ঠিকুজি বদল




 
      রণবীর পুরকায়স্থ

   
তারা দুই বন্ধু ফজল আলির পিতা আফজল আলি চাষি আর গান্ধি সিং এর পিতা ঁসুদামা সিংও চাষি। সাকিন বাদলিখাল চরগোলা করিমগঞ্জ। ২০০৪ এর ভোটার লিস্টেই শুধু গান্ধির নাম গান্ধি, না হলে সবাই ডাকে পুকা, পোকা ডাকতে ডাকতে পুকা সিং। পুকার বাবা মা দুজনের নামের আগেই চন্দ্রবিন্দু । ফজলু আর পুকার আলাদা বাড়ি, পাশাপাশির বাড়িতে কোন মার্কা নেই, দেখলে মনে হবে একই ভিটে । কিন্তু আছে জরিপের ডিমার্কেশন । ফজলু আর পুকা কেউই পড়াশুনা জানে না, যদিও ফজল আলির বাপ সম্পন্ন চাষি । পুকার সংসারে বাবা মা না থাকায় একটু হাবাগোবা সরলসোজা । ফজলুর দুরন্ত বুদ্ধি । ফজলুর বাড়িতে সব আছে । শাকসব্জি হয়, গরুঘরে গরু আছে তিনটে, ছাগল আছে, হাঁসমুরগি তো আছেই । পুকাদেরও সব ছিল, গরুঘরে একটা গরুও ছিল । ফজলুর বুদ্ধিতে দুই গরুঘর না রেখে একটাতেই চালান করে দেয় বিজুলিকে । বিজুলি তার চান্দকপালি গাইগরুর নাম, মা রেখেছিল আদর করে । ফজলু বলে,
--- ইতা আলেদা রাখিয়া লাভ নাই । আমরার গোয়ালো রাখিদে ।
একদিন বলে,
--- ওই পুকা, গরু ইগু বেচি দে । ভালা দাম পাইবে, হিপারোর খরিদ্দার ।
   হিপার মানে বাংলাদেশ । পুকা ফজলুর কথা অমান্য করে না । গরু বিক্রির টাকা দিয়ে শন কেনে, চৌচালা ঘরে একছানি দেয় । মনের ভিতর একটা খুশিও দৌড়াদৌড়ি করে । এবার বিয়েশাদিটাও সেরে নিলে মন্দ হয় না । যেমন ভাবনা তেমন কাজ, চরগোলা বাজার থেকে একমচা খুরমা নিয়ে যায় শ্রীদাম মামার বাড়ি শ্রীগৌরী । দূর সম্পর্কের মামা ঘরকামলা । হাবাগোবা হলে কী হয় পুকার জ্ঞানের নাড়ী টনটনে, জানে বিয়ে করতে একজন আভিবাবক চাই, মুরব্বি না হলে হবে না বিয়ে । মামারও বিয়ের যোগ্য মেয়ে দুটো । তাদেরও পাত্র চাই, পুকা বলে দেখবে । যদিও তার বিয়ের ব্যাপারে মামা হ্যাঁ না কিছুই করে নি । পুকা কিন্তু মনে মনে খুশিই হয় । সে জানে মামা কিছু একটা করবে, কথায় আছে আশায় বাঁচে চাষা ।
    শ্রীগৌরী থেকে ফেরার পর ফজলু তাকে ব্যবসার প্রস্তাব দেয় । বলে দুজনে মিলে করবে গরুর ব্যবসা । ছোটবেলা থেকে পুকা ফজলুর ছায়ায় বড় হয়েছে, কোন কথায় না করতে পারে না । দুজন মিলে লেগে যায় সাংঘাতিক এক ব্যবসায় । যদিও ফজল আলি কিংবা পুকা সিং কে দেখলে বুঝার উপায় নেই যে এতবড় ব্যবসাপত্র কী করে চালায় দুজনে । ফজলের হাতেই থাকে লাগাম, লাভের গুড় খায় সে একা । পুকার তেমন লোভ নেইসে তার কাজ করে যায় বন্ধুর নির্দেশ মতো । গ্রাম বাদলিখাল আর কুশিয়ারা নদীর মাঝখানে এক উঁচু জমি যার নাম বাজারটিল্লা । টিল্লার উপর বসে থাকা তার কাজ । রাত দশটা থেকে শুরু হয় পাচারের তোড়জোড়রোজদিনের ব্যাবসা নয়, সপ্তাহে দুদিন কী তিনদিন, আশেপাশের গ্রামগুলির হাটবারে । হাট মানে গরুর বাজার । শনি মঙ্গল বারের বাজারই বড় । ছোটখাটো বাজার নিয়ে মাথা ঘামায় না ফজলু । বাজারটিল্লার নীচে হেমন্তির সময় জল কমে থাকে কুশিয়ারায়, চরও পড়ে । হেঁটে পারাপার করা যায় ওপার বাংলাদেশ । সরকারি সীমান্ত নয় তাই পুলিশ প্রহরাও তেমন নেই । অবাধে গরু পাচার করে ফজলু । আর পুকা সিং গোনার কাজ করে টর্চ জ্বালিয়ে । পুকার এই এক আশ্চর্য প্রতিভা । গরুর মালিকের মুখে টর্চ মারলেই জানা হয়ে যায় তার শারীরিক গঠন আর চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ, গরুর মুখে আলো ফেলে জেনে নেয় পশুর জাত । দেখতে কেমন,  চান্দকপালি না চিতরাপাখরা না কালো কিংবা সাদা । গরুর বয়সেরও একটা ধারণা আছে স্পষ্ট, দাঁত না দেখেই বলে দিতে পারে উমর বাজারটিল্লা পর্যন্তই গরুর মালিকের অধিকার, ওখান থেকেই ফিরে যাবে ফজলুর কাছে, টাকা নিয়ে বাড়ি । ফজলু এই কাজ করার আগে স্থলসীমান্তের গরুপাচার দেখে এসেছে, সোনাতুল লামাগাও উলাকান্দি লাতু ও কামারাইলএ । তবে ওসব এলাকায় অনেক দেওয়া থোওয়ার ব্যাপার আছে । পুলিশ বিএসএফ আসাম রাইফেল, ওপারেও দফায় দফায় দেয় দালাল । পুকার কাজ গোনাগুনতি ঠিক রাখা । এপারের মাল ওপারে পৌঁছে গেলে সংকেতের হাতনাড়া দিয়ে কাটাকুটি হয় তার হিসাব । ওপারের বুড়ো লোকটি আলো দেখালেই বন্ধ হয় টিলার দোকান
   আসলে বাদখিলাল নামে গ্রাম হলেও গ্রাম নয় । জনপদ বলতে যা বুঝায় তা হয়তো ছিল এককালে, এখন টিকে আছে মাত্র দুইবাড়িতে । সংস্কারের অভাবে পুকার ভিটে ফজলুর বাড়ির পরিত্যক্ত বিচরাঘরের মতো মনে হয় । দুই বন্ধুর একবাড়ির নামই গ্রাম বাদলিখালভাঙনে গ্রামটি চলে গেছে কুশিয়ারার গর্ভে । ফজলুর বাড়িতে টিনের চাল আর তারসিমেন্টের দেয়াল, সম্পন্ন চাষি পরিবারে যেমন হয় । মা বাবা বৌ বাচ্চার ভরভরন্ত সংসার । গরুছাগল হাঁসমুরগি । ফজলুর বিয়ে হতেই তো পুকা ঘরের চালে শন লাগায়, তার মনেও একটা বাসনা জাগে বিয়ের । ফজলুও পুকার বিয়ে নিয়ে হাসি তামাসা করে, বলে,
--- তুইন বিয়া কর । খাটপালং দিমুনে । যদি কছ ... না থাউক গুসা করি লাইবে ।
   পুকা হাবাগোবা মানুষ । ফজলুর হাসি তামাসা বুঝে না । বলে,
--- আর খাটপালং !  নদী যেলা সব নিছে, অখন আমরার বাড়ি নিলে থাকমু কই বউ নিয়া । তোর তো নায় চরগোলার জমিন আছে ।
ফজলু জানে নদীর অধিকার । যতটুকু নেওয়ার নিয়েছে, আর নেবে না । বাজারটিল্লার বাঁধ আছে না সামনে । তাই মাঝে মধ্যে টোপ দেয় বাল্যবন্ধুকে । বলে,
--- তর যদি বেটা অত ডর, তে বেচিলা আমার কাছে । গেলে আমার জমিন যাইব পানিত ।
এদিকে আবার হিসেব টনটনে । মাবাপের ভিটে ছাড়বে না সে, ছাড়বে না ফজলুর সঙ্গও । রাতরাখালি করে তো কিছু পয়সা পায় । ফজল আলি দুশো টাকা দেয় মাসে মাসে । উপরিও দেয় । সারাদিন ফজলুর বাড়ির গরুরাখালি করে করেও আলাদা পায় । দেয় ফজলুর বাপ ।
 মাঝেমাঝে জাল নিয়ে নেমে যায় নদীর জলে । ফজলুর মা কাকির জন্য মাছ মেরে আনে পুকা । টর্চ দিয়ে কাটাকুটির হিসেব শেষ হলে, নদী শান্ত হলেই শুরু হয় তার জাল ফেলার কাজ । পুকা তখন আধো অন্ধকারে দেখে নদীর পারে শর্ষেখেতের হলুদ, লাইমূলোর চারাগাছের সবুজ, শিম উরি আর  কুমড়োর মাচান, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা তার সাম্রাজ্য দেখে মনে মনে গর্বিত হয় । এসবই তো তার হাতে সাজানো । যদিও সব ফসলই যায় ফজলুর বাড়ি । যাক, সেও তো ভাগ পায়, কাকি দেয় । নদীর জলে সহসা সপসপাৎ শব্দ শুনে সচকিত হয় পুকা । বেশ দূর থেকে শব্দ আসছে । যতই নিকটবর্তী হচ্ছে শব্দের তীব্রতা বাড়ছে । নদীর জলেও তোলপাড় হচ্ছে । অস্বাভাবিক কুইরমস্তলি দেখে তার সন্দেহ হয়, আশঙ্কাও হয় । এ আবার কোন জলজন্তু, হু নাকি । বাপ বলত উদলকুতকুত । চুনা চালকুমড়োর মতো দেখতে, মাঝের ডাঁটা একটু তীক্ষ্ণ ও দীর্ঘ । ভাল নাম নাকি শুশুক । হু তো নদীর মাঝখানে থাকে, এমন পারের কাছে হুলস্থূল কেন । জলের সঙ্গে পুকার এক অবাক সম্পর্ক, জল অশান্ত হলে তার মনও অশান্ত হয় । সশঙ্ক চিত্তে সে নেমে যায় নীচে । ও হরি, একটা ডেকা, বছর দুয়েকের দামাগরু ছপছপাৎ করে পারে উঠতে চাইছে, পারছে না । পুকা হিসেব মেলায় কোন ভুল হোল না তো তার । কোন দামাগরু ছিল না আজকের চালানে ।  পুকা জলে নেমে বাচ্চা গরুটিকে ওঠায় । তাহলে কী ওপার দেশ থেকে ভেসে এল কারো বাড়ির । তাই হবে, এপারের হলে তো এতক্ষণে তোলপাড় হয়ে যেত । ফজলুকেই ধরত সবাই, চালান দিয়েছে বলে চিৎকার শুরু হয়ে যেত । ফজলু এসব করে না । ঠিকঠাক দাম দিয়ে কেনে গরু ।  চোরের গরুও কেনে । বলে এতে তার কী দোষ, চোর না সাউকাড় চিনবে কী করে
  পুকার হাতে সবসময় পাটদড়ি আর ছোট খুঁটি একটা থাকে ।অবাধ্য গরুকে শায়েস্তা করতে দরকার । ভিজে সপসপ বাচ্চাটিকে কোলে উঠিয়ে নেয়, এত ছোট ডেকাগরুকে পুকা দড়ি পরায় না । ঠেং দিয়ে মারার মতো শক্তি নেই শিশু গোশাবকের । তবু একবার নামিয়ে নেয় মাটিতে, বলে থিরির । না, শব্দ করা ঠিক হবে না তাই আবার কোলেই নেয় । বাড়ির উঠোনে নামিয়ে ফজলুর দরজায় আলতো টোকা দেয় । হাঁপাতে হাঁপাতে বন্ধুকে জানায় সমাচারফজলু তাকে ধমকায় বলে,
--- চুপ চুপ হারামজাদা । চুপ যা গরুঘরো বান্দি রাখি দে, ঘাসঘুস দে একটুকরি । কাইল লইয়া যাইছ দূরোর বন্দো । কুনুবেটার অইলে অতখনে ধাক্কাধাক্কি আরম্ভ অই গেল নে । দামা ইগু হিপার থাকিউ আইছে । কিন্তু একলা কেমনে আইল বে ?
পুকা চুপ করে যায় ফজলুর সন্দেহটা অমূলক নয় । বন্ধু হলেও ফজলু তার প্রভু, মালিকের কথা অমান্য করা যায় না । বেঁধে রাখে গোয়ালঘরে । ফজলুর সঙ্গে সে বেইমানি করবে না । নইলে, তারও একবার ইচ্ছে হয়েছিল নিজের গরুঘরে বেঁধে রাখে । কতকাল থেকে গোয়াল শূন্য । বাবা মা চলে গেল আর সেও ফজলুর ছায়ায় মিশে গেল । ফজলুর মা তাকে খেতে দেয় দুবেলা।তার জন্য আলাদা থালা আছে কলাই করা। ফজলুর মা কাকি ছোঁয় না, আলাদা থেকে দেয় । গোস্ত ফোস্ত হলে ওকে বলে নেয়, মানে বড়টা । মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করে কিন্তু খায় না পুকা । দামাটার জন্য মন কেমন করে পুকার, বড় নধর, মায়াময় ।

  ফজলুকে সব কথা বলে নি পুকা । রাতে আর এক অতিথিও এসেছিল জলে ভেসে দামাগরুর সঙ্গে । ফজলুর সন্দেহটা অমূলক ছিল না, গরুর বাচ্চাটি একা আসে নি, নিয়ে এসেছিল এক মানুষশিশুবছর বারোর কালো রঙের ছেলে । আসলে জলের মধ্যে ছেলেটির গিসগাস শুনেই তো সে জলে নামে । ছেলেটিই গরুর বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে দূর থেকে, খাঁড়াই পারে আর কিছুতেই ওঠাতে পারে নি । শিশু গরুটির কিছু হয়নি কিন্তু অনেকক্ষণ জলে থাকায় মানুষের বাচ্চাটি নেতিয়ে পড়েছে । ওদের দুজনকে পারে উঠিয়ে প্রথমে ছেলেটিকে নিয়ে যায় ঘরে, তার বিছানায় কাঁথাচাপা দিয়ে দৌড়ে ফিরেছে আবার  গরুর বাচ্চা আনতে । ফজলুর কথায় ধরা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই সে আরো বেশি করে হাবাগোবা সাজে ।
  অন্ধকারে ছেলেটির মুখ ভাল করে দেখা হয়নি, তবু কালো রঙে একটা মিষ্টি মুখের আভা দেখে তার পছন্দ হয়ে যায় । নিষ্পাপ নধর মুখটি বড় ভাল লাগে পুকার । ফজলু তো জানে সে এক বোকা হাবাগোবা বাউন্ডুলে, বাড়িতে যে একটি জলজ্যান্ত মানব শিশুকে লুকিয়ে রেখেছে বুঝতে তো দেয় নি । এর জন্যেও পুকার খুব খুশি । ফজলু চলে যাওয়ার পর সে কাকিকে ডেকে ওঠায় । খাবার নিয়ে সে তার ঘরে চলে যায় । কুপি জ্বেলে ছেলেটিকে দেখে, দেখে তার কাতর ক্ষুধার্ত মুখ । মুরগির ঝোল এক মুঠো মেখে ডাকে কানে কানে,
--- এই উঠ ।
 ওঠে না ছেলে । নিদাল ঘুমে । কাঁথা সরিয়ে দেয় গা থেকে । ডাকে আবার,
--- ওই !
 চোখ মেলে তাকায়,দামাগরুর মতো অসহায় দুটি চোখ কিছু খোঁজে ।আবার নেতিয়ে পড়ে ঘুম চোখে । এর মধ্যে গোয়াল থেকে ডাক শোনা যায়, হাম্বা । এবার মন্ত্রের মতো কাজ হয়, বাচ্চাটি বাঁশের মাচান থেকে মচমচিয়ে নামে । পুকা তার সামনে ভাতের মুঠো ধরে । বলে,
 --- তুই কে বে ? খাছ না কেনে ?
 সে অবাক দৃষ্টিতে পুকাকে দেখে আর শোনে হাম্বা । হাম্বা হাম্বা । বাচ্চাটি বলে,
--- গিয়াস গিয়াস ।
  বলতে বলতে হাম্বা ডাকের উৎসে চলে যায় ।গরুর বাচ্চাটিকে আদর করে, খেতে দেয় দুমুঠো ঘাস । পুকাকেও গোয়াল ঘরে দেখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়বলে,
--- গিয়াস ।
--- ঠিক আছে ঠিক আছে, বুজছি তাইন গিয়াস ।  গিয়াসউদ্দিন । অখন চলইন আমার তো খানি লাগব ।
পুকা ছেলেটিকে পেয়ে তার ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে যায় । সব ভাত মাংস খাইয়ে দেয় ওকে ।

 সকালে গরু নিয়ে মাঠে যাওয়ার আগে ফজলুর কাছ থেকে অনুমোদন নেয় পুকাবলে,
--- গিয়াসরে লইয়া যাইতাম নি মাঠো ? কিতা কছ ?
--- ওই হালার হালা, গিয়াস কিগু বে ?
--- গিয়াস আরি । ডেকা গরু তো, বেটা নাম অউ ভালা । আমি দিলাইছি নাম গিয়াস ।
--- মাইর খাওয়াইতে নি ? গরু বাইচ্চার নাম রাখছি গিয়াস হুনলে মৌলবীয়ে মারি ফালাইবা । ইতা না বে । দুসরা কুন্তা রাখ । ইগুর রং তো কালা, রং দিয়া কিচ্ছু রাখি দে
--- তর হক্কলতাত কিকড়িমিকড়ি, গিয়াস তর পছন্দ অইল না । অখন আমি কই নাম খুজি । চল বা গিয়াস তর নাম খুজি গিয়া মাঠো ।
 বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে ছেলেটিকে বের করে নিয়ে যায় সঙ্গে করে । রণেমরার টিলা অনেকদূরে, নদীর পারে পারে পাইজন হাতে যেতে যেতে কী মনে হওয়ায় ছেলেটিকে কাঁধে তুলে নেয় । গরু চারটিকে ছেড়ে দিয়ে ওরা দুজন টিলার উপর গাছের ছায়ায় বসে । পুকা ওর সঙ্গে কথা বলে, নদীর গ্রাম সাবাড় করার কথা বলে । আফজল কাকা আর তার বাপ সুদামা সিং এর বন্ধুত্বের কথা বলে । বলে তার আর ফজল আলির দোস্তি কথা । বলে ফজলু যে তাকে রেখে বিয়ে করে ফেলল সেই দুঃখের কথা । বলে,
--- ইবার দেখিস আমি বিয়া করমু । তোর লাখান একটা পুয়া অইব আমার ।
   পুকা কথা বলে মনের আনন্দে । একবারও ভাবে না ছেলেটির কথা, ওর কথাও তো তার শোনা দরকার । আসলে পুকার তো কেউ নেই, সারাদিন একা একা কাটে থিথি হেই করে । আর তো কোন কথা নেই । ফজলুর মা কাকি কথা বললে সে জবাব দেয় না, মাথা নুইয়ে থাকে । কাকিকে দেখলে পুকার মনে বড় কষ্ট হয়, মার কথা মনে পড়ে । কাকি তাকে মায়া করে । নিজের কথা বলে বলে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যেতেই তার খেয়াল হয় বাচ্চাটির কিছু খাওয়া হয় নি । সে ছেলেটিকে বলে,
--- দেখিছ, গাই দুইটা আর দামা একটা আগর, আর তোর গিয়াস ।
ছেলেটি কী বুঝে কে জানে । খুব খুশি হয় । বলে,
--- গিস গিস ।
কাল রাতে পুকা যা শুনেছিল এখন যেন শোনে অন্যরকম । গিয়াস থেকে গিস । সে তো ছেলেটির দুটো কথাই শুনেছে । তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে তারাগুল ইস্কুলের সামনে চায়ের দোকান থেকে একটা পাউরুটি আর দুটো কলা কেনে ছটাকা দিয়ে।ছেলেটি ওকে ফিরে আসতে দেখে আবার খুশি হয় । পুকা পাউরুটি খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয় দুটুকরো । ছেলেটি কিন্তু এবার পুকাকে অবাক করে তার বাড়ানো হাতটা ঘুরিয়ে দেয় । ওর মুখের দিকে ইশারা করে খেতে বলে । পুকার অভুক্ত শুকনো মুখ, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আনন্দে । বাধা দেয় না, খায় দুটুকরো । ছেলেটিও খায় । কলা দিয়ে দুপুরের খাওয়া হয়ে যায় দুজনের । পুকার যেন একটু বেশিই হয়, মা যাওয়ার পর কেউ মুখের উপর বাড়িয়ে দিল খাবার । সে অবাক হয়ে ভাবে একরত্তি ছেলেটি কী করে বুঝতে পারল যে সে অভুক্ত আছে । আসলে ভুল হয়েছে তারই, সে সকালে যখন বেরোয় কাকি একথালা পান্তাভাত খাইয়ে দেয় । আজ তার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় উত্তেজনায়।যদি ধরা পড়ে যায়, বাচ্চা ছোকরাটিকে নিয়ে কি করবে তবে । গতরাতেও তো খায় নি কিছু । ছেলেটি কী তার পূর্বজন্মের কোন আত্মীয়, তার ভাই না সন্তান । চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায় । গাছতলায় বসে সে ছেলেটিকে কোলে তোলে নেয় । বলে,
--- ওই বেটা, তোর নাম কিতা কইলে না?অতখন থাকি বকিয়া মরিয়ার কিচ্ছু মাতছ না কেনেবে ? বোবা নি তুই ? নাম ক ?
ছেলেটি এবারও একই শব্দে জবাব দেয়,
--- গিস গিস ।
ও । তাহলে সে গিয়াস বলে নি । অন্যনাম, গিস । তার নাম কী । পুকা শুনতে ভুল করেছে । কিন্তু গিস আবার কোন দেশের নাম । ওপারে তো সব মুসলমান । গিয়াস ছাড়া কী হতে পারে । সে আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়ে । বলে,
--- আইচ্ছা, যা তোর গিস হারি গেছে, ডাকিয়া আন ।
সত্যিই কালোরঙের ডেকাগরুকে কিছুক্ষণ থেকেই খুঁজে পাচ্ছে না পুকা । দুটো গাইগরু আর এক ডেকা এই তো ছিল ফজল আলির গরুঘরের জন্তু, এবার দুই গাই দুই ডেকা । এর মধ্যেই হারিয়ে গেল কী করে । পুকা এদিক ওদিক খুঁজে হয়রান হয়ে আবার বাচ্চা ছেলেটিকে ডাকে । বলে,
--- কই গেলে বে ? ডাক চাইন তোর গিস রে, ডাকিয়া আন দেখি । যা ।
  ছেলেটি আনন্দে টিলা থেকে নেমে যায় গিসগিস করতে করতে । আরও নামতেই অবাক কাণ্ড । পেয়েও যায় হারানো ধন । দুজন গলাগলি করে বাকি চারটি প্রাণীর সঙ্গে মিলিত হয় । আর ক্রমাগত গিস শব্দে আনন্দিত হয় গোচারণ প্রান্তর । পুকা সিংএর মনেও তখন বিদ্যুৎচমক খেলে যায় । আরে, এই ডেকাগরুটি তবে হিন্দু বাড়ির, ছেলেটিও কী তবে হিন্দু ।গিস মানে গিয়াস নয়, গিরিশ হতে পারে । যাক গরুর নাম হয়ে গেল আর ফজলুর সঙ্গে খেচরমেচর করতে হবে না । কালো দামাকে গিরিশই ডাকবে ।

   তবে হাবাগোবা মানুষ পুকা সিং বেশিক্ষণ কোন কথাই চেপে রাখতে পারে না । বাচ্চা ছোকরা সহ ফিরে এসে ফজলুকে বলে দেয় ডেকাগরুর নতুন নাম । বলে,
--- যা, বদলাই দিছি নাম । অখন ইগুর নাম গিরিশ ।
--- গিরিশ আবার কিতা নাম ।
--- আর অগু আমার পিসাত্ত ভাই । লাতু থাকি আইছে । থাকব ।
--- থাকব ? কই থাকব ? খাইব কিতা ?
--- তুই কাম দিবে । সব কাম করব ।
--- কিওর সব কাম ? আমি কই থাকি দিতাম ? এক বেভুতারে রাখিয়াউ পস্তাইয়ার । কাম উম নাই,  যা ভাগআর আমার কাম ইতা পুয়া দিয়া অইত নায় । বিশ্বাসী কুনুগু পাইলে আনিছ তোর লাখান আউয়াচাড়াল । ইগুরে পাঠাইদে লাতু না কই থাকি আনচছ ।
   কিন্তু একরাতেই ফজল আলির মত পাল্টে যায় । তবে শর্ত দেয় দুটো । এক, কাজ দেখে বেতন আর দুই, নিজের রান্না নিজে করতে হবে । পুকা এককথায় রাজি, কারণ সে জানে তার মমতাময়ী কাকিকে ।সে পটিয়ে নেবে মুখ ভার করে থেকে । মা বাপ মরা পুকার দুঃখে কাকি রাজি হয়ে যাবে । বোবা ছেলের আহারের ব্যবস্থা করে দেবে ।
   ফজল আলির মতবদলের কারণও এক । যখন জানে ছেলেটি বোবা, কথা বলতে পারে না কানেও  শোনে না, তখনই সে ঠিক করে নেয় একে দিয়েই হবে তার কাজ ।
 পুকাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, কারণ সে তো টিলার উপর একতরফা কথা বলে গেছে, একটাও জবাব দেয়নি ছোকরা । রাতের খাবার নিয়ে এসে ডেকে সাড়া পায় নি । ভেবেছে বাচ্চা ছেলে ঘুমিয়ে আছে । গায়ে হাত দিতেই ফিরে তাকিয়েছে ।কিন্তু ডেকাগরুর হাম্বা ডাক শুনে কী করে বেরিয় গেল । হয়তো তাও নয়, সে গায়ে হাত দিতেই তো ঘুম ভেঙে গেল । ঘুমের ঘোরে তার মাথায় তখন কালো রঙের দামা গরু তাই ছুটে বেরিয়ে যায় । এর মধ্যেই ফজলু তাকে এক বেয়াড়া প্রশ্ন করে । বলে,
--- তোর ভাই ইগুর নাম কিতা কইলে ?
পুকা তখন মুচকি হাসে । বলে,
--- ক খানি দিবে ?
--- নামর লগে খানির কিতাবে আড়ুয়া ?
--- খানি দিলে তার নাম গিয়াস ।
--- আর না দিলে ?
--- তে আর কিতা আমার ভাই গিরিশ ।
--- ও হালার হালা । গরুর দালালি করিয়া তো বুদ্ধি হইছে বাক্কা । খালি মাগনা খাইতে । মাইর লগে মাত ।
পেট কাপড়ে শিশুশ্রমিক নিয়োগ করেই হাসে ফজল আলি । সরল সোজা পুকা সিং ভাবে বোবা ছোকরার নাম রাখতে হবে গিয়াস, দামা গরুর নাম তো রেখেই দিয়েছে গিরিশ ।


 এরপরের সাতবছরে সবার বয়স বাড়ে সাত বছর । ততদিনে বাদলিখাল গরুপাচারের মানচিত্রে বিখ্যাত নাম । ফজল আলিও সেই সুবাদে নামী মানুষ হিসেবে গণ্য হয় চরগোলা এলাকায় । পুকা সিংএরও বিয়ের দুঃখ যায় নি, যদিও কালোরঙের নধর যুবকটির অভিভাবক হয়ে সে বিয়ে না করার দুঃখ অনেকটাই  ভুলেছে।  যুবকটির চালঢাল চলন সবই যে হিন্দু বাড়ির মতো । ঠাকুর দেখলে নম করে, তবু সে বন্ধুকে যেহেতু কথা দিয়েছে তাই ডাকে গিয়াস । বোবা ছেলের তাতে কিছু যায় আসে না । পুকার কিন্তু অবাক লাগে তার এই গিস গিস শব্দ নিয়ে শব্দটা সে শিখল কী করে । সব কিছুতেই গিস, আনন্দেও গিস দুঃখেও গিস খিদে পেলেও গিস । গিস কথার কী জানি কী মানে ।
  এরমধ্যেই একদিন ভোটার লিস্টে নাম উঠাতে এল বিডিও অফিসের বসিরউদ্দিন । সবার নামধাম ঠিকঠাক দেখে নিয়ে পুকা সিংএর নাম মিলিয়ে বলে বাবা মার নাম কাটাতে হবে । আর তখনই কালো ছেলে গিয়াস গরু কটাকে নিয়ে যাচ্ছিল নদীতে, হাতে ধরা সেই নধর নয়বছরের ডেকা গরু গিরিশ । বসির মিয়া নতুন মানুষ দেখে প্রশ্ন করে,
--- ইগু কিগু ? আগে তো দেখছি না ফজল ভাই ?
পুকা সিং ত্বরিতে জবাব দেয় ।
--- দেখছইন না তে দেখিলাইন । হে গিয়াস, গিয়াস আলি । নাম উঠাইলাইন ।
বসির মিয়া ফজল আলির দিকে তাকায় । ফজলু সম্মতির ইশারা করায় লিখে নেয় নাম ।নাম গিয়াস আলি পিতা আফজল আলি বয়স কুড়ি ।


  পরের পাঁচ বছরেও বয়স বাড়ে আরো পাঁচ । গিয়াস গিরিশ আসার পর পুকা সিং এর বয়স বাড়ে বারো বছর । পুরো এক যুগ । বিয়ের বয়স তার শেষ । তবু এরমধ্যেই একদিন শ্রীগৌরীর শ্রীদাম মামার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কানিবাজার পোষ্টাপিসের সামনে । রথের মেলায় গিয়াসকে নিয়ে বেরিয়েছিল পুকা । নতুন দা কড়াই তসলা কেনার জন্য । ফজলুর মা কাকি চলে যাওয়ার পর তাদের খাওয়ার বড় কষ্ট হচ্ছে । ফজলুর বৌ কখনও দেয় কখনও না । এতে বড় অসম্মান হয় সরল সোজা পুকার । তাই ফাজলুর সামনে মাথা নুইয়ে থাকে । বলে,
--- আমরা অখন রান্দিয়া খাইমু ।
--- তেউ ? খাইবে ।
--- না, মেলা থাকি বাসন বর্তন কিনতাম ।
--- কিনবে ।
--- টেকা লাগব নানি । টেকা দে ।
   ফজলু দোনামনা করে দিয়েছিল টাকা বেতন থেকে কেটে নেওয়ার শর্তে । ঘরকামলা মামা মেলায় বাঁশের খলুই টুকরির দোকান দিয়েছে । অনেকদিন পর ভাগ্নেকে দেখে খুশি হয় । বলে,
--- ভালা আচছ নি ভাইগ্না ? বিয়া উয়া করচছ নি ?
--- না, কে দেওয়াইত বিয়া । তুমি তো পুড়িন্তর বিয়া দেওয়ার চিন্তাত থাকলায় ।
--- অয় দিলাইছি বিয়া । তর লগে ইগু কে বে ?
--- আমার ভাই ।
--- তোর আবার কুন ভাই ?
--- ই লাতুত বাড়ি । চিনতায় নায় ।
মামা ভাগ্নে কথোপকথনের মাঝখানেই গিয়াস আবার শুরু করে গিস গিস । এবার মামা নিশ্চিন্ত হয় ।
--- তুই আমারে কেনে লুকাছ । অউত্ত গিস গিস করের । ইগু তো আব্রা । মাতত পারে না । ইগুর নাম সুশীল, পরিমলদার পুয়া । আমরার উতরর ভিটাত বাড়ি । তুই চিনছ, তর মার লগে যখন আইচছ দেখচছ তার মা বাপরে ।
--- ঠিক নি ? তারা আছইন নি ?
--- থাকতা না কেনে ?
পুকা তখন মামাকে গিয়াস তথা সুশীল প্রাপ্তির সব সমাচার জানায় অকপটে । বলে,
--- আমি কেমনে জানতাম কও হে হিপারর নায় । হেনু গিস গিস করে খালি । তে বুঝছি হে যে বাঙাল নায় ।
--- কেমনে বুঝলে ?
--- বুঝছি । আরো বুঝছি তার দেবদ্বিজে ভক্তি দেখিয়া । কিন্তু কপাল দেখ, খানির লাগি গিয়াস বানাই দিলাম তারে ।
--- বাদ দেও । যেতা অইছে অই গেছে অখন চল তার মা বাপরে দিয়া আই পুত ।


   মাকে দেখে গিয়াসের চোখ দিয়ে জল পড়ে ধীরে ধীরে, যেন কোন যুগের থেকে জলধারা শুকিয়েছিল এখন অতিধীরে দ্রবীভূত হচ্চে । যুবক সুশীলের চোখ থেকে এর পর এক অস্বাভাবিক জ্যোতি বেরোয়, মনে হয় যেন এক চমৎকার কিছু ঘটবে । এখনই আনন্দে মা বলে ডেকে উঠবে তার জননীকে । তেমন কিছুই হয় না । সে তো একটি মাত্র স্বরেই প্রকাশ করতে পারে তার আনন্দ দুঃখ সবরকম হৃদয়াবেগসে যে মাকে দেখে গিস করতেও ভুলে গেছে, তার মায়ের অবস্থাও তথৈবচ, মা পুত্রকে কোলে নিয়ে বসে থাকে । বসেই থাকে বারো বছরের সঞ্চিত অশ্রুর অনিঃশেষ ধারায় । বাদলিখালের গিয়াসের হাবাগোবা অভিবাবকই অবস্থার সামালদেয় বুকচাপা দুখেবলে,
--- ইগুরে অখন ছাড়গো মামী । আমিও তোমার ভাইগ্না । পুয়ারে অতদিন দেখিয়া রাখলাম, খাওয়াইলাম । অখন তারে কেমনে ছাড়িয়া যাইতাম কও ?
  গিয়াসের মা পুকাকেও মাথায় হাত দিয়ে আদর করে । গিয়াসের আরো দুই ভাই আছে বাড়িতে, একভাই ছোট, একটা বড়, বোন দুটোরও বিয়ে হয়েছে একই গ্রামে।তারাও আসে কাঁদতে কাঁদতে আনন্দেপুনর্মিলনে যখন সবাই বিভোর তখন মনের দুঃখ মনে নিয়ে পুকা একাএকা বাড়ির পথে হাঁটা ধরে । অনেক রাত হয়ে যাবে তার বাড়ি ফিরতে ।
   পুকা আবার একা হয়ে যায় । বারো বছর কাটিয়ে দিল জীবনের এক আব্রা ছেলের অভিভাবকত্ব করে । মনেও হয়নি খুব বিয়েশাদির কথা । না, এবার আর মানবে না, মামার হাতে পায়ে ধরে একটা বিয়ের কথা পাকা করবেই করবে । ফজল আলিকে বলবে বেতন বাড়িয়ে দিতেনা হলে সে অন্য কাজ করবে । ঘরকামলার কাজ শিখে নেবে মামার যোগালি খেটে । মামার হাতের কাজ খুব নিপুন । মামার কথা মনে করতেই মামা এসে উপস্থিত । সঙ্গের মানুষটিকে দেখে আবার তার বিষণ্ণ মনটা খুশিতে ঝলমল করে ওঠে । গিয়াসকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে মামা । মামার কথা শুনে খুশি হয়েও মনটা তার বিষিয়ে যায় । মামা বলে,
--- থাকউক বেটা হে তর কাছে । মাসে এক আধবার যাইব নে বাড়িত ইখানো তো কামকাজ করের কইলে ?  তার বাপমারেও কিছু দিছ শদুইশো । কিতা কছ ?   
পুকা গিয়াসকে কাছে টেনে নেয়, বলে,
---হুঁ ।
মামা চলে যায় ।


গিয়াসের নামে আসে নোটিশ । সীমান্ত পুলিশ থেকে বলা হয় সন্দেহজনক । পুকা সিং বলে,
--- সন্দেহ অইছে তো অইছে আমার গিয়াস ভোট দিত নায় । চুকি গেল ল্যাঠা । 
ফজল আলি বলে,
--- না রে বেটা, অতো সুজা নায় । আমারে ফাসাই দিচছ তুইন আমার এমনেউ কত বদনাম । অখন আমার বাড়িত নি ডি ভোটার ? 
--- তে কিতা অইব বে ? 
--- ইগুরে  পুলিশে ধরিয়া নিব । হিপারো খেদাই দিব ।
--- হে কুনু হিপারোর নি । হে তো শ্রীগৌরীর । আমার মামার পরিবাড়ির পুয়া । 
--- তে তো অইছে বালা, দিয়া আয় যার পুয়া তারে ।
--- কছ নি ?
পুকা ফজলুর উপদেশ যথার্থ মনে করে ।


   পুকা সিং আবার যায় গিয়াসকে নিয়ে শ্রীগৌরী মামার পড়শি বাড়িতে গিয়ে বোবা ছেলে আর ডি ভোটার নোটিশ সমঝে দেয় । বলে,
--- তুমরার পুয়া । আর নেও অউ নুটিশ । অখন প্রমাণ কর হে তুমরার পুয়া । তুমরার নামো তো লুটিশ উটিশ নাই ?
--- না নাই ? কিতা যে মাতো । আমরারও কুনু ডেটা নাই । এনআরছি না অইলে কইছে খেদাই দিব । কই যাইতাম কও । অখন এক আতান্তর থাকি আরএক আতান্তর । ইগুরে লইয়া অখন কিতা করতাম । হে নাই ভাবি লাইছি, অখন ঠাউকরে মিলাই দিলেও রাখতাম পারতাম নায়। হে নাই মানি লাইছলাম, নাই অউ থাকঅউক । তুমি তারে লই যাও রেবা ।
--- বাক্কাউতো দেখি মা বাপ তুমরা । ছুটবেলা তারে হারাই লাও, বড় অইয়া অখন পাইছ তেও তারে মানরায় না ।
--- ইতা লাম্বা মাত হক্কলেউ মাততা পারইন রেবাপারলে ডেটা আনি দেও । তারে যে পুয়া মানতাম ডেটা কই ?
--- ডেটা কিতা ? ও বুঝছি । ফজলুয়ে ইতা করাই দিছে আমার । সহায়তা কেন্দ্রত লইগেছিল একদিন ।বাক্কা একশ টেকার মতো লাগছে । অউ নেও টেকা, আর তার লুটিস ইগুর কিতা করতায় দেখ ।
বিরস মনে গিয়াসের মা বাপ তাকে রাখে চিঠিসমেত ।


  কদিন পর আবার গিয়াস ওরফে সুশীলকে নিয়ে আসে তার বাবা ভাই । গিয়াসের বাবা বলে,
--- বউত চেষ্টা করছি রেবা লিগাছি এক গাছাও পাইছি না তার । বারো বছর থাকি তো হে নাই । কেমনে থাকব কও ?
--- তেউ ? তোমরা তো তার বাপ দাদা । ইনো লইয়া আইছ কেনে ?
--- তে কই লইয়া যাইতাম ? তোমার বন্ধু তো মুরব্বি মানুষ । তোমার কাছেউ থাকঅউক হে ।
হাবাগোবা পুকাও বুঝতে পারে বাপ ভাইর উদ্দেশ্য । জোর করে গিয়াসকে আবার ওর কাছে গছিয়ে দিয়ে যায় ওরা


পুকার মাথায় এবার বুদ্ধির পোকা নড়াচড়া করে । বোঝে যায় গান্ধি পোকার  সরল সোজা পথে কিছু হওয়ার নয় । তাই মুরব্বি বন্ধুকেই পাকড়াও করে । বলে,
--- তুই কইলে খানি দিবে । দিলে । হিন্দু পুয়ারে বাঙাল বানাই দিলাম । অখন ইগু ফাটাবাঁশর চিপাত ।
--- সাফসাফ মাত ।
--- ডি আরি । জানছ নানি ? ডেটা উটা নাই । ইগুরে বাচা ।
--- অ হালার হালা! কইলাম যে দিয়া আয় ।
--- দিতাম নায় । ইগু আমার পুয়া । কিওর যে পঞ্চাইতি করছ বুঝি না ।
--- বুঝতে নি ? যা বুঝাইমুনে ।ফজল আলিরে চিনাইতে নি ? ইতা আমার হাতর ময়লা বেটা । দেখছ না ইতা ডি রে কিলা সি করি ।
--- সি কিতা ?
--- ধুর বেটা বেভুতা । বেশ মাতি না । ইগুরে বুঝচছ নি হিপারো পাঠাই দিমু । আব্রার কোন দেশ নাই, মাত্তউত পারে নাআর হেও তো তোর কাছ থাকি  হিকি লাইছে গরু চালানর কামতুই যেলাখান ইপারো বই থাকছ টিল্লার উপরে, হিপারোও এগু আছে অলাখান । কাম শেষ অইলে টর্চ দিয়া তোর লগে কাটাকুটি খেলে । হিপারোর ছবিররে কই দিমু । তেউ তোর গিয়াসও থাকব চউখে চউখে । গন্তার ভাই গন্তা ।
--- ভাই কিতা বে ইগু নু আমার পুয়া কইলাম ।
বন্ধুর সামনে ঝরঝরিয়ে কাঁদে পুকা । বলে,
--- এছাড়া উপায় নাই  নি ইপারো থাকার ?
--- না নাই ।

না বললেই হল নাকি । বারো বছরে পুকা বোবার ভাষা শিখে নিয়েছে । কথা বলা মানুষের সঙ্গে তার কথাই হয় না আজকাল গিয়াসকে ছেড়ে পুকা থাকতেই পারে না । একজীবন সে আব্রা ছেলের সঙ্গেই কাটিয়ে দেবে । তবু ফজলুর কথাটা সে গিয়াসকে বলেইশারায় বলে,
--- বাঁচতে অইলে যা গি হিপারো । আবার অবস্থা ভালা অইলে আইবে নে । দুইভাই থাকমু ।
পুকা গিয়াসের চোখে মুখে আতঙ্ক দেখতে পায় । এক আক্রোশ, ক্রোধে সে গিস গিস করতে করতে ফুঁফায় । ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পুকাকে জড়িয়ে ধরে । পুকা কিছুতেই ছাড়াতে পারে না বোবা ছেলের স্নেহের বাঁধন । এই অন্তরবন্ধনে বন্দী দুই পরমাত্মীয় ঘুমিয়ে পড়ে। একজন নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে অন্যজন ভরসায় ।


  রাত দশটার পর থেকে শুরু হয় গরুর চালান । পুকা বসে থাকে বাজারটিল্লায় টর্চ হাতে । চালান যায় এক দুই তিন । টর্চ মারে গরুর মুখে একবার । অনেক বড় চালান এবার,  ষোল সতের পঁচিশ ত্রিশ একাত্তর পর্যন্ত গোনে । বাহাত্তরে গিয়ে সব ওলট পালট হয়ে যায় । আলো গিয়ে পড়ে গরুর মুখে গরু তো নীরব প্রাণী, এপারও যা ওপারও তা তার জন্য । সেও গিয়াসের মতো আব্রা, শুধু হাম্বা করতে পারে । বাহাত্তরের প্রাণীটি করে গিস । গিস গিস । আর অঝোরে ঝরে তার চোখ থেকে জল । জলের ভাষায় লেখা মিনতি,
 ---পাঠিও না আমায় ওপারে ।
 গরুর মুখটা অবিকল গিয়াসের মতো । পুকা টর্চ নিভিয়ে তার চোখে হাত দেয়, না নেই । জলের ফোঁটা নেই, কেন থাকবে । গিয়াস যাবে না ওপারে, পুকা সিং তাকে যেতে দেবে না ।


   হাবাগোবা পুকা সিং জানে না সে কী করে রক্ষা করবে গিয়াসকে । একজন প্রত্যয়ী অভিভাবকের জন্ম যখন হয়েছে একবার  তখন জেগে উঠেও সে স্থির  থাকবে তার সিদ্ধান্তে ।         
    

********


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ