প্রীতি পঞ্চায়েত
বরাক উপত্যকা
বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের হাইলাকান্দি অধিবেশনে সঞ্চালক বিল্বদল দেব তার স্বাগত
ভাষণে সবার শেষে উল্লেখ করে রঞ্জন সেন এর নাম । এবং প্রধান অতিথিকে ডাকেও অন্তিম পর্বে । রঞ্জন তাতে কিছু
মনে করে নি । বাকি যারা তার সঙ্গে সভায় বসেছিল তাদের বেশির ভাগই কলকাতার ঢাকার
সিলেটের স্বল্পখ্যাত বুদ্ধিজীবী । মন্ত্রী আর প্রশাসনিক প্রধানরা ঘিরেছিলেন
রঞ্জনকে । রঞ্জন সেন তো ঘরের ছেলে । বিল্ব তাকে সম্মান জানিয়ে বলে, রঞ্জনদার ঘরে
ফেরা । মহানাগরিক হয়ে যাওয়া রঞ্জন সেনকে একটু সুক্ষ্ম খোঁচায় বিদ্ধ করার প্রচেষ্টা
। হবে হয়তো, কথার মারপ্যাচ কত রকমেরই হয় । ওসব
কেয়ার করে না রঞ্জন, ডাউনমার্কেট কথাবার্তায় থাকে না সে । শ্রীচৈতন্যের মতো
বাংলা সাহিত্যবাসরে রঞ্জন সেন এর রাগ দেখে নি কেউ, এট লিস্ট তার উত্তরাশ্রমে ।
অলওয়েজ লাভারবয় ভাবমূর্তি । শুধু প্রেমের গল্প লিখলেই হবে না, ইমেজটাও ঠিক রাখতে
হয় । বলতে হয়, মেরেছিস কলসির কানা তা বলে কী প্রেম দেব না । তবে, যাদের বই বিক্রি
হয় না, যারা হিংসুটে, ওরা বলে বড্ড বানিয়ে লেখে লোকটা । এত সাজুগুজু করে পরিপাটি
করে নৌকা ভাড়া করে, সেন্ট পারফিউম মেখে কী করে যে অপেক্ষা করে থাকে প্রেম । সাগর
পাহাড় বরফ জলে একই ভালবাসার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর । ইস্তাম্বুলের
হিপোড্রোমে মিশরের রাজা তুতমোসিসের সঙ্গে এত কী সখ্য । ইতিহাস না জানলেও চলে । তবু
বিশাল ওবেলিস্কের তলায় মার্বেলবেদিতে বসেও মেকিং চালিয়ে যেতে হয় । প্রেমের হয়ে ওঠা
। এসব নাকি ভ্রমণকাহিনির পাঞ্চ, পাঠকের সঙ্গে তঞ্চকতা, ব্যক্তিগত ভ্রমণকথা কেন
পাঠককে জানাতে হবে । রঞ্জন হাসে, ব্যাটারা বীজপুর লালগড় আর খাসপুর ছাড়া তো বেড়ায়
নি কোথাও । আর বানিয়ে গল্প লেখার কথাটা তো সেন্ট পারসেন্ট হিংসে । কে বানিয়ে লেখে
না, বানাতে হয়, তাল ফল তো আর ঐ উঁচু থেকে বড়া হয়ে নামে না, চাঁদপুরের জেলেনৌকোয়
ভাপা হয়ে ধরা দেয় না রুপোলি ইলিশ । তালের বড়া যেমন বাঙালি গৃহবধূর ঘরের শিল্প,
সর্ষে নয় কচুশাক নয় কাচকলা নয় স্রেফ কালোজিরে ফোড়নের ইলিশকোলও দক্ষিণ বাংলার
অমৃতপদ । স্বাদে যোটক না মিললেও মন্দারমনির রূপোর গৌরাঙ্গ পদ্মাবতীর সঙ্গে অতুলনীয়
হয় না । রান্না আর রন্ধনশালাটাই আসল, কুচুটেপনা নয় । নিন্দুকের দলটাই ওরকম । রঞ্জন
সেন এর মুণ্ড চাই, কিংশুক পলাশ বিধান সুসময়রা সেই সত্তর থেকে বৈচিত্রহীন একটা গল্পই
লিখে চলেছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, এনামে ওনামে । একশটা ক্যামেরা দিয়ে একই দৃশ্য বারবার ঘুরে
ফিরে দেখাচ্ছে হিন্দি সিরিয়েলের মতো । পাঠশালার মাস্টার মশাই আর গ্রামের বিডিওর
পেডিগ্রি বলে তো কিছু নেই মনের ঝাল ছাড়া । টাটা হাউসের কর্তা হতে পারে,
হোমসেক্রেটারি হতে পারে মহাকরণে, একজন লেখক চাইলে কতকিছু হতে পারে । শিথিল বাঙালি কিছুই
হবে না । কে বা কারা খালাসীটোলার বাংলা, চাষী শ্রমিকের বিড়ি আর ইনটেলেকচুয়াল হওয়ার
চারমিনার ধরিয়ে চলে গেল বিটলেমি করতে মার্কিন মুলুকে । লাকিস্টাইক আর গোলোয়াজ
ফুঁকে যখন ফিরে এলো তখন দেশের বিড়ি আর চারমিনার হয়ে গেছে জাতীয় ধূম । সুনীল গাঙ্গুলি তো
এমন কথাই লিখে গেছেন স্মৃতির জীবনীতে । তার উপর আছে পরিপাটির ব্যাপার, রঞ্জন
অনেকবার বলেছে বিগহাউসের সিকিউরিটি খুব কড়া, আটকে দিলে আর কী করা । একটু ধোপদুরস্ত
কাপড় পরলেই কিন্তু ঢুকতে দেয়, দাড়িটাড়ি কামালে, চুলে একটু শ্যাম্পু দিলে । শুনবে
না কিছুতেই, পুলিশের মাইনে যে কিছুতেই বাড়ে না । পরিশ্রম করতে হবে যে । একই দৃশ্য
চলবে না, দৃশ্যান্তরে যেতে হবে । ভেনিস না যেতে পারো খাজুরাহো যাও, বসফরাস না যাও
পক ঘুরে এসো আঙ্করভাট না যাও গৌহাটির উমানন্দ ঘুরে এসো । শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে তার
আয়ের অধিক কিছু দেখাও, স্বপ্ন দেখাতে কার্পণ্য করলে চলবে না । গ্রামের সবজিখেত
খাটা পায়খানায় সে বিস্তর দেখেছে গরিবি । বিলাসের আভাস দাও, রুলেটের মার্বেলে ছুঁড়ে
দাও সব পাওয়ার ম্যাজিক । তিন কোঠার স্লটে যদি লেগে যায় তাহলে যে ঝনঝনাঝন । না হলেও
ক্ষতিবৃদ্ধি নেই কিছু, খাব থো আর খোব থা হয়ে যেমন আছো তেমন থাকো লিটল ম্যাগাজিন নামের
ঝাণ্ডিমুণ্ডার দান আঁকড়ে । হারলে বড় জোর ছত্রিশটাকার ঘড়ি যাবে, পঁচিশ টাকার লণ্ঠন
যাবে, হ্যাজাক গেলে গায়ে লাগবে, সাইকেলটাও বড় প্রিয় । বৌ যাওয়ার আগে ভাগ্য
উল্টোপাক পেয়ে যাবে চিন্তা নেই । তত্ত্ব বিশারদরা যে ম্যাজিক করবে, বলবে
সাংস্কৃতিক ইতিহাস, বলবে বিনির্মাণ, উত্তর-ঔপনিবেশিক ইত্যাদি, আরো জমবে যখন বলবে
লৈঙ্গিক বৈশিষ্টে উজ্জ্বল । যৌনতার প্রতিবেদন বললেও শ্লাঘা হয় । রঞ্জন সেন ওসব
তত্ত্ব ফত্ব বোঝে না, টাকা কামাতে হলে যা করার তাই করে, সে স্বপ্ন বিক্রি করে । পঞ্চাশ
বছর বয়স পর্যন্ত কলকাতার নাগরিক জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুখের উপকরণ খোঁজে দিয়েছে পাঠককে
। দক্ষিণাপণ ডলি বসুর চায়ের দোকান থেকে শুরু হয়েছিল যে প্রেম তাকে পত্রে পুষ্পে
বিকশিত করে নিয়ে গেছে সিগরি বরিস্তা আরসালান সামপ্লেস । কলকাতার বাইরেও ঘুরেছে,
বরানগর পেনেটি সোনারপুর পানিটেংকি থেকে বিশ্বভারতীর সুবর্ণরেখা পুরুলিয়ার
সাহেববাঁধ পর্যন্ত । তবে ঘুরে ফিরেই শিলচরে তার শিকড় ছুঁয়ে এসেছে মহিমালয় কিংবা
ননীদার চায়ের দোকানে । ইদানীং বিদেশভ্রমণের সূত্রে বৈচিত্রময় হয়েছে তার প্রেম ।
হাজার ডলার ব্যয় করে তুলুজ লোত্রেকের উইন্ড মিল এর কার্নিভাল দেখেছে । উদ্দাম ক্যানক্যান
নাচের তালে শতবছরের মুলারুজ আবিষ্কার করেছে । সেইন নদীতে মোচার
খোলায় দুলেছে দুজনে । শিল্পটিল্পও হয়েছে কম নয় । লুভ্রতে একদিন কাটিয়ে দু তিনটে তো
স্টোরি বনতা হ্যায় । পাশেই পুরনো দুনিয়ার জীবনঘর লণ্ডন, যুবরানি ডায়নার দেশ । কথায়
আছে লণ্ডনে বিরক্ত হলে মানুষের জীবনও অসহায় হয়ে পড়ে । আডাই মাইলের শহরে জীবনের
সমস্ত উপকরণ ঢেলে দিয়েছে রোমানরা । অ্যাংলো স্যাকসন না বলে রোমান বলায়ও রাগ করেছে
অনেকে । ইস্তাম্বুলের হাগিয়া সোফিয়া মসজিদে বাইজানটাইন চার্চের কারুকর্ম খুঁটিয়ে
দেখায়ও গোঁসা । না গেলে ওসব দেখা যায় না বিষমতা । কার্স নামে কোনো শহর আছে কিনা
জানে না রঞ্জন, ওটা টুকলি করেছে পামুক থেকে । নিন্দুকেরা ধরতেই পারেনি ।
তবে হ্যাঁ, রঞ্জন সেন এর মুদ্রাদোষও আছে ।
নামের পাগল মানুষটা, মিনি নামটা ভাল লাগল বলে ছাড়তেই পারে নি এক জীবনের সাহিত্যকর্মে
। বৌ ভাবে সে মিনি, যার সঙ্গে ফস্টিনস্টি সে ভাবে হিরোইন । ওদের নাম দিলেও আপত্তি থাকার
কারণ নেই, রঞ্জন সেন এর নায়িকা হতে কে না চায় । কবিতা লেখা বুলবুলি শেখ ফেসবুকে
লিখে দিলো রঞ্জনের নাম নিয়ে । রঞ্জন ভণ্ডামি করে নি, বলেছে হবে হয়তো । আসলে, তখন
বুলবুলিটা বেশ চনমনে, আপার হাউসে আনাগোনা হাই-সোসাইটি, একটি পার্শ্বচরিত্রে ছিল মন্দ
না, তখন তো রঞ্জনের ফসল তোলার দিন । তবে এসব ক্ষণকালের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না
রঞ্জন । স্থান নাম নিয়েও অধিকারবোধ কাজ করে তার । যেমন ইদানীং হয়েছে বসফরাস ।
তিনটে গল্পে তিনদিক থেকে দেখিয়েছে প্রাচী প্রতীচীর জলপানি ওয়াটার । একবার বিশাল
তোপিকাপি প্রাসাদ থেকে ইউরোপ গামী রাশিয়ান রণতরীর মিছিল, আরেকবার গ্র্যাণ্ডবাজারের
চাতাল থেকে । এতদেশ ঘুরেছে রঞ্জন কিন্তু এই কাপালিকার্সির মতো বাজার দেখে নি কোথাও
। কলকাতার নিউমার্কেট নিয়ে প্রাচীন গর্ব খান খান হয়ে গেছে তার । কী নেই শহরের
কেন্দ্রস্থলের এই বাজারে, একটা বাজারে চার চারটে মসজিদ মিনার সহ, ভাবা যায় । আতরের
বাজার থেকে সমুদ্র প্রণালীর সংযোগ কারী সেতুগুলিও দেখায় কী অসাধারণ । আর একবার,
নৌকো করে বেড়িয়েছে মায়াবী সুনীল জলে, সঙ্গে নীলনয়না গ্রীক সুন্দরী লুবলুবা হায়াৎ ।
যে মেয়ে কিছুতেই নিজেকে ইউরোপীয় বলবে না, বলে সে উজ্জ্বল এশিয়াবাসী । তবে
সংস্কৃতির পূর্বপশ্চিমের এই মিলনজল,দুইমহাদেশের বিভাজনকারি পানিরাশি রঞ্জন সেন এর
রক্তের ভিতর খেলা করেছে অনেকদিন ।
দুই
অলকানন্দা সেনকে ইতিহাস বুঝিয়েছে রঞ্জন । ভূগোলের গ্রীস আথেন্স
কনস্টান্টিনোপল বুঝিয়েছে । ইতিহাস কী করে ভূগোলের নাম পাল্টে দেয় শুনিয়েছে ।
অটোমান সুলতানরা মন্দ ছিল না, মুসলমান খৃস্টান পাশাপাশি থেকেছে । বসফরাসের ওপারে
টিলার উপর ইহুদিদেরও রেখেছে অবজ্ঞায় । ধর্মযুদ্ধ, ক্রুসেড হয়েছে একটার পর একটা, আর
পরিণতিতে জয়ীপক্ষ বাক্সবন্দী করে ইস্তাম্বুল থেকে তাড়িয়েছে সব বিধর্মী । এত
যুদ্ধবিগ্রহের পরও রঞ্জন সেনএর প্রিয় শহর ইস্তাম্বুল । প্রিয় জল বসফরাস । প্রিয়
সেতু ঢোপিকাপি সেতু । আর প্রিয় মানবী, পাশে পাশে থাকার মিনি । অলকানন্দার কী আনন্দ,
ভ্রমণের সুখ এমন রোমান্টিকতায় লিখতে পারে তার মানুষ, পাশে যখন থাকে কিছুই বুঝা যায়
না । বিদেশে গেলেই শুধু নামীদামী মদের বোতল কেনে আর খায় আকণ্ঠ । খালি বোতলে লাগেজ
ভর্তি করে ফেরে বাড়ি, সাজিয়ে রাখে সেলার ঘরে । তখন সদ্যসদ্য বিয়ের পর খুব শখ ছিল
চুমু খাওয়ার, মদমুখে চুম্বনে কোন টেস্ট পায়নি মিনি তাই একসুখ মাইনাস । একটা বিয়োগ
করলে যদি সব প্লাস হয়, মিনি মেনে নিয়েছে তার বর্ণিল মানুষকে । প্রেমের বিয়ের
রঞ্জনও বিয়ের পরপর বলেছে, এত বড় নামে ডাকা যাবে না । বলেছে,
--- তোমায় একটা ছোট মিস্টি নামে
ডাকব এবার থেকে ।
--- আমাকে তো সবাই নন্দা ডাকে, ছোট
নামই । তুমি এত বড় করে কেন ডাকো ?
--- ওটাও ডাকতে হয় । যখন ঝগড়া করব,
রাগ হবে তখন তো আর মিস্টি নামে ডাকব না । তখন বলব চিৎকার করে, চুপ করো অলকানন্দা ।
--- আর চুপ করে যাব ?
--- আমার মিনি চুপ করে যায় ।
--- গল্পের মিনি আর আমি কি এক ?
--- হ্যাঁ, তুমিই আমার মিনি ।
তোমাকে ডাকব ।
তিন
রঞ্জন সেন অথর নিয়ে তখন মিনি মুগ্ধ । তাই মিনি ডাকলে জবাব
দেয়, পরিচয় করিয়ে দিলে হাসে । পাঠক সম্পাদক প্রকাশক সবাই জানে রঞ্জন সেন এর মিনিকে
। এমনকি তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামও চেনে । বিয়ের আগে অনেকবার
গেছে দেউলিটি । মিনিদের দেশের বাড়ি সামতাবেড়ে গ্রামের নয়ানজুলিতে বসে বসে মাছও
ধরেছে বর্ষার দিনে । শরৎচন্দ্রের প্রতিবেশী বাড়ির মেয়ে বলেই হয়তো সূত্রপাত প্রেমের
। সুখের আক্ষেপে মিনিকে বলেছে,
--- শরৎবাবুর নাতনি হয়ে, সাহিত্যিক
রঞ্জন সেন এর স্ত্রী হয়েও দুছত্তর লিখতে শিখলে না । হেলাফেলা কেটে গেল সারা বেলা ।
--- বেলা এখনও শুরুই হয় নি গো মশাই
। যদি বলো, পার্সিয়ান মাছের কাবাবটা তাহলে নামিয়ে রাখি । চপার ছেড়ে পেন নিই হাতে ?
--- না না রান্নাটাই চলুক । আমার
লেখার পড়াটা শুধু ছেড়ে দিও না । মাহি কাবাব যেমন নার্গিস এসকানাজ না কি যেন একটা
মুরগির ঝোল কিন্তু তোমার হাতে খেলে ভাল ।
--- তোমার হাতে যেমন খুনসুটির
ছোটগল্প । তাই না ? লিখতে না পারি লেখাতে তো পারি প্রিয় । ইরান ইরাক তুরস্ক আর ইউরোপের
সেদ্ধ খাবার খাইয়ে কেমন একটা নধর লেখক বানিয়েছি বলো ? শরৎ চাটুয্যের গ্রাম
সম্পর্কিত নাতনিটি না হলে বাংলা জগতে কে জানতো বলো রঞ্জন সেন দ্য গ্রেটকে ?
চার
তাও কী ঠিক । হয়তো তাই । রঞ্জন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না এলে হতো না
কিছুই । বরাক উপত্যকা তো স্বপ্নের দেশ, স্বপ্ন দেখার দেশ । আর স্বপ্ন দেখার অভ্যাস
মানুষকে অলস করে । সাজানো স্বপ্নকে বাস্তবে নিয়ে আসতে, চাই বেরিয়ে পড়া । তালুক
ছেড়ে মুলুক ফেলে বেরোতে না পারলে সোনাবাড়িঘাট বেসরকারি স্কুলের প্রিন্সিপাল হওয়া
যায় বড়জোর, কিংবা মাকুন্দা দিবা কলেজে বাংলার অধ্যাপক । রঞ্জন সেন তার জীবনকে
ফর্মুলা ওয়ান এর চালকের মতো দৌড় করিয়েছে । তুলনামূলক সাহিত্যের এমএ আর
হোমিওপ্যাথির এমবিবিএস নাকি এক । ঠাট্টা করার মুখোমুখি সাহস কেউ দেখায় নি, তার নাগালও কেউ
পায় নি । সাংবাদিক হয়ে সাহিত্য করেছে । সাহিত্য করতে করতে ব্যবসা করেছে,
সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসায়ী অথর হয়েছে । ক্যানভাস বড় করে এঁকেছে । শেকড় বাকড় উপড়ে
ফেলে স্যাণ্ডি স্টর্ম হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশ বিদেশ । কিন্তু রঞ্জন সেন তো এমন ছিল
না, শিলচর ছেড়ে নড়তে চাইত না । বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে যেতে চাইত না কোথাও । গরমের ছুটি পূজোর
ছুটিতে ছোটমাসি মেজোমাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েও প্রতিদিন এনভেলাপে নীলুকে চিঠি লিখেছে
। ফিরে আসার পর দীপাল দিলু প্রতীক নীলুরা বলেছে, তোর চিঠি জমিয়ে রেখেছি রে, ভ্রমণ
কাহিনি ছেপে বের করব কলকাতা থেকে । অন্যজন বলেছে, আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে
নিয়েছি । বলেছে, একটা প্রেমের উপন্যাস লিখে দে না চিঠি গুলো দিয়ে । বলেছে, কী করে
তোর এত প্রেম হয়ে যায় রে যেখানে সেখানে যখন তখন । ডিমাপুর কোহিমা শিলং ইম্ফলে ।
লুংলে গিয়েও পেয়ে গেলি শাড়িপরা আগাথাকে । ঢপ না সত্যি । বিভ্রান্ত বন্ধুদের দিকে
মায়াবী হাসি ছড়িয়ে ননীদাকে বলেছে স্পেশাল চাফি দিতে, চায়ের সঙ্গে সামান্য কফির
গুঁড়ো ।
পাঁচ
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার কবছরেই টিন আর যৌবনের ক্রসরোডে বেশ কিছু প্রেম
প্রেম খেলার ঠিকানা রঞ্জন রেখেছে কলকাতার দুর প্রবাসে । গল্প তখন জমছে মনে মনে ।
গোডাউন ভরা কাঁচামালের স্টক । মিনির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বেরয় ফিনিসড প্রোডাক্ট ।
মিনির নামে গল্প লেখার শ্রীগণেশ । ভরপুর ভালবাসার সন্ধিসময় । মিনি পড়ছে এক একটি
গল্প আর আপ্লুত হয়ে ভেবেছে এতো তারই কথা, তাদের কথা । তারই শাড়ি, শাড়ির পাড়কথা ।
মিনি বলেছে,
--- আমি তো তোমাকে এমন কথা বলিনি
কখনও । শিলং পিকে যাইনি, ভুটিয়া মন্দিরেও যাই নি । তবে গেছি রুমটেক মনেস্টারি, তবে তুমি যেমন লিখেছ, ওমন পত্পতানো পতাকা দেখেছি
। আবার তুমি পাশে নেই বলে উদাস হয়েছে মন ।
রঞ্জন তার ভুবনমোহন হাসি দিয়ে
বলেছে,
--- ভালবাসা পেলে জেনো সব হয় ।
তোমার শাড়ির পাড়ের কল্কারাও কানে কানে কথা কয় তখন । কাছে থাকতে ডাকে ফিসফিসিয়ে ।
--- আমারও জানো এমন হয় । একটা
আকাশী রঙের টেরিলিন শার্ট দেখেছি শুধু । মিস করিনি, ভুল হয় নি । তোমার দেখা পেয়েছি
কলেজের ক্যান্টিনে ।
ছয়
মিনি রঞ্জনে আর রঞ্জন সেন মিনিতে ছেয়ে গেছে । রঞ্জনও তাই পিরিতি মহব্বতের
গল্প লেখা ছাড়তে পারে নি । তবে যত সময় এগিয়েছে তত হিসেবি হয়েছে । পরের দিকের লেখায়
তেমন বুনো গন্ধ নেই আর । যেমন ছিল কপিলদেবের উদয়কালীন ছক্কায়, ছিটকে দেওয়া
স্টাম্পের বিস্ফোরণে । এরপর সব কেমন নিয়ম বাঁধা রোমান্টিকতায় ছেয়ে যায় । কী জানি
কী । প্রতিষ্ঠার বিড়ম্বনা হয়তো । মাপা শটে খেলতে গিয়ে ছক্কা তেমন হয় না, রোমান্টিক
হয়, স্টেডি হয় । একে একে সব এসে জড়ো হয় লেখার রন্ধননলায়, তত্ত্বের দারুচিনিও যোগ
হয় । নিম্নবর্গ নারীবাদ যৌনতা বিনির্মাণ যাদু সব কিছুর ঘেঁট হয় একটা দুটো । পাঠক
থেকে প্রাবন্ধিকের টেবিল গিয়ে পড়ে হোম ডেলিভারির প্যাকেট । ছোটগল্প লিখতে লিখতে
মনে হয় এবার একটা বড় আকাশ হোক । ক্যানভাসটা বড় চাই । সবাই কেমন নভেল লিখে ফেলেছে
টপাটপ । এমএ শাজাহান একটাও ছোটগল্প না লিখে শুধু উপন্যাসের বেস্টসেলার এখন । বারোটা
করে উপন্যাস দিয়ে সমগ্র বের করেছে আকাশ পাবলিশার্স । রঞ্জন সেন তাই মনস্থ করে এবার
উপন্যাস লিখবে মারকাটারি, পঞ্চাশের এই প ড়ন্ত বেলায় ।
সাত
সব মানুষেরই পরিণত বয়সে শেকড়ে ফেরার একটা ইচ্ছে হয় । কেউ লেখে আত্মকথা, যে
তত বিখ্যাত নয় লেখে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস । তা বলে কী রঞ্জন সেনও লিখবে গতানুগতিক
স্মৃতির সুড়সুড়ি । নৈব নৈব চ । তবে শেকড়-দেশকে উপজীব্য করে লেখাই যায় একটি উপন্যাস
। মেইডেন নভেল । তাজ বেঙ্গলের মোগলসরাই জংশনে বসে রঞ্জন সেন ইন্টারভিউতে এসব কথা
সাজিয়ে বলছিল মিত্রা পাণ্ডবকে । দৈনিক আকাশের জন্য মশলাদার সাক্ষাৎকার দিতে দিতে ।
রঞ্জন সেন এই মেয়েটিকে খুব পছন্দ করে । বেশ একটা ঢলে পড়ার ভাব আছে, কিন্তু পড়ে না
। খুব প্রফেশনেল । রঞ্জন সবে একপাত্র মার্টিনি গলায় ঢেলেছে, একটু রঙিন
মধ্যযৌবনের কথা ও প্রীতিকথা, তখনই সে তার বহুব্যবহৃত সংলাপ ভেঙে খোলা চোখে ছুঁড়ে
দেয় মিত্রার গায়ে । বলে,
---ভারি সুন্দর তো ? রঙটা কী পিংক ?
--- না ডেমসন ।
--- মানে ?
রঞ্জন সেন মিত্রার থ্রি কোয়ার্টার সেল্ফ
ফেব্রিকের জামাটা পছন্দ করে । প্যানেলড স্কার্টটাও দারুণ । আসলে মহিলাটি একটি
আস্তো প্যাকেজ । পঁয়ত্রিশ বছরের ফ্রিসাইজকে নামিয়ে রাখে পঁচিশ বছরে, এটলিস্ট দশ
বছরের গ্রেস । তাই রঞ্জন সেনও আর একটু এগোয় । বলে,
--- আমি অপছন্দ করি । আই ডোন্ট
লাইক ।
--- ইয়েস স্যার ।
মিত্রার মুচকি হাসিকে সম্মান জানিয়ে রঞ্জন সেন বলে,
--- আমার সামনে বসে, এই জংশনে,
একজন অতিসুন্দরী যুবতি এক মাতাল লেখকের বকবক শুনছে, এ হয় না । দুপাত্রের পর সামনের
জন একটু ফ্লার্টি না হলে কী হয় । নেশাটা বেশ জমেছে, আর একপাত্র কী এলাউ করবে টেকো
বুড়ো ? তোমার এডিটার ?
--- অন্য কিছু নেবেন স্যার ?
--- নো, মাতাল গন্ধের কিছু চলবে না
। বাইরে বেরোলে সবাই শোঁকে । তুমি নেবে ? বলো ? আদারওয়াইজ আমার অর্দ্ধেক আকাশ ঢেকে
দেব নৈঃশব্দ্যে ।
--- সে আমার জানা আছে রঞ্জনদা ।
ড্রিংকস এর পর আপনি খুব সুইট হয়ে যান । তখন শুধু মুচকি হাসি । ওতেই হবে আমার ।
লিখে নেব বাকি অর্দ্ধেক ।
--- তুমিও ভারি মিস্টি ডিয়ার ।
খাবে না ? এ জেম অফ এ ড্রিংক । এই একটা মাত্র জায়গায় তুমি রিয়্যাল মার্টিনি পাবে,
রিয়্যাল অলিভ । একেবারে তোমার মতো, নেশা বাড়িয়ে দেয় । আচ্ছা আমি খাওয়ালে খাবে তো ?
--- আপনি কেন ?
--- আমি আরো দুটো নেব ফোকটে । এবার
কিন্তু মধুগন্ধে ভরা ।
--- নিন না, আপনার জন্য সব দেবে
আকাশ ।
--- রিয়্যালি ? ভিকিরি পেয়েছো
রঞ্জন সেনকে । আমি খাওয়াবো বলেছি, খাওয়াবো ।
--- অগত্যা ।
--- গুড বালিকা । তা হলে ঐ কোনের
টেবিলে কোট টাই পরা ভাতের দলাটিকে ডিস্টার্ব করে আসতে হবে । পারবে ? ডোন্ট ওয়ারি,
যেমন র্যভিশিং আউটফিটে আছো সুন্দরী, আজ তোমারই দিন । যাও না, ওর নাম শিবনাথ
পুরকায়স্থ, শিবু, আমার দেশিভাই । নিউজ চ্যানেল চালায় । প্রিন্ট মিডিয়ায়ও কি একটা
আছে ডেইলি । শিলচরের নাম শুনেছ ? বরাক ভ্যালি, সেই নদীর হাঙর, এখন হুগলিতে খাবি
খাচ্চে । বলবে, রঞ্জন সেন ওয়ান্টস,
--- কী বলব স্যার ?
--- রঞ্জন সেন ওর সঙ্গে বসতে চায় ।
বাকিটা আমি করব, যাও ।
শুধু জায়গা বদল । এরপর মিত্রা পাণ্ডবও মেরে
দেয় দুই পেগ । ড্রিংকসের পর মিত্রার ফর্সা মুখের রং বদলায়, হয়ে যায় টকটকে
লাল । হয় আরো বেশি ইয়ে । রঞ্জন সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পায় না । মিত্রাকে ধরেও
রাখতে পারে না, টাকিলা খাইয়ে ওকে নিয়ে চলে যায় শিবনাথ তার চ্যানেলে । রঞ্জনের
সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে যায় আর এক পাতিমাল, যশোময় পালকে । শিলচর স্কুলের লাস্ট বেঞ্চার
যশ এখন ঘ্যামা পাবলিক । যশ রঞ্জনকে আশ্বাস দেয় । বলে,
--- ডোন্ট ওয়ারি । আমার কাছে আছে গুরু
।
--- কী আছে ?
--- তোর বালক বেলা । শিবুটাতো
ইডিয়েট, তোর লাভার ভাগিয়েছিল, এখানে এসেও শালা...
--- অ্যাই, তুই কেরে ? মাইন্ড ইওর
ল্যাঙ্গুয়েজ । শিবনাথ আমার বেস্টফ্রেন্ড । আর লাভার কী ? বস্তাপচা কয়েন ।
কার কথা বলছিস ?
--- কেন শিবুর বউ, নাউ ওয়াইফ অরুন্ধতী
। গভটগার্লসের পেছনদিকে চার্চের বাগানে কম লাইন মেরেছিস ?
--- ওহ্ শিট, আবার সেই ফিলদি
ল্যাঙ্গুয়েজ, হোয়াট ইজ ইট যশ ?
--- তুই ভুলে গেছিস ? সত্যি মনে পড়ে
না অরুন্ধতীর কথা ? আমাদের তরণী বাওয়া ?
--- আবার ভাষার গোলমাল । তরণী ইজ নট
ইউজড ইন কলোকুয়েল ।
--- ঠিক আছে । মনের দুঃখে আমার
সাইকেলে ডাবল কেরি করেছিস বরাক নদীর পারে, গান গেয়েছিস ও নদীরে একটি কথা শুধাই
শুধু তোমারে । ভাঙা রেকর্ডের মতো একটি লাইনই গেয়েছিস বারবার । ভুলে গেলি ? চাতলার
পাশে শামপুর গ্রাম মনে পড়ে ? মোহনবাঁশিদার নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে গেলাম । মাছ ফাছ ফালতু, তুই
শুধু বিলাপ করে গেলি অরুন্ধতী নিয়ে । মোহনবাঁশি পাটনি আমার বাবার রায়ত, আমাদের
খাইয়েছিল আনাতেলে ভাজা মাছ । আমার সাইকেলের ঝুড়িতে ছিল নাগাপট্টির বাংলা ।
--- বাংলা ?
--- ওই আরকি, আসাম এক্সাইজ । কিছু
একটা নিয়ে গেছি, সিংহমার্কা ব্র্যান্ডিও হতে পারে, এতদিনের কথা । কিছু তো হেজি হয়ে
গেছে । মোহনবাঁশিদার বৌকেও ভুলে গেলি ? কাঞ্চন বৌদি, বলেছিলি অরুন্ধতীর মতো দেখতে ।
--- অ্যাই শালা, বৌদিকে নিয়ে
ইয়ার্কি ? যশ এর বৌ নিয়েও কিছু বলবি না ।
--- ওকে । চাতলা হাওরের ধীবরদের
দুঃখে কাতর হয়ে সেদিন কী বলেছিলি মনে আছে ?
--- নো । মাল খেলে আমার কিছু মনে
পড়ে না । লুপ্ত সময়ে আমি ফিরে যাই না ।
--- আমি যে দোস্ত লস্ট টাইমেই থেমে
আছি । এখনও সময় পেলে মাঝে মাঝে যাই মোহনবাঁশিদার বাড়ি । তোদের পরিত্যক্ত উইন্ডো
থেকে আকাশ দেখি হাওরের জল দেখি ।
--- তুইতো প্রিন্ট মিডিয়ায় আছিস ।
বাপের কাগজের মালিক ।
--- ডেইলি পেপার চালালে মন্ত্রী সান্ত্রী
হাতে থাকে । মাল কামানো যায় দেদার ।
--- আমি মুতব ।
--- কোথায় মুতবি । ফাইভস্টারে যে
কোথায় টয়লেট, মাল খেলে বুঝা যায় না ।
--- আমি তোর মালের উপরে মুতব ।
আট
মুতব বলেই চলে এসেছিল রঞ্জন । আসলে ওর তখন মনে
হয়েছে যশ মানুষটা একটু ইতর । রঞ্জন মেয়েদের সম্মান করে, অ্যাডমায়ার করে, ভালগারাটি
একদম পছন্দ করে না । অবশ্য ভেবে দেখলে রাগটা ওর যশোময়ের উপর যতটা তার থেকে বেশি
শিবনাথের উপর । কেমন দুপাত্র নেশায় ভুলিয়ে মিত্রাকে নিয়ে চলে গেল ড্যাঙড্যাঙিয়ে ।
যশোময় তারপর লেজার টাইমে তার পুরনো একজিমা খামচে দিলো আবার । অরুন্ধতীর মতো এক
সাধারণ কিশোরী নিয়ে কোনো লড়াই নেই তার কোনো কালে । তবু শিবু কেন যে জয়ী ভাবে সবসময়
। আর মিত্রা পাণ্ডবকে নিয়ে চলে যাওয়াও কী জয় । ফুশ্, সাতজন্মের কর্ম নয় শিবনাথ
পুরকায়স্থর । যতই হও মিডিয়া ব্যারণ, মিত্রা কে চেনো নি চাঁদু, আমের বড়ার মতো চুষে
ফেলে দেবে । হ্যা, মিত্রা থাকলে বাতাসে একটা যৌনতা থাকে, এয়ারি সেক্স হারানোর দুঃখ
হয়েছে তার । আর যশোময় পাল, শিলচরের মালদার হলেও ম্যান্টেলিটি খারাপ । লোয়ার
মিডলক্লাস । একলাইন বাংলা বলতে পারে না ঠিকঠাক । সে আবার রঞ্জন সেন এর ক্লাসমেট ।
তবে একটা শুদ্ধ কথা বলেছে, ওকে উস্কে দিয়েছে ধীবর কথায় । কৈবর্ত বলতে পারত, মাইমল
মাছুয়া পাটনি দাশ বলতে পারত । বলে নি ।
নয়
বাড়িতে এসে একপ্রস্ত বমি করে রঞ্জন । একটু বেশি হয়ে গেলে যা হয় । শিবুটার
বড় ফুটানি । মিত্রার সামনে কেমন নেগলেক্ট করে গেল । বলে কিনা,
--- টাকিলা ফাকিলা ছাড়, সোজা বিলিতিতে
নেমে আয়, আমরা যেমন খাই, ব্ল্যাকডগ । কালো কুত্তা ।
বলেই চলে যায় মিত্রাকে নিয়ে । জবাব দেওয়ার সময় না দিলে আর কী করা । মিনির
কাছে মাফ চেয়ে নেয় রঞ্জন । বলে,
--- আর খাব না বাইরে । আমাদের
ভালবাসার কসম । এবার কিছু খেতে দাও ।
--- কী খাবে ? রুটি না ভাত ?
--- ধীবরপোড়া ভাত । আছে ?
বলে,
--- না । আজ শুধু কাব্যপাঠ করব ।
সুনীল গাঙ্গুলির কবিতা পড়ব, নবীন কিশোর তোমাকে দিলাম..., কী যেন দিলাম, ভুলে গেছি
। জীবনানন্দের কবিতাটা কেমন বলো, চুল তার কবেকার..., আচ্ছা কুসুমকুমারীর কবিতার বই
আছে আমাদের, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে... । মিত্রা পাণ্ডবের কবিতার বইটা বের
করো, নৈঃশব্দ্যের বন্দনা... ।
বমিটমি করলেও হ্যাংওভার থাকে না রঞ্জন সেন এর । মিনির মতো বৌ থাকলে
পরিচর্যা হয় । বেশ ফুরফুরে সকাল হয় । এককাপ গ্রিন টি খেয়ে দুজন পরে নেয় নীল রঙের ট্র্যাকস্যুট আর
সাদা নাইকি স্নিকার । বেরিয়ে পড়ে প্রার্তভ্রমনে । পাতি বাঙালির মতো লেকের ধারে
কিংবা হর্টিকালচারে যায় । ছুটির দিনে যায় গোচারণ, সকাল থেকে সন্ধ্যে বাগানবাড়ি ।
নারকেল চারায় গোবর সার দিতে দিতে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বিস্তর বকাবকি করে
রঞ্জন, নতুন লেখার পায়তারা শোনায় মিনিকে । বলে,
--- আমাদের সঞ্জীবটা কেয়ার টেকার
হিসেবে মন্দনা, কী বলো ?
--- মন্দ কে বলল ?
--- না, ভাবছি এবার একটা উপন্যাস
লিখব নিম্নবর্গ নিয়ে ।
--- সঞ্জীবকে নিয়ে ? চাটুয্যে
বামুন ?
--- একটা নাম ঠিক করেছি, বলব ?
--- জানি ।
--- কী জানো ?
--- ধীবর বিবরণ ।
--- অ্যাঁ, কী করে জানো ? কাউকে
বলিনি তো ? নিজেকেও কী বলেছি ? তুমি যে দেখেছি অন্তর্যামী ।
--- তা নয় । আমার মনের কথা ভাঙিয়ে
গল্প লিখলে সারাজীবন, তোমারটা জানব না ?
--- ইমাজিনেশনটা আছে । তবে কাউন্ট
কম, সেন্ট পারসেন্ট নয় । ধীবর বিবরণ কোন উপন্যাস নাম হয় না । পাঠক নেবে না । ধীবর
কথা হতে পারে ।
--- প্রেমের উপন্যাস তো হবে ?
ধীবরটি কে ? আবার মিনি ?
--- না মিনি একটু আরবান হয়ে যাবে ।
কাঞ্চন হলে কেমন হয় ? কাঞ্চনমালা । মোহনবাঁশিদার বৌ ।
--- কাঞ্চন মাঝে মাঝে, ডাক নামে
মালা মন্দ না । রাগলে কাঞ্চনমালা । গায়ে মাছের আঁষটে গন্ধ থাকবে ?
--- একটু থাক না, ওটা ইউ এসপি ।
পরে পুষ্পগন্ধা করে দেওয়া যাবে । লেখক তো সব পারে । মি. ব্যাস পারলে আমিও পারব ।
--- দেশ এ দিয়ে দাও ধারাবাহিক ।
চাতলা ধীবরী ।
--- এতসব জানো ? চাতলাও জানো ? যা
জেনেছো জেনেছো, নামটা মন্দ না । চাতলার হাওর নিয়েই লিখব, তবে একটা কনফ্যুশনও আছে ।
চাতলা শব্দটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যে জানি না ।
--- চাতলা তো চাতল থেকেই হওয়া উচিত
। তোমার ছোটমামী উঠোনকে বলে চাতল ।
--- তাই তো ? বিশাল এক উঠোনের মতো
জলাশয় । থ্যাংক ইউ মামী । আর হাওর ?
.--- কামিনী কুমার রায় এর লৌকিক
শব্দকোষ কনসাল্ট করতে পারো । হাওর মানে সাগর হতে পারে, সায়র । আর তোমাদের দেশেও তো
শালাকে হালা বলে । চাতলা হাওর আমি দেখেছি বর্ষায়, প্রায় সাগর হয়ে যায় ।
--- তথ্য যোগানোর জন্য কৃতজ্ঞতা
জানাতেই হবে । এক চাঁড়ালের ধন লুণ্ঠন করতে তোমার দেওয়া নামটাই ফাইন্যাল ।
দশ
রঞ্জন সেন যশো পালের টাকায় মূত্রত্যাগের কথা
বলেছে মদের ঘোরে । মিনির মুখেও ধীবর কথা তথা চাতলা ধীবর লেগে যেতেই বদলে গেল মতটা
। যশকে বলতেই সেও রাজি । বলে,
--- তুই লিখবি ? আমার কাগজে ?
শিলচরে ? কামব্যাক স্টোরি ? একটা হাইপ তুলতে হবে গুরু । রঞ্জন সেন লিখলে আর কোন
দৈনিক ধারে কাছে থাকবে না আমার । ওকে, চলে আয় শিলচর, টিকিট পাঠাচ্ছি দুজনের ।
সঙ্গে থাকা খাওয়া গাড়ি ফ্রি ।
--- তোর ফ্রিতে আমি মু... । ওকে,
কত দিবি ?
--- চেক একটাও পাঠিয়ে দেব ।
এগারো
মিনি রঞ্জনের দাম্পত্য আর ভালবাসা এখন বাংলা
সাহিত্যের মিল ও বুন । এক জীবনে উদ্দাম প্রেমের সব চাঞ্চল্যকর উন্মোচন । পাঠক
মনোরঞ্জনী গল্পকথার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা । গল্পের বরাত পেয়েই রঞ্জন মিনিকে বলেছে
চলো । মিনিও রেডি তৎক্ষণাৎ । ব্যগ্যার কম্বিনেশন তালায় নম্বর মিলিয়েছে সাত আট নয় ।
সেন মশাই এর এস ফর সেভেন ইফর এইট এন ফর নাইন । মিনির যে ধ্যানজ্ঞান সবই তার পতি,
তার লাভগুরু একেশ্বর মহারাজ । বলে দ্বিতীয় পুরুষের দিকে মুখ তুলে দেখেনি জীবনে ।
রঞ্জনের সব জানে মিনি, মিনি বিশ্বাস করে নেশার ঘোরে মানুষ অকপট হয়, সত্যিকথা বলে ।
আর রঞ্জন তো দিনের শেষে স্ত্রীর কাছে একবার কনফেশন দেয় । তাই রঞ্জন রাতের বেলা যা
যা বকে তাই মিলিয়ে সুখের সংসার সাজায় । রঞ্জন বুদ্ধি করে মিত্রা পাণ্ডবের কবিতার
বইএর কথা পর্যন্ত বলে । বলে না শুধু পঞ্চাশ বছরের ম্যান আর পঁয়ত্রিশ বছরের ছুঁড়ির
লংড্রাইভ বৃত্তান্ত । বকখালি কোলাঘাট ডায়মণ্ড হারাবার, সাকুল্য তিনবার । ওসব
স্ত্রীকে বলার বিষয় নয় । বরং শিবনাথ পুরকায়স্থর সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া, মিত্রার
হাইজ্যাক হওয়ার গল্পটা হাইলাইট করেছে । বলেছে বোকাচাঁড়াল যোশময়ের কথা । মাথামোটা
প্রৌড় বললে এজ মিরাকল হয় । মিনিকে বলে,
--- চলো । যাই শিলচর । তোমার
মথুরাপুরি । একটা শর্টট্রিপ দিয়ে আসি ।
মিনির অরাজি হওয়ার কিছু নেই । রঞ্জনের স্বদেশ হলেও মিনির কেউ নেই বরাক
উপত্যকায় । তবে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে তার ভালই লাগে । শ্বশুর বাড়ির দেশে যেতে কার
না হাউস হয় । প্রথমবার যখন শিলচর যায় বিয়ের পর রঞ্জন খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে
উল্টোপাল্টা কথা দিয়ে । বলেছে,
--- যাবে ? এখনও ভেবে দেখ ? ভাষা
ভিন্ন রুচি ভিন্ন । শনবাঁশের বাড়িঘর । সাপ আর বাঘ শেয়ালের উৎপাত । কাঁচা টয়লেট ।
মুখের কথাও কাঁচা । কই যাইতা কিতা খাইতা, ভালা নি আর অয় অয় ।
--- অসমীয়া তো ? হিন্দিতে চালিয়ে দেব,
রাষ্ট্রভাষা । কিছু বাংলা কিছু ইংলিশ বাকিটা হিন্দি । কদিন আর থাকব ।
--- তাও তো কথা । ওখানকার খাদ্য
আলাদা, কচুমচু খায় সিদল শুঁটকিও খায় । মোচাকে থোড় বলে কুমড়োকে ডিংলা সিমকে উরি ।
সংস্কৃতিও আলাদা রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে গায় ভাল, গাজির গানও গায় । হজরত মহম্মদের
মেয়ে, মেয়ের জামাই আর নাতিদের নিয়ে দুঃখের জারি গানও গায় ।
--- শিলচরে কী সব মুসলমান ?
--- থার্টি পারসেন্ট তো হবেই । তবে
কলকাতার মতো দুর্গোৎসব হয় পাড়ায় পাড়ায় । পয়লা বৈশাখেও নববর্ষ হয়, মিলাদ হয় ইদ হয় ।
আর উনিশে মে ।
--- উনিশে মে ?
--- ভাষা আন্দোলনের দিন । এগারো জন
শহিদ হয়েছিল মাতৃভাষার জন্য ।
--- মাতৃভাষা তো অসমীয়া ।
--- না, বাংলা । আমরি বাংলা ভাষা ।
বাংলার মাটি বাংলার জল ।
--- তার মানে অসমীয়া ভাষার
বিরুদ্ধে সংগ্রাম ।
--- না । কোন ভাষার বিরুদ্ধে কেন
হবে আন্দোলন ? অসমীয়া একটি সমৃদ্ধ ভাষা । বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত রুখতে
শুরু হয় ভাষা আন্দোলন । শুরুর দিনেই এগারো জন শহিদ হয় । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে
এমন সংগ্রামকথা কেউ শোনে নি ।
--- আমিও তো শুনিনি । একুশ
ফেব্রুয়ারি জানি ।
--- আমাদের এক প্রথিতযশা লেখকও
বলেছেন এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ।
--- কে তিনি ?
--- আছেন এক প্রগতিশীল ।
বারো
বরাক উপত্যকায় গিয়ে মিনি অবাক হয় । এ যে ঘরের
ভিতর ঘর । এক ভারতবর্ষের মধ্যে আর এক বাংলা, নিখাদ বাংলা । মিনির ভাল লাগে তার
শ্বশুরবাড়ির দেশ । গ্রামীন সারল্যে ভরপুর মানুষের মন । সাধারণ মানুষের মনে
বিশ্বাসের ভিতটা বড় মজবুত । তাই এবার আর ভয় দেখায়না রঞ্জন । বলে,
--- এবার দেখবে হাওরের পূজো ।
--- দুর্গাপূজা, এই শ্রাবন মাসে ?
--- না, তিনি মা মনসা, হাওরের
অধীশ্বরী, তিনি জলদেবী । তার পুজোয় আছে বৈচিত্র, ওঝাগান হয় সারা মাস ধরে, নাচও হয়
। নৌকো পূজো হয় গ্রামের বাড়িতে ।
--- নৌকা পূজা । এও শুনিনি ।
--- চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙা
ডুবেছিল, আবার ভেসেছিল । তাই নিয়ে পূজো ।
--- ভেরি ইনটারেস্টিং ! কিন্তু
সবইতো পূজাপাঠ, স্টোরি কোথায় ?
--- নৌকো ডুবেছিল তাই স্টোরি,
ভাসতেও আনন্দের গল্প । লখিন্দরের ঢলানি সর্পদংশনে বিয়ের রাতে, বেহুলার নৌকো
ভ্রমণের ঘাটে ঘাটে স্টোরির পর স্টোরি, আলাদা আলাদা আখ্যান । নৌকো থাকলেই প্রেম ।
জিয়ানি । মনে নেই ইস্তাম্বুল ? বসফরাসের কিন্নাবোট, নীলনদীর ফালুক্কা, ডাল লেকের
শিকারা । এবার চাতলায় গিয়ে হারিয়ে যাওয়া নাও নৌকোয় ।
--- কোথায় হারাবে ? সব তো খোলা
মেলা ।
--- না ম্যাডাম । দেখা হয় নাই
চক্ষু মেলিয়া । নলখাগড়ার ঘন বন দেখোনি হাওরের জলে ? কত ডাকাতের আস্তানা ওখানে ।
--- ওরে ব্বাস । যাব না তাহলে ।
--- কিচ্ছু হবে না, ব্যাসদেব আছি না,
কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দেব । আমি নয় চোখ বুঁজে শুয়ে থাকব ভেলায়, তুমি বেহুলা হয়ে বয়ে
নিয়ে যাবে ।
--- যাব না । সর্পদংশনে মৃত পতি
নিয়ে যাওয়ার শখ নেই আমার ।
--- ওকে, উপমা উঠিয়ে নিলাম ।
মৎসগন্ধাই বহাল থাকুক ।
তেরো
যশোময়ের কথা মতোই চলে সব কিছু । করিৎকর্মা ধনবান পুরুষ বটে কলেজের লাস্ট
বেঞ্চার । শহর শিলচরের ধনপতি, দুদুটো চা বাগানের মালিক, ক্রীড়া প্রশাসনের কর্তা
এবার বিসিসিাআই পদাধিকারীর হয়ে যাবে রাজ্যসভার এমপি হবে । হাফলং পাহাড়ের নীচে ওর
চা বাগানে থাকার ব্যবস্থা করেছে সহপাঠী রঞ্জন সেন এর । সাততারায় দুরাত্তির থেকে একঘেয়ে
লাগে রঞ্জন মিনির । না বলে পালিয়ে যায় । ফেরার পথে রঞ্জন সেন মিনিকে বলে,
--- চা বাংলোর ছোটগল্প শেষ, এবার
শুরু আসলি উপন্যাস ।
--- এর পরেও আসল আছে নাকি ?
--- আছে আছে গো স্ত্রীরত্ন ।
কাঞ্চনমালার দেশে নিয়ে যাব এবার ছদ্মনামে । মালা হবে মিনি ।
--- মানে চাতলা ধীবরী ?
--- রাজকন্যেও হতে পারো, মহারানিও
। একটা রাজত্ব পাওনা আছে কালীদহের পারে ।
--- কালীদহ ?
--- হ্যাঁ, হাওর ডহরই আমাদের
মনসামঙ্গলের কালীদহ । আর বরাক নদী গাঙুড় । ঐ চাতলাপারে আছে আমার মাতুলবাড়ি । দাদুর
সম্পত্তি ভোগদখল করছে অকর্মা ছোটমামা । বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর সোনার খনি, এখন
কয়েক কোটি টাকার প্রপার্টি । ভাগ চাইব ।
--- তোমার আর সম্পত্তির কী দরকার ।
--- সম্পত্তি পেলে ছাড়ব কেন ?
আপাতত মামার বাড়ির আতিথ্য । ভয় নেই, মামী খুব কেয়ারিং, বিশাল বিশাল বেডরুম আছে,
কমোড বাথরুম ।
মিনি হাসে । ভেবে পায় না রঞ্জন সেন
হঠাৎ কেন এত এক্সাইটেড । মামার বাড়ির গল্প শোনাচ্ছে মিনিকে । যে বাড়িতে মিনি
কয়েকবার থেকে গেছে । রঞ্জনের কিসের এত উত্তেজনা কে জানে । যশোময় পালকে কাত করা, না
কি মামার সম্পত্তির লোভ, না উপন্যাস লেখার আনন্দে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে । বয়সে
ছোট হলেও রঞ্জনের ছোটমামীর সঙ্গে সখীর সম্পর্ক মিনির । ছোটমামাও রঞ্জনের বয়সী,
বন্ধু । মামী ও ভাগ্নে ভাগ্নে বৌকে পেয়ে
খুব খুশি । রঞ্জনকে বলে,
--- ঘি খাবে ?
--- বচুড়ি দিয়ে জাউভাত খাব মামী ।
--- ক্ষীরের সন্দেশ খাবে ?
--- ‘সুখে থাকো’ ছাঁচটা আছে ?
--- আছে ।
মামা বলে,
--- কী মাছ খাবি বল ? পুঁটি মকা
টেংরা ? পাবদা চিতল বোয়াল ? যা খাওয়ার আজই বলে দিতে হবে । ওয়ান উইক ডেট নেই ।
--- আমি পালাচ্ছি না । একমাস থাকব
।
--- থাক না । কাল বাজারবার
ধোয়ারবন্দে । আসবে জোড়াপাঁঠা । হরিণের মাংসের বরাত নিয়ে গেছে নুনুয়া । বনরুই হাঁস
মুরগি কাঠুয়া আর ভেড়ার মাংস আসবে বাগবাহার থেকে ।
--- উরিব্বাস । হাই কলেস্টরেল, হাই
প্রোটিন, হাই ক্যালরি ।
--- সব প্রটেকশন নেওয়া আছে । বার্ণ
করার ব্যবস্থা আছে, অনুপান আসবে জন স্মিল থেকে ।
ছোটমামার সঙ্গে ষড় হয় যশোময়ের । মামার বন্ধু
ভাগ্নেরও ক্লাসমেট । চলে আসে মামার ডাকে, ডিকি থেকে নামে জোড়া বাক্সের জনিওয়াকার ।
হরিণের মাংস খেয়ে আক্ষেপ করে যশ । বলে,
--- মামীমার হাতের পায়বার মাংসের
স্বাদ ভুলতে পারি না ।
রঞ্জন সেন বুঝতে পারে যশোময় দিদিমার কথা বলছে । সম্পর্কে বড় হচ্চে, মামার
বন্ধু হওয়ার সুবাদে । যদিও যাওয়ার আগে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে একান্তে ।
--- শোন, তোকে নিয়ে আমার অনেক
প্ল্যান আছে, পরে বলব । আপাতত, মিত্রা আসবে দুএকদিনের মধ্যে । এক্সক্লুসিভ
ইন্টারভিউ নেবে তোর, ফটোগ্রাফারও পাঠাব ।
--- কে মিত্রা ?
--- মিত্রা পাণ্ডব ইয়ার । শিবু যে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাজের জংশন থেকে ।
--- হাইট দেখেছিস ? গাণ্ডু । চাঁদে
হাত দিতে চাস ? দুটো চা বাগান আর দুটো রুরেল ডেইলির মালিক হলেই সব ছোঁয়া যায় না ।
আই সেইড, আগেও বলেছি তোর প্ল্যানে আমি মুতি শালা ।
চৌদ্দ
ড্রিংকস করলেই রঞ্জনের হিসি পায় আর তখন যাকে
সামনে পায় তার মুখটাই দেখে । যশকে এই নিয়ে দুবার ইনসাল্ট করে রঞ্জন । যশ ওসব নিয়ে
ভাবে না, রঞ্জনের করিগেন্ডামের অপেক্ষাও করেনি, ঝিমলি কে পাঠিয়ে দেয় পরদিন ।
মেয়েটিকে দেখে অবাক রঞ্জন, বরাক ভ্যালিতে এতো স্মার্ট শাড়িপড়া সাংবাদিক থাকতে পারে
ভাবে নি । কথার আর শরীরের দ্যুতিতে আলোকিত উষ্ণ হয়ে ওঠে ছোটমামার বাড়ির
স্যাঁতস্যাঁতে মেঘলা দুপুর । মেয়েটি বেশ অকপট । বলে,
--- আমার নাম স্মৃতি দাস চৌধুরী ।
স্যার বললেন ডাক নাম বলতে, বললাম ঝিমলি । টাইটেল দিলেন পাণ্ডব । নিইনি, যদিও স্যার
ডাকেন ঝিমলি পাণ্ডব । মিত্রা পাণ্ডবের কবিতার খুব ভক্ত তিনি ।
--- তোমার স্যার খুব রসিক পুরুষ,
নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি ।
--- স্যার আমার গার্জেন, গুরুজন ।
--- আমি ওসব হতে পারি না । একটু কম
হলে ভাবা যেত ।
--- আপনি শিলচর ছিলেন ছেলেবেলায় ?
--- স্যার বলবে না ? সম্বোধনহীন
প্রশ্নের জবাব দেব ? ওকে, কলেজ জীবনেও ছিলাম । চাকরি করেছি জুবিলি স্কুলে ।
--- লেখালেখি শুরু করেন নি তখনো ?
--- সলতে না হলে প্রদীপ জ্বলবে কী
করে ? প্রস্তুতি ছিল ।
--- নোট নেবে না ? কী করে লিখবে ?
--- আমি আপনাকে দেখিয়ে যাব । মনে
থাকবে সব । স্যার বলেছিলেন আপনি পত্রিকা বের করতেন ধারকর্জ করে । স্যারের প্রেসে
তিন সংখ্যার ছাপা খরচ বাদ পড়ায় নদীর পারে যাওয়া ছেড়ে দেন ।
--- প্যার মে কভি কভি হাফ সোল হলে
ভুলে যায়, ব্যবসায় চোট হলে ভোলে না পাতি বিজনেসম্যান । ঘুরপাক খায় তিনশো টাকায় ।
নদীর পারেই ছিল প্রেস এখন যেখানে আছে একজ্যাক্ট লোকেশন । হরিসাধন পালের তিনশো টাকা
এখনও দিই নি, দেব না । বলে দিও পুত্রধন যশোময় পালকে ।
--- ভারতী কমলা এই দুটোই তো ছিল
বইএর দোকান, অনেক দেনা করে বই কিনেছেন ?
--- বই কিনেছি পয়সা দিইনি, তো কী
হয়েছে ? ফালতু বই সব বটতলার স্বপন কুমার আর মোহন সিরিজ, কিরীট রায় ।জোকস এপার্ট,
ওরকম করেছি বলেই শিখেছি । ঐ ধারের সলতেটাই সত্যি, নইলে আর কেন সাক্ষাৎকারের পিছনে
ছোটা এই ধীবরগ্রামে ?
--- আপনি তো পাঠকপ্রিয় লেখক ।
নাগরিক প্রেমের গল্পে সিদ্ধহস্ত । গঙ্গার পারে ভিক্টোরিয়ার গোয়ার ডোনা পাওলায়
আন্দামানে ইস্তাম্বুলে ভেনিস নীলনদের পারে এক প্রেমিকা সম্বল করে টইটুম্বুর
প্রেমের গল্প লিখেছেন । এক নায়িকা মিনি । জনপ্রিয়তা হারানোর ভয় ছিল না ? শিলং
কোহিমা নুংলেতেও মিনি । মিনি কী বৌদি ?
--- আমার স্ত্রীর নামও মিনি ।
মিনি সেন এর সঙ্গে কথা বলে খুব খুশি ঝিমলি । মিনিও খুশি, ইমপ্রেসড ।
রঞ্জনকে বলে,
--- মেয়েটি তোমার ফ্যান । সব গল্প
পড়েছে । অবাক হয়ে গেছে, শুধু ছোটগল্প লিখে, এক নায়িকাকে নিয়ে কেউ এত জনপ্রিয় হতে
পারে দেখে । বলেছে কী করে হয় ?
--- প্রশ্ন হিসেবে ইন্টারেস্টিং ।
তোমার জবাব ?
--- বলেছি বিখ্যাত হতে রাজ্যও লাগে
না রাজকন্যাও না । শুধু বুদ্ধিচক্রে মেধাকে শান দিতে হয় । শৈশব থেকেই পড়াশোনা
করেছে রঞ্জন সেন । বাঙালির পেটেন্ট-কেনা কুঁড়েমি ছেড়ে ব্যবসা করেছে, সংসার সামলেছে,
প্রেম করেছে, লেখালেখি করেছে প্রেম নিয়ে, এক নারী নিয়ে তবে না রঞ্জন সেন ।
--- আর বালিকার প্রত্যুত্তর ?
--- সে তো মুগ্ধ । তবু একটা আশাভঙ্গ
কোথাও আছে, কল্কাপাড়ের গল্পটা নিয়ে কনফিউসড । সে নাকি অন্য, অপর এক নারী কথা ।
--- বলেছে ? গল্পকারের সাক্ষাৎকার
নিয়েছে স্মৃতি থেকে । অ্যাকস্ট্রা স্মার্ট । আদারওয়াইজ মেয়েটি ভাল । বিউটিফুল ।
--- তাও দেখেছো ?
পনেরো
বেফাঁস হয় না রঞ্জন সেন । সুন্দরী যুবতিকে তার পছন্দ লুকিয়ে রাখে । এই
প্রথম কোন শাড়িপরা যুবতিকে তার ভাল লাগে । আসলে লেখার সময় রঞ্জন অন্যরকম, শাড়িপরা
বঙ্গললনার প্রসংশক । কিন্তু ব্যাবহারিক জীবনে শাড়িকে আনস্মার্ট ভাবে, সুন্দর
পরিচ্ছদ মানে না । বোকা বোকা গ্রেসলেস কাপড়ের বাণ্ডিল । পঁচিশ বছরের শিলচরি মেয়েটি
কিন্তু রঞ্জন সেনকে উত্তেজিত করে । ঝিমলি দাস চৌধুরীর শাড়ির পাড়ে কল্কা দেখে
অভিনিবেশে । হুবহু তার গল্পের নায়িকা, কুড়ি বছর আগের লেখা গল্প আবার
লেখা হচ্চে । রঞ্জন কল্কাময়ীকে বলে,
--- ওগো মেয়ে, তোমার শাড়ির পাড়গুলো
বড় বাঙময় । কথা বলছে, হাঁটছে পাশাপাশি । হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে এ ওর গায়ে ।
--- না, এত প্রগলভ নয় আমার পরিধান
। ওদের তো আপনি ছুটি দিয়েছেন অনেক কাল আগে, অন্য এক মিনি কাহিনিতে ।
--- সেই উল্টো পাঁচের মতো নক্সাদার
শাড়ির গল্প ? ও তাই ফিরে পড়ার প্রস্তুতি ? না ফিরে লেখা ? রচনা আবার ? বাট, স্যরি
সুন্দরী, ও গল্প তোমার বৌদিকে নিয়েও নয়, তোমাকে নিয়েও নয় । মিনি সেন তাঁতের শাড়ি
পরে খুব কম । গল্পটা নাগাদেশের এক ছোট জনপদের, নাম লুংলে । ছোটমেশো ডাক্তার,
বাঙালি নয় নাগা খৃস্টান, মেশোর ভাইঝি, আমার থেকে বড়ই হবে । শহরটাতো ছোটো,
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ, মেঘলা সারাদিন । সুতীর শাড়িতে আগাথাদিকে দারুণ লেগেছিল
সেদিন । ঐ একদিনই মনে গেঁথে যায় । কথা বলা কল্কার গল্পটা বিয়ের পরপরই লিখে ফেলি,
মজার কনফিউশন, তাই না ? আমার কিন্তু এরকম রোমান্টিক থাকতে ভাল লাগে ।
--- আমারও ।
আমারও কথাটাই ক্যাচ করে নেয় রঞ্জন সেন ।
মোক্ষম মুহূর্তে একবার চোখাচোখিও হয় দুজনের । রঞ্জন ভাবে ঠকিয়ে দিল না তো যশ ।
ইন্টারভিউটা করিয়ে নিল মাগনা । ঝিমলিকে বলে,
--- তোমার স্যারকে বলো চেকটা
পাঠিয়ে দিতে । রঞ্জন সেন ফ্রিতে টক দেয় না ।
ঝিমলি চলে যেতেই যশোময়কে টেলিফোন করে । বলে,
--- তোর জেরক্স কপিটা বেশ ঝক্ঝকে
। বলতে পারিস এবার পাণ্ডব অনেকটাই মিত্রার মতো । গুড, কাজের মেয়ে । অনেক এগিয়ে
যাবে, ভাল জার্নালিস্ট হবে ।
--- ওয়া ! ফোঁটা না পড়তেই বর্ষণ
শুরু ? অকারণ প্রসংশা করার মানুষ নও বাবা তুমি ! লেট মি সি ।
ষোলো
নিজের ইন্টারভিউ পড়ে চমকে যায় রঞ্জন সেন । এত সব তথ্য তো তারও জানা ছিল না
। রীতিমতো গবেষণা করে লিখেছে ফুল পেজ প্রতিবেদন । ঝিমলি নিজে এসে দিয়ে যায় কপি ।
এর মধ্যেও একবার এসেছে কনফার্ম করতে, দেখিয়ে যেতে প্রুফ । রঞ্জন কিছুই দেখেনি,
একঘণ্টা তাকে দিয়ে গেল ভরপুর । মিনিকেও থার্টি মিনিটস । ফটোগ্রাফার ভবতোষ ছবি
উঠিয়েই চলে যায় । কপি দেওয়ার দিন উৎসব হয়, ছোটমামা খুশিতে গোটা মুরগির রোস্ট রেঁধে
খাইয়ে দেয় ঝিমলিকে । রঞ্জন আবার যশোময়কে টেলিফোনে জানায় ভাললাগা । বলে,
--- তোর জেরক্স কপিটা সত্যি ঝকঝকে
। দারুণ রিক্রুট । রঞ্জন সেন সংলাপ রিপিট করে না ।
কী জানি কী ছিল যশোময় পালের মনে । দুম করে স্থায়ী সম্পাদক ছাঁটাই করে ঝিমলি
দাস চৌধুরীকে করে দেয় এডিটার ।
যশ রঞ্জন সেনকে টেলিফোনে দেয়
খুশখবর । বলে,
--- রবিবার ঝিমলি পাণ্ডবের নতুন
অ্যাসাইনম্যান্ট, তোর উপন্যাসেরও শুরু । বড়াইল ভিউতে দুটো অকেশন সেলিব্রেট করতে
পার্টি থ্রো করছি । তোর জন্য থাকছে স্পেশাল টাকিলা ।
--- ককটেল পার্টিতে রঞ্জন সেন
টাকিলা ফাকিলা খায় না । ড্রাই মার্টিনি উইথ অলিভ গানর্সিং হলো ককটেলের কিং । কেন
য়্যু অ্যফোর্ড ?
--- ওকে বস । চিফ গেস্টের অনারে
তাই হবে ।
পার্টিতে ঝিমলি একটু বেশি ইনডিফারেন্স
দেখিয়ে ফেলে, বেশি সতি । রঞ্জন সেন এর এসব ফিমেল নখড়া পছন্দ নয় । ঝিমলিকে নিয়ে যায়
পার্ক রোডের দিকের ব্যালকনিতে । বলে,
--- হোয়াট ইজ দিস ? নিয়মভঙ্গ করেছ
। কেন ?
--- নিয়ম ? মিনস ?
--- ককটেল পার্টিতে এসে কেউ একাদশী
করে ?
--- সত্যি বলব ?
--- বলবে ।
--- আপনার ভয়ে ।
--- স্ট্রেঞ্জ । আমাকেও কেউ ভয় করে ?
--- করি, আমি করি ।
একটা অপরাধ বোধও কাজ করেছে । সেদিন পৌঁছে দিতে চাইলেন, না করলাম ।
--- কোনদিন ? কবে ?
--- শাড়ির কল্কাগুলো
ডাকছে বলছিলেন । আমি এড়িয়ে গেলাম ।
--- গুড,
ভেরিস্মার্ট, বুঝতে পেরেছিলে ? চলো আজ পৌঁছে দিয়ে আসি টুক করে ।
--- হবে না । ধরা
পড়ে যাব । গাড়ি স্যারের, ড্রাইভার কোম্পানির । কী ভাববে ?
--- কে বলেছে তোমায়,
গাড়ি আমার মামার, আমি ড্রাইভ করে এসেছি । ওকে, রিক্সায় যাই চলো ।
মেয়েটি বুদ্ধিমতী । বুঝতে পারে মালের ঘোর
ধরেছে রঞ্জন সেন কে । উৎসাহের উৎসও ধরতে পারে হয়তো । কথা দেয় অন্য একদিন একটা
ড্রাইভে বেরোবে, ভেরি লং । শনবিল ঘুরিয়ে আনবে ।
সতেরো
শনবিল ভ্রমণ বেশ জমে যায় । বরাক উপত্যকায় শুধু
জলাভুমি । চাতলার হাওর আর বকরির হাওর ছাড়াও যে বিশাল জীবন এক জীবনঘেরা জলের দেশ
আছে দেখা হয় নি রঞ্জনের । শনবিলের নাম শুনেছে, ভূগোলবইএ পড়েছে, দেখা হয়নি স্বচক্ষে
। জলকে ঘিরে যে এতবড় জনপদ হয়, এ যে না দেখেছে তার চোখই থাকবে অতৃপ্ত । মিনি জল
দেখে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে পৌঁছেই নৌকো খুঁজেছে । ভাগের ডিঙি নৌকোয় কী
করে বসবে এতজন । কর্ণধার আলু মিয়া আরো কয়েকজন মাতব্বর জুটিয়ে বলে, চলুন । বিরক্ত
এবং শংকিত মিনি বলে আগে গ্রাম ঘুরে দেখি তারপর তো জলভ্রমণ । জল দেখা আর হয় না এ
যাত্রা, রঞ্জন গল্পে এবার বাদ পড়ে নৌকো । মিনি বলে শ্রীপুর গ্রাম দেখবে । শিলচর
আসার পর একটা ব্যাপার মিনির খুব ভাল লেগেছে । শহরে একটা সাহিত্যের পরিবেশ দেখেছে
প্রানবন্ত । কবি আছে কথাসাহিত্যিক আছে প্রাবন্ধিকও আছে । আসলে ঝিমলির উৎসাহেই এত
জানা । বলেছে,
--- আমাদের শহর হলো কবির শহর ।
সুনীল শক্তির প্রিয় কবিদের বাস । তবে মফস্সলের সব গুনের সঙ্গে একটা গুণ আমাদের
বেশি । শিলচরে কথাসাহিত্যেরও একটা ঐতিহ্য আছে উজ্জ্বল । উৎকৃষ্ট ছোটগল্প উপন্যাস
লেখা হচ্ছে ।
--- এখানে জীবনের ওঠাপড়া বেশি ?
টানাপোড়েন ?
--- তা আছে । জীবন বড় মহার্ঘ
এখানে, আবার খুব সমৃদ্ধ মানুষের মনোরাজ্য । বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সম্মেলনে গড়ে উঠেছ
বৈচিত্রময় লোকসংস্কৃতিও । আর ছোটগল্প উপন্যাস তো জটিল জীবনেরই প্রতিফলন । কথা
সাহিত্য জীবনকে সহজভাবেও দেখতে জানে । দেখার চোখ আর শক্তিমান কব্জি আছে বলেই
প্রত্ন খননে বের করছে লেখক জীবনের সহজ আর জীবনের জটিলতা ।
--- ঠিক । পৃথিবীতে এত এত পাওয়ারফুল
লেখক আছেন, তারা কিন্তু জীবন অতিরিক্ত জীবন দেখেই সমর্থ হয়েছেন । এখানকার কোন
লেখকের নাম শুনিনি আমি । বরাক উপত্যকার গল্প সম্বন্ধে আলাদা ভাবে কোনো অবয়ব এখনও
গড়ে তোলতে পারিনি । আমার পাঠও খুব কম । তুমি যা পড়িয়েছ মনিমুক্তো, সেই সম্বল ।
--- নাম না শুনলেই কী বৌদি সব
মিথ্যা হয়ে যায় ? দেশভাগ মিথ্যে হয় ? শিলচর শহরে চারভাগের তিনভাগ মানুষই
বাস্তুহারা । দেশের মাটি তো দুভাগ করা যায়, কিন্তু মানুষের মন কতখণ্ড হয় কেউ জানে
? সে কাজ ছোটগল্পকারের, আপনাকে পড়াব এক আশ্চর্য আখ্যান । এক মহিলা গল্পকারের লেখা
‘উজান’ নামের ছোটগল্প ।
আঠারো
উজান
পড়েই মিনির শনবিল দেখার উৎসাহ । দোহালিয়া আনিপুর রামকৃষ্ণনগর হয়ে ফেরার বুদ্ধিটা
ঝিমলির, আর মিনিও অতি উৎসাহে বলে শ্রীপুর যাবে । গল্প চরিত্রের খোঁজে অলীক
বাস্তবের হাতছানি মিনিকে বিবশ করে দিয়েছে । উজান গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া যে বাস্তব
কল্পনার সীমা এমন করে মুছে দেবে মিনি ভাবে নি । মিনি এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে, বরাক
উপত্যকার জলমাটিতেও যে এমন লেখা সম্ভব কল্পনা করেনি । ছোটগল্পটির কেন্দ্রে
রয়েছে নববসতির এক গ্রাম শ্রীপুর । গ্রামের স্মৃতিকথা আছে আখ্যানে, সেই স্মৃতির
মধুর উপস্থিতি গল্প শরীর কে মেদুর করে রাখে পাঠকালে । স্নেহময়ী এক মহিলার
খোঁজে বাঁশের বেড়ার উপর দিয়ে উঁকি দেয় মিনি । যদি দেখা হয়ে যায় লালপাড় শাড়িতে চওড়া
করে সিঁদুর আঁকা এক গ্রামবৃদ্ধার । শ্রীপুর গ্রামটি অবিকল একটি গ্রামের মতোই,
গ্রামের মেয়ে মিনির সব গর্ব খর্ব হয় । আসলে তাদের সামতা গ্রামতো শুধু নামেই আটকে
আছে, নইলে শহরের সঙ্গে কোন ফারাক নেই । গল্পের গ্রামের ভিতর যেন স্নেহ মমতার এক
অপার ভাণ্ডার পেয়ে যায় মিনি, যাদুর পরশ বুলিয়ে যায় গ্রামবাসী মাসীমা কাকীমা বৌঝিরা
। হাড়ির কানা পায়ে ঠেলে বালিকারা খেলেছে এক্কা দোক্কা । মিনি ঘ্রান নেয় শ্রীপুরের,
ঘ্রানে খোঁজে ঠিকানা । রঞ্জন সেন মিনির এই ভাবান্তর পড়তে পারে, মনে পড়ে যায় তার
প্রথম সিলেট স্মৃতি । মায়ের জন্মভূমির খোঁজে দাড়িয়াপাড়ার এবাড়ি ওবাড়ি উঁকি দিয়ে
খুঁজেছে অসহায়ের মতো । দিঘীর পারে তার মাতৃগৃহ এখন কোথায় কেউ বলতে পারে না । সহচর
কবি মোস্তাক বলে, দাদা এখন গোটা দাড়িয়াপাড়াই হয়ে গেছে আপনার মায়ের বাড়ি । মিনির
খুশি খুশি মনখারাপের উৎসে চলে যায় ঝিমলিও । বলে,
--- কাকে খোঁজছেন বৌদি ?
--- আমার অন্ধমামা আর মামী চারুশশী
।
--- মামার নাম ক্ষিতীন্দ্রমোহন ?
আপন মামা ?
--- আপন থেকেও বড় ।
--- গল্পকারকে নিয়ে এলেন না কেন
দেখিয়ে দিত বাড়ি । ‘নোটবুক’ পড়েছেন ?
--- চিঠি বুড়িকে চেনো ঝিমলি ?
--- চিনি গো চিনি ।
--- ঠিকানা জানো ? জানো কোথায় যায়
চিঠি ?
--- ধুলিয়াখাল, রতনপুর পো গোপায়া
সিলেট ।
উনিশ
রঞ্জন সেন এসব পড়ে নি ‘সমান্তরাল’ এর গল্প ।
রঞ্জনের মতো শীর্ষেন্দু সমরেশ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ আর রঞ্জন সেন, জীবিত লেখকদের
মধ্যে এরাই এখন বেস্ট সেলার । এরাই দৃশ্যমান, বাকি কিছু নেই । হ্যাঁ, সত্তরের কিছু
লেখক মিলে একটি বারোয়ারি ছোটগল্প লিখেছিল শ্রমিক কৃষক আদি নিম্নবর্গদের নিয়ে ।
একটা আকাশেই ওরা দেখেছিল নিম্নমধ্যবিত্ত চোখের ধূসর নীল । সেই আকাশটাই ওরা প্রাণভরে
ব্ল্যাকওয়াশ করে যাচ্ছে ডাল ভাত আলুপোস্ত আর আলু ভাজা ডাল ভাত করে । সাবালকত্বহীন
ওসব ন্যালাখ্যাপা লেখা রঞ্জন সেন আর পড়েনি, পড়বেও না । তবে বরাক উপত্যকায় বেশ
কয়েকবার গল্পকারের বই সে দেখেছে খুব পপুলার, বিক্রিও হয় বারোমাস বইমেলায় । কক্ষপথ
কোষাগার পু ঘোষ আরশি নগরের রূপকথা সুখগাছের গল্প ঈশানের যাযাবর, উপন্যাসের খোঁজে
শরাইঘাট একটি প্রেম কাহিনী স্বপ্নের সীমানা ছুঁয়ে । বেশ তাগড়া স্টোরিটেলার সব ।
যশোময়ের
এডিটার মেয়েটি মিনিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে রঞ্জন সেনকে ভুলেছে । ইচ্ছে করেই কী । সে যাই
হোক, মেয়েটি সত্যি ভাল, ভেরি গুড গার্ল । যশকে বার দিতে সে ঝিমলিকে মিত্রা
পাণ্ডবের জেরক্স কপি বলেছে । ভুল, সত্যি নয় মোটে । ঝিমলিই ওরিজিনেল, মৌলিক, সিঙ্গল
পিস । রঞ্জন সেনকে শিকড়ে ফিরিয়ে আনতে প্রাণপন করছে । মাটির ঘ্রানে জড়িয়ে রাখছে,
বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, বইপত্র দিয়ে সাহায্য করছে । সবচে’ বড় কথা ওর সঙ্গে সময়
স্পেণ্ড করতে তার ভাল লাগে । রঞ্জন ভেবে দেখেছে মেয়েটি ডিফারেন্ট, মিত্রা পাণ্ডবের
মতো আহ্লাদি নয় এপারেন্টলি, চালাক নয় তেমন কম্পারেটিভলি । সেক্সুয়্যালিও যথেষ্ট
উত্তেজক । মিনিকে এসব কথা বলা যায় না, সন্দেহ করে । হাজারো প্রশ্নে জানতে চায়
উত্তেজক মানে কী । সব কথার ঠিকঠাক উত্তরও হয় না যে । ঝিমলি কম কাপড়ের পোষাক পরে
না, শাড়িই পরে হাইকলার থ্রিকোর্য়াটার স্লিভের । সুতী শাড়ির কল্কাপাড়ের কানাকানি
শোনে রঞ্জন । ঝিমলি-পায়ের পাতার উপর যখন নাচে তখন কিন্তু বেশ লাগে সন্ধ্যা দীপের
দপদপান আলোর মতো । ঝিমলি বেশ আঁটোসাঁটো, পৃথুলাও বলা যাবে না, আবার সাইজশূন্যও নয়,
মায়াময় মুখটায় জড়িয়ে রাখার আবেদন । শ্যামলা মুখের উপর চোখ দুটোয় সৌন্দর্য
হীরকদ্যুতিতে ছিটকে বেরোচ্ছে, বুদ্ধির দীপ্তি আকর্ষিত করছে । রঞ্জন সেন একা একা
উপভোগ করে আনন্দ । সতর্ক থাকে যাতে মিনির চোখে না ধরা পড়ে আকর্ষণের কেন্দ্র । তাই
হয়তো ঝিমলির সঙ্গে কথা বলার একটা আলাদা ভঙ্গি আয়ত্ত করেছে । পায়রার ওম দেওয়ার মতো
বকম বকমে কথা কয় । অবশ্য রঞ্জন সেন এর তো রাখডাক নেই, তাই সবার সামনেই কথা বলে
ফিশফিশিয়ে, সবার মধ্যে থেকেও সবার থেকে আলাদা হয় । একদিন দুদিন কেউ খেয়াল করে না,
তারপর গুঞ্জন হয় সবার মনে । আত্মবিশ্বাস মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় কেয়ারও করে না
পারিপার্শ্বিক । চোখে মুখে অসমবয়সী প্রণয়ীর বিরহব্যথার নীল আর সুখের আবেশে
মশগুল হওয়ার অলক্তরাগের প্রকাশ রঞ্জন সেন এর প্রতিরক্ষা দুর্বল করে । মুঠোফোন কানে
রঞ্জন সেনকে কেউ খুব বেশি কথা বলতে শোনে নি । সব কথা কয় ঝিমলি, রঞ্জন সেনএর গল্প
নিয়েই সব কথা । নতুন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী নিয়ে উচ্ছ্বাসের কথাও জানায় । বলে,
--- আপনার লেখার রোমান্টিকতা অন্য
জায়গায় । মিনির প্রেম তো জুড়ে দেওয়ার আঠা । আপনার লেখা যেন সুরমা গাঙের গাঙচিল,
ফকিরটিলা বাজার থেকে উড়া দিয়ে চলে যায় ব্ল্যাক ফরেস্টের গহিনে, গ্র্যাণ্ড বাজারে
যায় খান খলিলি যায়, যায় ম্যানহাট্টন নিউজার্সি যায় চেয়ারিং ক্রস । নৌকো ভ্রমণের জল
খেলায় দুই মহাদেশ এক হয়ে যায় অবলীলায় । বসফরাস প্রণালীর কথা পড়েছি ভূগোলে, এরকম
দুই বিষম সংস্কৃতির মিলন জলের বার্তা তো কেউ দেয় নি এর আগে । পূর্ব পশ্চিম মেলানো
বড় কম কথা নয় । বেড়ানোর সময় কী আপনারা ইতিহাস বিস্মৃত থাকেন, না জেনেশুনে ইতিহাস
কে স্যালুট করে করে দুজনের বিহার ?
--- দুজন, মানে তোমার বৌদির কথা
বলছ ? সে তো তখন হোটেলে বসে খাচ্চে মরোক্কান বাস্টিলা ।
--- তবে ইস্তাম্বুলের নৌকোয় কে ?
কোন মিনি ?
--- মিনি কী কম পড়িয়াছে ? সে মিনির
নাম মাখতুমা ।
--- সেদিন বললেন লুবলুবা ?
--- বলেছি ? ঝুট । আর বললেই বা কী
? ওসব একই নাম, আংকারা থেকে পাঠিয়েছিল গাইড । মাখতুমা চাকরি করে, কিন্তু রোমান্টিক
দারুণ ।
--- আর কার্সে ? জার্মানিতে ? বরফে
?
--- সে মাখতুনা ।
--- বৌদি নেই কোথাও ?
--- আছে হোটেলে । সরাইখানার স্টোরি
এখনও লিখিনি ।
কুড়ি
মাসের প্রথমদিকে ঝিমলি একটা কাণ্ড করে বসে ।
রঞ্জন সেন আর মিনিকে বলে, প্রণাম করব । বলেই পায়ের উপর রাখে মণিপুরি উলের চাদর,
মিনির পায়ে শাড়ি, মণিপুরি মন্দির ডিজাইনের । মিনি রঞ্জন খুব খুশি । মিনির
প্রসন্নতা বেশি । স্বামীকে বলে,
--- মেয়েটি ভাল । সঙ্গে থাকলে মন
ভাল হয়ে যায় । ওকে বলো কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আসতে । কিছুদিন থাকবে আমাদের সঙ্গে ।
কী বলো ?
ঝিমলির চোখে শ্রদ্ধা ছাড়া কিছুই দেখে না মিনি । শোনে না স্বামীর ফোনে কথা
বলার ধারাপাত । ঝিমলি এলে রঞ্জনের অকারণ পুলকিত হওয়ায় সন্দেহের কিছু দেখে না ।
ছোটমামী ঠাট্টার ছলে সাবধান করে দেওয়ায় প্রথম খটকা লাগলেও গায়ে মাখে না । বলে,
--- তোমাদের ভাগ্নেকে চেনো না মামী
। ভোলানাথ মানুষ ।
গল্পের মিনি নিয়ে ঝিমলির অতি উৎসাহে মিনি শংকিত হয় । লুংলে নিবাসী এক অজানা
যুবতিতে মিনি প্রতিস্থাপিত করায়ও খটকা লাগে । বসফরাসে নৌকাবিহারে অন্য মিনির কথা
শোনায় ঝিমলিচোখে সর্বনাশের ইশারা দেখতে পায় বাস্তবের মিনি । ঝিমলি বলে,
--- তুরস্ক দেশটা জানেন বৌদি আমার
খুব প্রিয় । যদিও খৃস্টান মুসলিম ইহুদিরা লড়াইকরেছে অনেক । জানি না বাইজানটাইন ভাল
না ওটোমান ভাল না কামাল আতার্তুক । সব মিলিয়ে তুর্কির ভূগোলটাই ভাল, আনাতোলিয়াও
ভাল । সভ্যতার একটা ক্রস চিহ্ন, জল প্রণালী ঘেরা শহর ইস্তাম্বুল এক আশ্চর্য মিলনভূমি
সভ্যতার । আপনারা ভাগ্যবান এনজয় করেছেন । উনি তো বলেছেন সুখস্মৃতি ।
--- উনি কে ?
মিনি ইচ্ছে করে কঠোর হয়েছে । উচ্ছ্বাসকে থামিয়েছে । ঝিমলি হেসেছে, জবাব দেয়
নি, রঞ্জন সেন এর নাম নেয় নি তাও, স্যার বলেনি । মিনি বলে,
--- সে যাই হোক । তুর্কির গল্পে
কিন্তু আমি নেই ।
--- তিনি বলেছেন আপনি, হুবহু আপনি
। তার লেখায় রোমান্টিকতার গুরু বলেছেন আপনাকে ।
--- তিনি গল্প কারিগর, গল্প কথায়
ভুলিয়েছেন তোমায় । আমি নেই কোথাও । আর আমার গুরুগিরিতেও বিশ্বাস নেই ।
একুশ
উপরোক্ত কথোপকথনের পরদিন ভোরের বিমানে রঞ্জন সেন আর মিনি সেন কাউকে কিছু না
বলে শিলচর ছাড়ে । কলকাতা পোঁছয় সকাল আটটায় । মামীর উৎকণ্ঠিত টেলিফোন যায় সাড়ে
আটটায় । মামী বলে,
--- পোঁছে গেছ ? বেশ করেছে, গুড
ডিসিসন । তা এখন তোমার ভোলানাথ কোথায় ? মোবাইল কানে ? ওটা কেড়ে নাও । তোমার
ছোটমামার মানসম্মান সব যে গেল । যশোময় পাল যা তা বলে বেড়াচ্ছে, গসিপ দিচ্ছে ডেইলি
নিউজে । এডিটার স্মৃতি দাস চৌধুরিকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছে ।
মিনি রাগে না সচরাচর । মিনির হাসিটাই চেনে
সবাই । এবার রাগে মামীর কথায় । ঝিমলিকে মোবাইলে ডাকে । ঝিমলি বলে,
--- আমি কিছু জানি না বৌদি, সব ফলস
।
--- মোবাইল এর কললিস্ট ফলস ? যশোময়
পালের গাড়ির লগবুকও ভুল ?
--- ওসব নর্মাল বৌদি । ঠিক আছে এখন
তো আর কেউ কিছু বলবে না । আপনারা শিলচরের বাইরে ।
--- ভিতরে আসতে কতক্ষণ ?
--- কথা দিচ্ছি দেখা করব না ।
--- টেলিফোন তো এখনও চালিয়ে যাচ্ছ
?
--- নো ম্যাডাম, আমি সিম পাল্টে
ফেলেছি ।
বাইশ
মিথ্যেবাদি মেয়েটি তাও পিছু ছাড়ে না । কলকাতা পর্যন্ত ধাওয়া করে । দক্ষিণ
কলকাতায় বিদ্যা বালন এর হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে । মোগলসরাইএ সন্ধ্যায় দেখা হয়
রঞ্জন সেন এর সঙ্গে । তাজ এর এই আশ্চর্য নেশার প্ল্যাটফর্মে কত ভিন্ন নামের
রেলগাড়ি এসে ঢোকে, ‘জংসন’ ছেড়ে চলেও যায় নেশার ফুয়েল ভরপুর হয়ে । রঞ্জন সেন তাই
কখনও পোষাকি নামে ডাকে না পাঁচতারা মদঘর জংসনকে, বলে মোগলসরাই । তবে এবার জংসনে
এসে পাল্টে যায় ক্রম । রঞ্জন সেন ঝিমলিকে অফার করে ড্রিংকস, মার্টিনি টাকিলার
তকরার হয় না । প্রিমিয়াম ভোদকা আর পেপসির ইকনমি কিক খেয়ে পৌঁছে দেয় ঝিমলিকে তার
আস্তানায় । পরদিন রঞ্জন ঝিমলিকে নিয়ে যায় হলদি নদীর পারে সাততারা রিসর্টে । তৃপ্ত
ঝিমলিও মিনি বৌদির সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যায় নদীরপারের তার কার্যালয়ে, শিলচরে । এবং
অবাক কাণ্ড, ‘চাতলা ধীবরী’ও চলতে চলতে উধাও হয়ে যায় রবিবারের পাতা থেকে । অনিবার্য
কারণের দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই ।
তেইশ
মধ্যবয়সী আহত ব্যাঘ্র রঞ্জন সেনও এবার একা যায় শিলচর । মামার বাড়ি যায় না,
সোজা বড়াইল ভিউ হোটেল । শেখ ইসমাইলের ভাড়া গাড়ি নিয়ে নদীর পারে । যশোময়ের ছাপাখানা
ও কার্যালয় । যশ বড় অর্থকষ্টে আছে । রঞ্জনকে বলে,
--- না গুরু, তুমি রকস্টার, পপুলার
রাইটার । নভেলটাও খুব পপুলার হয়েছে, ইনডিজেনাস ফ্লেভার আছে, আমি কী কালিদাস ? কেন
বন্ধ করব ? নিজের পায়ে কুড়ুল মারব ? অভারঅল তুই আমার ফ্রেণ্ড । উনিশে মের জন্য এক
রবিবার অন্য লিটারেচার বন্ধ থাকে । উনিশের জন্য বিশেষ লেখার জায়গা করতে ধারাবাহিক
বন্ধ রাখতে হয় । তুই তো আর লিখবি না উনিশে মে নিয়ে, তাই অ্যাপ্রোচকরিনি । তোদের তো
একুশ ।
--- বুলশিট । লাস্ট বেঞ্চে বসে বসে
তোর মাথার কাওডাং থেকে কোনো ম্যানিওর ট্র্যান্সফর্মড হয় নি । স্যরি । উনিশে মে
ডিনাই করব আমি ? রঞ্জন সেন ? আমার আজ পর্যন্ত যা লেখালেখি সব ঐ মহান দিনটির জন্যই
। উনিশে না হলে বরাক উপত্যকায় কারো কোনো লেখালেখি হতো না । বন্ধ্যা দেশ হয়ে থাকত
রে । তোর থার্ড রেটেড ডেইলিটাও হতো অসমীয়া ভাষায় । এক উদ্বাস্তু শিবির হয়ে থাকত
আমাদের ভাষা উপত্যকা । আমার আমাদের মুখের ভাষা ফুটিয়েছে উনিশ । আমি কী ভুলিতে পারি
? তুই ওসব বুঝবি না ।
--- ওকে বস । স্যরি, নেক্সট ইয়ারের
জন্য বলা রইল । তবে আজকের পার্টি আজকেই । রঞ্জন সেন এর রিভিজিট সমাচার জানাতে হবে
না শহরবাসীকে ?
চব্বিশ
রঞ্জন সেন বড়াইল ভিউর পার্টিতেই অ্যানাউন্স করে দেয় যশোময়ের কাগজ কিনে
নেওয়ার বিস্ফোরক সমাচার । বলে ডিডরেডি হলেই আবার আসবে । কলকাতা এডিশনের ব্যবস্থা
করতে হবে, তবে শিলচর থেকেই বেরোবে প্রাইম এডিশন । এত বড় দাঁও মারার আনন্দে যশ এর
মুখের হাসিও আর ধরে না । ঝিমলিকেও এত খুশি দেখেনি রঞ্জন । স্কচের নেশা মাথায় চড়লে
যশ রঞ্জনের কাঁধে হাত রাখে । বলে,
--- ঐতিহাসিক মোমেন্টার একটা ছবি
হয়ে যাক দোস্ত । অ্যাই ভবতোষ ।
--- গসিপ করবি কাগজে, তাও ফটো
উঠিয়ে রাখবি ? রঞ্জন সেন এর ছবি এত সস্তা নয়, নো নো ফোটোগ্রাফ । আর তোর ইতিহাসের
পাতায়ও আমি মুতি শালা ।
পঁচিশ
সুখে ছিল মিনি কলকাতায় । ঝিমলি ঝড় কলকাতা পর্যন্ত ধেয়ে আসায় মিনির
ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম সক্রিয় হয় । শখ করে তৈরি করা তাদের ছাদ ঘরেও হয়
দাপাদাপি । শখ করে গড়ে তোলা স্বচ্ছ ফাইবার শিটের ছাউনিঘর । ওদের একান্ত শিবির ।
কাউকে দেখায় না, ডাকে না । যশোময় দুর্বুদ্ধিতে একদিন চলে এলো ওপরে । রঞ্জন তখন
শিলচরে, যশোময়ও ডিল ফাইনাল করতে যাবে পরদিন । মিনি দেখায় যশকে, রঞ্জনের বাল্যবন্ধু
যশোময় পালকে তাদের মদঘর । সেলার খোলে কিছু একটা, একপাত্র গলায় ঢালে যশ পাল । মিনি
না করতে পারে নি অর্থকষ্টে কাতর একদার ব্যারণকে । স্বচ্ছ ঘরের ছাদে শুকনো পাতার
অন্ধকার তখনও দেখতে পায়নি মিনি । কলকাতার কাগজে যে তখন রঞ্জন সেনকে নিয়ে নতুন গসিপ
। মিত্রা পাণ্ডব লুবলুবা মাখতুমার পর সর্বশেষ সংযোজন শিলচরের ঝিমলি দাস চৌধুরী ।
মিনিও দেখিয়ে দেয়, একা ভ্রমণে সে অপটু নয় ।
শিলচরের বিমানবন্দর কুম্ভীরগ্রাম থেকে এসে নিয়ে যায় ছোটমামী । মামা শ্বশুরের
গাড়িতে যায় যশ কাগজের সম্পাদকের চেম্বারে । দুকথা নয় অনেক কথা শুনিয়ে দেয় একদার
প্রিয়ভাজন যুবতিকে । ঠেং ভেঙে দেওয়ার হুমকিও দেয় ছোটমামী । যশোময়কে কিছু বলে নি ।
শুধু বেরিয়ে যাওয়ার আগে সৌজন্যের হ্যালো করেছে । বলেছে ডিলটা কয়েকদিন পিছিয়ে গেল ।
ছাব্বিশ
হ্যালো করলেই যে ঝড় থেমে যায় তা নয় । এবার গসিপে যুক্ত হয় মিনি সেনও ।
সুখের সংসারে ঘর জ্বালানির ইগ্নিশন যে কে দেয়, কোন মেঘের আড়াল থেকে যে যোগান দেয়
ঘরের তথ্য, মিনি বোঝে না । বিভ্রান্ত হয় । প্রেমের গল্পবাড়িতে শুকনো০ পাতা জড়ো হয়,
কেন হয় কে জানে । আগুন লাগলে যে পুড়ে যাবে, ভস্ম হবে, জল পড়লে অন্ধকার গাড় হবে ।
জল কিংবা আগুন কিছুই হয় না, ঝড় ওঠে । ঝড়ে সব আবর্জনা উড়ে যায়, দু এক টুকরো শুকনো
পাতার পিস সূর্যালোক প্রতিহত করে একটা মায়াবী নক্সা এঁকে দেয় রঞ্জন সেন মিনি সেনএর
একান্ত ঘরে । মিহি সূতোয় বোনা লালরঙের কল্কাপাড় মনিপুরি শাড়িতে মিনি গ্রেসফুল হয় ।
আপন মনে হাসে, মনে মনে বলে, থ্যাংক ইউ ঝিমলি । মিনিও রঞ্জনের শিখিয়ে দেওয়া গল্পের
খেলায় মাতে, পায়ের নীচে শাড়ির ফলের দিকে তাকায়, মিনি হাঁটে আর তার পায়ের পাতার উপর
কল্কাগুলিও হাঁটে । হাঁটে, কথা বলে কলকলিয়ে, অভিবাদন জানায় স্মার্টলি কল্পিত
বাস্তবের সঙ্গে যেন অন্য একটা আলো আঁধারির নড়াচড়া দেখে মিনি, শাড়ির গায়ে আকাশের
গাছ পাতাগুলোও জ্যান্ত হয়ে নাচছে ।
ওদিকে খোলা আকাশের নীচে রঞ্জন সেনও তার পানপাত্র সাজায় । উল্টো পাঁচের
কল্কা আর শুকনো পাতার নাচন দেখে মুগ্ধ হয়ে ডাকে মিনিকে । বলে,
--- দাঁড়াও, দাঁড়াও । দেখি আমার
ছেচল্লিশকে । একটা তিল লাগিয়ে তো বলতেই পারি বালাই ষাট । না না বালাই পঞ্চাশ, থেমে
থাকো যেখানো আছো । না, একটু বীররস না হলে আসলি রোমান্টিক হওয়া যায় না ডার্লিং ।
যোশ আসে না, যদিনা বলতে পারি ‘তব কপোলের ঐ ক্ষুদ্র তিল লাগি বোখারা সমরখন্দ দিতে
পারি আমি’ ।
--- তাহলে কেন এত ভয় ? ঝড় তুফান
আগুন ?
--- পার্সোনাল টাচ ডিয়ার । তোমাকে
আবার সেই ঈর্ষাময়ী ষোড়শী গড়তে । প্রেম পঞ্চায়েত উপন্যাস লেখার একটা ডেমোও যে হয়ে
গেল মন্দ না । প্রভূত রসদ যোগাড় করা গেছে কী বলো ?
--- বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখাবে এবার
?
--- বুড়ো আর কোথায় দেখলে ? পনেরো
বছরের গ্রেস আছে না ? তোমাকেও বালাই ষাট বলতে গিয়ে থমকে গেছি । আর বয়স দিয়ে কী হবে
? বয়সটা রাজা নয় ম্যাডাম, মনটাই আসল রাজা । বলোতো, মনটা কোথায় থাকে ? বুকের ভিতর
সুরক্ষিত দুর্গে না রোদ জল ঝড়ে উন্মুক্ত শ্যাম্পু করা চুলের আশ্রয়ে ? তবে মাথাটাও
কিন্তু কম বুদ্ধিমান নয়, প্রেমের কাঁটা সহ্য করে না । নিপুন কেরামতিতে রাস্তা
পরিষ্কার করে । যেমন করেছি যশকে । মাইকেলেঞ্জেলোর শয়তানের মতো গড়েছি, আমিই ভেঙেছি
। কলকাতা থেকে শিলচর গিয়ে এক থার্ডরেটেড ডেইলি কিনব আমি ? রঞ্জন সেন ? ওকে শ্যুট
করা হয়েছে উপন্যাসে, শিলচর রামনগরের মাফিয়ার সুপারিতে ঢিসুম । ব্যাকআউট করার
ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেই এগিয়েছি আমি । আমার জীবনঘর অপবিত্র করার শাস্তি পেতে হবে না
? কাঙাল করে ছেড়ে দিয়েছি লাস্ট বেঞ্চারকে ।
--- বাকি দুজন ?
--- দুজন কৈ ? একজন তো ? ঝিমলি
মেয়েটি ভাল, ওরিজিনেল । আসলে যশের দুর্বুদ্ধির শিকার । তোমাকে শিলচরে দেখে ভয় পেয়ে
গেছে ।
--- তাহলে তো গল্প শেষ । পঞ্চায়েত
কী করে হয় ? চারজন হলো ?
--- পঞ্চজনই চাই ? মনে নেই মিত্রার
কথা । কবিনি মিত্রা পাণ্ডব ?
--- শুনবে কী করে । ওটাই তো অ্যাফেয়ার
।
এই সংলাপটা ভেঙে চুরে যায়, দুম করে যে লোডশেডিং হয় কলকাতায় । যদিও দুজোড়া
ঠোঁটের মুচকি হাসিতে তৎক্ষণাৎ আলোকিত হয় চরাচর ।
সাতাশ
একটি আনকাট সংলাপ
মিনি সেন : রঞ্জন সেন লেখকের
এই জীবন থেকে বড় ইমেজটা কী গ্রাহ্য হবে পাঠক মনে ?
রঞ্জন সেন : রঞ্জন সেন এর সংলাপটা মনে রাখলেই পাঠক খুশ । স্বপ্ন দেখাতে
কার্পণ্য করলে চলবে না ।
>>>>>>><<<<<<
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন