গোলা গুল্লি সংবাদ I রণবীর পুরকায়স্থ I

 

                        
ছবিঃ রণবীর পুরকায়স্থ 


মানুষটি সচরাচর রাগে না বলেই গুল্লি নামের ক্ষণরাগী মেয়েটি পর্যন্ত অনেক পাল্টে গেছে । গোলাকে মুখোমুখি দেখলেই ওর মুখের মুচকি হাসি বেরিয়ে পড়ে ফিচিক । পিছন ফিরে চলে গেলেও একই হাসি কেন যে লেগে থাকে সদাহাস্যময়ীর মুখে । মেয়েটি মানে গুল্লি কী তখন জানত এতসব হাসির মর্মার্থ । আসলে হাসির কথায় হাসত, গোলা নামের মধ্যেই যে হাসির রহস্য লুকিয়ে আছে তাই নিয়েই হাসততা বলে আঠার মতো লেগে থাকার তো কথা ছিল না সর্বক্ষণ । যদিও হাসির কথায় গুল্লির রাগের কথাটাই উঠে আসে প্রথমে । রাগের বিপরীতে যে এমন দমফাটা হাসিও থাকতে পারে তখনও জানত না সে । এত চেনা জানাও হয়নি তখন । বখাটে একটা ছেলে, কেউ বলেও নি যে ছেলেটির পেটে পেটে এতো, গুল্লির পিছনে লাইন মারবে । সকালের দিকেই কলেজের বটবেদির নীচে বসে থাকে তিন চারটে ছেলেকে সঙ্গী করে । কত কথা তাদের, বইখাতাও মাঝে মাঝে মেলে ধরে, আর গোলা স্যারও পণ্ডিতমশাই সেজে কী সব বুঝিয়ে দেয় । আবার গুল্লিকে দেখলেই সব পাল্টে যায়, পাঠবেদি হয়ে যায় ডিস্কোফ্লোর, খাতাবই আর সিমেন্টের বেদি বাজিয়ে গেয়ে ওঠে অশ্লীল গান,

নান্টু ঘটকের কথা শুইন্যা

অল্প বয়সে করলাম বিয়া...

গুল্লির তো খুব রাগ, রেগে মেগে তেড়ে যায়, বলে,

--- হেই ।

প্রথম দিন ঐ পর্যন্ত । ক্লাসে চলে গেছে বিরক্ত মৌচুষকি পাখির মতো । পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় আবার । আবার ওরা পড়াশুনা নিয়ে মশগুল, মাথা পর্যন্ত উঠিয়ে দেখে না কে আসছে যাচ্ছে । গুল্লি গট গটিয়ে বটগাছের সামনে দিয়ে এগিয়ে যায় । কলেজে ওর রাগের কথা তখনও বিখ্যাত ওকে কেউ ঘাটায় না, তখনও সে হান্টারওয়ালি । রানী মুখার্জির সিনেমা দেখে সবাই বলে মর্দানি । গুল্লিরও খুব পছন্দ পুলিশের চাকরি, ছোটবেলা থেকেই পুলিশ দেখে বড় হয়েছে । রংপুর থানার গায়ে বাড়ি আর বাড়িতেও আছে পুলিশ । ও হরি আগের দিনের মর্দানি হইতে যে কোন কাজই হয় না, ওর গটগট চলার ছন্দে বাইণ্ডিং খাতাও বাজে গানের তালে,

মুরব্বিরা কইল সবাই

নো টেনশন নো চিন্তা...

দ্বিতীয় দিনও দুলাইন, কারণ ঐ টুকুনি শোনার পর যখন গুল্লির রাগ আবার ময়ূরের মতো পেখম মেলেছে তখনই খাতাবই মাঝখানে রেখে অপরাধীদের দুহাত জড়ো হয় নকল অনুনয়ে । শুধু পালের প্রধান আবার নো টেনশন বলেই হয় ধা, নেমে যায় উল্টোদিকের কলেজ রোডে ।

পরদিন গুল্লি তেড়ে ফুঁড়ে আসে, একটা হেস্ত নেস্ত করতেই হবে এবার । যদিও নিরুপদ্রব নিশিন্তে সে পৌঁছে যায় ক্লাসের বারান্দায়, আর তখনই কাগজ বাজানো গান শুরু হয় ।

পাইছ জীবনে দারুণ একটা পোলা

পোলা তো নয় সে আগুনের গোলা ।

আহত খঞ্জনির মতো ছাত্রছাত্রীহীন ক্লাসরুমের বারান্দা থেকে সে আবার হনহনিয়ে ফেরে, ফিরে তাকায় গোলার দিকে । গুল্লিকে দেখে সেও ভিজে বিড়াল, যেন কিছুই চেনে না । গুল্লি ডাকে,

--- এই যে গোলা ।

গান আগেই থেমে গেছে ।

পরদিন আর গায়নি কেউ। গুল্লিও মরালির চালে ক্লাসের দিকে গেছে ধীরপায়ে। গান শোনার জন্য উদগ্রীব এবং উৎকণ্ঠায় ।গান গায় নি কেউ,গাইতে তো পারত। গুল্লির রাগ বাড়ে।

পরের সোমবার গুল্লি আরো তাড়াতাড়ি যায় কলেজে । বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে । ওরা আসে, ওদের জায়গায় গুল্লিকে দেখে ঘাবড়ায় না ওরা । পাশেই বসে যেন কেউ কাউকে চেনে না । শুরু হয় পদার্থবিদ্যার জটিল শিক্ষা । গুরু মহারাজ শেখাচ্ছে আর্কিমিডিসের প্রিন্সিপল ।

               ---ধরো এই বটবেদিটা যদি একটা তরল পদার্থের পাত্র হয় তাহলে কোনো  নতুন শরীর যদি পুরো বা আংশিক পাত্রস্ত হয় তাহলে সেই শরীরের মাপের ওজন তো তোমাকে ছাড়তেই হবে, হবে কী না বল?

সবাই সমস্বরে ধুয়ো দেয়,

               ---হবে হবে হবে ।

ইতিহাসের গুল্লি পদার্থবিদ্যার ফাঁকিবাজি ধরতে পারলেও কিছু বলে না, কারণ বিজ্ঞান তার বিষয় নয় আপাতত । এখন সে গান নিয়ে জয়ের মুখোমুখি । কয়েক মিনিট পর গুল্লি চলে যায় যাওয়ার আগে বলে যায়,

--- ভিতুর ডিম । আর্কিমিডিসের জলীয় বাষ্প । উবে গেছে গান । আমার সঙ্গে ইল্লি । জেলের চাক্কি  ঘুরিয়ে ছাড়তাম আজ গান শুনলে

গুল্লির প্ররোচনা সত্ত্বেও ওরা গায় না । গুল্লির অশান্তি বাড়ে । হেস্তনেস্ত হয় না বলে রাগ প্রকোপ বাড়ে । এক সোমবার শুরু হয়েছিল চারদিন চলল, দুদিন ফাঁকাপরের সোমবার থেকে আবার ছদিন শান্ত। গুল্লিও হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। তৃতীয় সোমবার গুল্লি আসে রংপুর থানার এ এস আই বরঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে। বরঠাকুর বলে,

--- গোলা কোন ?

মানে, কোন ছেলেটি গোলা । না গোলা বলে কেউ নেই । আর থাকলেও চলে গেছে পয়লাপুল কলেজে গিটার নিয়ে, হোক কলরব গাইতে গুল্লি বরঠাকুর পুলিশকে বলে,

--- আমি ছাড়ব না কাকু ।

---ঘরে চলো মাইকিজনি ।

গুল্লিকে জিপে উঠিয়েই নিয়ে যায় বরঠাকুর । ক্লাস তো এমনিতেই হবে না । মিছিল হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে ।

জিপ বরাক ব্রিজে মাঝামাঝি আসতেই নীচে বিরাট জটলা । ভিড় দেখলেই পুলিশের চোখ চকচক করে । বরঠাকুর বলে,

--- রবা । দাঁড়াও দেখে আসি । আজ তো মনে হচ্চে দিনটা ভালই যাবে ।

মানে পুলিশ কেস হলে, কগনিজেবল অফেন্স হলে আমদানি হবে । না হলেও মন্দ কী, ধমকাধমকি তো করা যাবে । পুলিশের অভ্যাস বজায় থাকবে । গুল্লিকে বসিয়ে রাখে গাড়িতে । বলে,

--- বসো, দেখে আসি কী কেস ।

বরঠাকুর নেমে যায় নদীর দিকে ভিড়মুখি রাস্তায় । গুল্লিও নামে কৌতূহলে । গুজব মানুষের মুখে স্যুইসাইড শুনে সে মিলিয়ে নেয় লাল বেনারসী সাজে বিয়ের কনের ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য। তাদের জিপ যখন সেতুর উপর উঠছে তখনই সে দেখেছে চারের খুঁটি থেকে মেয়েটির ঝপাংঝাপ । বরঠাকুর কাকুকেও সে বলেছে স্যুইসাইড । কাকু ভেবেছে গুল্লি নিজের কথা বলছে । কাকু সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে,

--- একটা ফালতু লরা, এর জন্য কেন স্যুইসাইড করবি ।

--- ধুর বেটা পুলিশ ।

গুল্লি কাকুকে বকেছে । আর কথাও বাড়ায় নি । এখন তো মিলে যাচ্ছে সব । হেমন্তের নদীতে বেশ চড়া পড়ে আছে, নীচে নামতে নামতে দেখে ভিড়ের আয়তন শেষদিনের গান্ধীমেলার মতো উপচানো । ভিড়দর্শক একজন বলছে,

--- মেয়েটাকে তো চিনি, মালিনী নাথতরণী রোডে বাড়ি । গোবিন্দ নাথের  ছোটবোন ।

সঙ্গী একজন বলে,

--- কোন গোবিন্দ রে ? টাউন ক্লাবের সেন্টার ফরোয়ার্ড ?

অন্য আর একজন এসে যোগ দেয় বলে,

--- কেস ছিল ছোটবেলার । বেরেঙ্গার কুতুব ।

--- কুতুব ? বাপের শুনেছি  অনেক পয়সা হোজাইতে বিড়ি ফেক্টরির মালিক ।

--- হলে কী হবে  মুখে বসন্তর দাগ । মেয়েটা কী সুন্দর রে ।

ভিড়ভাট্টার ভিতর গুল্লি খুব সাহসী হয়ে যায়পুলিশ পুলিশ ভাব একটা চলে আসেকথোপকথনে গুজব ছড়ানো পাবলিক তিনজনের মুখের দিকে তাকাতেই বন্ধ হয়ে যায় কথা । গুল্লিও ঢুকে যায় জটলার প্রধান কেন্দ্রে, যেখানে নদীর জল আর বালি গা মাখামাখি । আর ভেতরে ঢুকেই তো তার চোখ ছানাবড়া, গোলা । সেই গোলা বসে আছে বেনারসী শাড়ির বুকচেপে । মেয়েটার বুক নড়ছে, আর জল বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে ভুসভুসিয়ে । তার মানে মেয়েটি মরে নি । উর্দিপরা বরঠাকুরকে দেখে গোলা মেয়েটির বুক থেকে নামে । পাশে রাখা ভেজা গিটার নিয়ে সরে পড়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে । ছেলেটির হাটার ভঙ্গিটা খুব চেনা চেনা লাগে গুল্লির, কম বয়সের অনিল কাপুরের মতোছিছি, অনিল কাপুরের মতো দেখতে ছেলেটা এরকম কাণ্ডে জড়িয়ে যাবে । তার মানে কুতুব ফুতুব কিচ্ছু নয়, সব কেস গোলা । করিতকর্মা বটে । গুল্লির ভিতর পুলিশ সত্তার রাগী অংশটা এবার সক্রিয় হয়, বাঁ হাত দিয়ে গোলার কলার চেপে ধরে । গোলা ফিরে তাকায়, ঘাবড়ায় না । বলে,

--- পুলিশকে বড় ভয় । বাঁচান ? আপনার বাড়ি তো বৈদ্যনাথ সরণি । দেন না একটু শেল্টার ।

--- কেন দেব? কুকর্ম করবেন আপনি  আর বাঁচাব  আমি ?

গোলা ঠাণ্ডা মাথায় আপনি থেকে নামে । বলে,

--- পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা বাঁচাবে না, তাই তোচলো ।

গুল্লির রাগ যে কেন ঝপ করে নেমে গেল কে জানে । বলে,

--- চলুন ।

সত্যি সত্যি দুপা ফেলিয়া তার বাড়িতে নিয়ে যায় । ড্রয়িংরুমে বসিয়ে চা খাওয়ায়, খুব গল্প করে, আর হাসে । ভেজা গিটারসহ চলে যাওয়ার পরও হাসতে হাসতে শোনে নান্টু ঘটকের গান ইউটিউবে । ভাবে, বেশ তো । নো টেনশন নো চিন্তা ।

 

 

(২)

 

মৃন্ময়ী নাথ কিন্তু পড়াশুনায় খারাপ ছিল না । ইতিহাসের সন তারিখ পর্যন্ত তার মুখস্ত, ৩২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণ যেমন জানে, হরপ্পা সভ্যতার আনুমানিক সনও সে জানে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মায়ের নামও জানে, মহাত্মা গান্ধী আর কয়েদে আজমের জন্ম সালও তার মুখস্ত । এতসব জেনেও মেয়েটি একবারে বিএ পাশ করতে পারল না, অনার্সটা ফস্কে গেল, ইকনমিক্সে ব্যাক রয়ে গেল । আর পরীক্ষার আগে পরে এত টানা পোড়েন থাকলে পাশের উত্তর লিখতে পারে না মৃন্ময়ী । দীপনারায়ণ নন্দী মজুমদারের সঙ্গে প্রেমের পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা তো ছিলই, তার উপর বরঠাকুর পুলিশ কাকুর সঙ্গে দীপনারায়ণের সম্মুখ সমর নিয়েও তার আতান্তর । কাকু বলেছে মৃন্ময়ীর পরীক্ষার কদিন পুলিশের জিপে করে পৌঁছে দেবে হলে, দীপ বলেছে তার চাচা পৌঁছে দেবে । আর যেমন বলা তার তেমনি কাজ, কাকুকে চকমা দিয়ে সে প্রথমদিন আটটায় এসে উঠিয়ে নেয় পরীক্ষার্থিনীকে । ইকনমিক্স পরীক্ষার দিন আচমকা ব্রিজ অবরোধ । নতুনের দাবিতে আর বর্তমান সেতু সারাই নিয়ে কতৃপক্ষের ধানাইপানাইের প্রতিবাদ । মৃন্ময়ীর উচাটন হয় । দীপনারায়ণকে বলে,

--- বরঠাকুর কাকু ঠিক বের করে নিয়ে যেত

--- তাই ? ঠিক আছে দেখে নিও, আমার চাচা কখনও ফেল করে না, উড়িয়ে নিয়ে যাবে ।

এদিকে উৎকন্ঠায় মৃন্ময়ী একে একে সব মুখস্ত করা উত্তর ভুলে যাচ্ছে । ল অফ ইকুইলিব্রাম ডিমিনিশিং রিটার্ন কিছুতেই মনে পড়ছে না, ইনফ্লেশনের কারণ কী ... ধুর সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে । এদিকে দুমিনিটের ভিতর ফিরে এসে দীপনারায়ণ বাইক স্টার্ট দেয় ভট ভট ভটর । মৃন্ময়ী বলে,

--- কী করে হল ?

--- কী করে আবার, সংগ্রামী নেতাকে বললাম, আমার বউ প্রেগন্যান্ট কপ্লিকেটেড কেস, মেডিকেল যেতে হবে, ছেড়ে দিল ।

ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলেও গোল পাকানো প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক লিখতে পারে নি । জানত পাশমার্ক উঠবে না । বাড়ি ফিরে দেখে অন্য নাটক । বাবা আর বরঠাকুর কাকুর মান অভিমান । কাকু নাকি অনেকদিন থেকেই বলছে আর ভাড়াটে থাকবে না । অর্থনীতির মন্দ পরীক্ষার দিন বাবাও বলে দিল থাকতে হবে না ভাড়াটে । আসলে শুরুর দিন থেকেই দীপনারায়ণের পাকামো মৃন্ময়ীর প্রশ্রয় অপছন্দ পুলিশ কাকুর । তাই মৃন্ময়ীর বাবার বিনাভাড়ায় থাকার প্রস্তাবেও খুশি নয় এ এস আইযদিও মৃন্ময়ীর দেওয়া সমাধানসূত্র মেনে নেয় । মৃন্ময়ী বলে,

--- তুমি আমার কাকু । তুমি না বললে না, ওর সঙ্গে কথাই বলব না । তবে এককাজ করতে পার, তুমার ডাণ্ডা দিয়ে দুঘা বসিয়ে দাও না । পুলিশের মার খেয়ে টাইট হয়ে যাবে ।

কাকু বলে,

--- ছিছি, দুদিন পরে জামাই হবে লরা, আমি মারব ডাণ্ডার বাড়ি ?

--- তাহলে এক রাত লকআপে আটকে রেখে দাও ।

কাকু ভাতিজি মিলে খুব হাসাহাসি করে ।

তবে এটাও তো ঠিক, বরঠাকুর কাকুকে পাত্তাও দেয় না দীপনারায়ণ । মৃন্ময়ীকে বলে,

--- চাকরিটা হয়ে গেলে একটা প্রণাম করে নেব তোমার কাকুকে ।

--- কেন ?

--- বারে, পুলিশ ভেরিফিকেশনে আছে না বাগড়া দিলে গেল ।

পদার্থবিদ্যার গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার পরপরই দীপনারায়ণ অধ্যাপকের চাকরি পেয়ে যায় ডিব্রুগড়ে । ডিব্রুগড় শান্তিপাড়ায় বেশ বড় সড় বাড়িও ভাড়াতে নেয় । ফিরে এসে বরঠাকুর কাকুর মান ভাঙাতে ধুতিপাঞ্জাবি উপহার দেয় । প্রণাম পেয়ে কাকু ফিক করে হাসে । বলে,

--- ধুর । আমি কী বুড়ো ? তা ভাল, ধুনিয়া । মাঝেমাঝে পরব বিয়াশাদিতে ।

কাকু খুশি হয়ে দীপনারায়ণকে উপদেশ দেয় । বলে,

--- চৌকিডিঙিতে ভাল বাড়ি পেতে সস্তায়, সম্ভ্রান্ত মানুষের বাস । আমরাও থাকি ।

পরে কাকুই বলে,

--- না দরকার নেই । ভালই করেছ, অসমিয়া বাঙালি হলে আর রক্ষা নেই । এর  থেকে ভাল  শান্তিপাড়া । সব বাঙালি ।

মৃন্ময়ী ওসব দেখে নি, জানেও না অসমিয়া বাঙালি হলে কী হয় । বলে,

--- কী হয় কাকু অসমিয়া বাঙালি হলে ?

--- রায়ট হয়। খুনাখুনি হয়চৌকিডিঙ্গি বাসস্ট্যান্ডে একবার বাঙালি মারতে গিয়ে কনফিউসড হয়ে যায় অসমিয়া ছোকরারা । একই রকম তো দেখতে, অহোমরা একটু অন্য রকম, চোখ ছোটো ছোটো, তির্যক চক্ষু, খুব ফর্সাতাই রাজহুয়া ঠাইত বোমাটোমা মারে না

--- তাহলে তো নো প্রবলেমবুঝাই যখন যায় না ।

-- নহয় মাইকিজনি । উপায় আছে। বাস থেকে নামিয়ে দশকিয়া বলতে বললেই ধরা পড়ে যায়, এক দুই তিন বললেই মার

--- কেন ?

--- অসমিয়া তিন নয়, বলে তিনি, চার নয়, বলে চারি । অনেকে চারি পর্যন্ত বলে পাঁচে গিয়ে আটকে যায় । বলে পাঁচি । পাঁচ পাঁচই । আমাদের মহন্ত বাবু প্রমোশন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় সব শিখিয়ে দিয়েছি । বলেছি বাবা বলবেন না বলবেন দেউতা, বলেছি পান তাম্বুল দিলে না করবেন না ।

পুলিশ কাকুর অনুমতি নিয়ে বিয়েটাও হয়ে যায় শুভে শুভে । এবং দীপনারায়ণও শিলচর থেকে ডিব্রুগড়ে এক অভিনব হনিমুনে বেরোয় চাচাবাহনে । চারদিনের ভ্রমণ, প্রথম দিন হাফলং দ্বিতীয় দিন ডিমাপুর তৃতীয় দিন কাজিরাঙ্গা, চতুর্থ দিন শিবসাগর পঞ্চমদিন সকালে শান্তিপাড়া চাচা মানে হজার সিসির পালসার । বাইকের নম্বরটাও খুব মজাদার, এ এস এগারোর পর তিন নয় চার চার । শেষ চার চার এর সংক্ষিপ্ত রূপই চাচা । দীপনারায়ণ যতই গাড়ির নাম দিক চাচা । কিন্তু পরিচর্যা করে পুত্রস্নেহে । বলে জিও মেরে লাল । মৃন্ময়ীর পছন্দ নয় দুচাকা, বলে,

--- আমি চাকরি পেলে চার চাকা কিনব ।

দীপনারায়ণ বলে,

--- চার চাকায় এমন অপরিসীম শক্তি আর সৌন্দর্য পাবে না । একদম বাঘের বাচ্চা আমার চাচা ।

   বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার জন্য নামডাফার অভয়ারণ্য দিয়ে চালিয়েছে চাচা, সওয়ারি দুজন । মৃন্ময়ীকে বলে দুর্গম পথের কথা হিংস্র ভালুকের কথা । চাচা পালসারের ভটভট শব্দে বন্যজন্তুর দেখা না মিললেও ওরা পড়েছিল শিলাবৃষ্টির কবলে, কী বিশাল সাইজের সাদা বরফের টুকরো ।  ডিহিং নদীর পাশ দিয়ে তো দারুণ চলছিল যাত্রা, আশি নব্বুই শো । সামনেই চাংলাং ফরেস্ট লজ্‌, লজের পাশেই তাপসীর ফরেস্টার বরের কোয়ার্টার । কিন্তু শিলাবৃষ্টির বিভ্রাট থেকে যে কী করে উদ্ধার পাবে ভাবার অবকাশও মেলেনি, এক মিনিটে কালো পথ সাদা, কয়েক কুইন্টল সাদা পাথর । ভাগ্যিস একটা ছাদওলা পাহাড়ের খাঁজে আশ্রয় নিয়েছিল ওরা । না হলে যে কী হতো, চাচা তো ভাঙতই, ওরাই কী আস্ত থাকত । মৃন্ময়ীও  কিন্তু জেনে বুঝে সঙ্গ নিয়েছে অনিশ্চয়ের । মিনিটে যেমন জমেছে শিলা, মিনিটেই সাফ, ডিহিং এর বুকে তোলপাড় তুলে রাস্তা পরিষ্কার আবার, বাঘ ভালুক না মেলার আফশোসের কথা বলতেই দেখা হল এক আহত সিংহের ।

কিবিক্রমরে বাবা, সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত, তবু ফুঁসছে । কুড়ি পঁচিশ বছরের যুবক পিলিয়া, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সোজা ফরেস্টারের বাংলোয় । বাঁশ কাটতে গিয়ে বন্যজন্তুর আক্রমণে আহত । বলতে পারে না কী পশু, বাঘ না ভালুক, তবে লড়াই যে করেছে সে বুঝা যাচ্ছে, জন্তুটাকে যে মারতে পারে নি সেই রাগে ফুঁসছে । মৃন্ময়ীর বান্ধবী তাপসী কিছু বুঝে কিছু না বুঝে অনুবাদ করে জানিয়েছে ওদের । দীপনারায়ণ বুঝেছে ছেলেটি হাসপাতালে যাবে না, গাছপাতার রসকস লাগাবে এবং মরবে । বন্যজন্তুর আক্রমণে আহত হওয়া কিংবা মারা যাওয়ার ঘটনা অরণ্যে কিছু নতুন নয় । দীপনারায়ণ জানে হাসপাতালে নিয়ে গেলে লোকটি বেঁচেও যেতে পারে । কিন্তু কী করে । তাপসীর বর বলে ফরেস্টের জিপ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে । দীপ মৃন্ময়ীর দিকে তাকায় এবং বলে,

--- উপায় আছে । আছে আমার চাচা ।

সময় নষ্ট না করে বলে টাটা । মৃন্ময়ী আর তার মাঝখানে উঠিয়ে নেয় প্রায় মুমুর্ষু পিলিয়াকে । একঘণ্টায় নিয়ে আসে মার্ঘেরিটা হাসপাতাল । ওখানের সর্ব রোগের বিশেষজ্ঞ বাঁধাছাদা করে বলে মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে । কী দুরন্ত সাহস তার, সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে মরণাপন্ন রোগীর সাথে পাঠিয়ে দেয় অ্যাম্বুলেন্সে, সে পিছন পিছন যায় ডিব্রুগড় মেডিকেলে । ভর্তি করিয়ে ফেরে রাত বারোটায়, পরদিন তাপসীরা চলে আসে ,  অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া দিলে নেয়, বলে,

--- আমার ডিউটি শেষ ।

ভুলে যায় পিলিয়ার কথা । মৃন্ময়ী বলে,

--- কী হল যাবে না ?

--- না, আমার আর কোনো ভূমিকা নেই, এখন শুধু প্রশংসা কুড়নো । ওসবে দরকার নেই ।

তবে না গিয়ে পারে নি দীপ, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে তো পিলিয়ার, রক্ত চাই ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত পেতে হলে ডোনার চাই নইলে হাজার টাকা । তাই ভলাণ্টারি ব্লাড ডোনার্স এসোসিয়েশনের আশুদাকে বলতেই কাজ হয় । টাকা পয়সা লাগে না ।

বিয়ের পরপর স্বামীজীবনের এসব রোমাঞ্চকর ট্রেইলার দেখে মৃন্ময়ীর বেশ মজাই লাগে পিলিয়া কাণ্ড শেষ হতে না হতেই অন্যকাণ্ড । ডিব্রুগড় আসার একমাসের মধ্যেই দীপনারায়ণের মাসের বেতন পকেটমার হয়ে যায় । মৃন্ময়ী বলে,

--- থানায় যাও, এফআইআর কর

দীপনারায়ণ বলে,

--- ধুর পুলিশকে বললেই কী টাকা ফেরৎ আসবে ? পকেটমার সাধু যুধিষ্টির হয়ে দিয়ে যাবে ? এরচে’ এক কাজ করো না ?

--- বলো ?

--- তোমার পুলিশ কাকুকে বল কিছু টাকা আরটিজিএস করে দিতে ।

মৃন্ময়ী বলে,

--- কাকু কেন ? বাবাকে বলতে পারি

শ্বশুর কিংবা নিজের বাবাকে বলে টাকা নেওয়ায় দীপের ঘোর আপত্তি । বলে,

--- কাকুর তো যথেষ্ট উপরি পাওনা । তার থেকে নয় কিছু গেল কিঞ্চিৎসামান্য ।

 কাকুকে জানাতেই পাঠিয়ে দেয় টাকা এনইএফটিতে । তবে মৃন্ময়ী বলে দেয় পরের মাস থেকে মাইনের দিন সে যাবে দীপনারায়ণের সঙ্গে । দীপের তাতে কোন আপত্তি নেই ।

শিলচর থাকতে চালডালের দোকানের নাম ছিল ভূষিমালের দোকান ডিব্রুগড়ে হয়ে গেল গালামাল । পিন্টুর দোকানে খাতায় লিস্টি দিয়ে দিলেই হল, মাসের বাজার পৌঁছে যায় বাড়িতে । এরপরে যা যা লাগে তাও খাতায় লিখে নিয়ে আসা যায়, মাসকাবাবে হিসেব বরাবর । দুমাসের মাথায় সেখানেও গরমিল হতে শুরু করে । মৃন্ময়ীর সন্দেহ হয় পিন্টুর উপর । দীপ বলে,

--- না না পিন্টু ছেলেটি ভাল ।

--- ভাল হলে দুদিন পরপর দুপ্যাকেট করে ভৌতিক ক্যাডবেরি ? সন্দেহজনক । চকলেট তো বাড়িতে আসে না । এবার থেকে নগদে খাব ।

দীপের আপত্তি নেই ভবিষ্যৎ নিয়ে । সে জানে টানাটানির সংসারে বললেই সব হয় না । পরের মাসেও খাতা বহাল থাকে । এবার পিন্টু ভুল করে পাঁচলিটার সর্ষের তেলের বদলে দিয়ে দেয় অলিভ অয়েল তিন হাজার টাকার দীপকে বলে,

--- ফেরৎ দিয়ে এসো ।

ফেরৎ দেওয়াতেও কমে না মাসকাবারি খরচ । দীপনারায়ণকে বলে কিছু হওয়ার নয় জেনে পিন্টুকেই বলে । পিন্টু চুপ করে থাকে, দীপের সঙ্গে চোখাচোখি করে । বাড়ি ফিরে মৃন্ময়ী বলে,

--- বলতো, অলিভ অয়েল এর কেসটা কী ? তেলটা ফেরৎ দাওনি, হারিয়ে ফেলেছ ?

জেরার মুখে ভেঙে পড়ে দীপনারায়ণ অধ্যাপক । বলে,

---  হ্যাঁ । হারিয়ে ফেলেছি ।

মৃন্ময়ী বলে,

--- বাড়ির সামনেই তো দোকান, কী করে হারালে ? এতো ভুলোমন হলে হয় ।

দীপ বলে,

--- না, হারাই নি, পিন্টুকে দিয়েছি তো ।

--- দিয়েছ ? বেশ । তবে পিন্টু না করল কেন ? চোখাচোখি কেন ?

--- তাহলে আবার কী, বেচে দিয়েছি ।

--- কাকে ?

--- পিন্টুকে । বললাম খাতা কাটাকুটি করে কী লাভ ক্যাশ দিয়ে দাও ।

--- টাকাটা কোথায় গেল ?

--- গোবিন্দ গগৈর গেস কানেকশনটা হয়ে গেল ।

--- কোন গোবিন্দ গগৈ ? ক্যান্টিন বয় ?

--- ইয়েস ম্যাডাম ।

--- বেটা তো নচ্ছার, কর্মচারি পরিষদ করে, বাঙালি দেখতে পারে না ।

--- না না । ছেলেটি ওরকম নয় । কর্মচারি পরিষদ করলে যদি চাকরিটা স্থায়ী হয় মন্দ কী ? গোবিন্দ যখন খেতে দেয় দুপুরে তখন কিন্তু বাঙালি অসমিয়া দেখে না । মমতায় খাওয়ায়

একটার সূত্র যখন পাওয়া গেছে মৃন্ময়ী অন্যটাও হাতছাড়া করতে চায় না । বলে,

--- এবার বলো দুটো ক্যাডবেরি রহস্য ?

--- না না ওসব পিন্টুর ভুল ।

--- ভুল তো ? বলব তাহলে ?

--- আরে না , মমতা খায়, দিয়েছি ।

--- মমতা ?

--- দারোয়ানের মেয়ে । মদনদার ।

--- ঐ বিহারী লোকটা ? একটা মেয়ে দেখেছি, ডাকে মম্‌তা ।

                  ---ওই ওইআমরা বলি মমতা । আমাদের মেয়ে হলে দিতে না বলো ?

অকাট্য যুক্তি । মৃন্ময়ী বলে,

--- তা বলে দুটো করে ?

--- বলল ওর দাদা আছে ।

--- ছি ছি । আমি পিন্টুটাকে দোষ দিচ্ছি খামোকা ।

--- দিলে কিছু হয় না, দিলে বাড়ে । তুমিও তো দাও ।

--- আমি দিই না । এমনিতেই ঘর চলে না । টাকা ধার করতে হয় ।

--- ধার কোথায় । কাকুর টাকা ধার নয়, ফেরৎ দেব না । ঘুষের টাকা সৎপথে গেল কাকুর পুণ্যি হল ।

--- মানে ? তোমার পকেট মার হয় নি ?

--- হয়েছে । আলবৎ হয়েছে । চলো দেখিয়ে আনব কোন জায়গায় হয়েছে ।

--- পকেটমার কোন জায়গায় হয়েছে ধরা যায় নাকি ? ও তো অজান্তে যায় ।

--- তাই গেছে । তুমিও তো রেবতীকে এটা ওটা দাও ।

--- দিই ,  তুমি এবেলার খাবার অন্য বেলা খাও না তাই । থাকলে দিই, ফেলব নাকি ?

--- তাওতো কথা । আর শাড়ি বেডকভার ? 

--- গরিব মানুষ, বলে পুরনো থাকলে দিতে । দিয়েছি ।

--- বিয়ের দুমাসেই পুরনো ?

দীপনারায়ণ এরপর জ্ঞানের কথা বলেছে । বলেছে,

--- উপকার করলে ভাল লাগে । লাগে না বলো । তুমি রেবতীকে দাও, যা চায় দিও । টাকা না থাকলে বরঠাকুর কাকুর কাছ থেকে আনিয়ে নেব আবার ।

শনিবার হলেই শুরু হয় সমাজ সেবার ঠেলা । আশুদার ভলান্টারি ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প, উত্তর লখিমপুরের বন্যাবিধ্বস্তদের কাপড় চোপড় বাক্স বাজিয়ে চাঁদা তোলা । যখন ভাটা থাকে তখন বিকেলে রানিসতি গলিতে পকোড়া খেতে যায় মৃন্ময়ীকে নিয়ে । ব্রহ্মপুত্র বাঁধের পারে বটগাছের নীচে কচুরির দোকানে হামলে পড়ে । মাসের প্রথম দিকে চৌকিডিঙির চরাইদেউ রেস্টুরেন্টের রাজসিক ভোজ । আর একটু সখ হলে তিনসুকিয়ার ডেইলি বাজারে দাদা বৌদির হোটেলে চিতলের পেটি । আসলে ওখানে সুশান্তদার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার একটা কাজ । এবার দীপনারায়ণ বলে,

--- আর ডেইলি বাজার নয় । এবার চলো হিজুগুড়ি । একটা নতুন খাবারের ঠেক হয়েছে, কাকুর খার । মালিক ছেলেটি খুব ভাল, দেখবে খাতির করে খাওয়ায় ভাইটি ।

--- কী নাম বললে ? ভাইটি ?

--- হেমন্ত হাজরিকা ।

--- অসমিয়া ? তোমার খুব পীরিত হয়েছে আজকাল । আমি খাব না, খারমার খাই না, ছে ।

--- আরে বাবা চলোই না, খার পাবে শাক পাচলি পাবে মাছও পাবে । টেকেলি দই পাবে শেষপাতেঅসমিয়া খাবার কিন্তু খুব উপাদেয় । হেমন্ত আর ওর বউ মাইনি দুজনে মিলে চালায় আগে ঠেলা গাড়িতে চাউমিন বিক্রি করত । আমরা তিনজন মিলে টাকা দিয়েছি হোটেল করার জন্য ।

--- কত টাকা ?

--- একলাখ । সুশান্তদা আশুদাই দিয়েছে বেশি । সবাই একমাসের বেতন দিয়েছি । ভাইটি বলেছে ফেরৎ দেবে । ধুর কেনেবে ফেরতের টাকা ।

 

(৩)

 

বকুলচন্দ্র ব্যবর্তার বয়স হয়েছে, এখন আর কাজে যায় না । বিমানবন্দরে যাত্রী মাল টানাটানির কাজ আর পোষায় না । যদিও এখন ট্রলি হয়ে খুব সুবিধা হয়ে গেছে । তবু ছেলে ছোকরাদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে খদ্দের ধরলেও মাল নামানোয় কষ্ট হয়, পারে না । একমাত্র ছেলে পুরুষচন্দ্রকে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর জায়গায় । দুপয়সা আয় হয় । এরোপ্ল্যানের যাত্রীরা সবসময়ই একটু কিপটে টাইপের বেশি দেয় না । মাঝেমাঝে দুএকজন যে অ্যাক্সট্রা দশটাকার নোট দেয় না তাও না । এক্সরে থেকে চেকইনে পৌঁছে দিলে দেয় । বকুলের প্রথম জীবনের কিছু বাধা খদ্দের ছিল, কেউ কেউ এখনও যায়, বলে দিয়েছে পুরুষ ওর ছেলে । বকুল এখনও বিমানবন্দরের কাজের কথা ভেবে মন ভাল করে । মন্দ ছিল না কুলিগিরি, ফিটফাট বাবুদের হয়ে কাজকরায় একটা ফুটুনি ছিল এখন এই লাহোয়াল পাকাপুলের উপর একাএকা বসে থাকে সকাল সন্ধ্যে, গ্রামের ছোকরাদের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দেয় সময়ছেলেপিলেরা যে তাকে খুব মান্য করে তা নয়, তবে ঝামেলা জোর পেকে গেলে ওকে সালিসি মানে । বলা আছে ওদের কথামতো হা তে হা মেলাতে । পাড়ার ছেলেরা প্রায় সারাবছরই ব্যাস্ত থাকে সড়ক ধরায় । দুর্গা পুজা বিহু সরস্বতী পূজাআর দু’একঘর যে মুসলমান আছে তাদেরও ধরে এনে ইদ মহরম বড়দিনের জন্য চাঁদা তোলে । ওদের বিভিন্ন রকমের কর্মকাণ্ড, দড়ি দিয়ে পথ আটকে চাঁদার রসিদ ধরিয়ে দেয় । টেটিয়া কেউ দড়ি ছিড়ে বেরিয়ে গেলে গালাগাল দেয় । যারা থামিয়ে দেয় ওরা মুর্গা । মুরগিও ছুড়ে দেয় গাড়ির সামনে, মৃতমুরগির জন্য পাঁচশ থেকে শুরু হয় টানাটানি, তিনশ’য় রফা । কুকুরও ছোঁড়ে, কেঁউ কেঁউ করলেই বলে ঠেং ভেঙেছে, চারশ টাকা । বকুল বলে,

--- এসব করিস কেন ? কাজকর্ম কর না কিছু ।

ওরা বকুলকে অবজ্ঞা করে । বলে,

--- শেয়ার তো পাও ।

দেয় ওকে দুপাঁচ টাকা, বিড়ি কিনে খায় । বকুলের বাড়ি কালভার্টের উল্টোদিকে, ধানখেত পেরিয়ে অনেকটা ভিতরে সে নিজের পরিচয় জানে না ঠিকঠাক, সে যে বাঙালি ছিল এককালে ভুলে গেছে । ছেলেদের রাজত্ব দেখে তার যে খুব খারাপ লাগে তা নয়, আয় তো হয় । তাই সে পাকাপুলের রাজা হয়ে যায় অনেকসময় । রাজপথ যেন তার দখলে, সে বৃদ্ধ রাজা । হেলেদুলে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটে । হাঁটতে গিয়েই তো কাণ্ডটা ঘটল । একটা বাইক প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল, ছিটকে যেতে পারত । কিছুই হয় নি । বাইকটাই গিয়ে উল্টে পড়ল ধানখেতে দুজন আরোহী সমেত । ভ্যাবাচ্যাকা বকুল ব্যবর্তার কিন্তু রক্ষা হল না, একটা ম্যাটাডোর এসে মেরে দিয়ে গেল । ওপার থেকে বুড়ো ধরণী শর্মা হেই হেই করে উঠল,

--- বকুলদা, বকুলদা ।

বকুলের বন্ধু ধরণী শর্মাও পুলের উপর বসছে আজকাল । ডিব্রুগড়ের মিলনী মেস উঠে যাওয়ায় মেয়ের বাড়ি ফিরে এসে এখন নাতি নাতনির দেখাশুনা করে কাটিয়ে দেয় সময় । আর সকাল বিকাল দুবেলা অসমিয়া রান্নায় খার আর বাঙালি রান্নায় সুক্তো এই দুই আইটেমের মুণ্ডপাত করে বকুল ব্যবর্তার সঙ্গে । আবার দুজনেই বলে, দুটো আইটেমই ভাল, স্বাস্থ্যকর । সঙ্গে বাঙালি অসমিয়া মাড়োয়াড়ি বিমান যাত্রীর পকেট নিয়ে মতবিনিময়েও কেটে যায় অবসর কালীন আড্ডা ।

    বকুল ব্যবর্তাকে ম্যাটাডোর ধাক্কা মেরে চলে গেল । বাইক আরোহী দুজনও ধানখেতের মাঝখানে কাত হয়ে দেখে নিমেষে ঘটা কাণ্ড কারখানা । বাইক আরোহীর একজন সালোয়ার কামিজ উঠে এসে দেখে নাকে হাত দিয়ে বেঁচে আছে । পুরুষ মানুষটি উঠে এসে ম্যাটাডোরের পিছনে লাগায় দৌড় আর চিৎকারে বলে ধর ধর । কে কাকে ধরে । ওকেই ধরে ফেলে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ধরেই শুরু হয় মার । ধরণী শর্মা ছেলেটিকে অকারণ মার খেতে দেখে ক্ষীণকণ্ঠে কিছু বলতে চায় । সালোয়ার কামিজের যুবতি কিন্তু মেদিনী কাঁপিয়ে চিৎকার করতেই থামে মার । ওর কথা শোনে । মেয়েটি বলে আহত মানুষটিকে মেডিকেল নিয়ে যেতে হবে । ওরা বলে, সে ওরা দেখবে কিন্তু কম্পেনশেসন দিতে হবে বলেই আবার শুরু হয় আরএক দফা মার । বাইক চালকের সঙ্গিনী আবার থামায় ওদের, বিহ্বল ধরণী শর্মা আবার কিছু বলতে চায় । ওরা, দুষ্কৃতির  দল বৃদ্ধকে দূর দূর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় । মেয়েটি বলে,

--- ওকে মারলে কী টাকা বেরোবে, গাড়িটা তো মেরে চলে গেল ।

--- তোমরা মেরেছ, ঐ লোকটা বাইক দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে বকুলকাইকে । এখন টাকা দাও চলে যাও ।

নারী বলে,

--- কিসের টাকা ?

ওরা বলে,

--- গরিবের প্রাণের দাম নেই ? একলাখ দাও, কেস ফয়সালা হয়ে যাবে ।

এদিকে বাইক আরোহীর অবস্থাও সঙ্গিন, সারা শরীরে রক্ত । সালোয়ার কামিজেরও পুরনো রোগ মাথা চাড়া দেয়, রাগ ওঠে নাক বেয়ে চড়চড়িয়ে । বলে,

--- কথা বাড়িয়ে লাভ নেই কেস হোক । একটাকেও ছাড়ব না, সবকটাকে জেলে পুরব । আমার কাকুও পুলিসের লোক ।

দুজন মুমুর্ষু মানুষের সামনে অনেক রকম চাপ হয় । পুলিশ আসে । বলে,

--- পঞ্চাশ দিয়ে মিটিয়ে নিন ।

নারী বলে,

--- না একপয়সাও না ।

ওরা বলে,

--- কিছু দিন ।

--- ভিক্ষে নাকি ? আমি ভিক্ষে দিই না । হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুণ দুজনকে ।

কেস হয় । চালকের ডাক পড়ে । ছমাসে সাতখানা তারিখ পড়ে, সব কিছুতেই বাইক চালক অভিযুক্ত । তার স্ত্রীর নাম নেই অভিযুক্তের তালিকায় । মৃন্ময়ী দীপনারায়ণের বেডের নীচে বসে থাকে দুদিন । দীপনারায়ণ সুস্থ হতেই মৃন্ময়ী দেখে আসে বকুল ব্যবর্তাকে । ওখানেই দেখা ধরণী শর্মার সঙ্গে । ধরণী বুড়ো বলে,

--- জানি আপনি মারেননি বকুলদাকে । তবে দিয়ে দিন না হাজার দশেক, বড় গরিব মানুষ । নিয়মিত উপার্জন নেই কোনোদিন হয় কোনোদিন না । একটু হাবাগোবাও আছে বকুদার ছেলেটি ।

মৃন্ময়ী দীপনারায়ণকে বলে,

--- দিয়ে দেবে ?

--- না । যথেষ্ট হয়েছে পরোপকার । আর নয়

--- তাহলে কী করবে ? আবার গান গাইবে বটগাছের নীচে চার বোতল ভটকা ?

--- তাই করব মদ খেয়ে খরচা করব আমার টাকা । কার কী ?

--- কাকুর খারে যাবে না, শাকপাচালি খেতে । তিনসুকিয়ায় ।

--- যাব । তবে টাকা উশুল করতে । তোমার কাছে মিথ্যে বলেছি পকেটমার টার কিচ্ছু নয় ।

--- জানি তো । এরকম পাগলামি নিয়েই তো আমার গোলা ।

--- না আমি গোলা ফোলা কিছু নই । এক অর্ডিনারি মানুষ । শুধু নিজের জন্য বাঁচব এখন । খাব সব গাণ্ডে পিণ্ডে পিজ্জা খাব স্যাণ্ডউইচ খাব ডনাট খাব পপকর্ন খাব মাল্টিপ্লেক্সে । কাউকে কোনো শেয়ার করব না । শালা অকৃতজ্ঞের জাত ।

--- কারা অকৃতজ্ঞ ? অসমিয়া ?

দীপনারায়ণও তাহলে রাগে । রেগে যায় মৃন্ময়ীর উপর । বলে,

--- আমি বলেছি অসমিয়া ? বলেছি গরিব মানুষ, বলেছি ধান্দাবাজ ?

  দীপনারায়ণ নিজের কথা ঠিকমতো বলতে পারছে না । কিরকম ভুলো মন হয়ে গেছে । সব ভুলে যায় কিন্তু ভুলে না কেস এর দিন যেদিন ডেট থাকে সবার আগে রিক্সা করে পৌঁছে যায় একা একা । মৃন্ময়ী পুলিশের কাছ থেকে বাইক ছাড়িয়ে এনে রেখে দিয়েছে সিঁড়ি ঘরে, দীপনারায়ণের চোখের থেকে দূরে । মৃন্ময়ী মুছামুছি করে, মেকানিক ডেকে এনে স্টার্ট দিয়ে ব্যাটারি চালু রাখে, তেল মবিল ভরিয়ে দেয় । চকোলেটের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মমতা এখন বাড়িতে চলে আসে, মৃন্ময়ী ওকে লুকিয়ে দশটাকা দেয় । দীপনারায়ণের চোখে পড়ে গেলে রাগে । বলে,

--- কেন দিলে ?

 মৃন্ময়ী কিছু বলে না । কারণ আজই তো কোর্টের রায় বেরোবে । দীপের মন খুব অশান্ত । মৃন্ময়ী বলে সেও যাবে । দীপ বলে না । বলে অফিস কামাই করে লাভ নেই । নতুন চাকরি পেয়েছে মৃন্ময়ী, বিগবাজারে সেলস সুপারভাইজার । কাজ নিয়ে খুব খুশি নয় সে, বারোঘণ্টার ডিউটি । মৃন্ময়ীরও মনে উৎকণ্ঠা । বিকেলে ফিরে এসে তো অবাক । চাচা নেই সিঁড়ির নীচে । তবে কী কেস হেরে গেল, হেরে গিয়ে মনো কষ্টে ব্রহ্মপুত্রে বিসর্জন দিতে নিয়ে গেল সাধের বাইক চাচা । কিন্তু উকিল বাবুর কথামতো রায় তো তাদের পক্ষেই যাওয়ার কথা  ধরণী শর্মা দীপনারায়ণকে নির্দোষ বলেছে । সন্ধ্যে সাতটায় ভটভট করে চাচার ডাক কানে বাজে । চাচা ফিরে এলো তবে । চাচার পিঠে নান্টু ঘটকের হাসিমুখ পাত্র । সার্টের বুকপকেটে উঁকি দিচ্ছে ছেড়া ক্যাডবেরি । দীপনারায়ণ স্ত্রীকে বলে,

          ---ছেড়ে দাও চাকরি । 

--- চাকরি ছাড়লে খাবে কী ?

--- আমার চাকরি আছে না ।

--- আর বকুল ব্যবর্তাকে যে আজ এতগুলো টাকা দিয়ে এলে ?

লাগলে তাক না লাগলে তুক, ভেবেই সম্ভাব্য প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় মৃন্ময়ী । আর লেগেও যায় তাক তুক দুটোই । বলে,

--- ছেলেটা হাবাগোবা ঠিকই । বকুলকাই টাকা নিতে চায় নি । ধরণীদা মানুষটা বড় ভাল গো চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা ।

--- সে তো বুঝলাম মাস চলবে কী করে ? মমতার চকলেট ?

--- পিন্টুর খাতা আছে ।

--- তারপর ।

--- পুলিশকাকু আরটিজিএস পাঠাবে ।

--- না । আর ওপথ মাড়ানো চলবে নাকোনো রকম টানামানি করে চালিয়ে দেব । তারপর তো আমারও বেতন । 

*****

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ