মনার বাড়ির ইঁদুর II রণবীর পুরকায়স্থ II

  





কটা ইঁদুরের উপদ্রবে মনার জীবন থেকে পাঁচ পাঁচটি বছর উবে গেল। তছনছ হয়ে গেল সাজানো জীবনের খাটপালঙ্ক আর ড্রেসিংটেবিলের সুগন্ধিতে ভরপুর তার ঘুমঘর। নেংটিহঁদুরের কাণ্ড, কেটে কুটিকুটি করল জীবন। যৌবনের দুর্লভ শেষপর্বের পাঁচটি বছর। তবে ইঁদুর যেদিন পালাল জমাট অন্ধকার রাতে, আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠল আবার তাদের চৌখুপি ঘর। সুখী জীবনের আবর্জনা নিয়ে ভাগলবা ইঁদুর চলে যেতেই আবার নতুন করে সাজল তাদের গেরস্থালি। যদিও ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। অরুণিমার কানের লতির উপর ঝুলে থাকা ঝুরো চুলগুলি একইরকম আছে এখনও। কেউ ধরতেই পারে না পনেরো দিনের ব্যবধানে লাগানো লরিয়েল কলপের ছাপে কানের উপর উড়তে থাকা জয়পতাকাকে আরো মোহকারী করে তুলেছে কিনা। ইঁদুর গল্পের ফিকে রহস্যের রঙ ঢাকতেই কলমকারির কারুকাজ পাঁচ বছর আগের কালো চুলের ডাকসাইটে মফসসল সুন্দরীর। মান্তু যে বলত আমার মাসি সুচিত্রা সেন।

মান্তু হল নেংটিইদুর। তেল কোম্পানির পনেরো দিন আরবসাগরে পনের দিন ছুটি, একমাসে আয় দুমাসের। রুনার মাসতুতো বোন শিখাদির ছেলে। নতুন বিয়ের ভাড়াবাড়ির পাশের বাড়ির বোনপোশালিবাহন জামাই বাবুও তখন টগবগে যুবক। তিনসুকিয়া উওম্যানস কলেজের অধ্যাপক। গৌহাট থেকে বদলি হয়ে আসা আবগারি আধিকারিক ভায়রা ভাইকে বললেন এসো পাশাপাশি থাকি। তখন আর কত বয়স নেংটি ইঁদুরেরে, সাত আট বছর থেকে ন্যাওটা হয়ে আছে মাসির। বয়স বাড়তে বাড়তে মাসির বোনপোর সাত আটের সঙ্গে কম করেও বছর পঁচিশেক যোগ হয়েছে। বাইশ বছরের মাসিও তো দিনে দিনে হয়েছে আগুনবর্ণা রুপসী। মাঝবয়সে পৌঁছেও পেটানো শরীরের মনোহর আইচ মান্তু আড়ে বহরে বাড়লেও দৈর্ঘে রয়ে গেল যে কে সেই, পাঁচফুট তিন ইঞ্চি। তবে মান্তুর তাকে অনেক টাকা বিয়ে করা আটকাত না। কিন্তু বেঁটে মানুষের এক গোঁ, মাসির মতো সুন্দরী পেলেই বিয়ে করবে। সুন্দরী অনেক পাওয়া যায়, কেউই যে রুণা মাসির মতো হয় না জেরক্স কপি। অবস্থা বেগতিক দেখে মান্তুর মা শিখাদি এসে কাতর মিনতি করে,

--– তুই ওকে রাজি না করালে আইবুড়া থেকে যাবে রে। ওর ছোটটাকেও তো বিয়ে দিতে হবে?

রুণা হাসে। বড় রহস্যময় সে হাসি।

রুণা মান্তুকে নিয়ে বেড়াতে যায় বছরের শেষ দিনে। মান্তু যে নতন ইনোভা গাড়ির চাবি মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে বলে,

--– চলো, কামাখ্যায় পূজো দিয়ে আসি।

--- কামাখ্যা? এত দূর যেতে পারব না রে।

--- পারব না বললে হবে না। যেতেই হবে মা। চলো

--- তোর বাবাকে রেখে যেতে পারব না। অন্তুটাও সবে শুরু করেছে।

--- এরচেচল তিলিঙ্গা মন্দিরে ঘন্টা বেঁধে আসি।

বড়ডুবি তো যখন তখন যাওয়া যায়। কামাখ্যা যাব বলে কিনলাম বড় গাড়ি?

মান্তুর ছোটভাই অন্তুর পড়াশুনা হয় নি। পাড়ায় মাস্তানি করতে করতে এখন রাজনীতি করে। মান্তুর টাকায় রাঙাগড়া রোডে চপ কাটলেট বিরিয়ানির দোকান খুলেছে সবেমাত্র। মায়ের যুক্তিপূর্ণ বাধাকে বাধা মানে না মান্তু। বলে

--- সবাইকে নিয়ে যাব বাবাও যাবে, অন্তুও যাবে।

--- বাবাও যাবে! ও হার্টের রোগীকে নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না, তুই বরং রুনাকে নিয়ে চলে যা।

--- মাসি? যাবো

--- যা না।

মায়ের অভয়বাক্যে মাসিও রাজি।

একটানা গাড়ি চালানোর ধকল কমাতে তিনসুকিয়া গৌহাটির মাঝখানে একটা যাত্রা বিরতির ব্যবস্থা থাকে কাজিরাঙায়। অরণ্যবাড়ির দুটো ঘর নেওয়া হয় পাশাপাশি। রুণা মান্তুকে বলে,

--- তিন বেডেরটা নিয়ে নে মান্তু, একসঙ্গে থাকা যাবে।

--- তিন বেডেরটা স্যুইট, নিয়ে নিই মাসি?

ডিসেম্বরের শেষ দিন, ঠাণ্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। কেতাদুরস্ত অতিথিশালার ড্রইংরুমটিও মস্ত, ফায়ার প্লেস আছে, ওম হয় বেশ। রুণা খুশিতে টগবগ হয়ে মনার কাঁধে ঝাকুনি দেয়, জড়িয়ে ধরে না। মান্তু বাথরুমে আছে, যে কোন সময়ে বেরোতে পারে তাই সতর্কতা। স্বামীকে বলে,

--- খাবে?

রুণা হাসে রহস্যময়ী, ঠাণ্ডা লাগার ভান করে দুহাতে দুহাত ঘষে। মনা অবাক হয়ে রুনাকে দেখে। বলে,

--- কী ?

একটু বিরস কণ্ঠস্বর। বুঝেও না বুঝার ভান। হবে না কেন, এরকম একটা রোমান্টিক হওয়ার সুযোগ নষ্ট করে দিলে কার মুড ভাল থাকে। ভালই। দুদুটো রুম, একটু জড়াজড়ি করে শোয়া যেত জঙ্গুলে পরিবেশে। এখন শুয়ে ঘুমাও তিনজনে এক বেঁটে হাড়ের টুকরো নিয়ে। রুণা ওসব খেয়ালই করে না। বলে,

--– আরে বাবা লাউপানি।

--- সে তো মদ? খাবে তুমি মান্তুর সামনে?

--- সামনে কেন? ওইতো বলল ওর কাছে আছে কয়েক বোতলওরা খায়। মান্তু মদ খায়? এই তোমার ভাল ছেলে?

--– চুপ চুপ চুপ শুনতে পাবে। ওসব মদ নয়, নেশা হয় না, কোল্ড ড্রিংকসের মতো

--কোল্ড ড্রিংকস?

--- হ্যাঁ, মাত্র ছয় পার্সেন্ট। কোরেক্সে থাকে বারোযত সব ব্যাক ডেটেড পাবলিক।

--- বা, বেশ তো জানা আছে মদের আপডেট।

--- জানি তো মাজুলির একটা মেয়ে। পাঞ্জাবি, মুন্ডা

--- মেয়েদের আবার মুন্ডা কী? সবাই সদারণী এক মাথা চুল।

--- হাউ ফানি। ব্যাড জোকস।

--- কেন?

--- কেন আবার কী অনেক মেয়েই এখন বয়কাট রাখে। সেই মেয়েটা গবেষণা করছে। লাউপানিকে বিশিষ্ট পানীয় করে তোলার আর অ্যাণ্ড ডি করছে।

--- লাউপানি রিসার্চ! ইন্টারেস্টিং।

--– বিশ্বাস হচ্ছে না? মেয়েটির টাইটেল বাত্রা। লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট।

--- , তাই ল্যাপটপ ঘাটছিল তোমার কাজিনপুত্র? এরজন্য এত খাটাখাটনি? এসব পুরনো খবর। ইসপ্রিত বাত্রার নাম সবাই জানে। 

--- তাই? কী শয়তান। আমাকে এত জ্ঞান দিলোদেশি মদ খাব না বলে নাক সিটকে ছিলাম তাই।

---এখন নাক ঠিক হয়েছে?

--- হয়েছে। চলো না গো খাই সবাই মিলে। নিউইয়ার এনজয় করি। 

--- না, না, নেভার। মদকে যে নামেই ডাকো মদই থাকে।

--- খেয়ো না যাও। সেলিব্রেশনের মুডটাই নষ্ট করে দিল। উজবুক, পড়ে পড়ে ঘুমাবে শুধু। বুড়ো ভাম একটা।

বারোটায় মনা রাগ করে শুয়ে থেকে শুনেছে ওদের বোতলের ঠোকাঠুকি আর প্রগলভ হাসি। রাত ব বলেছে হ্যাপি নিউ নিয়ার। নতুন বছরে মান্তু মাসিকে চুপিচুপি বলেছে,

--– সিগারেট খাবে মাসি?

--– তুই খাস?

--- না না, তুমি খেলে দুটান দেব।

--- পাবি কোথায়?

--- সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি তোমার জন্য।  

--- তবে রে ছেলে, তুমি খাও না, না?

--- সিগারেট খাওয়ার আগে রুণা একবার উঠে যায়। বলে গরম লাগছে। আসলে মনা ঘুমিয়ে পড়ল কী না দেখে আসা। নিশ্চিন্ত হয়ে শাড়িটা পাল্টায়, মনার কিনে দেওয়া গোলাপি নাইটিটা পরে, গায়ে চাপায় কাশ্মিরী শাল, মান্তু এনেছিল দিল্লী থেকে। নতুন সাজে বেরিয়ে আসতেই মান্তুর চোখে বিষ্ময়। বলে,

--- ওয়াও, মাসি তুমি এত সুন্দর!

বোনপোর মুগ্ধ প্রশংসায় আরো পেখম মেলে রুণা, তর্জনী আর মধ্যমায় চেপে সিগারেট ধরায় পেশাধারী অভিজাত্যে। বাঁ হাতের মান্তু আবার বলে,

--- মাসি একেবারে ইংরেজি সিনেমার হিরোইন এলিজাবেথ টেলর।

 

দুহাজার এক থেকে দুই এ গমন হয় এভাবে কথার আর ধোঁয়ার রহস্যে।

নতুন করে শুরু হয় বছর। রুণার একটা আফসোস থেকে যায়। একটা  বোকাবোকা শখ তার আর মান্তুর। বছরের প্রথমদিন গৌহাটি চিড়িয়াখানায় গণ্ডারকে কাতুকুতু দিয়ে আসা, পরের বছর হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে কিনা দেখার মনোবাসনাদ্বিতীয় ইচ্ছেটায় গণ্ডার মূখ্য নয় মান্তুর, মাসির সঙ্গে আর একবার গৌহাটি ভ্রমনের আনন্দটাই আসল। বেড়ানোর আনন্দে ওরা সব নতুন করে সাজায় ভ্রমনসূচি। গৌহাটি আর স্টপওভার হয় না, কামাখ্যাও যাওয়া হয় না পূজো দিতে। সোজা চলে যায় শিলং আর চেরাপুঞ্জি। মাসি বোনপোর যে তখন খুশির জোয়ারে ভাসছে। রুণা কখনও সামনে বসে মান্তুকে চিপস খাওয়ায়, কখনও নংপো থেকে কেনা কমলার কোয়া। পিছনে এসে মনার পাশেও বসে। বলে,

--- দেখো, মান্তুটা কেমন গাড়ি চালায় সুদলি। হেয়ারপিন ব্যাণ্ডগুলো পর্যন্ত কাটিয়ে এলো অবলীলায়। আমি তাকে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছি, এই হয়তো কলিশন হলো

মনাও প্রশংসা করে। বলে,

--- ভাল চালিয়েছে। তবে স্পীডটা কম করা দরকার।

রুণার পছন্দ হয় না তার বিপরীত মন্তব্য। রুষ্ট হয়েই বলে,

--– পিছনে বসে সবাই জ্ঞান দিতে পারে। গাড়িটা চালাতে জানলে ওর একটু রেস্ট হতোসামনে থেকে মাসির প্রশংসা এবং মেশোকে ভৎসনায় বিব্রত হওয়ার ভান করে মান্তু। বলে,

 

--- না মেশো, গাড়ি চালাতে আমার মোটেই কষ্ট হয় না। মাসি পাশে থাকলে তাকে কথাই নেই। মাসি চলো না আমরা দূরে কোথাও ঘুরে আসি। মুম্বাই গোয়াযাবে মেশো?

রাগে অগ্নিশর্মা মেশো কোন জবাব দেওয়ার অগে রুণামাসি উচ্ছাসিত খুশিতে বলে,

--- এই গাড়িতে করে? পারবি? চল।

মনা ভাবে ব্যাপারটা কী। সে বুড়ো হয়ে গেল। রুণা আর তার বয়সের ফারাকটা একটু বেশি, পাঁচ ছবছরটা আর এমন কী ব্যবধান। তবে কেন ওর সঙ্গে উচ্ছল হতে পারে না রুণা, যেমন হয় মান্তুর সঙ্গে। বারো বছরের ছোট এক বামন অবতারের সঙ্গে। কুড়ি বছরের বিয়ের স্ত্রী কী তার সম্পর্কে কিছুই জানে না, ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পর্যন্ত দেখেনি। নাকি দেখলেও বিস্বাস করে নি। ড্রাইভার চালায় বলে অফিসের গড়ির স্টিয়ারিং এ হাত দেয় না সে।

রুণা সব কথা তার সঙ্গে শেয়ারও করে না। মামুলি হজমের গণ্ডগোলে পেটব্যাথা হলেও মান্তুকে জানায়। বলে,

--- চল মান্তু ডিব্ৰুগড়।

মেডিকেলের ডাক্তার বলে অ্যাণ্ডোস্কোপি করতে হবে কলনোস্কপি করতে হবে। মান্ত রাজি হয় না। বলে,

--- সব ফালতু। এরা কিছুই জানে না। এই টেস্ট ওই টেস্ট করে পয়সা মারার ধান্দা। ফুলবডি করিয়ে আনব মাসি, চলো চেন্নাই।

যা বলা সেই কাজ। ভুলে যায় সব পূর্ব পরিকল্পনা, গোয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত কথা। প্লেনের টিকিট কেটে আনে দুটো, মেশোর সঙ্গে পরামর্শও করে না কিছুই বলে না।

ওরা চলে যায় চেন্নাই। গ্রিমস রোডের হোটেলে রান্নাঘর দেখে খুশি রুণা। দুজেন মিলে কাতলা মাছের টুকরো কিনে আনে, মুশুর ডাল আলু পেঁয়াজ তেল হলুদ লঙ্কা নুন পাঁচ ফোড়ন। দীপ ওদের ছেলে, ডেন্টাল কলেজ থেকে চলে আসে রাতের ভোজ খেয়ে চলেও যায় হোস্টেলে। ফেরার পথে বাবাকে টেলিফোন করে পিসিও থেকে,

--- বাবা, তুমি মাকে ঐ বাটকুল লোকটার সঙ্গে পাঠিয়েছ কেন?

--- কেন আবার কী ? ও তেমার দাদা।

--- দাদা না ছাই। মা কি ওর প্রপার্টি? সব সময় জুড়ে আছে গায়ে গায়ে। 

মনা বলে,

--- হুঁ।

দীপের সঙ্গে কথা শেষ করেই মনা হোটেলের টেলিফোনে রুণাকে বলে, দীপের অ্যাকাউন্টে টাকা আছে। যতটাকা লাগুক। টিকিট কেটে ওকে নিয়ে চলে এসো কাল।

--- আর মান্তু?

--- আমি তোমাকে আসতে বলেছি দীপের সঙ্গে। ব্যস।

--- মান্তু আমার বোনপো, ও আমাকে নিয়ে এসেছে।

--- কাকে বলে নিয়ে গেছে? আমি তোমার স্বামী, বলেছে? আমি তোমার ট্রিটম্যান্ট করাতে পারি না? মাদ্রাজ নিয়ে যেতে পারি না?

--- আমি ওর সঙ্গেই ফিরব ফাইনেল চেকআপ করিয়ে

--- তা হলে বেছে নাও কী করবে?

--- মানে? দাঁড়াও দাঁড়াও। এখানই ফয়সালা হয়ে যাক। এই মান্তু শোন, তুই পারবি না আমায় সারাজীবন তোর কাছে রাখতে?

মনা ফোন রেখে দেয়

রুণা যথারীতি ফেরে মান্তুর সঙ্গে। মান্তু মাথা নুইয়ে দাঁড়ায় মনার সামনে। টুক করে একটা প্রণাম করে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঝরঝর করে কেঁদেও ফেলে। মনা রুণার দিকে না তাকিয়ে বলে,

--- কুমীরের চোখে সব সময় জল থাকে।

ইঁদুর বলতে কুমীর বলে ফেলে মনা। কুমীর তো থাকে জলে। তাদের বিছানা ঘরের ডাঙ্গায় এখন এক নেংটির ভুলকি বারবারবিয়ের পর থেকেই অতিষ্ট করে তুলেছে তাকে। সেই চ্যাংডা বয়স থেকে। কিন্তু ইঁদুরের চোখের জলে ভোলে রুণা। টপটপ করে জল ঝরে তার চোখ থেকে অগ্নিবর্ষী। বলে,

--- ছেলেটা প্রণাম করল, কাঁদল তাও লোকটার কিছু হল না, এমন নিষ্ঠুর। বলে কিনা কুমীরের কান্না।

সেই শুরু। কথা বন্ধ হয়ে গেল।

অভিমান আর অবিশ্বাস গা জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে রুণা মনার বিছানাঘরে। নীরব কাটাকুটি চলে তাদের সংসারে। রাতের অন্ধকার নীরব হলেই শোনা যায় কুটকুট। যৌথজীবনের দায়িত্ব ভুলে রাতের পর রাত ওরা কাটিয়ে দেয় পিঠোপিঠি শুয়ে। দেখেও দেখে না কিছু, নিজের সংসার যে ছারেখারে যাচ্ছে, ভাবে আমার কী। রাত জমেজমে দিন হয় মাস হয় বছরের পর বছর হয়। কেউ কারো মুখ দেখে না পিঠ দেখে না। দুজনেই শ্রান্ত হয়, ভাবে এবার ধরাপড়ুক নয় পালিয়ে যাক উপদ্রব কিন্তু ইদুরের গলায় ঘন্টি বাঁধবে কে। দুজনেই ভাবে সে কেন। সে তাকে কোন ভুল করে নি বরং ভাবে একটা অলৌকিক ঘটুক, শান্তির জন্য রাত জেগে জেগে পাঁচ বছর কেটে যায় তাদের একই বিছানায় শুয়ে। মনা ভাবে সেকী কোন ভুল করেছে। না, সে তো তার স্ত্রীর প্রতি সদা বিশ্বস্ত। নেংটিটার ভাবগতিক সে কোনকালেই মান্য করে নি। রুনা ভাবে তার ভুলই হবে। কিন্তু মনা কেন তাকে সন্দেহ করবে। পুরুষ মানুষের এত কিসের গোঁ। তাই অভিমান জমে জমে সর্ষের পাহাড়। রুনা ভাবে মান্তুর সঙ্গে কথা না বললে যদি সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, তবে তাই হোকদুতিন দিন কথা বলে না, মান্ত বাড়ি এলেও বলে না। টেরিয়ে টেরিয়ে সব দেখে মনা, কিন্তু ভাবগতিকের পরিবর্তন হয় না। ও একবার কাঁধে হাত দিলেই তো ঝরঝরিয়ে কাঁদে রুণা। মনার নিষ্ঠুরতায় রুণা মর্মাহত হয়, ফিরে যায় আবার নিজের জায়গায়। মনার সামনেই মান্তুকে ফোন করে। ভুল যখন করে নি তখন কেন কথা বলবে না। কথা না বলার হার স্বীকার করবে না সে। তাই আগের মতো না হলেও, চালিয়ে যায় মান্তুর সঙ্গে প্রতীকী কথা বলা।

মান্তুর মা শিখাদি একদিন রুণার কাছে অভিযোগ করে ছেলে তার নষ্ট হয়ে গেছে, চরিত্র দোষ হয়েছে। রুণা বিশ্বাস করে না। বলে,

--– কী বলছ শিখাদি?

--- অন্তুর বৌ এর সঙ্গে ছি ছি কী লজ্জা! তুই এসবের একটা সমাধান করে দিয়ে যা বোনচারদিকে কী ঢিঢিক্কার!

বিষয় জটিল হলে রুণা একা সামাল দিতে পারে না। তখন মনাকে চাই।

এদিকে মনাও একটা কাণ্ড করে বসে আছে। হপ্তা দুয়েক আগে মান্তু এসে উপস্থিত ওর অফিসে। একলাখ টাকা টাই, জরুরি দরকার। কোন কথা না বলে ব্যাঙ্ক থেকে উঠিয়ে দিয়ে দেয় মনা। তারপর আর দেখা নেই নেংটি ইঁদুরের । এতগুলো টাকার চোট হয়ে গেল। লক্ষ করে দেখেছে রুণার সঙ্গেও কথা নেই। পনের দিন পরে অফিসে এসে টাকা দিয়ে আবার একটা প্রণাম করে যায় মান্তু। কী হল, বিয়েশাদি নাকি। মনার কৌতুহল হয়, কিন্তু কোন উপায় নেই জানার। এতবড় চাকুরে যে একলাখের কেন দরকার পড়ল। সব বলতে পারে একজনই, যার সঙ্গে তার কথা বন্ধ। চুকে বুকে গেলেও বিষয়টা যে রুণাকে না বললেই নয়।  

সেদিন ঝমঝমাঝম বৃষ্টির বিকেল, হেমেকা আবহাওয়া। হেমেকা কথাটা অসমিয়া হলেও মনার খুব পছন্দ। বাংলায় ভিজে ভিজে ভাব কথাটা তেমন রোমান্টিক হয় না। অনুরক্তি আসে না। মনা যখন ভাবছিল খাবারের কথা, পেঁয়াজি কিংবা পকৌড়ার মতো তেলে ভাজা। তখনই দেখে বারান্দার টেবিল ডাকছে গরম গরম সোনালি উষ্ণতায় আহা সঙ্গে যদি হয় মশলাদার এককাপ গরম চা। তাও উপস্থিত, মেঘ চাইতে মেঘ জল। উপযুক্ত পরিবেশ। অবিরাম ঝরে পড়া ধারা আর এক আকাশ রঙ শাড়ির উপর প্রিয়মুখের উদ্দেশ্যে বলে মনা,

--- ভেবে দেখলাম মান্তুর সব মন্দ নয়?

--- আবার মান্তু কেন? মান্তুকে নিয়ে কোন কথা অমি শুনতে চাই না। ও একটি নচ্ছার ছেলে।

--- না, ওর অনেক গুনও আছে।

--- ও তাহলে শোনা হয়ে গেছে।

--- কী শুনব?

--- অন্তুর বৌ এর সঙ্গে।

--– আমি ওসব জানি না।

--- তাহলে, কীসের গুন শোনা হল?

--- ছেলেটা পরোপকারী

--- গরিবের মেয়ের বিয়ে দিয়েছে? ওসব ও করে, ওর অনেক টাকা আছে, তা করে।

--- বলেছিলে বটে বিশ্বাস করি নি।

--- এখন কে বলল? কারো ছেলেমেয়ের পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে। আগেও দুটো বাচ্চার নিয়েছে।

--- এসব ভাল নয়?

--- খারাপের ওজন ভারি।

--- অন্তুর বিরিয়ানি দোকানের মুসলমান কারিগরের বাইপাস করিয়ে আনল ভোলার থেকে। ধার কর্জ করে গেছে, ফিরে এসে শোধ দিয়েছে।

--- ভাল ভালর জায়গায় থাকুক। আমি আর ওর কথা শুনতে চাই না।

--- কথা বন্ধ করলেও কত বছর পর হেমেকা বাতাসের মধুর পরশ সে উপভোগ করে চা আর গরম পকোড়া সহযোগেবেহায়ার মতো প্রসংশাও করে চা এবং টা এর।

অনেক রাত পর্যন্ত দুজনেই ময়ূরের মতো পাখনা মেলেই রাখে। বৃষ্টিপতনের শব্দে যেন নিশির ডাক পক্ষা করতে পারে না। ঘুমঘরে চলে আসে তাড়াতাড়ি। পাঞ্জাবি খুলে অভ্যেস মতো শুয়ে পড়ে উদোম গায়ে। শীত হোক গ্রীষ্ম হোক খালিগায়ে শোয় মনা বারোমাসবিয়ের পর থেকে চালু হয়েছে এই উদোমগিরি। আর পিঠমোড়া অভ্যেস তো মাত্র পাঁচ বছরের, ওপারে কী হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। ড্রেসিং টেবিলের প্রসাধনী নাড়াচাড়ার শব্দে বুঝতে পারে নিভিয়া না ওলে না ভেসেলিন কিংবা বডি লোশন আলো নিভে গেলে পর যথারীতি উল্টোমুখে শুয়ে গড়াগড়ি। গড়াগড়ির শব্দে বুঝে নিতে হবে কোনমুখোতখন মনাও দেয় গড়ি। মুখোমুখি যে কখনও হয়নি তাও নয়। হয়েছে, শুধরে নিয়েছে তৎক্ষণাৎ। আজ প্রথম প্রহরে কিছু একটা হয়মনা বুঝতে পারে একটা চেলাপোকার নড়াচড়া ওর পিঠে। শিরশিরিয়ে উঠছে নামছে। অনেক দিনের অনভ্যাস তাই মনা আবার আঙুলপোকার ফিরে আসার অপেক্ষা করে আনন্দে উৎকণ্ঠায়। বিছানার নো-ম্যানস ল্যান্ডএ শুয়ে করে ছটফটানি নিঃশ্বাসে নিয়ন্ত্রন রাখতে খুব একটা সতর্কতার দরকার নেই, বাইরে টেউটিনে টিং টিং বৃষ্টির শব্দে তালে তালে শ্বাস ফেলে। এবার বিলির আঙ্গুল নয়, মনার পিঠের উপর কুসুম গরম জলের এক ফোঁটা। আর ভুল করে নি। দু ফোঁটা পড়তে দেয় নি। পাঁচ বছরের ঘাপটি থেকে বেরিয়ে পড়ে মনা, জড়িয়ে ধরে বৌকে। কত কী হয় এরপর শোধ বোধকত কথা, না কথা এবং সঠিক সময়ে সঠিক ক্রিয়া শেষে মনা যায় কলঘরে। জলকলের পাইপের দিকে তাকিয়ে হাসি সামলাতে পারে না। রুণাকে ডাকে। বলে, --- দেখ। দুজনেই অবাক হয়ে দেখে পাইপ বেয়ে পালাচ্ছে এক নেংটি ইঁদুর।

*****

 

 

  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ