অপাপবিদ্ধ

 অপাপবিদ্ধ 

রণবীর পুরকায়স্থ 

তারা অনেক দিন অভিযোগ করেছে চক্রধরের গাড়ি চালানো নিয়ে।ষাটের উপর ওঠায় না স্পিড। আর রাত হলে তো কথাই নেই, কিছুই দেখেনা গতি বাড়াবে কোথায়। মানুষটা রাতকানা। পারলে তারা আরও কিছু দোষযোগ করতে পারে। বাইরে কোথাও গেলে চক্রধর মদটদ খায় কিন্তু কখনওমদ খেয়ে গাড়ি চালায় না। তবে মূল অভিযোগের প্রথমটি যে ধোপে টেকেনা, দুরন্ত গতিতে গাড়ি চালায় না বলেই তো তাকে রাখা মূলত তারারসুপারিশেই। আর দ্বিতীয় অভিযোগ নিয়েতো তারা নিজেই নিশ্চিত নয়, তারছেলে নকুলমাকে বলেছেনকুলগাড়িতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে মাল খেয়েবোতল ফেলতে ভুলে গেছে। পরদিন গাড়ির ভিতর থেকে হুইস্কিরবোতল দেখিয়েছে চক্রধর ব্যস, চক্রধরের উপর খার খেয়ে গেছেছেলে। তাই বাবুর গোঁসা তবে তারার রাগের স্থায়ীত্বতাৎক্ষণিক, বলে,

---একটা ড্রাইভার দেখ এবার

আবার চক্রধর নাহলে তার চলে না। বউদি কী কী ভালবাসে, কখন কোথায় যেতেপছন্দ করে সব চধরের নখদর্পনে বরদান মার্কেটে গেলে লিটলরাসেল স্ট্রিটের পাঞ্জাবি ধাবায় গাড়িতে বসে এক কাপ চা আর পদ্মনিমকি খেয়ে ওয়েটার গোবিন্দকে দু পয়সা বেশি করে টিপসদেওয়ার বিলাসিতা করে মাঝে মাঝে, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালেরপাশের গলিতে গুরুদোয়ারার উলটোদিকে শর্মার দোকান থেকেএকইধরণেচাসিঙাড়া অমৃতির ব্যবস্থা করে চক্রধর দক্ষিণকলকাতার মহারাজার গরম কচুরি আর চা খেতে হলেনামতে হয়গাড়ি থেকে, তবে ওখানে দুচারটে বেশি খায় চক্রধরআরএসএন ব্যানার্জি আর মতি শীলের ক্রসিংয়ে হিংয়ের কচুরি খাওয়াহয় না কাছাকাছি পার্কিংপাওয়া না গেলে চক্রধর ওদের ছেড়ে গিয়েআবার এসে নিয়ে গেলেই তো পারে। কিন্তু না, তারার এই উদ্ভট নিয়মওরা যা খাবে, যেখানে যাবে চক্রও যাবে এবং খাবে। অহিভূষণের মতেচক্রধর ড্রাইভার হল একটি কমপ্লিট প্যাকেজ। গাড়ি চালানোর সাড়েবত্রিশ ভাজা। গাড়ির মালিকনিকে সন্তুষ্ট করার কলাকৌশল সে জানশহরকলকাতাআর তার আশেপাশের সব মন্দিরের ঠিকানা তারজানাকলকাতায়নাকিকালি মন্দির সবচেয়ে বেশি তারপরই জগন্নাথ মন্দির, এখন তোদীঘায় হচ্ছে বৃহত্তমসব দেখা হয়ে গেছে। তার উপর পাড়ার, রাজ্যের এবংকেন্দ্রের রাজনীতি নিয়ে আপডেট দেওয়ায় চক্রধরের জুড়ি নেই। কোন কালে পাড়ারতৃণমূল নেতা তাকে বিনাকারণে ক্যালিয়েছিল বলে সে এখন মোদিভক্ত হনুমানবিজেপিকিংবা তৃণমূল নয় বলে তারা চক্রধরের রাজনৈতিক ভাষ্যে উৎসাহ দেয়,শুধু সিপিয়েম নিয়ে কিছু বললেই বলে, ছাড়িয়ে দেবে। তবে চক্রধর মাঝেমাঝেনেই পার্টিবলে, ফেলে মুখ ফসকে গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে এসব বকবকানি অহিভূষণেরএকেবারেই পছন্দ নয়। বিরক্তি প্রকাশ করলেও তারা কেয়ার করে না। বলে আমার গাড়িআমি যা ইচ্ছে হয় তাই করব,তুমি বলার কেতারার যুক্তিগুলি সব দাবা খেলারঘোড়ার চালের মতো, লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। যতদিন চাকরিছিল ততদিন গাড়িতার, রিটায়ার করার পর কিছুদিন আমাদের, এখন তো মালিকানা একারযুক্তি নিয়েলড়াই করলে জিতবে না জেনে অহিভূষণমেনে নেয়। যেমন ছেলে নকুলেশ্বরেরমালিকানা নিয়েও যৌথ অভিপ্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে তোমার ছেলেআমাদের ছেলে এখন আমার ছেলেতারা জানে তার ছেলে চেন্নাই থাকলেওদিনে তিনবার ভিডিও কল করবেই করবে। অহিভূষণএ দানে ইদানীং সে ছেলেরবিষয়ে কিছুই জানে না, যেমন নতুন গাড়ির ব্যাপারেও কিছুই জানেনা।অহিভূষণ জানে তার গাড়ির রং গ্রে, কিন্তু সেটা যে কেমন গ্রে, ততটাজানে না ভিড়ের মধ্যে গাড়ি থাকলে সে অন্য গাভির হাতল ধরেওটানাটানি করে। গাড়ির ব্রেক কিংবা ক্লাচে শব্দ হলে তারা ধরতে পারে,কোনদিন গাড়ি ধোয়ানো হয়নি সবজানে। ড্রাইভার চক্রধরের মুখভার থাকলে সে ধরতে পারে, লং ড্রাইভের পথে চাসিঙাড়াখাইয়ে মুড ঠিক করে দেয়। সোনাঝুরির হাট থেকে চক্রধরেরস্ত্রীর জন্য শাড়ি কিনে দেয়, বনলক্ষ্মী থেকে ঘি কিনলে চক্রধরকেওদেয় এক কৌটো, নিমপিঠ থেকে নলেন গুড়কিনলে একহাড়িযায় ড্রাইভার বাড়ি এসব নিয়ে খুব সুনাম বউদির চক্রধরেরবউতরঙ্গও খুশি হয়ে হিংয়ের বড়ি বানিয়ে স্যারের জন্যপাঠায়। বৈশাখ মাসে আমের আচারও আসে স্যারের জন্য।তারা অহিভূষণকে বলে, আমিকি হিংয়ের বড়িখাই না,নাকিআমের আচার তুমি খেয়েছ কোনোদিন?

---আমি কীকরে জানব?

---বলেছ হয়তো কোনো দিন

---চিনিই না মহিলাকে

---শুনেছি তোমার ড্রাইভারের বউ খুব সুন্দরী

---কী আশ্চর্য!

অহিভূষণ জানে পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক, এসব কথারফাঁকে ওকে গাড্ডায় ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা তারা নিজেওখাবে না অন্যকেও খেতে দেবে না, স্বামীর প্রতি মূলো পটলের মতো ব্যবহারকরবে, পাত্তাই দেবে না আর ভিন্ন রমণীর দিকে তাকাতেও দেবে না।প্রসংশা করলে তো দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে ফেলবে। তাই অদেখা তরঙ্গকে নিয়ে তারা বিক্তি মেপে অহিভূষণের স্ত্রীভক্তির মাপ দেখে নেয় ঠিক আছে কিনা। বিয়ের আগেদু একটা ছুটকা ছাটকা প্রেম করলেও, বিয়ের পর তারা ছাড়া গীত নেই অহিজীবনেযদিও বিয়ের আগের একটা কেস বেশ বেয়াড়া ভাবে নড়াচড়া করেছে কিছুদিন, ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে।এখনও আছে বাবলি মোবাইলে তারা প্রসন্ননামে। তারাপ্রসন্ন এখনও হোয়াটস অ্যাপে গান পাঠায় রোমান্টিক, ফেলে আসাদিনের ছবি পাঠায় একারঅহিভূষণ বোকার মতো কোনো কাজই করেনি প্রমাণরাখেনি কোথাও, প্রেমিকার সাথে পোজ দিয়ে ছবি ওঠে নি। তবে নতুন করেহারিয়ে যাওয়াফিরে পেয়ে মন্দ লাগে নি, তাবার প্রতিও তার প্রেম কমেনিতারাই তার জীবনটা পঙ্গু করে দিয়েছে। বিয়ের পর কেমন ভ্যাবলে গেছে। একার চোখেজীবন দেখতে ভুলে গেছে অহিভূষণ, সব কিছুতেই তার তারা চাই। সে নিজে এমনভিতুর ডিম ছিল না, সুন্দরী বউ বিয়ে করে পাহারাদার হয়েই কেটে গেল জীবনসেএকা বাড়িতে থাকতেও ভয় পায়, তাই তারা বাপের বাড়ি গেলে সেও সঙ্গে যায় ফ্রি।অহিভূষণের জীবন প্রণালী হাইজ্যাক করে নিয়েছে তারা। তারা যত জানে সেতার কতটুকু জানে।অদেখা এক ড্রাইভার পত্নী তরঙ্গের নামে গ্রেম গভির করেতারা নিজেকে উপেক্ষিত সাজায়আবার গভির রাতে একজন আর একজনেরমুখে তাকিয়ে বলে,

---আচ্ছা,তুমি যদি জানতে পারো আমি আর একজনকেভালবাসি, তুমি কী করবে?

রেশম তুলতুলে পঞ্চান্ন বছরের শরীরে ডুবে যেতেযেতে চুম্বনে মুখ বন্ধ করে দেয় অহিভূষণ। দীর্ঘক্ষণ অর্গলবদ্ধ থাকার পরশ্বাস নেওয়ার অবকাশে আবার বলে,

---বললে না তো?

অহিভূষণের তখনজবাব দেওয়ার সময় কোথায়। তবু বলে,

---করলে করবে, আমার ভাগেরটা কমনাপড়লেই হল।

--- ঈশ, শুধু ভাগাভাগি, শরীর ছাড়া কিছু নেই

---এমন একটাদেহ পেলে অমরত্বপ্রত্যাখ্যান করতে পারি ম্যাডামআমারও একজন আছে

জানো?

---জানি, আমিও বলেছি আমার আছে, কাটাকাটি।

---তোমার নেই,আমিজানি।

--- কচুজানো, ধান খেয়েছো মুরগি যাবে কোথায়? অহি ছাড়া গতি নাই

--- মানুষটাএকটা সিরিয়াস কথাও বলতে পারে না। ষাট বছর বয়সেও শখ যায় না।

অহিভূষণ তখনআলো জ্বালিয়ে আপন রমণীর নগ্নিকা রূপ দেখছে আর অবাক হচ্ছে। বলছে,

---শখেরআর কী দেখেছ, এই রূপ দেখেছিল কালো রাজা, দেখেছিল তার ডেসডিমোনাকে,বলেছিল আমি একটি অপাপবিদ্ধ সন্তানের জন্ম দিতে চাই

---তোমার তো আছে সন্তান

---সে তো তোমার

---আমাদের।

---তবে যে বলো...।

---সে তোমাকে আঘাত করতে, যখন দেখিতুমি আর আমায় ভালবাসো না!

---বাসি তো।

-- তবে বলো আই লাভ ইউ।

---ধুর,ওসব বলেকি লাভ হয়?

বলেই অমরকবির কবিতা আউড়ে আবার মুখের কথা বন্ধ করে। বলে

---তৎকাল যৌগে ক্রমৈঃ।

আর তারাও বন্দী বিহঙ্গের মতো বিভিন্ন বিভঙ্গেশরীরী খেলায়মেতে ওঠে। পঞ্চান্ন বছরের এই অপরূপা রূপসীকে এমন সোহাগী করে তোলাসহজ কর্ম নয় অহিভূষণের, সে এক সাধনার ধন। অহিভূষণ তার নিজস্ব রমণীকে এমন উদ্ধৃত প্রগলভ হতে দেখে নি বহুদিন।

আবার যেদিন তারার শরীর ডাকে সেদিন অহিভূষণ আগেরদিনের অসমাপ্ত বিষয় তালিকা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। বলে,

---তুমিযে বলেছিলে তোমারও আছে একজন, আমি চিনি?

---চেনো তোবটেই।

---বাড়িতে আসে, থাকে? আমি অফিসে গেলে তোমরা একাবাড়িতে?

---কী? একা বাড়িতে কী? সবাইকে সন্দেহ করবে নাকিতোমার ধর্মশালার?

আসামের ছেলে অহিভূষণের বাড়িতেতার আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধরের জন্য অবারিত দ্বারসে অফিসেচলে গেলে অতিথিরা থাকে তারার তত্ত্বাবধানে অহিভূষণের বন্ধুমৃন্ময় অনিমেষ বিপ্লবকে তো দাদা ডাকে তারা, শুধু অহিভূষণেরপ্রাক্তনছাত্রঅমিতএলেঅন্যরকম অমিত বয়সে কম একটু বেশিস্মার্ট, এছাড়া কিছু না। সবাই এলেই তারা অন্যরকম। তাহলে তো ড্রাইভারচক্রধরকেও সন্দেহের তালিকায় রাখতে হয়, কী সুপুরুষডাক্তার সিদ্ধার্থবলেছিল গাড়ির মালিক থেকে ড্রাইভার সুন্দর। অহিভূষণ এসব গায়েমাখে না, সে জানে তার গায়ের রং মাজা, নামটা সেকেলে, তারার নামওতো একালের নয়। অহিভূষণ তারাকে বলে,

---ডাক্তার সিদ্ধার্থ কি তোমারআকাঙ্খার পুরুষ?

---হতে পারে।

তারা মুচকি হাসে।

অহিভূষনের জীবন তছনছ করে পঞ্চান্ন বছর বয়সে চলে যে যায়তারাদুদিনেরজ্বরে হার্টফেল করে কী কেউ চলেযেতে পারে, তবু তো গেল তারার ছেলে চেন্নাই থেকে ফিরে এসে বলল,

--- এরকম হতেই পারে না।

অহিভূষণকে বলে,

--- কোন ডাক্তার দেখিয়েছে,দেখি প্রেসক্রিপশনসবকিছু দেখে ছেলে বলে,

--- হুম

ছেলে নকুলেশ্বর কিতাহলে কিছু সন্দেহ করছে। ছেলে বাপের হাত ধরে থাকে রাতে অহিভূষণঘুমায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে একা একা কাঁদে, বুক ফেটে যায়কান্নার চোটে। ছেলে সব দেখে। বলে, কাজ চুকলে বাপকে নিয়েযাবে। অহিভূষণ বলে যাবে না, বিবাহিত ছেলেতোআর সারাজীবন বাপেরহাত ধরে ঘুমোবো না। চক্রধর বলে, সে থাকবে স্যারের সঙ্গে, এওতো সমাধান নয়, তারও তো তরঙ্গ রয়েছে। চক্রধর বলে, কিছুদিন তো থাকি। রাতে শোয়ার আগে একবাড়িতে অহিভূষণচক্রধরের সঙ্গে তারাকে নিয়ে কত কথা বলে।অহিভূষণ একথাসেকথার পরজানতেচায়, বউদি কোথায় কোথায় যেত, কোনমন্দিরে কোনবন্ধুরবাড়িচক্রধর জানায়, ডাক্তার বাবুরবাড়িনিয়ে যেত প্রায়ই।

--- কোন ডাক্তার, সিদ্ধার্থ সেন?

---হ্যাঁ স্যার সিদ্ধার্থডাক্তার তো একা থাকে বিয়ে করে নি।

গলার স্বরে রুক্ষতা নিয়েচক্রধরকে বলে,

--- আগেবলোনি কেন?

---বউদি না করেছে আপনাকে বলতে।

এরকম একেক রাতে এক এক গল্প বলে চক্রধর কখনও অমিতের সঙ্গেসিনেমা দেখার গল্প। মৃন্ময় অনিমেষ বিপ্লবকে নিয়েওগল্পবলে অহিভূষণ কাকে সন্দেহ করবে, মিছিমিছি সিদ্ধার্থকে নিয়েভেবেছে। সিদ্ধার্থ ওরকম মানুষই নয়। কাজের মেয়ে ছবিকে দেখাতেনিয়ে গেছে সে কথা প্রথম দিন বলে নিচক্রধরঅহিভূষণ বুঝতে পারে ওরবাড়ির অতিথিদের মধ্যেই যে কেউ তাও সত্যি নয়। অন্য কেউ হবেমেঘের আড়ালে। তাহলে চক্রধরের উদ্দেশ্যটা কী, ওকে বিভ্রান্তকরে ওঁর কী লাভনাকি চক্রধরই আসল কালপ্রিট দুমাসপর অহিভষণ সিদ্ধান্ত নেয় চক্রধরকে এবার ছাঁটাই করবে। তারএখন স্থায়ী ড্রাইভারের দরকার নেই, সেন্টার থেকে আনিয়েনেবে ঘণ্টার হিসেবে। সেইমতো চক্রধরকে জানিয়ে দেয় সামনেরমাস থেকে আর তার দরকার নেই।চক্রধর কিন্তু সেয়ানা ড্রাইভার,চাকরি গেছে তো কী হয়েছে অহিভূষণকে অনুরোধ উপরোধ কিছুইকরে না। যাওয়ার আগে পরদিন তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেযায়বলে,

---দুটো ডাল ভাত খাবেন স্যার। তরঙ্গ বলে দিয়েছে।

তরঙ্গকে প্রথম দেখে অহিভূষণ, সত্যি আগুন রূপসী তারড্রাইভারের বউ, কত পদ রান্না করে খাওয়ালো। কতবারআচল বুকের মাঝখান দিয়ে কাঁধের ওপারে গেলদুবুকখুলল আবার আঁচল খুলে ঢাকল।অহিভূষণচক্রধরকেবলে তরঙ্গকেনিয়েচলেআসতেপারেতারবাড়িনিচেরতলারবড়ো ঘরটা তোখালিই পড়ে আছে; ভাড়া দিতে হবে না।চক্রধর রাজি হয় না, পতিগত প্রাণ তরঙ্গ রাজিনা অরাজিবুঝা যায় না।ভাল কথা, নিজের বাড়ি ছেড়ে কেন যাবে, অহিভূষণ তাও চক্রধরকে ছাড়ায় না, বলে যেমন আসে তেমনআসতে তবে চক্রধরের উপর মানসিক অত্যাচারেরবাড়িয়ে দেয়। তারা বেঁচে থাকতে যেসব ছোটোখাটো চুরিধর্তব্যের মধ্যে আনত না, সে সব আভাসে ইঙ্গিতে এবার বলতেথাকে। আবার গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়িলাফিয়ে উঠলেরাজ্যসরকারের রাস্তার উপর দোষারোপ করলে সাবধানকরে দেয়,

---গাড়িটা দেখে চালাও চক্রধর।

আবার মাছ মাংসকিনে বাড়িতে এসে বলে,

--- ধুর, কাজের মানুষকে আর তেমনরাঁধতে পারে তুমি নিয়ে যাও, তরঙ্গ রাঁধলে আমাকে একটুদিয়ে যেও

তরঙ্গ রাঁধে অহিভূষণ খায়। বাঙালবাড়ির মেয়ে বলেতরঙ্গ কত রকম রাঁধতে জানে, ভাজা বড়াশাকপাতুরি ভাপে ছেঁচকিরসা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাঁধে। টিফিন কৌটো আসে ফিরে যায় শূন্য।তরঙ্গের অনুরোধে প্রায়ই চক্রধরের বাড়িতে যায় অহিভূষণতারাকে দেখেনি তবু তরঙ্গ তারাম্যাডামের কথা বলে স্যারেরমনের কাছাকাছি পৌঁছতে। শরীরটাও তো মনের পাশেই থাকে, একই গাঁয়ের পড়শি। অহিভূষণ ও তরঙ্গকে বলে,

---তোমার বরচক্রধরকে খুব পছন্দ করত ম্যাডাম আমাকে বলত ওর বেতনবাড়িয়ে দেওয়ার কথা। আমি তো জানতাম যাদিই না কেনতোমার ম্যাডাম ঠিক পুষিয়ে দেবে। একস্ট্রা ইনকাম কমেগেলতোমার বরের। আমি ঠকাব না, তোমাকেই দেব বাকিটা, দিচ্ছিনাবল? বাজার করার অভ্যাস তো বন্ধ করিনি, তোমার বাড়িতেপাঠিয়ে দিইআরও দেব, ক্যাশ দেব।

---আর কেন স্যার, আপনিতোদিচ্ছেন।

--- তোমারবরচক্রধর খুব চালাকসব কথা খুলে বলে না। ওকে দিয়েহবে না। যা করার তোমাকেই করতে হবে। কিছুখবরদিতেহবেকিন্তুগোপনেপারবে তো?

তরঙ্গ এক অভিলন ভঙ্গিতে সম্মতি জানায়। বুকের কাপড়ঠিকঠাক করার ছলে স্বল্প উন্মুক্ত করে, মানে হ্যাঁ। অহিভূষণ বলে,

---তোমার ম্যাডামের চক্কর কার সঙ্গে ছিল চক্রধর জানে, তোমাকেডিটেলস জেনে বলতে হবে।

অহিভূষণকে অবাক করে তরঙ্গজানায় সে সব জানে। বলে,

--- তোমার বন্ধু অমিতটা ভালো না।

---অমিতনা সিদ্ধার্থ ডাক্তার?

---নানাঅমিত ঠাকুর দিল্লি থেকেএসেপড়েথাকত তোমার তো ছাত্র, গুরুপত্নীর সঙ্গে ওর এত কিসেরগুজগুজ ফুস ফুসবউয়ের সঙ্গে নাকি বনিবনা নেই, সব তোমারবউকে নিয়ে

---ধেৎ, অমিত কী করে হয়, আমার স্টুডেন্ট

--- তোমারতারা বউও তো ছাত্রী

--- কে বলল তোকে, চক্রধর সব উলটোখবর দেয়। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি।

---তবে চক্করথাকলেওতোমার বউ তোমাকেই বিয়ে করত

--- তুই কি জ্যোতিষ নাকি?

---তারা বউ তোমাকে ভালবাসত

---হুঁ

--- হুঁকী, ঠিক কিনাবলো?

---আমার বউ আমাকে ভালবাসবে না তোর বরকেভালোবাসবে?

---বাসতেও তো পারে বস

---যত সব ভুলভাল

অহিভূষণতো তরঙ্গর মুখে তুমি শুনে অবাক, ম্যাডাম না বলে তারাবউ, সেও তাই ছুটিযে দিল তুই তোকারির ঠেলাগাড়িসেতরঙ্গের হাতে দাদনের টাকাও গুঁজে দিয়ে আসে।

ডিব্ৰুগড়ের বিপ্লবকে দিয়ে অমিতকেটাইট দেওয়ার কথাভাবে অহিভূষণ। এক মামুলি পান দোকানি, শান্তি পাড়ায় জমজমাটদোকানে কত কিছু পাওয়া যায়। তিন তলায় অহিভূষণের ভাড়া ফ্ল্যাটআরনিচে বিপ্লবেরকাত্থা আর বেগর কাত্থা একশ বিশতিনশ জর্দাঅহিভূষণ বলে, উপর বিবিকা মকান আউর নীচেপান কী দোকানবিপ্লব দিনে দুবার তিনবার পান পাঠায়। রাতে দোকানবন্ধ করে কোক পেপসি চপ কাটলেট নিয়ে আসে। ছুটির দিন অহিভূষণ সহ সিনেমা দেখতে যেত জ্যোৎস্নায় বউদিকে নিয়েশাড়ি কিনেদেয় বউদিকে দামী দামী বিপ্লবের দোকান লাটে উঠতে উঠতেঅহিভূষণের অস্থায়ী আস্তানার লটবহরও চলেযায় কলকাতাবদলিদোকাননেই তাই ভেরেণ্ডা ভাজতে ভাজতেবিপ্লবওচলে আসে বউদির টানে। তবেঅহিভষণ নিশ্চিত তার তারা আর যাই করুক এই চামচিকে মার্কাছোকরার সঙ্গে ফস্টি নষ্টি করতে পারে না।কিন্তু বিপ্লব,যেরকম এগ্রেসিভ, কুছ ভি হো সকতা তাই কাঁটাদিয়েকাঁটাতুলতে প্রাক্তন পান দোকানিকে সুপারি দেওয়ার কথা ভাবে

ওএনজিসির অনিমেষ তারার মতো বোন পো,মাসততো দিদির ছেলে। ছোটো বেলা থেকেই অনিমেষতারারন্যাওটা অনিমেষের বাবা বাংলার অধ্যাপক কবি। অনিমেষও কবিতালেখে,গল্প টল্পও লেখে শরীরী প্রেমের অহিভূষণ আর তারারমধ্যে দাম্পত্য কলহেও সেঢোকে যায় মাসীর পক্ষেআসকারানিয়ে তারা অহিভূষণকে বলে,

---রইল তোমার সংসার, আমিঅনিমেষের কাছে চলে যাব। কিরে দেখবি না? অনিমেষ তখনই

প্রস্তুত। বলে,

---চলো

দেবী দিদি ছেলের বিয়ের জন্য ব্যস্তহতেই সে বলেবিয়ে করবে না, করলেও মাসির মতো বউ চাই

এদের মধ্যে মৃন্ময় একটু অন্যরকম। অহিভূষণ বলে ভালমানুষ টাইপেরগুণ্ডামৃন্ময় বলে,

---সেটা আবার কী রকম।

---তুই যেরকম।

তারাদের পাড়ারছেলেমৃন্ময়ের ভয়েভজমালীপাড়ার মেয়েদের কেউ উত্যাক্ত করেনিকোনোদিনঅহিভূষণের লাইনে তারাকেদেখে মৃন্ময় অনুমোদন দিয়েছিল একবাক্যে,বলেছিল,

---ওতো মেয়ে নয় রে বাইসন, দারুণ মেয়ে। বিয়ের পর তো মিনুদারনামে আহ্লাদে তারাঅষ্টাশিখানা। ডিসেম্বরের শেষদিন বাড়ি এসে বলল,

---চল তারা, পাটি করে আসি

--- চলো, কোথায় যাবে?

--- শিলংযাবো

শিলং গিয়ে পাড়ার দাদা আর তারা পার্টি করল,অহিভূষণ একা হোটেল ঘরে জেগে থাকলনতুন বছরে বাসে করেফিরেওএল তিনজনেগৌহাটি এক সিটে মৃন্ময় ওরফে মিনুদা আর তারা জানালারপাশে আর অহিভূষণ আইল সিটের অবজ্ঞায়। তারা বলে,

---মিনুদা ওরকম,আমাকে ভালবাসে

--- আর আমি?

---তুমি তো স্বামীজি,হিংসাকরো না।

অহিভূষণঘটনাটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিল।মৃন্ময়ের সঙ্গে সম্পর্ক কাট করে দিয়েছিল, কলকাতায় কী করেযে আবার জুড়ে গেল তারার একজন হয়ে।

জমানো টাকা পেনশনেরটাকা জমে জমে অহিভূষণের এখন অনেক টাকা তারার প্রেমিকাখুঁজতে এখন ড্রাইভার চক্রধরের সুন্দরী বউয়ের পেছনে খরচকরে দুহাত খুলেতরঙ্গও এখন সূত্র ধরিয়েদিতে যখন তখনচলে আসে অহিভূষণের বাড়িতে সে তরঙ্গকে তারার পুরনোকাপড় চোচাড় দিতে চাইলে নেয় না। বলে,

---সঙ্গে চত্রধরেরজন্যেওকিছু একটা না দিলে সন্দেহ করতে পারে।

অহিভূষণ পুরণোব্লেজার দেয় সার্ট দেয় নতুন লুঙ্গি দেয়। বিনিময়ে তরঙ্গ সুখদেয় সূত্র দেয়।

তেলে জলে মিশ খায় না।তারার সঙ্গে তরঙ্গের কিছুই মেলেনা। দেখতে সুন্দর মাকাল পুষ্প একটিঅহিভূষণ তারাকে হারিয়ে এখনদিশেহারা। কাজটা সেঠিক করে নি তারা বেঁচে থাকলে তারসুখ থাকত আনন্দ থাকত অহিভূষণ জানে তারা যখনতার সঙ্গে থাকে তখন সে তার একান্ত আপনসুখের সময়অহিভূষণ কত কথা বলেবলে সোনাবাবু বলে আই লাভ ইউতবে তারার তো একটা অতৃপ্তিও ছিল, নইলে কী আর কেউ চরমসুখের মুহুর্তে বলে সে একটা অন্যপুরুষ কামনা করে, অন্যেরসঙ্গে খেলতে চায় শরীর খেলা প্রতিদিন, যে যে রাতে তারা মিলিতহয়েছে তারা সুখ যেমন দিয়েছে অপমানও করেছে সে কত আরসহ্য করবে, যা করেছে ভালই করেছে। অহিভূষণ মুখে কিছুবলে নি তারার সুন্দর শরীর দেখতে দেখতে অন্ধকার থেকেআলোয় নিয়ে এসেছে মাথার উপর বাহারি পর্দা সরিয়ে।কামুক আলোয় চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর দুহাতেজড়িয়েধরেছে কামনার বহ্নি মুখ। শেষ দিকে গলার কাছে নিয়ে এসেছে দুহাত। সজোরে শ্বাসনালী টিপেধরতে চেয়েছে। বলেছে অন্য কারো দিকে তাকালে গলাটিপে মেরেই ফেলবে। তারা হেসে বলেছে,

---রাগছো কেনগো,আমিতো তোমারই আছি।

বলে আরওমোহময়ীহয়ে উঠেছে। বলেছে,

---মেরে ফেললেও আমি তোমারইথাকব। এখন একরকম একটু আগে অন্যরকম,এসব কীযেখেলা তার তারাসুন্দরীর অহিভূষণেরও একই কথাসে তার আদরের ধনকে ভাগ করতে চায় নাসে বুঝতেপারে তাঁর বাড়ির ধর্মশালায়ই রয়েছে রাধাবিদ্যার একগোপন পাঠশালাদৃশ্যমান যাঁরা আছে তার বাইরেকী আছে কেউ, নাকি অহিভূষণ ধরতে পারছে নাতারার অতিঘনিষ্টজনকে তারার কথাকেই তাহলে ধ্রুবতারামানতে হয়, জীবনে যেমন মরণেও তো সে তারই থাকবেবেঁচে থাকতে যখন অন্য পুরুষের খোঁজ পায় নিতাইএবার সে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাবে গভিরেতরঙ্গই তাকেপৌঁছে দেবে সঠিক শরীরে।

 

 

 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ