কথার ঠিকঠাক উত্তরও হয় না যে । ঝিমলি কম কাপড়ের পোষাক পরে না, শাড়িই পরে হাইকলার থ্রিকোর্য়াটার স্লিভের । সুতী শাড়ির কল্কাপাড়ের কানাকানি শোনে রঞ্জন । ঝিমলি-পায়ের পাতার উপর যখন নাচে তখন কিন্তু বেশ লাগে সন্ধ্যা দীপের দপদপান আলোর মতো । ঝিমলি বেশ আঁটোসাঁটো, পৃথুলাও বলা যাবে না, আবার সাইজশূন্যও নয়, মায়াময় মুখটায় জড়িয়ে রাখার আবেদন । শ্যামলা মুখের উপর চোখ দুটোয় সৌন্দর্য হীরকদ্যুতিতে ছিটকে বেরোচ্ছে, বুদ্ধির দীপ্তি আকর্ষিত করছেরঞ্জন সেন একা একা উপভোগ করে আনন্দ । সতর্ক থাকে যাতে মিনির চোখে না ধরা পড়ে আকর্ষণের কেন্দ্র । তাই হয়তো ঝিমলির সঙ্গে কথা বলার একটা আলাদা ভঙ্গি আয়ত্ত করেছে । পায়রার ওম দেওয়ার মতো বকম বকমে কথা কয় । অবশ্য রঞ্জন সেন এর তো রাখডাক নেই, তাই সবার সামনেই কথা বলে ফিশফিশিয়ে, সবার মধ্যে থেকেও সবার থেকে আলাদা হয় । একদিন দুদিন কেউ খেয়াল করে না, তারপর গুঞ্জন হয় সবার মনে । আত্মবিশ্বাস মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় কেয়ারও করে না পারিপার্শ্বিক চোখে মুখে অসমবয়সী প্রণয়ীর বিরহব্যথার নীল আর সুখের আবেশে মশগুল হওয়ার অলক্তরাগের প্রকাশ রঞ্জন সেন এর প্রতিরক্ষা দুর্বল করে । মুঠোফোন কানে রঞ্জন সেনকে কেউ খুব বেশি কথা বলতে শোনে নি । সব কথা কয় ঝিমলি, রঞ্জন সেনএর গল্প নিয়েই সব কথা । নতুন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী নিয়ে উচ্ছ্বাসের কথাও জানায় । বলে,
--- আপনার লেখার রোমান্টিকতা অন্য জায়গায় । মিনির প্রেম তো জুড়ে দেওয়ার আঠা । আপনার লেখা যেন সুরমা গাঙের গাঙচিল, ফকিরটিলা বাজার থেকে উড়া দিয়ে চলে যায় ব্ল্যাক ফরেস্টের গহিনে, গ্র্যাণ্ড বাজারে যায় খান খলিলি যায়, যায় ম্যানহাট্টন নিউজার্সি যায় চেয়ারিং ক্রস । নৌকো ভ্রমণের জল খেলায় দুই মহাদেশ এক হয়ে যায় অবলীলায় । বসফরাস প্রণালীর কথা পড়েছি ভূগোলে, এরকম দুই বিষম সংস্কৃতির মিলন জলের বার্তা তো কেউ দেয় নি এর আগে । পূর্ব পশ্চিম মেলানো বড় কম কথা নয় । বেড়ানোর সময় কী আপনারা ইতিহাস বিস্মৃত থাকেন, না জেনেশুনে ইতিহাস কে স্যালুট করে করে দুজনের বিহার ?
--- দুজন, মানে তোমার বৌদির কথা বলছ ? সে তো তখন হোটেলে বসে খাচ্চে মরোক্কান বাস্টিলা ।
--- তবে ইস্তাম্বুলের নৌকোয় কে ? কোন মিনি ?
--- মিনি কী কম পড়িয়াছে ? সে মিনির নাম মাখতুমা ।
--- সেদিন বললেন লুবলুবা ?
--- বলেছি ? ঝুট । আর বললেই বা কী ? ওসব একই নাম, আংকারা থেকে পাঠিয়েছিল গাইড । মাখতুমা চাকরি করে, কিন্তু রোমান্টিক দারুণ ।
--- আর কার্সে ? জার্মানিতে ? বরফে ?
--- সে মাখতুনা ।
--- বৌদি নেই কোথাও ?
--- আছে হোটেলে । সরাইখানার স্টোরি এখনও লিখিনি ।

কুড়ি
 মাসের প্রথমদিকে ঝিমলি একটা কাণ্ড করে বসে । রঞ্জন সেন আর মিনিকে বলে, প্রণাম করব । বলেই পায়ের উপর রাখে মণিপুরি উলের চাদর, মিনির পায়ে শাড়ি, মণিপুরি মন্দির ডিজাইনের । মিনি রঞ্জন খুব খুশি । মিনির প্রসন্নতা বেশি । স্বামীকে বলে,
--- মেয়েটি ভাল । সঙ্গে থাকলে মন ভাল হয়ে যায় । ওকে বলো কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আসতে । কিছুদিন থাকবে আমাদের সঙ্গে । কী বলো ?
   ঝিমলির চোখে শ্রদ্ধা ছাড়া কিছুই দেখে না মিনি । শোনে না স্বামীর ফোনে কথা বলার ধারাপাত । ঝিমলি এলে রঞ্জনের অকারণ পুলকিত হওয়ায় সন্দেহের কিছু দেখে না । ছোটমামী ঠাট্টার ছলে সাবধান করে দেওয়ায় প্রথম খটকা লাগলেও গায়ে মাখে না । বলে,
--- তোমাদের ভাগ্নেকে চেনো না মামী । ভোলানাথ মানুষ ।
   গল্পের মিনি নিয়ে ঝিমলির অতি উৎসাহে মিনি শংকিত হয় । লুংলে নিবাসী এক অজানা যুবতিতে মিনি প্রতিস্থাপিত করায়ও খটকা লাগে । বসফরাসে নৌকাবিহারে অন্য মিনির কথা শোনায় ঝিমলিচোখে সর্বনাশের ইশারা দেখতে পায় বাস্তবের মিনি । ঝিমলি বলে,
--- তুরস্ক দেশটা জানেন বৌদি আমার খুব প্রিয় । যদিও খৃস্টান মুসলিম ইহুদিরা লড়াইকরেছে অনেক । জানি না বাইজানটাইন ভাল না ওটোমান ভাল না কামাল আতার্তুক । সব মিলিয়ে তুর্কির ভূগোলটাই ভাল, আনাতোলিয়াও ভাল । সভ্যতার একটা ক্রস চিহ্ন, জল প্রণালী ঘেরা শহর ইস্তাম্বুল এক আশ্চর্য মিলনভূমি সভ্যতার । আপনারা ভাগ্যবান এনজয় করেছেন । উনি তো বলেছেন সুখস্মৃতি ।
--- উনি কে ?
   মিনি ইচ্ছে করে কঠোর হয়েছে । উচ্ছ্বাসকে থামিয়েছে । ঝিমলি হেসেছে, জবাব দেয় নি, রঞ্জন সেন এর নাম নেয় নি তাও, স্যার বলেনি । মিনি বলে,
--- সে যাই হোক । তুর্কির গল্পে কিন্তু আমি নেই ।
--- তিনি বলেছেন আপনি, হুবহু আপনি । তার লেখায় রোমান্টিকতার গুরু বলেছেন আপনাকে ।
--- তিনি গল্প কারিগর, গল্প কথায় ভুলিয়েছেন তোমায়আমি নেই কোথাও । আর আমার গুরুগিরিতেও বিশ্বাস নেই ।


একুশ
   উপরোক্ত কথোপকথনের পরদিন ভোরের বিমানে রঞ্জন সেন আর মিনি সেন কাউকে কিছু না বলে শিলচর ছাড়ে । কলকাতা পোঁছয় সকাল আটটায় । মামীর উৎকণ্ঠিত টেলিফোন যায় সাড়ে আটটায় । মামী বলে,
--- পোঁছে গেছ ? বেশ করেছে, গুড ডিসিসন । তা এখন তোমার ভোলানাথ কোথায় ? মোবাইল কানে ? ওটা কেড়ে নাও । তোমার ছোটমামার মানসম্মান সব যে গেল । যশোময় পাল যা তা বলে বেড়াচ্ছে, গসিপ দিচ্ছে ডেইলি নিউজেএডিটার স্মৃতি দাস চৌধুরিকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছে ।
    মিনি রাগে না সচরাচর । মিনির হাসিটাই চেনে সবাই । এবার রাগে মামীর কথায় । ঝিমলিকে মোবাইলে ডাকে । ঝিমলি বলে,
--- আমি কিছু জানি না বৌদি, সব ফলস ।
--- মোবাইল এর কললিস্ট ফলস ? যশোময় পালের গাড়ির লগবুকও ভুল ?
--- ওসব নর্মাল বৌদি । ঠিক আছে এখন তো আর কেউ কিছু বলবে না । আপনারা শিলচরের বাইরে ।
--- ভিতরে আসতে কতক্ষণ ?
--- কথা দিচ্ছি দেখা করব না ।
--- টেলিফোন তো এখনও চালিয়ে যাচ্ছ ?
--- নো ম্যাডাম, আমি সিম পাল্টে ফেলেছি ।



বাইশ
   মিথ্যেবাদি মেয়েটি তাও পিছু ছাড়ে না । কলকাতা পর্যন্ত ধাওয়া করে । দক্ষিণ কলকাতায় বিদ্যা বালন এর হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে । মোগলসরাইএ সন্ধ্যায় দেখা হয় রঞ্জন সেন এর সঙ্গে । তাজ এর এই আশ্চর্য নেশার প্ল্যাটফর্মে কত ভিন্ন নামের রেলগাড়ি এসে ঢোকে, ‘জংসন’ ছেড়ে চলেও যায় নেশার ফুয়েল ভরপুর হয়ে । রঞ্জন সেন তাই কখনও পোষাকি নামে ডাকে না পাঁচতারা মদঘর জংসনকে, বলে মোগলসরাই । তবে এবার জংসনে এসে পাল্টে যায় ক্রমরঞ্জন সেন ঝিমলিকে অফার করে ড্রিংকস, মার্টিনি টাকিলার তকরার হয় না । প্রিমিয়াম ভোদকা আর পেপসির ইকনমি কিক খেয়ে পৌঁছে দেয় ঝিমলিকে তার আস্তানায় । পরদিন রঞ্জন ঝিমলিকে নিয়ে যায় হলদি নদীর পারে সাততারা রিসর্টে । তৃপ্ত ঝিমলিও মিনি বৌদির সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যায় নদীরপারের তার কার্যালয়ে, শিলচরে । এবং অবাক কাণ্ড, ‘চাতলা ধীবরী’ও চলতে চলতে উধাও হয়ে যায় রবিবারের পাতা থেকে । অনিবার্য কারণের দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই ।  


তেইশ
   মধ্যবয়সী আহত ব্যাঘ্র রঞ্জন সেনও এবার একা যায় শিলচর । মামার বাড়ি যায় না, সোজা বড়াইল ভিউ হোটেল । শেখ ইসমাইলের ভাড়া গাড়ি নিয়ে নদীর পারে । যশোময়ের ছাপাখানা ও কার্যালয় । যশ বড় অর্থকষ্টে আছে । রঞ্জনকে বলে,
--- না গুরু, তুমি রকস্টার, পপুলার রাইটার । নভেলটাও খুব পপুলার হয়েছে, ইনডিজেনাস ফ্লেভার আছে, আমি কী কালিদাস ? কেন বন্ধ করব ? নিজের পায়ে কুড়ুল মারব ? অভারঅল তুই আমার ফ্রেণ্ড । উনিশে মের জন্য এক রবিবার অন্য লিটারেচার বন্ধ থাকে । উনিশের জন্য বিশেষ লেখার জায়গা করতে ধারাবাহিক বন্ধ রাখতে হয় । তুই তো আর লিখবি না উনিশে মে নিয়ে, তাই অ্যাপ্রোচকরিনি । তোদের তো একুশ
--- বুলশিট । লাস্ট বেঞ্চে বসে বসে তোর মাথার কাওডাং থেকে কোনো ম্যানিওর ট্র্যান্সফর্মড হয় নি । স্যরি । উনিশে মে ডিনাই করব আমি ? রঞ্জন সেন ? আমার আজ পর্যন্ত যা লেখালেখি সব ঐ মহান দিনটির জন্যই । উনিশে না হলে বরাক উপত্যকায় কারো কোনো লেখালেখি হতো না । বন্ধ্যা দেশ হয়ে থাকত রে । তোর থার্ড রেটেড ডেইলিটাও হতো অসমীয়া ভাষায় । এক উদ্বাস্তু শিবির হয়ে থাকত আমাদের ভাষা উপত্যকা । আমার আমাদের মুখের ভাষা ফুটিয়েছে উনিশ । আমি কী ভুলিতে পারি ? তুই ওসব বুঝবি না ।
--- ওকে বস । স্যরি, নেক্সট ইয়ারের জন্য বলা রইল । তবে আজকের পার্টি আজকেই । রঞ্জন সেন এর রিভিজিট সমাচার জানাতে হবে না শহরবাসীকে ?





চব্বিশ
   রঞ্জন সেন বড়াইল ভিউর পার্টিতেই অ্যানাউন্স করে দেয় যশোময়ের কাগজ কিনে নেওয়ার বিস্ফোরক সমাচার । বলে ডিডরেডি হলেই আবার আসবে । কলকাতা এডিশনের ব্যবস্থা করতে হবে, তবে শিলচর থেকেই বেরোবে প্রাইম এডিশন । এত বড় দাঁও মারার আনন্দে যশ এর মুখের হাসিও আর ধরে না । ঝিমলিকেও এত খুশি দেখেনি রঞ্জন । স্কচের নেশা মাথায় চড়লে যশ রঞ্জনের কাঁধে হাত রাখে । বলে,
--- ঐতিহাসিক মোমেন্টার একটা ছবি হয়ে যাক দোস্ত । অ্যাই ভবতোষ ।
--- গসিপ করবি কাগজে, তাও ফটো উঠিয়ে রাখবি ? রঞ্জন সেন এর ছবি এত সস্তা নয়, নো নো ফোটোগ্রাফ । আর তোর ইতিহাসের পাতায়ও আমি মুতি শালা ।

পঁচিশ
  সুখে ছিল মিনি কলকাতায় । ঝিমলি ঝড় কলকাতা পর্যন্ত ধেয়ে আসায় মিনির ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম সক্রিয় হয় । শখ করে তৈরি করা তাদের ছাদ ঘরেও হয় দাপাদাপি । শখ করে গড়ে তোলা স্বচ্ছ ফাইবার শিটের ছাউনিঘর । ওদের একান্ত শিবির । কাউকে দেখায় না, ডাকে না । যশোময় দুর্বুদ্ধিতে একদিন চলে এলো ওপরে । রঞ্জন তখন শিলচরে, যশোময়ও ডিল ফাইনাল করতে যাবে পরদিন । মিনি দেখায় যশকে, রঞ্জনের বাল্যবন্ধু যশোময় পালকে তাদের মদঘর । সেলার খোলে কিছু একটা, একপাত্র গলায় ঢালে যশ পাল । মিনি না করতে পারে নি অর্থকষ্টে কাতর একদার ব্যারণকে । স্বচ্ছ ঘরের ছাদে শুকনো পাতার অন্ধকার তখনও দেখতে পায়নি মিনি । কলকাতার কাগজে যে তখন রঞ্জন সেনকে নিয়ে নতুন গসিপ । মিত্রা পাণ্ডব লুবলুবা মাখতুমার পর সর্বশেষ সংযোজন শিলচরের ঝিমলি দাস চৌধুরী ।
    মিনিও দেখিয়ে দেয়, একা ভ্রমণে সে অপটু নয় । শিলচরের বিমানবন্দর কুম্ভীরগ্রাম থেকে এসে নিয়ে যায় ছোটমামী । মামা শ্বশুরের গাড়িতে যায় যশ কাগজের সম্পাদকের চেম্বারে । দুকথা নয় অনেক কথা শুনিয়ে দেয় একদার প্রিয়ভাজন যুবতিকে । ঠেং ভেঙে দেওয়ার হুমকিও দেয় ছোটমামী । যশোময়কে কিছু বলে নি । শুধু বেরিয়ে যাওয়ার আগে সৌজন্যের হ্যালো করেছে । বলেছে ডিলটা কয়েকদিন পিছিয়ে গেল ।





ছাব্বিশ
  হ্যালো করলেই যে ঝড় থেমে যায় তা নয় । এবার গসিপে যুক্ত হয় মিনি সেনও । সুখের সংসারে ঘর জ্বালানির ইগ্‌নিশন যে কে দেয়, কোন মেঘের আড়াল থেকে যে যোগান দেয় ঘরের তথ্য, মিনি বোঝে না । বিভ্রান্ত হয় । প্রেমের গল্পবাড়িতে শুকনো০ পাতা জড়ো হয়, কেন হয় কে জানে । আগুন লাগলে যে পুড়ে যাবে, ভস্ম হবে, জল পড়লে অন্ধকার গাড় হবে । জল কিংবা আগুন কিছুই হয় না, ঝড় ওঠে । ঝড়ে সব আবর্জনা উড়ে যায়, দু এক টুকরো শুকনো পাতার পিস সূর্যালোক প্রতিহত করে একটা মায়াবী নক্সা এঁকে দেয় রঞ্জন সেন মিনি সেনএর একান্ত ঘরে । মিহি সূতোয় বোনা লালরঙের কল্কাপাড় মনিপুরি শাড়িতে মিনি গ্রেসফুল হয় । আপন মনে হাসে, মনে মনে বলে, থ্যাংক ইউ ঝিমলি । মিনিও রঞ্জনের শিখিয়ে দেওয়া গল্পের খেলায় মাতে, পায়ের নীচে শাড়ির ফলের দিকে তাকায়, মিনি হাঁটে আর তার পায়ের পাতার উপর কল্কাগুলিও হাঁটে । হাঁটে, কথা বলে কলকলিয়ে, অভিবাদন জানায় স্মার্টলি কল্পিত বাস্তবের সঙ্গে যেন অন্য একটা আলো আঁধারির নড়াচড়া দেখে মিনি, শাড়ির গায়ে আকাশের গাছ পাতাগুলোও জ্যান্ত হয়ে নাচছে ।
   ওদিকে খোলা আকাশের নীচে রঞ্জন সেনও তার পানপাত্র সাজায় । উল্টো পাঁচের কল্কা আর শুকনো পাতার নাচন দেখে মুগ্ধ হয়ে ডাকে মিনিকে । বলে,
--- দাঁড়াও, দাঁড়াও । দেখি আমার ছেচল্লিশকে । একটা তিল লাগিয়ে তো বলতেই পারি বালাই ষাট । না না বালাই পঞ্চাশ, থেমে থাকো যেখানো আছো । না, একটু বীররস না হলে আসলি রোমান্টিক হওয়া যায় না ডার্লিং । যোশ আসে না, যদিনা বলতে পারি ‘তব কপোলের ঐ ক্ষুদ্র তিল লাগি বোখারা সমরখন্দ দিতে পারি আমি’ ।
--- তাহলে কেন এত ভয় ? ঝড় তুফান আগুন ?
--- পার্সোনাল টাচ ডিয়ার । তোমাকে আবার সেই ঈর্ষাময়ী ষোড়শী গড়তে । প্রেম পঞ্চায়েত উপন্যাস লেখার একটা ডেমোও যে হয়ে গেল মন্দ না । প্রভূত রসদ যোগাড় করা গেছে কী বলো ?
--- বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখাবে এবার ?
--- বুড়ো আর কোথায় দেখলে ? পনেরো বছরের গ্রেস আছে না ? তোমাকেও বালাই ষাট বলতে গিয়ে থমকে গেছি । আর বয়স দিয়ে কী হবে ? বয়সটা রাজা নয় ম্যাডাম, মনটাই আসল রাজা । বলোতো, মনটা কোথায় থাকে ? বুকের ভিতর সুরক্ষিত দুর্গে না রোদ জল ঝড়ে উন্মুক্ত শ্যাম্পু করা চুলের আশ্রয়ে ? তবে মাথাটাও কিন্তু কম বুদ্ধিমান নয়, প্রেমের কাঁটা সহ্য করে না । নিপুন কেরামতিতে রাস্তা পরিষ্কার করে । যেমন করেছি যশকে । মাইকেলেঞ্জেলোর শয়তানের মতো গড়েছি, আমিই ভেঙেছি । কলকাতা থেকে শিলচর গিয়ে এক থার্ডরেটেড ডেইলি কিনব আমি ? রঞ্জন সেন ? ওকে শ্যুট করা হয়েছে উপন্যাসে, শিলচর রামনগরের মাফিয়ার সুপারিতে ঢিসুম । ব্যাকআউট করার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেই এগিয়েছি আমি । আমার জীবনঘর অপবিত্র করার শাস্তি পেতে হবে না ? কাঙাল করে ছেড়ে দিয়েছি লাস্ট বেঞ্চারকে ।
--- বাকি দুজন ?
--- দুজন কৈ ? একজন তো ? ঝিমলি মেয়েটি ভাল, ওরিজিনেল । আসলে যশের দুর্বুদ্ধির শিকার । তোমাকে শিলচরে দেখে ভয় পেয়ে গেছে ।
--- তাহলে তো গল্প শেষ । পঞ্চায়েত কী করে হয় ? চারজন হলো ?
--- পঞ্চজনই চাই ? মনে নেই মিত্রার কথা । কবিনি মিত্রা পাণ্ডব ?
--- শুনবে কী করে । ওটাই তো অ্যাফেয়ার ।
   এই সংলাপটা ভেঙে চুরে যায়, দুম করে যে লোডশেডিং হয় কলকাতায় । যদিও দুজোড়া ঠোঁটের মুচকি হাসিতে তৎক্ষণাৎ আলোকিত হয় চরাচর ।





সাতাশ
  একটি আনকাট সংলাপ
মিনি সেন : রঞ্জন সেন লেখকের এই জীবন থেকে বড় ইমেজটা কী গ্রাহ্য হবে পাঠক মনে ?
রঞ্জন সেন : রঞ্জন সেন এর সংলাপটা মনে রাখলেই পাঠক খুশ । স্বপ্ন দেখাতে কার্পণ্য করলে চলবে না ।





                    >>>>>>><<<<<<

















































      






  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ