ইশারা I রণবীর পুরকায়স্থ I



ছবিঃ রণবীর পুরকায়স্থ 

হিরণ তার ডাকনাম। হিরণ পড়াশুনায় খুব মনোযোগী নয়টেনেটুনে সিবিএসই প্রথম বিভাগে পাশ করা মেয়েকলকাতায় মনোমতো পড়ার বিষয় না পেয়ে ব্যাঙ্গালুরু মাইক্রো বায়োলজি বিএসসি কোর্সের ছাত্রীতবে পড়াশুনায় মোটামুটি হলেও আদার ক্যারিকুলারে সে চৌখুশকথা বলে চটপট নাচে ভাল গায় ভাল নাটকও করেছে নামীদামী দলে, দুএকটি সিরিয়ালেও অভিনয় করেছে কর্ণাটক যাওয়ার আগেকিশোরী শিল্পীর নায়িকা হওয়ার ম্যাটারিয়াল থাকলেও চপলমনের বিরোধিতায় ছেড়ে দেয় অভিনয়এবার পূজোর ছুটিতে কলকাতায় নিয়ে আসে চার চারটে বন্ধুএকসঙ্গে এতজনের তো বসার জায়গা হয় না বাপের স্যুইফট ডিজায়ারে, তাই মালপত্র নিয়ে বিভ্রাট কাটাতে ল্যাপটপে স্যুটকেশওরাও থাকবে তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটেযদিও পরদিন, মানে মহাষষ্টীর দিন সকালবেলা পিতা বকুলচন্দ্র আবার পাঁচজনকে নিয়ে যায় এয়ারপোর্টে, সঙ্গে তিনজনের লাগেজমিত্রা ছন্দা ও তিতির যায় আগরতলাথেকে যায় তেজপুরের ভগদত্ত হাজরিকা

হিরণের পিতা বকুলচন্দ্র নাথ একটি দেশি ইন্সিওরেন্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারপূজোর কদিন ড্রাইভারের ছুটি তাই বকুল নিজেই চালায় গাড়ি। একমাত্র মেয়ের আদেশ অমান্য করা যায় না। ফেরার সময়ও বাপের পাশে বসে হিরণ। পিছনে একা দত্ত। হিরণ বাপকে বলে দত্ত থাকবে পুজোর কদিন তাদের বাড়িতেই। দশমীর পরদিন ভাসান দেখেই ফিরবে গুয়াহাটি, গুয়াহাটি থেকে তেজপুর বাসে। তাই বাপকে নির্দেশ দেয়,

--- বাপি, পুজোর কদিন রান্না বান্নায় হেল্প করবে মাকে।

--- মানে?

--- মানে অ্যারেঞ্জম্যান্ট করে দেবে। গুড ট্র্যাডিশনেল ডিশেস।

--- নো ওয়ে, আমি ছুটি কাটাব। খাব আর ঘুমোব, হোম ডেলিভারিকে বলে দিয়েছি।

--- ও নো। দত্তকে বলেছি মাই ফাদার ইজ এ গুড কুক। চিতল মাছের মুইট্‌ঠা বানায় ডিলিশাস। তেল কই এণ্ড ইলিশ মাছের ভাপে। ওসাম।

--- হোম ডেলিভারিতে সব পাওয়া যায়।

--- ও কি মনে করবে, বলো?

--- ভগদত্ত খুব ভাল ছেলে, কিছু মনে করবে না।

--- মনে করবে ড্যুড। পেছন ফিরে একা বসে থাকা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলে বকুল। হিরণ অবাক হয় বাপের কথাবার্তায়। বলে,

--- ড্যুড? ড্যুড মানে তো দোস্ত, বন্ধু। তুমি কি ওর বন্ধু?

--- হতে আপত্তি কী? ব্রো বলবো তাহলে?

--- ঠিকাছে ঠিকাছে, বুঝতে পারছি, লেগ পুলিং হচ্ছে। তবে বলে দিচ্ছি এটাও ঠিক হচ্ছে না ড্যাড। তোমার ওয়ান এণ্ড ওনলি ডটারের প্রেস্টিজ বলে কথা। বহুত বেইনসাফি হয়ে যাবে ভাল না খাওয়ালে, ইউ মাস্ট কুক মাই ডিয়ার মাস্টার শেফ, প্লিজ?

--- মাখন এখন পাওয়া যায় না কলকাতায়।

--- অ্যাঁ! তাহলে কী করে দেব গুরুদক্ষিণা?

--- ওর আর তোর সাবজেক্ট এক নয়।

--- ও পড়ে ইনফরমেশন টেকনোলজি। ও তোকে কী পড়িয়েছে যে দিতে হবে ফিজ?

--- কাম অন বাপি, তোমার প্যাঁচানো ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলবে না, ও আসামের ছেলে, সহজ কথা বোঝে। আর গুরুদক্ষিণা কি শুধু ক্যারিকুলাম বিদ্যা দিয়েই হয়, তোমাদের শুধু পড়া। আমি জানো ফ্লুয়েন্ট কান্নাড় বলতে পারি, তেলেগু পারি, কিছুটা তামিলও।

--- ইম্পসিবল, এই চারমাসে?

--- দত্ত হেল্প করেছে। আই নো অ্যাসামিজ টু। একদম দত্তের মতো পারি। তুমিও তো জানো, গুয়াহাটি ছিলে না? ভগদত্ত বলে গুয়াহাটি নাকি কলকাতা থেকে বেটার সিটি, শিট। আচ্ছা বলো তো বাপি কলকাতার কাছাকাছি কোনো শহর আছে? যদিও আমি এখন লাইক করছি ব্যাঙ্গালুরু। ব্রিগেড কমর্শিয়াল ম্যাজেসটিক। তুমি তো অনেক জায়গায় থেকেছ, বলো না কোনটা তোমার ফেভারিট শহর?

বকুল নাথ অসমীয়া যুবক ভগদত্তকে দেখে মাথা না ঘুরিয়ে। রিয়ার গ্লাসটা সরিয়ে ছেলেটার মুখে ফোকাস করে। একা বসে আছে পিছনের সিটে। শান্তশিষ্ট ছেলেটির মুখে একটি ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। অসমিয়ারা এমনিতে বেশ ভালো মানুষই হয়। ওকে দেখে অকারণ চমকায় বকুল। চেনাচেনা লাগে, কোথায় যেন দেখেছে মুখটি। কোনো চেনা মুখের আদল। ক্ষণিকের অনবধানে বাগুইআটির লাল সিগন্যাল দেখেও সাদা দাগ অতিক্রম করে। পুলিশের ইশারায় পিছিয়ে যায়। এরকম হয় না তার কখনও, সে একজন দক্ষ চালক। আসলে মেয়েটা তাকে এক আশ্চর্য দোটানায় ফেলে দিয়েছে। সে কী জবাব দেবে আত্মজা প্রশ্নের। কোন শহর তার প্রিয়। মেয়ের বয়সী শহর কলকাতাকে সে কতটা ভালবাসে, আদৌ কি কোনো টান আছে এই ধূসর শহরের প্রতি। না কোনো সম্পর্ক নেই এই গিজগিজে যন্ত্রমানুষের শহরের সঙ্গে। জন্ম শহর সিলেটকে তো দেখেই নি, শুনেছে ধোপাদীঘির পারে তাদের বাড়ির কথা, জন্মের পরই তো চলে আসে শিলচর। অম্বিকাপট্টি কুর্মি বাংলোর পাশে ছিল বাড়ি, দুর্গাশঙ্কর পাঠশালা থেকে তৃতীয় মানের বৃত্তি, অধরচান্দে ষষ্ট মানের বৃত্তি, ম্যাট্রিক। জিসি কলেজে বি-কম। একটানা পড়াশুনার এই শহরটা এখনও তার প্রাণের আনন্দ। এখনও বরাক নদী ঘেরা শহরটা তার রক্ত মাতাল করে। অম্বিকাপট্টির চার মাথায় মোড়ের নামটা যে কে রেখেছিল চৌরঙ্গী। কলকাতার চৌরঙ্গী থেকে এখনও বিশাল হয়ে আছে তার স্মৃতির এই চার পথের মিলনস্থল। চার্চ রোডে গির্জার বিশাল সবুজ মাঠ নাকি এখনও আছে, যেমন ছিল তার ছেলেবেলায়। নেই শুধু ঘোড়দৌড়ের মাঠ, সাপনালার প্রাকৃতিক পরিবেশও হারিয়ে গেছে। তবে বরাকবাসীর মাতৃভাষার গৌরববাহী স্মৃতিবেদী উদ্যানটিকে মহিমান্বিত করেছে। এক মস্ত বড়ো বাজারের স্মৃতি এখনও তার মনে অমলিন। নাম ফাটকবাজার, আশ্চর্য এক হাট, সেখানে পাওয়া যায় না এমন জিনিস নেই। এক একটা বিভাগের নাম ছন্তর। কালীবাড়ির পেছনে বরাক নদীর বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে কত বিচিত্র মানুষের অস্থায়ী আস্তানা। বছরে এক দুবার প্লাবনের ভয়ে আর স্থায়ী হয় না নদীর পারের বসতসদরঘাটে জোড়া নৌকা জুড়িন্দায় নদী পারাপার, শুধু মানুষ নয় গাড়ি ঘোড়াও পারপার হয়। কত বছর এপারে অর্ধেক ওপারে কিছুটা হয়ে আটকে ছিল বরাক সেতু। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সময় একবার মাত্র স্টুডেন্ট কনসেশনের অর্দ্ধেক ভাড়ায় মাত্র কুড়ি টাকায় ডাকোটা বিমানে যাওয়ার সময় ব্রিজের উপর দিয়েই গেছে আই এর বাস কুম্ভীরগ্রাম বিমান বন্দরে। এরোপ্লেনের উপর থেকে শহর শিলচরকে কী মায়াময় মনে হয়েছিল সেদিন। মনে হয়েছে এবারই কি শেষ যাওয়া, আর ফেরা হবে না কোনোদিনফিরে এসেছে একবার বরাক ভ্যালি এক্সপ্রেসে পুজোর ছুটিতে হই হই করতে করতে। দোকানের চাকরি থেকে সাতদিনের ছুটিতে। বরাক উপত্যকার কম ছাত্রছাত্রী ছিল না গৌহাটিতে। পাহাড় লাইনে কয়লার ইঞ্জিনে ভ্রমণের মজাই আলাদা। বাড়ি পৌঁছেও দুতিন দিন মজে থাকে ভ্রমণকণা কয়লার টুকরোয়। চোখের ভিতর কয়লার টুকরো ঢুকে চোখের জল ফেলেনি এমন ছাত্র দেখেনি বকুল। স্টিম ইঞ্জিনে রেল ভ্রমণের কয়লা পোড়া গন্ধও হারিয়ে গেছে তার যৌবনের প্রথম পাদেই। বাড়ি ফেরার উত্তেজনায় এক এক করে ছত্রিশটা টানেল গোনার লড়াই হত বন্ধুদের সঙ্গে। ছত্রিশটা পেরিয়ে গেলেও সংস্কৃতের জিতেশ বিভ্রান্ত করে দিত পঁয়ত্রিশ বলে। কোথায় শেষ টানেল তাও মনে নেই, চন্দ্রনাথপুর বা হিলাড়া না অন্য কোথাওদুপুরে লোয়ার হাফলং এর ক্যাটারিং এ নিরামিষ খাওয়ার আনন্দ কি এখন আছে, পাবে বকুল। পাম বিডিম এর ডাকে স্টেশনগুলি গমগম করত, হাফলং এ কমলালেবু আর আনারস কিনে নিয়ে গেলে মায়ের খুশি মুখটাও যে ছিল উপরি পাওনাএইসবই শহর শিলচরের সীমানা।শিলচরের জন্যই তো এত আসা যাওয়া দেখা।

কখন যে শিলচর শহরও হারিয়ে গেল। শিলচর থাকাকালীন পাগড়ি বাঁধা সর্দারজি দেখেনি বকু্ল,গৌহাটি গিয়ে প্রথম দেখে বাঁধাকপি। বয়স কম ছিল বলে না বুঝে বলেছে বন্ধুদের সঙ্গে। এখন আর বলে না। গৌহাটি শহর তো তখন ব্রহ্মপুত্র নদের পারে পারে, উজানবাজার পানবাজার ফেন্সিবাজার। ফেন্সিবাজারে শিখেদের উপাসনা গৃহ শিখটেম্পল, গুরুদোয়ারা বলে না কেউ সর্দারজি ছাড়া। প্রথম বিমান থেকে নেমেই হেমেন এর কাকার বাড়ি পাণ্ডুতে গিয়ে দেখে আর এক শিলচর। সব বাঙালি, তবে ভাষা একটু অন্যরকম সিলেটি নয়। কাকার বাড়িতেনিরামিষ মাছের ঝোল ভাত খেয়ে রওয়ানা দিয়েছিল পল্টনবাজার। তবে কাকিমার রান্নার গুনেই হয়তো গৌহাটি শহরের আতিথেয়তার শুরুটা হয়েছিল উপভোগ্য। গৌহাটি স্টেশনের গায়ে ঘোষ ডাইরির অমৃতি খেয়েছিল দুটো, মুখে দিতেই মিলিয়ে যায় এত তুলতুলে, জিও ডেফলদা। কলেজে জিএস ছিল এককালে। এম এ পাশ করে এখন ডিসির অফিসে চাকরি করে। কতকিছু শিখিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল বাবা বলবি না বলবি দেউতা। দিদিমা নয় বলতে হয় আইতা। শতকিয়ার উচ্চারণ শিখিয়েছিল। এক দুই পর্যন্ত ঠিক আছে, তিন হয় তিনি চার চারি, বলেছে পাঁচ পাঁচই থাকবে, পাচি করলেই ঝাড়। বকুলের মজা লেগে যায়। একদিনেই অসমিয়া ভাষাটাকে তার আপন মনে হয়, আপন মাতৃভাষা থেকেও প্রিয়, তা কি কেউ পারে। হয়তো নয়, কিন্তু একটা ভাল লাগা তো ছিল। ডেফলদা বলেছিল একরাত জনতা হোটেলে কাটিয়ে ছলারপার একটি মেস আছে, দেখে নিতে। রাস্তাটা একটু ঘিঞ্জি খাটাল টাটাল আছে, বিহারি বেশি, নতুন স্টেডিয়াম হচ্ছে খাটাল উঠে যাবে। উড়াল পুলও হবে সোজা উজানবাজার পর্যন্ত। উজানবাজার তো গৌহাটির বালিগঞ্জ তখন। কলকাতা না গেলেও বালিগঞ্জটা চেনে বকুল। স্টেশন টপকে আবার চলে আসে পানবাজার, তখন প্ল্যাটফর্ম টিকিট নিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না। ওভার ব্রিজের নিচে একটা ভাঙা দোতলা হোটেল বাড়ির কথা বলেছিল কাজলদা, বকুলের প্রিয়বন্ধু পুতির লাভার, তখনকার দিনেওরকম বলত। কাজলদা ডেফলদা বন্ধু, বকুলের প্রিয়জন দুজনের কথাই শুনতে হয়।প্রথম দর্শনে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল হোটেলটা , যে কোনো মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলে হোস্টেল একটা পাওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু বকুলের মাথায় যে অন্য চিন্তা, রাতের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সঙ্গে দিনে একটা চাকরির ব্যবস্থা করলে মায়ের পেনশনে ভাগ বসাতে হয় না।

একটা মাড়োয়ারি মদের দোকানে চাকরি পেয়ে যায় বকুল, আড়াইশ টাকা কম নয়। এই দোকানেই নাকি মাস ছয়েক আগে লুটপাট হয়েছে, স্থানীয় মানুষ বলে গ্রেট মাড়োয়ারি কিলিং, ছেলেরা মদের দোকান দিয়ে শুরু করেছিল, দোকান ভেঙে মদ খেয়ে গোটা ফেন্সিবাজার দাপিয়ে বেড়িয়েছে সারাদিন। পুলিশ প্রশাসন চুপচাপ বসেছিল। বাঙালিরা খুব হেসেছে, বলেছে এই ব্যবসায়ীরাই তো বঙাল খেদা আন্দোলনে দুহাতে অর্থ দিয়েছে, আপেল খাইয়েছে। সমাজ বিরোধীদের কাজকর্মে কত রকমের সামাজিক চাপান উতোর হয়েছে আসামে, তার ইয়ত্তা নেই। এসব গল্প কথায় বকুল কোনো সমাজকেই কখনও অভিযুক্ত করেনি।

বকুলের জীবনে সবকিছুরই শুরুতে একটা ক্যাচাল থাকে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি নিয়েও হয়েছে, ভর্তির শেষদিনে গিয়েও হয়নি, সিট খালি নেই, তখন প্রাইভেট এম কম দেওয়ার ব্যাপারটা চালু হয়নি। রাজখোয়াদা আর শিবানী বাইদেউ কী করে যে সব করে দিল, হয়ে গেল অ্যাডমিশন। কাশীনাথ রাজখোয়া জি এম আর শিবানী শর্মা তার প্রেমিকা, যেমন পুতির লাভার কাজলদা।

রাতের এম-কম ক্লাসে একজন মাত্র মেয়ে, প্রণামিকা হন্দিকৈ। সেও হয়ে যায় বকুলের বান্ধবী। একই বাসে যাওয়া একসঙ্গে ফেরা। প্রণামিকা থাকে রিহাবাড়ি, মিলনপুর। বাড়ি থেকে রিক্সা করে আসে ফেন্সিবাজার, বকুলের কাজের জায়গায় ঢোকে না, তখনকার দিনে মদের দোকানে মেয়েদের ঢোকা বারণ ছিল, এখনও আছে হয়তো। তবে প্রণামিকার আসার একটা সংকেত থাকে, কাচের ঘরের ভিতর থেকেও বুঝতে পারে বকুল। প্রস্তুত হয়, ছুটি করে, সবদিন ছুটি পায় না, কিন্তু পাশের লক্ষ্মী কেবিনে শিঙাড়া চা খাওয়া হয়। আজো মানে বকুল পৃথিবীর কোনো দোকানে লক্ষ্মী কেবিনের মতো বড়ো মাপের শিঙাড়া হয় না। চায়ের কাপও বড়ো বড়োযদিও ভার্সিটি ক্যান্টিনের শিঙাড়াও খুব ছোটো নয়। শীতের রাতে সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে তাম্বুল একটা মুখে ফেলে নেশার ঘোরে শীত তাড়ানো যেতো। কিন্তু প্রণামিকা তাম্বুল খাওয়া পছন্দ করে না। বকুলও বাধ্য হয়ে বলেছে, ঠিক আছে বাবা নেখাউ।মানে খাব না।

ডেফলদার ব্যাকরণ শর্ত এখানে মেলেনি। ডেফলদা বলেছে কোনো কিছুকে না করতে মূল ক্রিয়া শব্দের প্রথম আকার দন্ত্যন এর সঙ্গে লাগিয়ে দিতে। যাবার অসমিয়া শব্দ যাউ, যাব না হবে নাযাউ, খাউ নাখাউ কিন্তু সবাই যে বলে নেখাউ। ডেফলদার প্রাথমিক শিক্ষার ভুলচুক শুধরে দিয়ে প্রণামিকা এখন বকুলের ভাষাগুরু। তবু ভুলভ্রান্তি হয়েই যায়।

রাজখোয়াদার সামনে সেদিন কী লজ্জায় পড়েছিল বকুল, বর্ষার বিকেল, কাছারি ঘাটের সামনে রাজখোয়াদা আর শিবানী বাইদেউকে দেখে সে লজ্জায় অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। সেদিন ব্রহ্মপুত্র কী উত্তাল, সামনে কর্মনাশার চর, যেখানে মানুষ যায় না, তাকায় না পর্যন্ত, তাকালেই কাজ পণ্ড। কিন্তু উমানন্দর চর মন্দির দেখতে হলে তো কর্মনাশায় চোখ পড়েই যায়। এদিকে ঝামাপাথরের গায়ে জল ঢেউ দিয়ে ফুঁসছে। কেন যে মানুষ বলে ব্রহ্মপুত্র অন্তঃস্রোতা, বর্ষায় কিন্তু স্রোত থাকেই। ওরা বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভিজছিল, ওর পালানো দেখে সার্টের কলার ধরে টেনে আনে রাজখোয়াদা। বলে,

--- কোথায় পালাচ্ছিস? এত ভিজে ভিজে একটা চায়ের দোকান পেলাম।ওই দেখ। বন্ধ সরকারি অফিসের বারান্দায় বসার জায়গাও আছে, চায়ের দোকানও আছে। শিবানী বাইদেউ বলে,

--- প্রণামিকা কোথায় রে?

--- আজ তো অফিসও বন্ধ, ভার্সিটিও বন্ধ।

--- বন্ধ বলেই তো বলছি।

রাজখোয়াদা এবার অসমিয়ায় বলে,

--- তেনে হলে পলাই ছিলি কিয়?

--- এনেই দাদা, দেখা নাই।

ছি ছি, ওরা ওকে আর প্রণামিকাকে নিয়ে কী ভাবছে। তবে বকুল তো বড়ো হওয়া ইস্তক বর্ষার এমন রূপ দেখেনি, এমন একটা বিশাল নদীই দেখেনি, কী জানি এই বিশালত্বের জন্যই কি নদীর বিশেষণ মহাবাহুচায়ের দোকানের পাশে বসে ব্রহ্মপুত্রকে আরও একান্ত ভাবে দেখে বকুল। শিবানী বাইদেউর কথা মনে করে একটু বিষণ্ণও হয়, সত্যি প্রণামিকাকে দেখাতে পারলে বড় উপভোগ্য হতো বিকেল। আসলে এক এক সময় এক একটা জায়গা মনের ভিতর ভিত গেড়ে নেয়, মনে হয় ওখানে মেঘলা সন্ধ্যায় না বসলে, বিশাল লুইতকে না দেখলে ভালবাসাই শেখা যায় না। তাই ওদের দুজনকে কাছাকাছির একা সময় কাটাতে দেওয়ার জন্য বলে,

--- যাউ।

--- যাবি গৈ?

--- আচ্ছা দাদা পানবজার ওভারব্রিজ কর পরা যাম?

রাজখোয়াদা আর বাইদেউ দুজনেই হো হো করে হাসে। নির্মল হাসি একটুক্ষণ। তারপর ওর কথার অশুদ্ধি ধরিয়ে দিয়ে বলে,

--- কেনেকা যাবি? কী করে যাবি? বলছি শোন, এদিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেই ডিসির বাংলো টিলার উপর একটু এগোলেই শুক্রেশ্বর শিবের মন্দির, মেডিকেল। ওদিকে যাবি না, বাঁদিকে ঘুরে সোজা পানবাজার ওভারব্রিজ। একটু এগোলেই পড়বে আরএমএসের মেসবাড়ি, কলেজ স্টুডিও, কটন কলেজ, শেখ ব্রাদার্স, বি এন দে, মহামায়া হোটেল, গোল্ডেন শিল্প ফ্যাক্টরি, মধুমিতা, কল্পনা, দারোগার পান দোকান, নাককাটা পুখিরি, গৌহাটি ডাইরি, প্রগ্রেসিভ বুক স্টোর ডান দিকে হরিসভা, যাবি না। ইডলি দোসার দোকান মালাবার হোটেল,  টেকেলি দই আর অসমিয়া মিষ্টির দোকান আনন্দ ভবন। তারপরই তোর গ্রেট হিন্দু বিনাশ হোটেল। একদিন যাব তোর হোটেলে।

--- আবার হাসে বকুলের দুই স্বঘোষিত অভিবাবক।

ওরা দুজন কেন, প্রণামিকাও বকুলের বড় অভিভাবক। মেয়েটার চাপে মাঝে মাঝে রেগেও যায় বকুল। বলে,

--- তুই আমার গার্জেন নাকি? বাবাও আমাকে এত বকেনি তোর মতো।

--- হ্যাঁ, বাবাই তো।

--- আমার বাবা নেই এখন।

--- তবে মা। বোকা বাঙালির মা।

--- এই শোন, আমি মোটেই বোকা নাই, বাঙালি বটে। আর আমি হলাম গ্রেট ধান্দাবাজ বকুল। মা বোনকে শিলচরে একা ফেলে রেখে কেমন হোটেলে থাকছি বল আনন্দে। করমচান্দের মদের দোকানে চাকরিও করছি আড়াইশ টাকায়।

--- আর মদ বেচতে হবে না। এবার পলিসি বিক্রি করবি হোললাইফ এন্ডাওমেন্ট।

প্রণামিকা ইন্সিওয়েন্স কোম্পানির ফর্ম নিয়ে এসে বলে, ভর্তি কর। দশ টাকার পোস্টেল অর্ডারও কিনে আনে। সার্টিফিকেটগুলো টাইপ করিয়ে ইউনিভার্সিটির রেজিস্টরারকে দিয়ে অ্যাটেস্টও করিয়ে নেয়। মেয়েদের এই একটা সুবিধা ছিল তখন। রাজখোয়াদাও অবস্থা বুঝে শিবানীদিকে দিয়ে কাজ হাসিল করত। মেয়েদের কোথাও যেতে কেউ বাধা দেয় না নইলে রেজিস্ট্রারের ঘরে ঢোকা চারটিখানি কথা নয়। রিটেন পরীক্ষা একটা নামমাত্র দিয়েছিল, কী দিয়েছিল মনে নেই, ছুটির দিনে পরীক্ষা এমনিতেই তার অপছন্দ, তার উপর গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের প্রথম টেস্ট। প্রথম ইনিংসে শূন্য। দ্বিতীয় ইনিংসের উৎকণ্ঠায় সবাই রেডিওর সামনে। আর সে কিনা অবজেক্টিভ টেস্ট দিচ্ছে, টিক মারছে, অঙ্কের ভুল শুদ্ধ ঠিক করছে, প্রেসি লিখছে ইংরেজিতে। বাইরে বেরিয়ে বিশ্বনাথের সেঞ্চুরির কথা শুনে মনে হল সব শুদ্ধই হয়েছে। ইন্টারভিউ ভালই দেয়, ব্রহ্মপুত্র পারে মস্তবড়ো অফিস। ওখানে শুনেছে দেবব্রত বিশ্বাস চাকরি করতেন। সত্যি মিথ্যা জানে না, তবে বয়স্ক সহকর্মীরা তো আর ভুল বলবেন নাহেমাঙ্গ বিশ্বাস আসতেন ভূপেন হাজরিকাও। তখন কী সহজ ছিল জীবন। আরও কিছু বছর আগে জন্ম হলে ওদের চা খাওয়া দেখতে পারত, আড্ডার কথা শুনতে পারত, একটা তাম্বুল এগিয়ে দিতে পারত শ্রদ্ধায়। ও বাড়িতে নাম লেখালেখির শেষে বকুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পানবাজার। শেখ ব্রাদার্সের উপরে একটা অফিস আছে। সবচেয়ে খুশি প্রণামিকা, ওর জন্যই তো এত বড় চাকরি। বলে,

--- এবার মা বোনকে নিয়ে আয়।

--- রাখব কোথায়? ভাঙা হোটেলে না ফুটপাতে?

--- আরে নিয়ে আয় না, পেয়ে যাবি ভাড়াবাড়ি। না পেলে আমাদের বাড়ি তো আছে, কদিন থাকবে। অসমিয়ারা খার খায় কিন্তু খুব অতিথি পরায়ন।

--- আর বাঙালি পেলে তো কথাই নেই, ফুল বেলপাতা খাইয়ে বলি দেয় ঘচাং।

মদের দোকানের চাকরি শেষ হতেই হোটেলের খাওয়া থাকাও বন্ধ হয়ে যায়। প্রণামিকার পাশের বাড়ি গোলাপ দাস কলোনির আটবাড়ির একটি পাওয়া যায় মাসিক সত্তর টাকা ভাড়ায়। আসাম টাইপের বাড়ি, দুটো বড়ো ঘর ড্রইংরুম রান্না ঘর, দূরে খাটা পায়খানা তখনকার দিনে যেমন হতপাশের বাড়িটাই বকুলের সবচেয়ে সুবিধাজনক, প্রণামিকার বাড়ি। বাবা উকিল, পসার কম, ছোটো ভাই মস্তান অটো চালায়। পাড়ার সবাই ভয় পায়। দেখে বোঝার কোন উপায় নেই এমন মিষ্টি মায়া মাখানো মুখ। শিখাকেও ভর্তি করে দেওয়া হয় বেঙ্গলি গার্লসে। শিখা একদিন স্কুল পালিয়ে চলে যায় মেঘদূত, ফরিদা জালাল ভারতভূষণের ভাগ্য দেখতে। হিন্দি থেকে ডাব করা, অসমিয়া ভাষায়। আর পড়বি তো পড় ভাইটির সামনে। প্রণামিকার ভাইয়ের নাম ভাইটি। বন্ধুদের সামনে ধমক দিয়ে অটোয় উঠিয়ে পাড়ার গলিমুখে এনে ছেড়ে দেয়। এই নিয়ে বাড়িতে কী অশান্তি। মায়ের রাগ ভাইটির উপর, স্কুল থেকে ফেরার পথে কেন শাসন করবে। প্রণামিকা বলতে আসল ঘটনা বেরোয়। এরপর মা যায় ওদের বাড়ি। মা বুঝে না একবর্ণও অসমিয়া প্রণামিকার মা বুঝে না বাংলা। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায় দিদিতে দিদিতে। বকুলও মহা মাহি ডাকে, মেসো মাসির অসমিয়া রূপ। দুপুরের রান্না এদিক ওদিক হয়। ওরা রান্না তরকারিকেবলে আঞ্জা, একরকম ডালকে বলে খার, প্রথম প্রথম তেল মশলাহীন খাবার আলুনি লাগত। বকুলের মার প্রণামিকাকে মন্দ লাগে না। শুধু পুত্রবধূ হিসেবে মানতে বাধা। তাও ছেলের মুখ চেয়ে বলেন,

--- বিয়ে করে ফেল এবার, চাকরিটা তো ভালই।

--- দাঁড়াও, শিখা বিএ পাশ করুক, ওর বিয়ে দিই।

--- প্রণামিকা কতদিন অপেক্ষা করবে?

--- প্রণামিকা কেন মা? বাঙালি মেয়ে কী কম পড়েছে? প্রণামিকা আমার ক্লাসমেট, ওসব ভাবিনি।

মা দমে যায়। আশ্বস্তও হয় হয়তো। মাকে একটা রেডিও কিনে দেয় বকুল, ফিলিপসের ট্রানজিস্টার, বলে নাকের বদলে নরুন, বউ-এর বদলে কথা বলা যন্ত্র। শেখ ব্রদার্সের পাশেই নয়নদার রেডিওর দোকান। বরঠাকুর ব্রাদার্সের একমাত্র উত্তরাধিকার। ব্যবসা বুঝলেও মজার মানুষ এই নয়নানন্দ খেলার মাঠ নিয়ে মশগুল, দিলদরিয়া। বাবা ও এক ভাই,  নয়নদাও এক ছেলে, তবে কেন ব্রাদার্স। নয়নদাকে বললে হাসে। দোকানে অনেক কর্মচারী, নব্বই ভাগ বাঙালিকারণ জিজ্ঞাসা করলেও হাসে। তবে জবাবও দেয় একটু ঘুরিয়ে। একজন কর্মচারীকে ডাকে। বলে,

--- এই হেরা, হুনা।

--- হয় দাদা।

--- হয় নহয়। তুমার নাম নু কুনে রাখিলে আনন্দকর। তোমার দেখো আনন্দই নাই। দমাদমন দুটা খাইলবা। আজি রাতি কিন্তু থাকিব লাগিব। দিল্লির পরা মাল আহিব।

---  হয় দাদা।

ছেলেটি সানন্দে রাজি হয় রাত জাগতে। নয়নদা আবার হাসে। বকুলকে বলে,

--- শোন বাচ্চু। অসমিয়ায় এই হেরা আর হেরি শব্দটা দারুণ কার্যকরী। কেমন ডাকলাম নাম না ধরে বল?

--- বাংলায় ও আছে নয়নদা, এই শুনছো।

--- এতো স্বামী স্ত্রীর সংলাপ।

নয়নদা সব কথায় জিততে চায়, তাই বেশি তর্ক করা যায় না বলে,

--- এবার শোন আমাদের পিতাপুত্রের সংলাপ। আমার বাবাকে তো দেখেছিস, এখনও পুলিশের বড়বাবু,হম্বিতম্বি। ব্যবসায় তার কথাই শেষ কথা। বিজনেসে কোন ছাড় নেই আত্মীয়তা নেই, নাম রেখেছে বরঠাকুর ব্রাদার্স, বাপ ছেলে দুই ভাই, কিন্তু কাজের বেলায় আমিও আনন্দের মতো স্টাফ। হেরা আর হেরি দিয়ে ইন্সট্রাকশন দেয় আমাকে। বলে ‘এ হেরা হুনা, ময় কথা কইছু হেরির লগত, হেরিয়ে কইছে হি হেরিত আহিব তুমি হেরিত যাবা হেরিয়ে তোমাক হেরি দিব হেরিত লিখি থইচু চাবা হেরিটো পালে হেরিত জমা করিদিবা।’ বুঝলি কিছু? এই হলো আড়াই লাখ টাকার ক্যাশ ট্র্যানজেকশন।

রাজখোয়াদা শিবানী বাইদেউ নয়নদা প্রণামিকা ভাইটি নিয়ে গৌহাটির জীবন তো চলছিল মন্দ নয়। এর মধ্যেই দশ বছর পরপর ঘটে যাওয়া অসমিয়া বাঙালির কাজিয়া কথাও শুনেছে বকুল। পঞ্চাশ ষাট সত্তরের এর পর আশিতে এসে যেন থামতেই চায় না। ষাটের সময় সাংস্কৃতিক জগতটাও ছিল উন্নত, ভূপেন হাজরিকা ছিলেন মধ্যগগনে, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে চষে ফেললেন উজনি আসাম, হারাধন রংমনের গানে গলেছে দাঙ্গাকারিদের মন। এত বছর পর হঠাৎ ছাত্রদের মনে কী হল যে আবার বাঙালি তাদের জাতশত্রু হয়ে গেল। হয়তো চাকরির বাজারে টান পড়াও একটা কারণ হতে পারে। প্রণামিকাও এতদিন চাকরির চেষ্টা করেনি, বলেছে প্রফেসারি করবে বাড়ির কাছাকাছি। এখন তো সবদিকে চেষ্টা করছে, যোড়হাটে টকলাই ট্রেনিংয়েরঅ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরি পাকা করে ফেলেছে। বলেছে যাবে। বকুলের অভিভাবিকার গৌহাটি ছেড়ে যেতে মন নেই। বলে,

--- ছেড়ে দিই? কি বলিস?

--- কেন ছাড়বি, এত ভাল চাকরি?

--- ছেড়ে চলে গেলে এই বেয়া বাঙালিটাকে দেখবে কে?

--- আমি বেঁচে যাব। যা পালা। আসাইম্যাদের কোনো ভরসা নেই, ওদের অভিভাবকত্ব আর মুসলমানের মুরগি পোষা একই। বাঙালি হল ওদের অতি প্রিয় খরিচার বাঁশের কোঁড়। কী আদরে টুকরি দিয়ে ঢেকে ঢুকে রাখে, নাদুশনুদুশ হলেই খেচ!

--- সব বাঙালি দিয়ে খরিচা হয় না। বেয়া বাঙালি হলো খারাপ, ভালো মানে ভালো। কলকাতার বাঙালি নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই ওরা ভালো। কাছাড় সিলেট কুমিল্লার বাঙালিরা হলো বেয়া, মানে খারাপ। ওদের দিয়ে আমরা খরিচা খাই।

--- আমি কাছাড়ের সিলেটেরও

--- সেই তো ভয়, ভাইটিও এখন কেমন হয়ে গেছে রে। এসব শিখেছে। পড়াশুনার ধার ধারে নি, টেন পর্যন্ত পড়ে অটো চালাচ্ছে। এখন আসুর কর্মকর্তা। বলে জয় আই অসম।

--- ভালইতো, জাতীয়তাবোধ থাকা ভাল।

--- ভাল, কিন্তু বাঙালি পেলেই মেরে তাড়ানো, চাকরিতে জয়েন করতে না দেওয়া, এসব কেন? জ্যোতি বসুর উপর রাগ ইন্দিরা গান্ধির উপরও রাগ। শ্লোগান দেয় জ্যোতি বসু গেলা কচু।

--- সে তিনি আসুর আন্দোলন সমর্থন করেন নি বলে। বিদেশি বিতাড়নের বিপক্ষে বলেছেন বলে। বাঙালি নিধন বন্ধ করতে বলেছেন বলে।

--- আমারও মনে একটা প্রশ্ন জানিস, তবে কেন দেশভাগ হলো? এত বছর পরও যদি ওপার থেকে মানুষ আসে? আমাদের আসাম দেশটাও তো ছোটো, আমরা ছোটো জাতি। যে হারে বাঙালি আসছে, ওদের যদি বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত না করা হয় তাহলে অসমিয়া জাতিটাই তো সংখ্যালঘু হয়ে যাবে আসামে।

--- তাহলে এই নির্বাস মানুষগুলো যাবে কোথায়?

--- তাও তো কথা।

--- ধুস্‌, ওসব কথা ছাড় তো। রাজনীতির  খেলা নিয়ে আমাদের কী? ওরা যা করে করুক।

বকুল আসলে এসব নিয়ে খুব একটা ভাবে না। হয়তো প্রণামিকার কথাই ঠিক, একটা বিদ্বেষের বিষ বাতাসে ছড়িয়ে আছে। আন্দোলন চলছে লাগাতার, তেল শোধনাগার বন্ধ, তেলের পাইপলাইন ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। দেড় মাস থেকে লাগাতার বন্ধের কবলে রাজ্য। অফিসের সামনে হাজিরা দিতে হবে তার পরে মিছিলে পা মিলিয়ে যেতে হবে জাজেস ফিল্ড, দিতে হবে শ্লোগান ‘বিদেশি খেদিবই লাগিব’কে বিদেশি, বকুল উল্টেপাল্টে দেখে। সত্যি তো, অসমিয়া আন্দোলনকারিদের চোখে হয়তো উদ্‌বাস্তুরা বিদেশি কিন্তু যারা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছে তাদেরও তো দেশ চাই। তাই স্লোগান বিকৃত করে বলে ‘বুঝলাম তো যাইতাম কই।’

আসাম তখন বারুদের স্তূপের উপর। একটা স্ফুলিঙ্গ পড়লেই বিস্ফোরণ। বরদলৈ ট্রফির ফাইনাল খেলা স্টেডিয়ামেকলকাতার লাল হলুদ আর একটা বিদেশি টিম। দুগোলে জিতছে বিদেশি টিম, মাঠ ফেটে পড়ছে উল্লাসে। এর মধ্যেই গোল শোধ এবং গোল দাতার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি। আগুন জ্বলল স্টেডিয়ামের দর্শকাসনে। বেছে বেছে লাল হলুদের সমর্থকদের ছুঁড়ে ফেলা হল মাঠ থেকে। কেউ কেউ ঝুলে রইল দেয়ালে। খেলা শেষ হলেই অফিসে ফিরে কাজ শেষ করার কড়ারে ছুটি  পাওয়া গেছে খেলা দেখার,  নয়নদা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে নয়ন বরঠাকুর বকুলদের নিয়ে দে দৌড় দৌড় দৌড়। গাড়ি ছুটিয়ে পানবাজার অফিসের সামনে এনে বলে, যা ঢুকে পড়, রাতে বাড়ি পৌঁছে দেব। বকুলের সেদিন খুব গর্ব হয়েছিল। এত অবিশ্বাস দেখেও সে জেনেছে তার নয়নদা আছে শিবানী বাইদেউ আছে, আছে প্রণামিকা, আর কী চাই তার। আরও বড় কিছু চাইলেও আছে এক মহাবাহু নদ ব্রহ্মপুত্র। তাই মেয়ের প্রশ্নের জবার খুঁজতে কলকাতা শহরের কথা বিবেচনায়ও আনে না। মেয়েকে বলে,

--- আমার শহর গৌহাটি।

--- গুয়াহাটি খুরা।

কাকা সম্পর্ককে অসমিয়ায় বলে খুরা। বকুল হাসিমুখে ভগদত্তর দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। বলে,

--- তেতিয়া গৌহাটি আছিল। মই যেতিয়া এরিছো।

হিরণের পছন্দ হয় না বাপির জবাব। বলে,

--- আর কলকাতা?

--- মাসির বাড়ি। এই শহর কারো আপন হয় না। প্রাণহীন এক সংখ্যার শহর। ইন্সিওরেন্স কোম্পানির এক সাধারণ কর্মচারী বকুল নাথকে এখনও চেনে গৌহাটি। ভগদত্তকে বলে,  স্যরি ভগদত্ত, গুয়াহাটি। সেই কোম্পানির জিএমকে কতটুকু চেনে কলকাতা? পানবাজার ফেন্সিবাজার শেখ ব্রাদার্স বরঠাকুর ব্রাদার্সের কেউ না কেউ চেনে আমাকে। গোল্ডেন শিল্প ফ্যাক্টরির রবীন রায়কে বললে এখনই জড়ো করে ফেলবে পুরনো বন্ধুদের।

--- এত যদি ভালো, তবে চলে এলে কেন?

--- যব ছোড় চলি লক্ষনৌ নগরী! ট্রেনে চড়লে অনেক কথা শিখতে হয় রে মেয়ে যেমন ওয়ান্স লেট ওলওয়েজ লেট। গাড়ি একবার লেট করলে সে গাড়িকে সবাই লেট করাবে। তেমনি ওয়ান্স উদ্বাস্তু ওলওয়েজ উদ্বাস্তু। সিলেট থেকে জন্মে শরণার্থী হয়ে এসেছি শিলচর। শিলচর শহর ভরনপোষণের ব্যবস্থা করতে পারে নি গুয়াহাটি বুকে টেন নিয়েছে।

--- গুয়াহাটি ছাড়লে কেন?

--- তোকে শরণার্থী জীবন দিতে চাই নি বলে।

--- আমার তো জন্মই হয় নি আসামে

--- তাই তো ভগদত্ত হাজরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব।

--- বাট মিস্টার নাথ ইউ আর লাইইং, ইউ ডিডনট লাইক গুয়াহাটি।

--- গুয়াহাটি একটি সুন্দর শহর। বৃষ্টির দিনে কাছারি ঘাট থেকে ব্রহ্মপুত্র দেখলে উমানন্দ দেখলে বলবি।

--- বাট, আই নো এ ডিফারেন্ট স্টোরি বাপি। ইউ আর টেলিং ইট ডিফারেন্টলি। তুমি একদম পছন্দ করো না গুয়াহাটি, কারণ একটা হেট স্টোরি তোমাকে পাল্টে দেয়, তুমি আজ পর্যন্ত আসাম নিয়ে গৌহাটি নিয়ে কোনো স্টোরি বলনি আমায়। বাঙালি বলে তোমায় কয়েকজন মেরেছিল তাই আসামের কথা শুনলেই তুমি চুপ করে যাও, তোমার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়, মুখের খাবার পড়ে যায়। মা বলেছে তুমি ডিপ্রেশনে চলে যাও, ইটস এ ট্রমা।

--- ভুল শুনেছিস, ভগদত্তর সঙ্গে আছি দুদিন। ও বলতে পারবে কিছু?

--- বাট।

--- ট্রমা ডিপ্রেশন হলে কি জি এম হওয়া যায়? গাড়ি চালানো যায় এত স্মুদ।

--- স্মুদ চালাচ্ছো না আজ।

--- তাই?

কেষ্টপুর পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, পাশের একটা পাঞ্জাববডি গাড়ি কালো ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে, বকুলের জানলা দিয়ে ঢুকছে ক্রমাগত। বিরক্ত হয়, কিছু বলে না, কাকে বলবে, সে নীচে আর ওই উপরে গাড়ির ড্রাইভার। ধোঁয়া পরীক্ষা না করেই শহরে ঢুকিয়ে দিয়েছে গাড়ি। বকুল হিরণকে বলে,

--- শহরটা একদম গোল্লায় গেছে, আইনের শাসন নেই কোথাও। তোদের ব্যাঙ্গালুরুতে এরকম হয়? ধোঁয়া ঢুকিয়ে দেওয়া?

হিরণ বাপের উপর রাগে। বলে,

--- তুমি ওর সঙ্গে লড়তে যাচ্ছ নাকি? ওকে যেতে দাও আগে, বিগ সিটিতে ওরকম হয় বাপি। আমরা তো ইউরোপ আমেরিকায় থাকি না।

ব্যস, বকুল যা চেয়েছিল। ডাইভার্ট করতে পেরেছে তর্কবাগীশ মেয়ের বক্তৃতা। এত সরাসরি কথা কী করে বলে এই টুকুনি মেয়ে। আজকাল আর কোনো রাখটাক নেই, অসমিয়া ছেলেটির সামনে বলে দিল দুম করে, জবাবে কী বলত সে, স্বীকার করে নিত ভগদত্তর সামনে যে সে একটি পুঁচকে ছেলের হাতের হকিস্টিকে বেদম মার খেয়েছে। একমাস বাহ্যজ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফিরলেও বারবার আতঙ্কিত থেকেছে। ডিপ্রেশনের রোগীকে ডাক্তার বলেছে আসাম ছেড়ে যেতে। টুকটাক লেগেই আছে, মেডিকেল কলেজে মরল একজন জুনিয়র ডাক্তার, নামরূপে মরল এক ব্যাঙ্ক চাকুরে, তিমিরকে চিনত বকুল। বকুল তাও প্রণামিকাকে বলেছে,

---ওসব রাজনৈতিক ব্যাপার, কেউ একদল ফায়দা তুললেই শেষ হয়ে যাবে, আবার ফিরে আসবে সৌহার্দ্য।

বকুল নাককাটা পুকুরের পারে সান্ধ্য আড্ডা শেষ করে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বাড়ি ফিরছিল, ইদানীং তার মন মেজাজ ভাল যাচ্ছে না কিছুদিন, কারণ খুঁজে পায় না কিছুই, খিটখিট লেগেই থাকে মনে। প্রণামিকা যোড়হাট চলে যাওয়ার পর একটা শূন্যতা গ্রাস করে তাকে। এই কয় বছরে মেয়েটা তার সর্বস্ব নিয়ে নিয়েছে, বাঙালি এক সহপাঠীর সব দায়িত্ব নেওয়ার সময় বুঝেনি কিছুই এখন চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছে সে কেমন অকর্মা। রিহাবাড়ি হরিসভার সামনে পৌঁছে একটা সিগারেট খাবে কী না ভাবছে, সিগারেট খেলে মনটা একটু হাল্কা হবে, প্রণামিকা এসব নেশা ভাং পছন্দ করে না, তাই লুকিয়ে খাওয়ায় আনন্দ। বাড়ি গিয়ে একটা বিশাল চিঠি লিখবে সারারাত ধরে। কী লিখবে, বড়ো বড়ো কথা কিছুই না ছোটো কথাও না, প্রণামিকার সঙ্গে কথা বলায় বড়ো ছোটো থাকে না, বকবক করে গেলেই আনন্দ। রাত দশটায় সব অন্ধকার, পান সিগারেটের দোকানটাও বন্ধ, পাশের ল্যাম্পপোস্টটায় তাম্বুলের চুন লেগে ফর্সা হয়ে আছে। রাতটাও জ্যোৎস্নায় আলোকিত, বকুলের মনে কোনো সন্দেহ হয় না এই অস্বাভাবিক শান্তির জন্য। জয় আই অসম শুনেও কিছু মনে হয়নি। বকুলকে কে মারবে, নির্বিরোধী মানুষকে মেরে কার কী লাভ। তবু ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেদম মার মারে, বেহুঁশ হয়ে যায় বকুল, তবে জ্ঞান হারানোর আগে আক্রমণকারীদের কাউকে চিনতে পারে নি, শুধু হকিস্টিক হাতে ভাইটিকে দেখে বলেছে, ‘ভাইটি তয়’ভাইটি রেগে গিয়ে বলেছে ‘কিহর ভাইটি, কেলা বঙাল।’

বকুল জানে না কে তাকে মেডিকেলে নিয়ে গেল। যেদিন জ্ঞান ফিরল, দেখে প্রণামিকা। মা শিখা। দেখে নয়নদাকে। একদিন এল রাজখোয়াদা শিবানী বাইদেউকে নিয়ে। নয়নদা বলে,

---রাগ করিস না ভাইটি, অসমিয়া মানুষজন এত খারাপ নয়। ওরা বাঙালির মতোই নির্বিরোধী।

বলে,

---একই রকম দেখতে আমরা অসমিয়া বাঙালি, তাই দেখিস না আসাম আন্দোলনে বোমা ফাটে না। সিনেমা হলে বিস্ফোরণ হয় না, জনসভায় হয় না। চিনবে কী করে কোনটা বাঙালি কোনটা অসমিয়াএরা বড় ভালরে, একা একা ভাল। রাইজ হয়ে গেলে মানে জনতা হয়ে গেলে, ‘মাস’ যখন হয় কী করবে বল। তখন সে গুণ্ডা হয়ে যায়। আমাকে যে নয়নদা বলে সবাই ভয়ডর করে, আমিও রক্ষা করতে পারব না তখন। পেরেছি নাকি তোকে।

বকুলের চোখের কোনে জল বেরিয়ে যায়, নয়নদা একদিন তো বাঁচিয়েছে। রাজখোয়াদা শিবানী বাইদেউ বলে,

---প্রণামিকা না এলে তোকে বাঁচানো যেতো না রে। কী করেছে মেয়েটা এই একমাস। নতুন চাকরিটাও তোর জন্য ছেড়ে দিল

প্রণামিকার কথায় চোখে জল আসে না বকুলের। প্রনামিকা তার জন্য করবে না তো কার জন্য করবে। বকুলের ভয় কমে না। এক আতঙ্ক। ভাইটিও দেখা করতে আসে, ওকে দেখলে ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে থাকে সে। নীল হয়ে যায় শরীর, জ্ঞান চলে যায় আবার। ডাক্তার আসে, আবার সুস্থ করে তোলে। ডাক্তার প্রণামিকাকে বলে মাকে বলে তাকেও বলে, এরকম হবে মাঝে মাঝে। তবে গুয়াহাটি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলে কমে যাবে। ভাইটি আবার আসে, বলে অটো করে নিয়ে যাবে বাড়ি। বকুল প্রণামিকার হাত শক্ত করে ধরে রাখে, বকুল কুঁকড়ে যায়, জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফেরার পরও প্রণামিকাকে বলতে পারে না ভাইটির কথা।

নয়নদা, নয়ন বরঠাকুরও যে এরপর বকুলকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠবে কল্পনাও করতে পারেনি বকুল। বকুল অফিস যাওয়ার উপযুক্ত হওয়ার পর নয়নদাও পাল্টে যায়। এমনিতে তার দোকানে যাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা ছিল না আগে যখন ইচ্ছে গেলেই হল। নয়নদা এবার ঠিক দশটায় বকুলকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে দোকানে ঢুকে যায়। রবিবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নবগ্রহে বশিষ্ঠে কখনও কামাখ্যা মন্দিরে, সঙ্গে থাকে প্রণামিকাও। জালুকবাড়ি পলাশবাড়ির পথে বকুলকে দেয় স্টিয়ারিং, শেখায় স্মুদ গাড়ি চালানোর বুদ্ধি। সাতমাইলে রুটি পরোটা চা খাইয়ে মন চাঙ্গা করে দেয়, কোনো দিন প্রণামিকার কথায় ভার্সিটি ক্যান্টিন দেখিয়ে আনে। গভীর বিশ্বাসে নয়নদা বকুলকে বলে গৌহাটি পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে। একবারও ব্রেক না চেপে পৌঁছে যায় মিলনপুর। সেই নয়নদার শিষ্যকে কিনা হিরণ বলে গাড়ি ঠিক মতো চালাচ্ছে নাতখন গৌহাটিতে কখানা আর গাড়ি, যুবক চালকদের মধ্যে নয়নদাকে চিনত সবাই।

বকুলকে সুস্থ করে তুলতে সব রকম চেষ্টাই করে নয়নদা আর প্রণামিকা। কিন্তু ভাইটিতে ভয় তার যায়নি। প্রণামিকাদের বাড়ি থেকে ভাইটির গলার আওয়াজ শুনলেই অসাড় হয়ে যায় শরীর মন, ভাতের গ্রাস পড়ে যায় মুখ থেকে। এসব কাণ্ড কারখানার কথা প্রণামিকা জানায় নয়নদাকে। ইন্সিওয়েন্স কেম্পানির বড় সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে নয়নদাই, আসামের বাইরে বদলির আবেদন জানায় কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে যায়। বকুল প্রণামিকাকে বলে,

--- এবার শিখার জন্য একটা ছেলে দেখ।

--- আমি দেখব ছেলে? ঘটক নাকি? মই অসমিয়া নহউ বঙালি।

--- তাতে কী হয়েছে, তুই তো আধা বাঙালি হয়ে গেছিস।

--- ঠিক আছে ঠিক আছে মাখন লাগাতে হবে না। কিন্তু বোনটাকে তো বিয়ের কনে করে তুলতে হবে। দেখছিস দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে।

বকুল খেয়াল করে নি ঠিকই। মাকে দিয়ে গগৈ ডাক্তারের কাছে পাঠায়। ডাক্তার বলে, কোনো অসুখ নেই, খাওয়া দাওয়া করতে হবে। তবু অসুখে পড়ে শিখা, একমাস ধরে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে মোটামুটি কিন্তু পায়খানা বন্ধ। ডাক্তার গগৈ বাসায় এসে দেখে যান, জোলাপের ব্যবস্থা করেন, কিছুই হয় না। মা কচুর ডাটায় তেল মাখিয়ে কত কসরত করে। সেরাতে তো শিখা চোখ উল্টে দেয় আর কী। সব আশাই প্রায় শেষ, মায়ের কান্না পাড়ার মানুষ জড়ো হয়, মহা মাহি আসেন প্রণামিকা আসে ভাইটিও আসে। বকুল ভয় পায় না ভাইটিকে। শুধু অসহায় চোখে প্রণামিকার দিকে তাকায়। ভাইটি চলে যায়, এর মধ্যেই মধ্যরাতে ভট ভট আওয়াজ অটোরিক্সার। ভাইটি আবার ফিরে আসে, পাঁজাকোলা করে শিখাকে উঠিয়ে নেয়, বকুলের মাকে বলে,

---মাহি তুমি আহিলে আহা, নহলে ময় অকলে তাইক লই যাম মেডিকেলত।

ভাইটি সেরাতে অটো করে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে কী যে ঘটত কে জানে। শিখা সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর আবার ভাইটির মুখটি মনে পড়ে বকুলের। নামঘরের সামনে হকিস্টিক হাতে তার মুখটি মনে পড়ায় আবার আতঙ্কিত হয় বকুল।

নয়নদার দুশ্চিন্তার অবসান হয়, কোম্পানির পদোন্নতির পরীক্ষা দেয় বকুল এবং পাশ করায় খুলে যায় সর্বভারতীয় বদলির রাস্তা। কলকাতা বদলি হওয়ায় কী খুশি নয়নদা। বলে,

--- গিয়েই একটা গাড়ি কিনবি। আমি কিন্তু ট্যাক্সি চড়তে পারব না।

প্রণামিকা খুশি হলেও মনের কথাটা বলে ফেলে চোখের জলে,

--- যাস না বকুল, অয় বেয়া বঙাল?

বকুল বলে,

--- উদ্‌বাস্তুর ধর্মই তো রে এ ঘাট থেকে ও ঘাটে যাওয়া। এখানে এসে হকিস্টিকের বাড়ি খেয়েছি ওখানে এর থেকে মারাত্মক কিছুও অপেক্ষা করতে পারে। জানি না। এখানে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী সুস্থিতি দিতে পারব নিশ্চিত তো নই তাই আবার একার এক্সোডাস

বকুলের মাও যেতে চাননি গৌহাটি ছেড়ে প্রণামিকাকে ছেড়ে। মা ভেবেছিলেন হয়তো শেষ পর্যন্ত প্রণামিকাকে বিয়ে করবে বকুল।

আর ফিরে তাকায় নি। প্রণামিকা নয়, বকুলের হয়েছে তার আপন ভাষার স্ত্রী। আর পরবর্তী প্রজন্ম, মেয়েকেও দিতে পেরেছে বকুল তার উত্তরাধিকারের ভাষাযদিও মেয়ে এখন অন্য এক ভাষায় কথা বলে, যা বাংলা নয় অসমিয়া নয় ইংলিশ হিন্দিও নয়, কন্নড় তেলেগু নয়। মেয়ে জেনেছে ভাষা লড়াই করার মাধ্যম নয়, মনের কথা বলার যোগাযোগের সোনার কাঠি। তাই এখন লড়াই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। জটিলতাহীন এক সহজ সমাজ গড়ছে হিরণরা আগরতলার মিত্রা ছন্দা তিতিররা তেজপুরের ভগদত্ত হাজরিকারা। কলকাতা শহরের জিএম বকুল চন্দ্র নাথও যন্ত্রের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন সে অটোরিক্সার ভটভট শব্দে আতঙ্কিত হয় না, হকিস্টিক দেখলে কুঁকড়ে যায় না। সদাব্যস্ত জীবনে ফুরসৎ কোথায় ফিরে দেখার। জীবনকে রিওয়াইণ্ড করার। শুধু এই ছুটি ছাটায় কয়েকদিনের জন্য মরুদ্যান ভরে যায় তার কন্যা হিরণের বাছাই করা ফুলে। কেউ একদিন থাকে কেউ পাঁচ ছয়দিন। তাই মনের আনন্দে সে হিরণের ভাষাগুরু ভগদত্ত হাজরিকার খিদমত খাটবে কদিন মেয়ের হয়ে গুরুদক্ষিণা দেবে।

গাড়ি বাড়ির গ্যারেজে ঢোকার আগেই হিরণ নেমে যায়। গাড়িতে শুধু বকুল আর ভগদত্ত হাজরিকাবকুল ভগদত্তকে প্রশ্ন করে,

--- গুয়াহাটিতে তোমার ঘর নু কত?

বকুলের কথাটি একটি বদ্ধ প্রশ্ন, উত্তর জানার ইচ্ছে নেই প্রশ্নকর্তার। কিংবা উত্তরে তো কিছুতেই বিহাবাড়ি কিংবা মিলনপুর আসবে না জবাব। বলবে আমার বাড়ি গুয়াহাটি নয় তেজপুরচেনামুখের ছেলেটিকে নিয়ে আতান্তরে বকুল তাকে এড়িয়ে যাওয়ার ফন্দি করে যায় শুধু। যদিও এক প্রজন্ম পেরিয়ে যাওয়া আসামের যেকোনো ছেলে মেয়েকেই তার আপন মনে হয়, মনে হয় বড়ো চেনা। তবু বকুল নাথের মনের উচাটন শেষ হয় না। যদি ভগদত্ত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানিয়ে দেয় তার আত্ম পরিচয়। বলে অমুক আমার বাবা কাকা মা কিংবা মাসিমা। কিছু একটা বললে তো বুকে জড়িয়ে ধরার কারণ হয়। ভগদত্ত বড়ো কম কথা কয়। বকুলকে খুশির জবাব দেয় না আবার খুশি হয় বকুল। হিরণ ডাকে দোতলা বাড়ির উপর থেকে। হিরণের ডাক শোনে,

--- ব্রেকফাস্ট রেডি, বেগেতে আহা বাপি।

পাঁচ শব্দের বাক্যে একটা মাত্র বাংলা শব্দেই খুশি বকুল। ভগদত্তকে ইশারায় বলে,

---চলো।

 

 

*****

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ