তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ

 


রণবীর পুরকায়স্থ


বিজনঘন গ্রামে খেলার আলো কখন কার ওপর ঘাপটি মেরে নেমে আসে, কেউ জানে না। লুকোচুরি আলোর অতকানো মেঘের তিতলি এখনও বনরাজিনীলা বাড়িতে সংগোপনে উচ্চারণের নাম।

সকাল নয়টায় সপ্ততিপর বসুন্ধরা সরস্বতী মেঘের খেলা দেখতে দেখতে হাসেন মেঘ ও রৌদ্রের যাকে পাবি তাকে ছোঁ খেলার অভ্যাস তাঁর নিত্যদিনকার। মেঘলা হোক রোদেলা হোক, গ্রামের বেপথু মায়ামমতাকে রোধে কার সাধ্য! জরতী বসুন্ধরা গোপন দুঃখ নিয়েও অভ্যাস-প্রেরণার খেলায় মাতে এক দীর্ঘসূত্রী কণ্ঠবায়ু। মিথ্যা ঝগড়ার মহড়া দিতে ভাল লাগে সাতসকালে! সারাদিনের জন্য উথালি পাথালির মনকে একপেশে করে রাখা। পবনপদবি এই সময়টা বসুন্ধরার জন্য ছেড়ে দেন। কালভার্টের উপর বসে বসে সারণি প্রস্তুত করা। সবার আগে নিজেকে তিরস্কার। শুভবুদ্ধি নিয়ে নাড়াচাড়া। দুঃখিত হওয়া। তিতলি আলোর অপেক্ষায় থাকা। দিনের প্রথম আলো দিয়ে জীবনের ফাঁক ভরাট করা। ফাঁকির জায়গা নিয়ে প্রতিদিনের ঝগড়া – ঝগড়া খেলা।

বসুন্ধরা ভাবেন স্বামী বড়ো বোকা! কিছুই বোঝে না।

ভুল মহাশয়া ভুল।

ভুল মন্ত্রে প্রতিদিন স্ত্রীকে নিরাময় দেন পবনপদবি। বলেন সময়ের চেয়ে বড়ো চিকিৎসক নেই। সময় সবাইকে রোগ-নিবৃত্তি দেয়।

--- তোমাকে দেয় নি।

বসুন্ধরার নিদান যুক্তিতর্কে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

--- ত্রিশ বছরের একা জীবনে মেয়ে তোমার একবারও ফিরে তাকিয়েছে? না তুমি অহংকার ভুলতে পেরেছ?

--- পারিনি। আমার আদর্শ আমার আনুগত্য।

--- কিসের আদর্শ কিসের এত অহংকার?

--- আমার ভাষা আমার মাতৃদুগ্ধ।

--- আর আমি? মা নই?

--- আমরা সমাজ বদ্ধ জীব বসু। সন্তান তোমার একার।

--- নেতা হলে সন্তান হয় না? কী পেয়েছ?

--- সম্মান বিশ্বাস।

--- কী দিয়েছ?

--- সব সব আমার জীবনটাই দিয়েছি।

--- ভাঙা বুকের পাঁজর খুলে দেখাতে পেরেছ কাউকে?

--- তোমাকে দেখিয়েছি। ভাগ করে নিয়েছি।

এমন কথা বসুন্ধরা কোনোদিনই স্বামীকে বলতে পারেন নি।

স্ত্রীমনের গহীন কূটযন্ত্রে অভাবিত সংলাপ সাজিয়ে পবনপদবি ভুলতে চান কৃতকর্মের সন্তাপ।

মিথ্যে ঝগড়ার মহড়া দিতে ভাল লাগে মেঘলা দিনে। স্বামী মহারাজের মনটাকে সারাদিনের জন্য উদাসী করে রাখা। একাকী আকাশে তাকিয়ে মেঘ ভাঙার হাতিয়ার খোঁজা যতক্ষণ না ঝমঝমিয়ে নামে বাদলের ধারা। বাদল বাউল ঝোলা থেকে বের করবে সারাদিনের সঞ্চয় মাধুকরী। ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষটা ভুলে যাবে তার ধর্মক্ষেত্র। বলবে বসু খিচুড়ি চাপাও আজ।

বসুন্ধরা সরস্বতীর খিচুড়ি-মিচুড়ি ভাল লাগে না। খেয়াল না-মেটা খেয়ালি মানুষের গোমড়ামুখ দেখতে ভাল লাগত প্রথম জীবনে। এখন ততটা পারেন না। কাটছাঁট তো হয়ই। সত্তর বছরের বসুন্ধরার বেঁচে থাকা পবনপদবি সরস্বতীর শখ মেটাতেই। দম দেওয়া পুতুলের মতো কাজ হাসিমুখে করতে হয় অভিযোগহীন। অবসরের দশ বৎসর পরেও আদর্শ বিদ্যালয়য়ের শিক্ষকতা করতে হয় অবৈতনিক। লেটার প্রেসের বাংলা ম্যাটার কম্পোজ করতে হয় অসমসাহসে। বাংলায় গান গাইতে হয় অঞ্জলিপুটে। তোমার সুর আমার সুর বিজনঘনর সুর মিলিয়ে।

মানুষটা বাঙালি।

বাঙালিয়ানার পরাকাষ্ঠা চলনে বলনে।

চলনে খুঁত আছে একটু। খুঁড়িয়ে হাঁটে। ডানপায়ের ভাঙা হাড় জোড়া লাগেনি একষট্টি ইংরেজি থেকে।

বলতেও নিখুঁত বাঙালি। বলে আমি বাঙালি মৌলবাদী। সারা পৃথিবীতে যেখানে যা কিছু বাঙালি আছে সব আমার।

বিপিন পাল থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি পর্যন্ত বিস্তৃত তার সাম্রাজ্য। জামা খুলে পতাকা উড়িয়েছে বলে কী আনন্দ! বলে বেশ করেছে। সাহেবের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে! আশ্চর্য এক বিষমতাও আছে মানুষের ব্যবহারে। সেই মানুষই বলে বাঙালির সর্বনাশ-হেতু নাকি এক স্থান কাল পাত্রের মহাযোটক।

স্থান কলকাতা শহর। কাল ঊনবিংশ শতাব্দী।

আর পাত্র চিৎপুরের রবিন ঠাকুর।

ত্রিশক্তির যে কোনও একটিকে মন্ত্রবলে সরিয়ে দিলেই খেল খতম।

শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব খর্ব।

এখানে ওখানে মার খাওয়া বঙ্গাল-খেদা উৎসবের স্থায়ী সমাপন।

মানুষটা পেটুক।

কচু মচু শুঁটকি সিদল বিরইন ভাত চুঙ্গাপিঠা জাতীয় উদ্ভট সব দেশীয় খাবারের মেনু প্রস্তুত হয় ভোর হতে না হতে। বাঙালির মতো তার প্রকৃতিতেও আছে খেয়ালিপনা। যখন তখন রোদ বৃষ্টি আর কুয়াশা খেলতে নামে এক্কাদোক্কা। ওপেনটি বায়স্কোপ। যে জেতে তারই রাজত্ব সারাবেলা। তারই নিয়মে পাকশালে জ্বলে উনুন। তরিবতিতে প্রস্তুত হয় আনন্দব্যঞ্জন।

আনন্দের অনিঃশেষ ধারা ছিল তিন বছর আগে।

একষট্টির ভাষা-আন্দোলনে উত্তাল গ্রাম-শহর ঘেরা বাংলার প্রান্তিক জনপদ। মিছিলে মিছিলে মুখর। মানুষটি ভোর হতেই চলে যায় শহরে। পয়দলে ফিরতে সেই সাঁঝ সন্ধে। লণ্ঠনের আলোয় উঠোন ঘিরে গ্রামজনতার উৎসুক কলরব।

দশ বছরের কিশোরী কন্যার কোঁচড় থেকে দু মুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে মানুষ শোনায় দিনের ধারাবিবরণী। রথীন সেন ছাড়া পেয়েই চলে এসেছেন করিমগঞ্জ জেল থেকে। কী অসাধারণ বক্তা এই ভাঙা কণ্ঠস্বরের অধিকারী জননেতা। ভাষা জননীর শৃঙ্খলমুক্তির বার্তা গান্ধীবাগের কয়েক হাজার শ্রোতা বয়ে নিয়ে গেছে গোটা জনপদে। কাল আসবেন নিশীথ দাস। সভাও মিছিল জনতার কণ্ঠ এক ঐকতানে ধ্বনিত হয়েছে বারবার- আমরি বাংলা ভাষা! রোমাঞ্চকর এই জনকল্লোলের। জনস্রোতের পরিমাপ আর জনরোষের মূল্যায়ন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে রক্ষক প্রশাসন। প্রশাসন প্রধান বি দোয়ারা।

তখন উন্মাদনার দিন তখন বিভেদহীন একাত্মতার দিন। বার্তা বাহকের। মুখের কথা শুনেই জনতা জানায়। প্রণাম। বন্দেমাতরম। তারপর যে যার ফিরিয়া যায় আপন ঘরে। দশমী কন্যা লণ্ঠন নিয়ে ফিরে যায় পাঠ প্রস্তুতিতে। অন্ধকারে আনন্দময় মানুষটিকে দুদণ্ডের নিবিড় দেখা দেখে আশ মেটে না বসুন্ধরা সরস্বতীর। লুপ্ত চরাচরে সময় বহিয়া যায় স্থাণুবৎ। এরই মধ্যে কখন যেন ‘নিশীথ ফুল্লকসুম যুগলবৎ’ জনক জননীর কাছে কন্যার প্রশ্ন। সমাসমুক্তি এবং বিশ্লেষণ। সময়োচিত প্রশ্নে পিতার গর্ব আর ধরে না। এগারোশো ছিয়াত্তররের মন্বন্তর থেকে বন্দেমাতরম। জাতীয় গানের সৃষ্টি। আনন্দমঠের গাম্ভীর্য ছেড়েও বেরিয়ে আসেন গর্বিত পিতা।

মিছিলের নতুন নতুন শ্লোগান শুনে মেয়ে বলে, আমিও যাব।

পিতামানুষ বলে, বন্দেমাতরম পুলিশের মাথাগরম।

চালিয়ার চালিয়াতি চলবে না। বিমলাপ্রসাদ চালিহা আসামের মুখ্যমন্ত্রী।

ফকরের ফকরামি। ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ মন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র, পুলিশ-প্রশাসন। সিদ্ধিনাথ শর্মা শিক্ষামন্ত্রী।

মানুষটা কেন যে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ল।

একদিন বাড়িতে নিয়ে এল এক ভারিক্কি জনকে। সে অনেক পরের কথা।

বললে দুলালদা। মাছ মাংস সবই খাবেন। সিঁদলপোড়াও চলবে।

ভীষণ বিব্রত হয়েছিলেন বসুন্ধরা দুলাল বড়ুয়ার আতিথ্য নিয়ে।

ভালমানুষ মানুষটি বসুন্ধরাকে ভগিনীর মর্যাদা দিয়েছিলেন।

এসেছিলেন আর একজনও সঙ্গে।

নন্দকিশোর সিংহ।

তৃতীয় ভুবন বাঙালির নয়নের মণি।

নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিচালনার প্রতিবাদে বিধানসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাভাষী মানুষটি।

দুলালদা মানুষটিও ছিলেন অসমীয়া।

মেয়ে অসমীয়া বন্ধুকে বিয়ে করতে চাইলেই বন্ধ হয়ে যায় আনন্দের ধারা। হৃদয়ের মণি একমাত্র সন্তানকেও ত্যাজ্য করতে বাধে না মানুষটির।

একাবাড়িতে পেটুক মানুষের আহারের অরুচি হয় কিছুদিন।

মেঘলা দিনে এখনও মনখারাপ।

বসুবুড়িকে মন লুকোলে কী হয়?

মনের দর্পণ মুখে প্রতিফলিত হয়।

মেঘ ডাকিলে যে বাপের আদর বাড়ে।

পরিপাটি শাস্ত্রীয় খিচুড়ি আর ডিমের বড়া।

ইলিশ মাছটাছ গ্রামে পাওয়া যায় না। মেয়েও পছন্দ করে না।

এখন আর জয় পরাজয় নেই। সব সিদ্ধান্তই টাই। বসুন্ধরা আর মনে কোনও নির্ণয়ই মেলান না। শেষ বিচারে জয় তব জয় বলে ছেড়ে দেন।

পবনপদবি সরস্বতীর মতেই মত।

বাহাত্তুরে মানুষটির রাজনীতি আর জনসেবায় আছে নিজস্ব মতবাদ।

হিল্লি দিল্লি বাংলা থেকে চাপিয়ে-দেওয়া কথা নেই তার ধ্যানধারণায়।

তাই সত্তর বছর বয়সেও দুবেলা রান্না করে জনসেবার চাকরি করতে বেরোন বসুন্ধরা।

সন্ধেবেলা বসুবাড়ি ফিরলে দুকাপ চা একসঙ্গে খেয়েই শুরু হয় সাহিত্য-পাঠও আলোচনা।

কে ভাল লিখল কার লেখা ছাপানো যাবে না। সবুজ কালির মার্কামারা পাণ্ডুলিপির সামনে মোম জ্বালিয়ে নেমে পড়বে গুটেনবার্গের সৈনিকরা। নব্বুই দিন পর অতিক্রান্ত হবে এক একটি ব্যূহ। বাংলা আর বাঙালিয়ানার অতন্দ্র প্রহরী সাহিত্য-পত্রিকা তৃতীয় ভুবন। চল্লিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যাওয়া কম কথা নয় একটি পত্রিকার। যারা পাঠক তারাই চালায় কাগজ। বিজ্ঞাপনহীন গ্রাহক-নির্ভর চল্লিশা কাগজ দুনিয়ার দুর্লভ।

পবনপদবির সম্পাদকীয় মজাও কম নয়। একষট্টির পঁচিশ বছর পর শুধু সম্পাদকীয় নিয়েই বেরোল ‘ভুবন’ পত্রিকা। এছাড়া বাংলা ভাষার শব্দ ও পদবিন্যাসে প্রতিবেশীরা চোখরাঙানি।

পবনপদবি প্রহরীর চোখ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। জুড়ে দেন বিতর্ক প্রতিবাদ। বসুন্ধরা এসব নিয়ে স্বামীকে খোঁচাখুঁচি কম করেন না। বলেন এ তিনমাসে নতুন কোনও বাংলা শব্দ গিলে ফেলল না তো প্রতিবেশী? বাংলা ভাষার আয়তন বৃদ্ধির সওয়াল কেউ করলে রক্ষা নেই। বিভীষণ-মীরজাফরদের বড়ো ভয় পবনপদবির।

চল্লিশ বছরের সাবালক পত্রিকাকে মায়ের মমতায় লালন করেন পবনপদবি। মতের মিল না হলে অসাহিত্যিক মন্তব্যও সহ্য করতে হয় সমালোচককে। আবার সাহিত্যিক অতিথিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে বনরাজিনীলায়। নিত্য সেবার ব্যবস্থা থাকে বসুন্ধরার আনন্দবাজারে। বসুন্ধরা বিহনে পবনপদবির গেরস্থালি অন্ধকার। তবে বসুন্ধরা কখনও কৃপণা নন। পেটুক মানুষের জন্য ব্যঞ্জন প্রস্তুত করে রেখে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত ব্যবস্থাটুকু ভোলেন না।

খাদ্যরসিকের নাকের ডগায় সকাল থেকেই গাজর ঝুলিয়ে যেতে হয়।

টিলাবাড়ির উপর থেকে নিচে নামতে নামতে শুরু হয় পাখি-পড়া। বলো পাখি ছোলা লঙ্কা মিষ্টি কুমড়ো। খাদ্যতালিকা মুখস্থ করিয়ে দিতে হয় স্মৃতি এবং শ্রুতিমাধ্যমে।

--- মুড়িঘণ্ট রয়েছে মিটসেফের উপরকোনে। বাসন্তীকে বলো গরম করে দেবে। ডাল কাঁঠালবিচি ভাজা নালিয়াশাক গরম না করলেও চলবে। সর্ষেবাটা দিয়ে চ্যাংমাছ পোড়া আছে বাসন্তীর জন্য। পছন্দ হলে নিও একটুখানি। ঘনিয়া মাছের ঝোলে আদাবাটা একটু বেশি হয়ে গেছে। বিলাতি ধনিয়ার পাতা একটু গরম করে দিতে বলো। সুখিয়া আদাজামির দিয়ে যাবে দুটো। মানুষ বুঝে চাল নিতে বলবে।

আগুন-গরম ভাত না হলে বাবুর রোচবে না উপাদেয় আহার্য। আঙরার টুকরো চুলা থেকে উঠিয়ে গামছা কাঁধে নদীর দিকে যেতে যেতে প্রতিদিনই হাঁক দেন পবনপদবি অনুপস্থিত পত্নীকে। বসু ভাত বাড়ো। বাসন্তী তখনই উনুন ধরায় লাকড়ির উপর শুকনো পাতা আর নেড়া বিছিয়ে। সব শুনে বসুন্ধরা মুচকি হাসেন আর বলেন তোমার মতো সুখী মানুষ দুটো হয় না। দু-দুটো বউ বসুন্ধরা নিয়ে তোমার সংসার। পবনপদবির কষের দাঁত দুদিকে দুটো নেই। বৌ-এর অমনধারা কথা শুনে বোকার মতো হাসেন আর তিন তিনটে হাসি ফোটে বেরোয় একই মুখে।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের বিবাহিত জীবন এখনও আছে তরতাজা। মানুষটা লুকোচুরি খেলতে ভালবাসে কিন্তু কোনও ধান্দাবাজি থাকে না। যেমন দোক্তা মুখে রেখেও বলবে ছেড়ে দিয়েছি কোনকালে। বলবে হাঁড়িয়াখোর সুখিয়াকে আমি পয়সা দেব সন্ধ্যের পর? তারপরই টলটল সুখিয়া এসে পায়ে পড়বে গোরলাগু বড়োবাবু, আট টাকায় দু গেলাস, দুটাকা ফেরত ঝনঝনা। বসুন্ধরা হাসেন ভেতরে। বাইরেটা শাসনে মোড়া থাকে। বুড়ো হলে কী হবে, হাত ফসকে বেরিয়ে গেলে এখনও যে কোনও অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারেন। ভালবাসার বিয়ে তাদের নয়। আবার ভালবেসে বিয়ে হয়েছে। বেকার মানুষটার জেদের কাছে কাত হয়ে গেল অভিভাবককুল। তিনটে শর্তে বিয়ে করতে রাজি। এক, পাত্রীকে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সভ্য হতে হবে। তখনকার দিন ওসব কেউ করত? বসুন্ধরা করতেন। নতুন পট্টির প্রতিবেশী অচিন্ত্য ভট্টাচার্য ডাকসাইটে নেতা। বীরেশ মিশ্র শ্রমিক নেতা। তো মিলে গেল প্রথম শর্ত। দুই, কোর্টে বিয়ে করতে হবে। রাজি। এখানে একটু লুকোচুরি খেলেছিল ছোড়দা। বললে, আমরাও কোর্টেই ঝামেলা চুকিয়ে দিতে রাজি। মাকে শুধু পারছি না। হার্টের রুগি, কখন কী হয়। ব্যাস দয়ার সাগর ভিজে গেল মন। যদিদং করেই বিয়ে হল টোপর মাথায়। তিন নম্বর শর্তটাই মানতে পারেন নি বসুন্ধরা। নিজের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। এ কেমন উদ্ভট শর্ত! এই একটি শর্তেই যখন পরিবার থেকে নাকচ করে দেওয়ার প্রস্তুতি সমাপ্ত তখনই বসুন্ধরা জেদ চাপল। ভালবাসলেন মানুষটাকে। লুকিয়ে দেখা করলেন গান্ধীবাগে। অভিমানে স্কুল-মাস্টারির চাকরি নিয়ে নিলেন। সারাজীবনে একবারও বলতে পারেন নি, এ কেমন উলটো নিয়ম?

তুমি কিছু করবে না, আমাকে চাকরি করতে হবে?

আর এক অভিমান আছে বসুন্ধরার।

অভিমান দেশ বেড়ানোর।

এত যে বাংলা বাংলা করে মানুষটা, বাংলাই দেখল না।

নিজেকেই ঠকাতে খুব ওস্তাদ।

বলে গণেশ ঠাকুরের গল্পটা জানো না? কার্তিক-গণেশ দুই ভাইয়ের ওপর নির্দেশ হলো তীর্থভ্রমণের। কার্তিক ঠাকুর ময়ূর চড়ে সর্বতীর্থ সেরে এসে দেখেন ভুঁড়ো বদন ছোটভাই মার কোলে বসে আদর খাচ্ছে। বসুন্ধরা থামিয়ে দেন চতুর মানুষকে। বলেন, জানা আছে গল্প। পবনপদবি বলেন, কী হবে ঘুরে বেড়িয়ে। বাংলাকে তো আমি চিনি। গোলাপ কত রকমের হয় বলো। লাল-নীল-হলদে হাজার রকমের। বরাক বাংলা  হুগলী ভাগীরথী বাংলা আর পদ্মাযমুনা বাংলাও তেমনি। পবনপদবির মনে গভীর এক অভিমানও আছে বাংলা নিয়ে। দুয়োরানীর সন্তান বরাক বাংলা নিয়ে এত গর্বের কী আছে? বাকি দুই ভাগ তো চেনেই না কোথায় হাইলাকান্দি কোথায় শিলচর করিমগঞ্জ। একুশের শহিদ সালাম বরকত যত চেনা উনিশের কমলা শচীনকে চেনে কতজন? তাই বেড়াতে যান না কোথাও। মাকে ঘিরে তিনপাক সেরে পৃথিবীর আনন্দ অনুভব করেন। যদিও অজুহাত রয়েছে পায়ে। কী করে যাই বলো, ল্যাংড়া মানুষ। একষট্টির দুপুরে দমদমাদম গুলিবৃষ্টি শুরু হলো শিলচর রেল ইস্টিশনে। পঁয়তিরিশ বছরের যুবক সর্বাধিনায়কের সাক্ষাৎকার সেরে ফিরছে মালুগ্রাম থেকে। অহিংস কিন্তু গেরিলা পদ্ধতিতে মিটিং সমাবেশ তখন। পুলিশ আর টিকটিকিতে ভর্তি উপত্যকা। সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুঞ্জন। অধিনায়ককে ধরলেই আন্দোলনের রাশ টানা যাবে। তাই ফিসফিসে ছড়িয়ে দেওয়া হয় আন্ডারগ্রাউন্ড ডিটেক্টরের আগমনবার্তা। পুলিশ গোয়েন্দা বিভ্রান্ত করে সভা হয় নির্বিঘ্নে। পরবর্তী গোপন পদক্ষেপ সংকেত নিয়ে নির্বিরোধী পবনপদবি দশমী কন্যাকে নিয়ে যান ইস্টিশন। পুলিশের সন্দেহ থেকে বাঁচার মোক্ষম কবচ তার আত্মজা, কোনও প্ররোচনা নেই। নিশ্চিন্ত ছাত্রছাত্রীরা নিদাঘ তাপ থেকে বাঁচতে ছায়া দেখে গা এলিয়ে দিয়েছে রেললাইনের উপর। দুনম্বর-একনম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে এসেছে ছায়া। লুচি-আলুর দম দু-এক প্যাকেট তখনও পড়ে আছে ইতস্তত। অনুপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকের নামাঙ্কিত হয়ে। পবনপদবির খাওয়া হয়নি কিছু। দায়িত্ব পালন না হওয়া পর্যন্ত রোচবে না তার। বালিকা কন্যা পেটে সকালবেলার মুঠি। ক্ষুদের জাউ আর বচুড়ি। পিতার না হয় সারাদিনের খুঁটি হয়ে থাকল। মেয়েকে লুচির লোভ দেখাতেই মাথা কাত। একটা স্বেচ্ছাসেবক প্যাকেট দিয়ে উঠিয়ে দিলেন খালি কামরায়।

পবনপদবি দেখলেন চোখের সাম্নী গুলি ভরার পজিশন। যেখানে নীলমণির চা-সিঙড়ার দোকান কার্তিকের পান বিড়ির। বন্দুকের ধাতু আর ভারী জুতোর মর্মর। লোহা আর পাথরের খটখটাখট। উপত্যকার নিস্তরঙ্গ জীবনে পরিকল্পিত মৃত্যুর কড়া নাড়া। হতভম্ব পবনপদবি স্বার্থপর মানুষের দায়িত্ববোধে এক পা উঠিয়ে দেন স্থির হয়ে থাকা যাত্রীগাড়ির পাদানিতে। প্রথম উঠেছিল ডান পা। হাঁটুতে লাগল গুলি। অদম্য সাহসে ল্যাংচে-ল্যাংচে গেলেন গাড়িতে। মেয়েকে জড়িয়ে বসে রইলেন। যতক্ষণ না থামে কড়কড়াকড় বজ্রপতনের শব্দ। আমের ভেতর আঁটিটিকে অক্ষত রাখলেন পবনপদবি। বসুন্ধরার পরানের ধন ফিরিয়ে দিতে পারলেন যেমন এনেছিলেন। একবারও ভাবলেন না নিজের বিক্ষত পায়ের কথা। হয়তো গোলাগুলি থেমেছিল তাই লাফ দিয়ে নামলেন। সেই ছায়ানিবিড় কচিকাঁচার ভিড় নেই আর, এক মুহূর্তেই ফুলের বাগান হয়ে গেল বধ্যভূমি।

স্টেশনের সামনেই জলাশয়। তারই পারে পারে দৌড়। একহাতে মেয়ে, একহাত উরাতে। চলতে চলতে উরাতের হাত সরে গেল। রক্ত গড়িয়ে পড়ল কি পড়ল না দেখে কে? সবাই দৌড়চ্ছে, একজন জলে পড়ে যেতেই মেয়ে বলল, বাবা। মেয়ে জানে তার পিতাকে। অভিভাবক মানুষের কর্তব্যচ্যুতি ঘটল। জলমগ্নকে উদ্ধারের কোনও চেষ্টাই করলেন না। কতক্ষণে পৌছবেন তারাপুরের রাজপথ তারপর গলিঘুঁজি চাঁদমারি মালিনীবিল। ল্যাংড়া দৌড় একটানা তিনঘণ্টা। স্বার্থপর মানুষ পৌঁছে গেলেন বিজনঘনয়। বসুন্ধরার হাতে মেয়েকে সঁপে  দিয়ে জ্ঞান হারালেন পবনপদবি।

তিনদিন বেহুঁশ। শিলচর থেকে ডাক্তার আনিয়ে চিকিৎসায় সময় নষ্ট অনেক। হোমিওপ্যাথির বীরেশ বৈদ্য আর কবিরাজ মিথিলেশ শর্মাকে চিকিৎসার এমন উচ্চতায় পৌঁছাতে কেউ দেখেনি। শল্যবিদের নৈপুণ্যে হাড়জোড়র প্রলেপ তিনদিনের বন্ধনশেষে পবনপদবির ডান পা নড়ে উঠল। হুঁশ ফিরল। বললেন আমি যাব। কোথায় যাবেন? যেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন। বসুন্ধরা বাধা দেন নি। মধুরামুখে চিতাভস্মে নিয়ে মৌনযাত্রার সঙ্গী হয়েছিলেন ভাঙাপায়ের স্বেচ্ছাসেবক।

সেই প্রথম ও শেষ। স্বামীর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। মধুরামুখে বসুন্ধরা সঙ্গে ছিলেন। ছিল দশমী কন্যাও এগারোজন শহিদকে ভাষা উপত্যকা ভুলতে পারেনি  কোনোদিন। ভুলবে না। শহিদের রক্ত ভোলা যায় না। প্রতিদিনই তখন এক একটি কর্মসূচি। প্রভাতফেরি। গান। একদশ শহিদেরা ভাই। হবে জয় হবে জয়। সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরই অপমান।

কোর্ট-কাছারি-অফিস অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। গৌহাটি কলকাতা থেকে নেতা আসছেন প্রতিদিন। কুম্ভীরগ্রাম বিমানঘাঁটি থেকে সদরঘাট-খেয়াঘাট। লালবাহাদুর শাস্ত্রী এলেন ত্রিভাষা সূত্র নিয়ে। গঠিত হলো মেহেরোত্রা কমিশন। নামী দামী ব্যারিস্টার এলেন কলকাতা থেকে। এন সি চ্যাটার্জিকে মাল্যদান করা হলো সদরঘাটে। একটি ফুলের মতো মেয়ে ফুল দিতে এসে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করল শপথ। রক্ত দেব ভাষা দেব না। সেই মেয়ে পথে গান গেয়ে ফেরে। বাপ শিখিয়ে দেয় মাতৃদুগ্ধের কথা। শিখিয়ে দেয় ভাষাঋণ কাকে বলে।

মেঘলা দিনে ভাবনার ঝাঁপি হাট করে খুলে বসেন কালভার্টের উপর। সময় নেবে গো সময়? সারা দিনমান ঘুষঘুষে জ্বরের প্রকোপে কাটে। শেষ বিকেলে ক্রোসিন-গোলা জল দিয়ে নিরাময় করেন বাসুবাড়ি। উলটোকথায় ফিরিয়ে আনেন কুল-হারানো তরণী। বলেন, মেয়ে মেয়ে মেয়ে। সর্বক্ষণ মেয়ের ভাবনায় বুঁদ। মেয়ে ছাড়া কি কেউ নেই পৃথিবীতে? এত যদি সোহাগ তবে তাড়িয়েছিলে কেন?

পবনপদবি জানেন এরপর বর্ষণসম্ভব মেঘকে রোধ করা যাবে না। তাই সারাদিনের মেঘভার সরিয়ে বের করে আনেন একটি তারা আকাশে। মন ভোলানো সংলাপে নিবেদন করেন প্রেমের অর্ঘ্য। ওগো দূরদ্বীপবাসিনী, তুমি যে আমার সাঁঝের তারকা। তুমি আমার মরণকালের গীতার মতো শিয়রশায়ী। তুমি আছো বলে মেঘে জল।

বসুন্ধরা পবনপদবির মেঘে জলসঞ্চার করেছেন সর্বদা। মানুষটার খেয়ালকে যেমন প্রশ্রয় দিয়েছেন, বেখেয়াল নিয়েও মেতেছেন। বাংলা নিয়ে সারাজীবনের উন্মাদনা মেনে নিয়েছেন। সাহিত্য নিয়ে মেটে থাকাও মেনে নিয়েছেন।

ওখানেও এক নৈতিকতার নিশান আছে।

নিছক গল্প কবিতা ছাপানোর কাগজ নয় তৃতীয় ভুবন।

ভুবনভাবনায় মাতিয়ে দিয়েছেন পবনপদবি বসুন্ধরাকে।

কলকাতা ঢাকা তাদের নিজস্ব ভুবন নিয়ে মাতোয়ারা।

তৃতীয় ভুবনের নামও জানে না কেউ।

লাল নীল হলুদ ফুলের সমারোহ থাকুক না হয় রাজবাড়ির গোলাপবাগানে। কালো গোলাপের প্রান্তিক চাষী হয়েই থাকবেন পবনপদবি।

তৃতীয় ভুবন পত্রে তাই নেই কোনও বিজ্ঞাপনের বাজার।

নেই বাঁধা গতের গল্প কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস।

নেই কোনও শারদ সংখ্যা বিশেষ সংখ্যা।

সব সংখ্যাই এখানে বাংলা সংখ্যা।

তৃতীয় ভুবনের বাংলা।

বসুন্ধরার জলসিঞ্চনের ক্ষমতা জতদিন আছে করে যাচ্ছে অকৃপণভাবে।

আবার বেখেয়াল-কেও বাধা দিতে পারেন নি প্রাণভরে।

প্রতিবারেই মনে হয়েছে এবারের নির্বাচনে মানুষটি জিতবে।

বিধায়ক হয়ে যাবে দিসপুর।

এক এক বিঘে জমি বেচেছেন জলের দরে।

অবসরে অর্থ দিয়ে পোস্টার ছাপিয়েছেন। কর্মীবৃন্দের ভাণ্ডারা সাজিয়েছেন বাড়িতে।

জনপ্রিয় মানুষের জেতার পথেও কোনো বাধা ছিল না কোনও কালে।

নিজেই নিজের শত্রু হলে জেতাবে কে?

বাংলা ভাষার ধর্মপুত্র তিনি।

নির্বাচনের চৌসর খেলার শখ হয়েছে তাই মনোনয়ন ভোটপত্র।

এক-একজনের এক-এক উদ্দেশ্য।

পবনপদবির খেলা হেরে যাওয়ার জন্য।

বসুন্ধরার বাজি আর একটি শরাইঘাটের যুদ্ধ।

মুখোমুখি পিতাপুত্রী।

যদি দেখা হয় গুয়াহাটির দিসপুরের বিধানসভায়।

 

পবনপদবি যখন তিন মুখের হাসি দিয়ে পরাজয় বরণ করেন তখনই রাগ হয়

বসুন্ধরার।

মানুষটার দ্বিচারিতায় ক্রোধও হয়।

হেরে গিয়ে যদি এত হাসি, সন্তানের বেলায় কেন জেদ?

সমাজ ছাড়াও কি ব্যক্তিগত কোনও পরিচয় নেই পিতার?

পিতার নাম না থাক মাতার তো আছে।

এমন গুরুদন্ডের অধিকারী তারা মাতাপুত্রী?

 

বাপও কম বন্ধু ছিল না।

কন্যার প্রতিভার স্ফুরণে পিতা সবই করেছেন।

বিদ্যালয়-বিদায়ী পরীক্ষায় বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্ব বিজনঘন গ্রামের

পবনপদবি সরস্বতী পুত্রীর।

তৃতীয় ভুবনে কবিতা লিখেছে নিয়মিত।

বঞ্চনা আর অবিচারের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন পিতা।

দেশভাগের দগবগে ঘায়ের প্রকোপ দেখেছেন পবনপদবি পরিণত কৈশোরে। শুধু

ধর্মাচরণের বিভিন্নতা থেকে দলে দলে মানুষ হয়ে গেল বাস্তুহারা।

মেয়ে দেখেনি। জানেও না কিছু।

মেয়েকে শুনিয়েছেন তেভাগা আন্দোলনের কথা। মুসলিম লিগ আর কংগ্রেসের

রাজনীতি। শিখিয়েছেন ছড়া-কবিতা। 

জাতের নামে বজ্জাতি সব/ জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া

তেলের শিশি ভাঙলে পরে খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যেসব ধেড়েখোকা ভারত

ভেঙে ভাগ করো।

পিতা চেয়েছেন সন্তান হোক মুক্তমনা।

মেয়েকে সমাজসচেতন করতে ব্যক্তিকে ভুলতে শেখাননি বসুন্ধরা।

বসুন্ধরা কখনও ভাষিক মৌলবাদের পাঠ দেননি বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সন্তানকে।

অসমিয়া যুবকের সঙ্গে বন্ধুত্বে এমন কি সর্বনাশের ভূত দেখতে পেলেন পিতা পবনপদবি?

এমনিতে তো বাড়িতে অসমিয়া পুরুষের প্রবেশ নিষেধ নয়।

দুলাল বড়ুয়া বিধায়ক থেকে গেছেন।

 

নির্বাচনে হেরে প্রিয় শিষ্যের সঙ্গে খুশিতে মেতেছেন পবনপদবি সরস্বতী। ধুতির উরাতে থাবড়া মেরে কাঁকনকে বলেছেন দেখবি পরের বার আমি জিতব নিশ্চয়। রানাপ্রতাপ এবার জিতে গেল স্রেফ তার নামের জোরে। লড়াকু মানসিকতার জন্য। আমার যদি বয়সটা থাকত দেখিয়ে দিতাম মেবারের রানাকে।

দেখানো-টেকানো কিছু নয়। লোকটার অহংকার।

পিতৃপ্রতিম অবস্থানটা কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে রাজি নয়।

রানাপ্রতাপও তারই হাতে গড়া নেতা।

পবনপদবি বোঝেন শুধু বাংলা ভাষার দরদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। একজনই পেরেছিল বাংলায়। শেখ মুজিব।

এদেশে চাই দোল। সর্বভারতীয় দল না হলে কিছু হবে না।

একটা কালভার্টও না। ইস্কুল সার বীজধানের জন্য চাই রানাপ্রতাপ আর তার দলকেই।

বসুন্ধরা জানেন মানুষটি মহাপুরুষ নয়।

দোষেগুণে জড়াজড়ি।

কিছু অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মানুষটি নেশা করে।

বসুন্ধরা জানেন লড়তে নামা কেন, হেরে ফিরে আসাই বা কেন?

তাও তার একান্ত আপন এই গোপন শত্রুমানুষকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। অসহায় পিতাও সমঝোতার একটি মাঝামাঝি পন্থা হিসেবে স্ত্রীর যাবতীয় সঞ্চয় ও পৈতৃক সম্পত্তির বিক্রিবাটা করে পরতে চান হেমকুণ্ডল মণিময় তাজ। জয়ের মুখে এসে অহংকারের দোলাচলে ভাঙবেন না।

 

মেঘলা দিনেই ওসব ভাবনার বিব্রত করে বেশি পবনপদবিকে।

সব ভুলে কালভার্টের উপর বসে থাকেন। ভুলে যান এই সময়টাই বিজনঘনর বনরাজিনীলা বাড়ির ব্যস্ততম সময়। বসুন্ধরা বেরোবেন মাস্টারি করতে। বসুন্ধরার কাছাকাছি না থাকলে আর বিষয়ানুক্রমিক লেখা থাকবে না দিনের সূচিপত্রে। তাও পবনপদবি তীর্থযাত্রীর মতো অঞ্জলিবদ্ধ বসে থাকবেন নালার ধারে। জোড়া হাতে আছে অর্থ আর ফিরিস্তি। দুরকম হোমিওপ্যাথি একরকম সাধারণ আলোপ্যাথি একরিম ছাপার কাগজ ও কালি এককৌটো, উজালা একশিশি। প্রতিদিনের ধুতিশার্ট ধবধবে রাখতে দুফোঁটা উজালা চাইই। সেসব দিন এখন আর নেই। দুপয়সার নীল একটুকরো কিনে ন্যাকড়া বেঁধে জলে গুলতে হত। তারপর এল রবিন-গুঁড়ো নীলের জমানা। এখন দুফোঁটা। আর আছে এক গোপন জহরত। নেশার পাতা। কাঁকন শিষ্য প্রশ্রয় দেয়। সপ্তাহে একদিন কাঁকন যায় শিলচর পবনপদবির ফরমাশ খাটতে। বসুন্ধরা জানেন সব বৃত্তান্ত। জানেন আবগারি বস্তুর গোপন পাচার-কথা। জানলেও উচ্চবাচ্য করেন না। অসহায় মুহূর্তে নেশার চেয়ে উপশম কিছুতেই নেই। বিহারিদের মতো আশি নব্বই শ তাল দিতে  হয় না পবনপদবির। গোল-পাতা শাদা টুকরো করে মুখে রেখে দিলেই মৌতাত। অভিনব দোক্তাসেবন।

কালভার্ট পেরিয়ে বাস থামতেই টুক করে অর্থ ফর্দ ধরিয়ে দেন জানালার আগ্রহী হাতে। গ্রামগঞ্জে এমন হয়। বাড়ির সামনে বাস থামিয়ে ওঠানামা হয়। সম্ভ্রান্ত হলে তো কথাই নেই। দিনে তো সাকুল্যে চারজোড়া বাস- এর আসা-যাওয়া। যান চলাচলের এমন নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জোরে গাড়ি চালানোর সাহস বিজনঘন গ্রামের কেউ ভাবতেই পারে না।

অভাবিতই ঘটে গেল! এমন জোরে ব্রেক কষল গাড়ি যে আশেপাশে দু-একটা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল আর্তনাদ। বাসভর্তি মানুষের হায় হায় রব। গারিটা কি একবার লাফিয়ে উঠল থেমে যাওয়ার আগে? পবনপদবি সরস্বতী বাঁচলেন একটা বড়সড় দুর্ঘটনার কবল থেকে। আসলে তিতলি মেঘের আলো এমন ঘন নয় যে সুমোগাড়ি হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়তে চাইবে প্রভাবশালী গ্রামপুরুষের গায়ের ওপর। ইচ্ছাকৃত অভিসন্ধিতেই টালমাটাল হলেন পবনপদবি বাহাত্তর। গ্রামের সখা কাঁকন, মৃদুতা যার স্বভাবের নির্যাস, সেও রাগল ঘটনা আকস্মিকতায়। স্যারের গোলপাতা দোক্তা কাগজ কালি উজালার বাজার আপাতত পিছোল অনির্দিষ্টকাল। ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে গেল দুর্বিনীত চালকের দিকে। সঙ্গে অনুগামী যাত্রীদল। জড়ো হওয়া জনমণ্ডলী। এত বড়ো দুঃসাহস! পবনপদবি সরস্বতী ওপর আক্রমণ। জনরোষ কারে কয় আজ দেখবে দুষ্কৃতি! কিন্তু হায়। প্রাথমিক জনশিক্ষা কার্যক্রম পথিমধ্যেই বিপর্যস্ত হয়। সুমোগাড়ির চালক দরজার ওপর অপ্রস্তুত। স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া গতি ছিল না ভবিষ্যৎ জননায়ক কাঁকনবন্ধন প্রজাপতির।

ভাস্কর অঙ্কনপ্রসাদ হজরিকা বিজয় সিংহ বাঙালির স্ট্যাচু নিয়ে এসেছে গৌহাটি থেকে। সদরঘাটে যেখানে এন সি চ্যাটার্জি লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে সম্বর্ধনা দিয়েছিল বরাকের বাঙালি। ফুলের মালা দিয়েছিল এক কিশোরী। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিল রক্ত দেব ভাষা দেব না। বলেছিল মুখের ভাষা বুকের রুধির।

বাঙালি বাঁচাও কমিটির সভাপতি প্রকাশচাঁদ সুরনার খুঁতখুঁতানিতে আবার নতুন করে কাস্টিং হচ্ছে বিজয় সিংহের পৈতে। বারোগাছার লগুন তো ব্রাহ্মণ পরে। বিজয় সিংহ ক্ষত্রিয় তাই ছয়গাছা করতে হবে। ভাস্কর-কন্যা তপজা বললে, আমি যাই দেউতা ঘুরে আসি মাতৃভূমি। উৎসাহী সভাপতি বললে, গাড়ি দিচ্ছি ম্যাডাম। ড্রাইভার ভি দিচ্ছি ইভন আমার লেড়কি কাছাড় কলেজে থার্ড ইয়ার টিডিসি। সঙ্গে লিয়ে যান। বাঙালির কালচার দেখবেন তো? শিখিয়ে দেবে। বহুত কুছ মিলে যায় বাঙালি-আসামির। ডাল ভাত পানি।

বাঃ! চল্লিশ বছরে আবার বাঙালির নবজাগরণ হলো তাহলে? নতুন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ঈশান বাংলায়। নতুন লালা ক্লাইভ! তপজা বলে সঙ্গী দিতে চাইছে ব্যবসায়ী। তপজা তেমন বাপের মেয়ে নয়। বললে, আপনার ছেলে নেই?-কেন নেই? চার ছেলে আমার। - দিন না একজনকে আমার সঙ্গে। সহি সালামত ফিরিয়ে দেব। - লিয়ে যান। আপনারই বাল বচ্চা। কিন্তু ম্যাডাম ওরা যে গদিতে আছে। - একজনকে ফ্রি করে দিন। - দিয়েছি। ছোটটার ওপর ইনেগুরেশনের ভার। আপনাকে ভাল গাড়ি দিচ্ছি ড্রাইভার ভি ভাল।– ড্রাইভার দেবেন না। আমি চালাব। - লাইসেন্স সঙ্গে আছে? – আছে আছে। আমার ফাদার দেউতা গ্যারেন্টি।

মার কাছে থেকে তপজা ধার করে এনেছে প্রভূত সম্পদ। মা বলেছে নিয়ে যা আমার সব উদ্‌বৃত্ত। অফেরতযোগ্য মাতৃঋণ শোধ করতে তাই রণে চলল মেয়ে তপজা। মা বলেছে, বারুদ গন্ধে আমার ঘুম ভাঙে। একষট্টির উনিশে মে। মা শহিদ হয়ে যেতে পারত শিলচর রেলস্টেশনে। তপজা মার কাছ থেকে গুলিচালনার গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছে। বলেছে, তোমার সব মনে আছে? মা বলেছে, না। সব নতুন করে সাজিয়েছি। সবাই সাজিয়ে দিয়েছে। শুধু মনে আছে, দশ মাইল দৌড়েছি বাবার হাত ধরে-তারপর? –গান গেয়েছি শহিদবেদির তলায়। মালা দিয়েছি। দশ থেকে কুড়ি বছর ভাষণ দিয়েছি জ্বালামুখি। শহিদের রক্ত ভুলছি না ভুলব না। ভস্মকলস ভাসিয়েছি মধুরামুখে।

--- এত সবের পর পালটে গেলে কী করে?

--- পালটাই নি। পিতা কখনও পাল্টানোর শিক্ষা দেন নি। স্বচ্ছ দেখার চোখ দিয়েছেন।

--- তুমিই বলতে তোমার পিতা ছিলেন ভাষিক মৌলবাদী।

--- এখনও আছেন। তাই তো বাঙালি প্রতীক পুরুষের মূর্তি বানানোয় আপত্তি। ভাষা ব্যবসায়ীদের প্রতি লড়াই। তৃতীয় ভুবন সম্পাদকীয়তে একে হাস্যকর বলা হয়েছে। বাঙালি বীর কোনও মূর্তির মানব নয়। বই পুস্তকের কাল্পনিক পুরুষ। বাঙালি-মনের গর্ব।

--- দেউতা রাজি হলো কেন?

--- বলব না।

--- আমি জানি উপলক্ষ তো হলো। পৌত্রী দেখানো  অভিলাষ তোমাদের।

--- তোর বাবার ইচ্ছা। মানুষটা ছিল তেজস্বী বক্তা। অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শিল্পী। জানি না কাকে দেখে ভাল লাগল। যৌবনের ধর্মে আমরা তেজ দেখিয়েছি। এখন যেমন সাম্যবাদী আমরা।

--- আমার দিদুকেও সাম্যবাদী বেছে বের করেছে দাদু।

--- হয়তো মার শিক্ষা। তোর দাদু যতোই হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিক। এক অসমিয়া শিল্পী বাঙালি বীরের মূর্তি গড়ছে, এই কি যথেষ্ট নয়?

--- তুমিও তো বিহুনাচ করো।

--- আমি ধামাইল করি। মনসামঙ্গল করি। নাচিয়া ভুলাও তো দেখি দেব ত্রিপুরারি।

তপজা মার কাছ থেকে মণিমুক্তোর মতো স্থাননাম মুখস্থ করেছে শৈশব থেকে। কনকপুর দুধপাতিল বেরেঙ্গা ঝাঞ্ঝারবালি ঝাঁপিরবন্দ ডুঙরিরপার খাগিরা মেষাবিল রাঙ্গিরখাড়ি মাঝিরগ্রাম আলগাপুর যাত্রাপুর ফুলবাড়ি বড়খলা ইটখলা। মাকে বুঝতেও দেয়নি। মাতৃভূমির টান তো তপজারও আছে। তার থেকে বেশি টানে তার মাতামহ। গান্ধীর মাতামহী। মন যখন খুলল, মা তখন কুচিলা গ্রামের বড়ঝরনা। তপজা অঞ্জলি সাজিয়ে ছোট বিলে সব জমিয়ে রাখে মিঠিপানি। মার সিন্দুকে অকারণ টানাটানি করলে খোলে না কিছুতেই। কম্বিনেশন তালায় মাতৃহৃদয়ের জাদু লাগলে চোখ ঝলসে যায়। বিজনঘন গ্রাম আর বনরাজিনীলা বাড়ির কথায় মার অস্থিরতা বাড়ে। উত্তর-পঞ্চাশের মা এখনও অস্থির হয়ে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। বলে মানুষের মন বড়ো আজব রে। কোনও কারণ নেই, জটিলতা এসে বলবে তোর ঠাকুরদাদা আমার জলঘোলা করেছিল।

আসলে এক এক বয়সের এক এক যন্ত্রণা। আমার পিতা সেটা বুঝতে পারেনি। আমাদের জেদ আমাদের অহংকারকেই ভেবেছি শুদ্ধ, সত্য। আমার তখন কত আর বয়স? বাইশ তেইশে কি কেউ অত বোঝে? তখন দুর্বার যৌবন। যৌবনের মতো স্বার্থপর কিছু নেই। অবুঝ একরোখা।

মা বাবাকে বুঝলাম না। কষ্ট দিলাম।

দুই যুবক ছিল।

হাতে ছিল কয়েন। যে কোনও একজনকে বাছতে পারতাম। ভুল বলব না। ওলটপালট হয়ে গেল।

তোর দাদুর স্ববৃত্ত সাম্রাজ্য আঘাত করি নি। মাতৃভাষা নিয়ে কোনও রাজনীতিতে জড়াই নি বলে জাতশত্রু। বিজনঘন আমাকে নির্বাসন দিল। তোর দাদুর আদর্শ প্রতিবাদী হতে পারল না। আমার মা স্বামীকেই বেছে নিলেন সত্যপুরুষ। তোর মা ই কি তাহলে আদর্শহীনা?

গান গেয়ে কখনও কোনও বিপল্ব সমাধা হয় নি। হয়নি জেনেও তপজা গায়, তার মা গাইত বাংলা ভাষার গান, গেয়ে উদ্বুদ্ধ করত ভাষাজনদের। এখনও গায় বাংলা অসমিয়া। পৃথিবীর তেরোটি ভাষার গায়। তপজা নাচে। ওর মা নাচত। শরীরী গঠনতন্ত্রের প্রদর্শনী নয়। মানুষের উর্দ্ধতন গতিও যাত্রার সাংকেতিক বিবরণ। নবভাষা। তপজা আঁকতে পারে না। গড়তে পারে না পিতা দেউতার মতো।

পিতা বলেন অঙ্কনের কোনও জাত নেই। এক ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা নেই। মুখের ভাষা ইশারায় মিথ্যা আর দুষ্টুমি আছে বলে অঙ্কনপ্রসাদ কথা বলেন কম। তপজা দূর থেকে বাপকে স্যালুট করে। বলে, আমি অত পরিশ্রমী নই, মূর্তি টুর্তি গড়তে পারি না। আমি কথা বলতে পারি। ঝগড়া করতে পারি। তাই আমি যোগসূত্রের কাজ করি। আমি সাংবাদিক। পত্রকার। আই আই টিতে তিন বৎসর পড়ে ফেল করে এখন সে পুরোদস্তুর ফ্রিল্যান্সার। শালগঙ্গার মন্দির পাহাড়ে পাথরের খোদাই সাধুবাবাকে দেখতে অবিকল নেতাজির মতো। মা বলে বাঙালি খুব নেতাজি ভক্ত। বাঙালি মনের মাধুরী মিশিয়ে বানিয়েছে মূর্তি। মন্দিরের ভাস্কর্যও অনুপম।

ঘনিয়ালা পেরিয়ে বরাক নদীর পারে মকাপিরের মাজারও খুব জাগ্রত। পিরবাবার জীবনকালে ভক্তজনের হুড়োহুড়ি পড়ে যেত কিল ঘুসি খাওয়ার জন্য। বাবার মার খেয়ে অনেকের ভাগ্য ফিরেছে।

মা বলে মানুষ এই করেই অতিমানুষ হয়। নিজের মাপের থেকে বড়ো না হলে হিরো হয় না। পিতা বলেন ভাস্কর্যের মূল তত্ত্বই তা ই। বুদ্ধদেব আর মহাবলীর মূর্তিতে সব কিছুই মানুষের মতো আবার মানুষ থেকে আলাদা। বিশাল দেহ। কুক্কটান্ডাকৃতি মুখাবয়ব গ্রন্থলকার কর্ণ তিলফুলের নাসা কণ্ঠ শঙ্খসমায়ুতম্‌। পদ্মপলাশ নয়ন। সব মিলিয়ে অতিপরিচত অথচ অপরিচয়ের সমীহ। জেলরোডে গির্জার গম্বুজ সাধারণ ভিটেবাড়ির তিনগুণ উঁচু। দিনমানে রঙিন কাচের প্রতিফলিত আলো এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করে প্রতি মুহূর্তে। ব্রহ্মঠাকুরের মন্দিরের চারপাশ ঘিরে চা বাগান। বরম বাবাকে ভয় পায় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে গাড়িচালকেরা। মা যখন কলস্বনা তখন শোনায় মধুরা নদীর বালুকাবেলায় লিখে রাখা নামের সারি। বলে আমরা হেঁটে চলে আসতাম। মন্দির সংলগ্ন পুকুর টিলা পাহাড় কী অপরূপ!

--- কবিতা লিখেছ?

--- বাবার এক শিষ্যও লিখত।

--- শিরিষশাখা?

মা চুপ করে থেকেছে। তপজা জানতে চেয়েছে, গোটা গাছের নাম নয় কেন মা?

--- গিরিশ জেঠু নিজের নাম মিলিয়ে রেখেছিল। বাবা যোগ করে দেয় শাখা। শুনেছি ওর ছেলেও একজন কবি হয়েছে এখন।

--- তুমি কী করে জানলে মা? তোমার গুপ্তচর আছে বিজনঘনময়?

পথে বেরোলেই তপজার মাথায় কেড়া নড়েচড়ে।

তপজা পাগলির সঙ্গে বেরোলে পথকেই পথে থেমে থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। বিজনঘন গ্রামের থেমে থাকা অযান্ত্রিক সুমো আর সময়যন্ত্রকে দাঁড় করিয়ে রাখতেই হবে ক্ষণিক। মায়ের গাঁয়ের অভযাত্রিণী যাই দেখে তাতে থেমে থাকে। পিরবাবার দরগারও যে পঁচিশ বছরে একই আছে সে কথা মাকে বলতে হবে। সেই রাহে লিল্লাহর সবুজবাক্স আর চাঁদতারার ছাপ। লিল্লাহর বাক্সে দশ টাকা ঢুকিয়ে ভাবে আরব্য উপন্যাসের মতো চমৎকার কিছু একটা ঘটুক এখন। মা আর দাদুকে এনে মিলিয়ে দিক চমৎকারি চাদর। জাদু একাডেমিতে ওরকম হয়।

পাহাড়ের উপর উঠতে উঠতে সাড়ে নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকে যায় সুমোগাড়ি। ডিহবাবার মন্দিরে কিছুক্ষণ মাথা গুঁজে বসে থাকে তপজা দুষ্টবুদ্ধি। কী যেন মন্ত্রণা হয় বাবা আর তপজা তরঙ্গিণীর। এই বাবারও কেরামতি কম নয়। বাবার হাত নাকি আগলে রাখে বিজনঘন গ্রাম। সারারাত দুহাত দিয়ে শান্তি বিছিয়ে দেন বাবা। এই নিয়ে তপজার সঙ্গে বাবার লড়াই। বাবাআ বলেন, আমি অশান্তি দেব নাআ। তপজা বলে, একটা ঝড় আমি তুলবই। বসুন্ধরা সরস্বতীকে আড়চোখে দেখে তপজা।

পবনপদবি আর কাঁকন কবি যখন তাকে বয়ে নিয়ে এল, তখন তো বেরুচ্ছিলেন সেজেগুজে।

এর মধ্যেই পালটে গেল আটপৌরে।

মার কথার সঙ্গে মিলছে না কিছুই। বসুবাড়ির সময়জ্ঞান নাকি খুব টনটনে। কোনও কারণেই কামাই চলবে না। তপজা তাই ঘাপটি থেকে চোখ বের করে বলে,

--- তুমি স্কুলে যাবে না দিদু?

--- তোকে কে বলল আমি স্কুলে পড়াই। কবে রিটায়ার করেছি। অবিকল মায়ের মতো সেই মুচকি হাসির দুষ্টুমি।

--- তুমি পড়াও আমি জানি।

--- ভুল জানো।

ভুল জানে তপজা? এত বড়ো কথা বলল বুড়ি। এত সাহস! তপজাকে চেনে না তাই। তুমি যদি জেদি দিদিমা তবে আমিও কম নাতনি নই। আমি কখনও ভুল করি না।

--- আচ্ছা দিদু আমাকে দেখে তোমার কিছু মনে পড়ছে না?

--- পড়ছে। আমার ফুলটুসির কথা মনে পড়ছে।

--- ফুলটুসি কে? তোমার মেয়ে?

--- না রে। আমাদের মিনি বিড়াল। আমারই বিছানায় শুয়ে আমাকেই ম্যাঁও করে।

তপজা এখন থামবে না। গম্ভীর থেকে টপস্টোরি বের করতে হবে।

--- বিড়াল ফিড়াল নয়। এই ধরো ছাব্বিশ বছর আগে।

--- সে তো তুই। এই এইটুকুনি।

--- তুমি তো আর দেখোনি?

--- দেখিনি আবার?

--- ঠিক আছে দেখছ? কার মতো দেখতে বলো তো আমি?

--- হৃদকমল বাড়ির মেয়েটার মতো দেখতে হবে।

--- নাম বলো?

--- নাম? সে হবে টুকাই দূর্বাদল বিলকিস নয় ঝুমঝুমি।

ভুল। হৃদকমল বলে কোনও বাড়ি নেই। মা বলেছে বনরাজিনীলা।

--- সে যখন বলেছে তখন। হিসেব করে দেখতে হবে। আমরা বছর-বছর নাম পালটাই।

--- আর মেয়ের নাম?

--- তাও পালাটাই, মুছে দিই।

--- সিঙাড়া  খাবে দিদু? মোহন বংশীধারীর সিঙাড়া এনেছি এক ঠেঙা। বসুন্ধরা সরস্বতী চোখের কোনের চিকচিক আটকে রাখেন মনের ভেতর। ওরকম সিঙাড়া আনত আর একজন। এবাড়িতে এখন মোহন বংশীধারীর সিঙাড়া আনা বারণ। বেয়াড়া মেয়েটা কি সরস্বতীবাড়ির নিয়ম ভাঙতে চায়?

একা কাঁকন ছাড়া সবার কাজকর্ম রয়েছে বিজনঘন গাঁয়ে। তপজার ভালই লাগে। সর্বক্ষণের একটা সঙ্গী পাওয়া যায়। মুখে রাগ দেখিয়ে বলে।

--- তুমি কেমন মানুষ গো? কর্মহীন।

--- আমার সকাল বিকেল সমান। বিঘ্নকারিণীর কৃপায় আজ আমার ছুটি। এখন শুধু একটাই কাজ

--- কী কাজ?

--- তোমার দেখভাল।

--- ময় তেনেকা ছোঁয়ালি নহৌ। ময় অসমিয়া নহৌ দুখিয়া। আমি এখন বেড়াব একা একা। যাব শিরিষশাখার বাড়ি।

--- চলো আমিও যাই। তবে আমরা ওরকম ন্যাড়া নামে কাউকে ডাকি না।

--- ঠিক আছে ডাকব মিস্টার শিরিষশাখা। তোমার নাম কী?

--- আমি? মিস্টার কাঁকন।

--- কাঁকনশাখা?

--- কাঁকনবন্ধন প্রজাপতি।

বিজনঘন গাঁয়ের মানুষগুলি বড়ো মিথ্যাবাদী।

শিরিষশাখার জন্য এক প্যাকেট চারমিনার কিনে আনল সদরঘাট থেকে। লোকটা বলে কিনা খায় না। কোনওকালে খায়নি। বাপের বয়সী মানুষটা মিথ্যাকেও এত সুন্দর করে পরিবেশন করে। খাওনি যদি বরমবাবার মন্দিরে কী করতে তবে? শুধু কবিতা  লেখা? ধোঁয়ার চাকতি ছুঁড়ে ছুঁড়ে প্রতিজ্ঞা-অঙ্গীকার! হাটে হাঁড়ি এবার আমি ভাঙব।

--- আচ্ছা মিস্টার শিরিষশাখা, তিতলি সরস্বতীকে বিয়ে করলেন না কেন?

--- কে তিতলি? এ পাগলি বোধহয় গাঁয়ে নতুন এসেছে। এখানে এরকম কোনও নাম হয়না।

--- হয় হয়। রানাপ্রতাপের ডেগার দেখে ভয় পেয়েছিলেন।

--- চরাচরে মেঘের বরিষণ।

এ কেমন বিজনঘন? মা বলেছে এখানে মেঘ ঘাপটি মেরে থাকে বনরাজিনীলার গাছ গাছালি পাখপাখালির উপর। এমন ক্লান্তিহীন বর্ষণের কথা বলে নি। ডিহবাবার হাত লেগেছে নির্ঘাত।

বাবা কথা রেখেছে। শান্তিভঙ্গের নমুনা নিয়ে এসেছে দু-একটা।

মেঘের কড়া-কড়াৎ। ঝড়ের তাণ্ডব।

তপজার মার ঝড়কে বড়ো ভয়।

ঝড় এলেই মেয়েকে শুনিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক লাইন আবৃত্তি শোনাবে। মাগো গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি।

যতই বাধা আসুক। পাহাড় ভাঙুক। তপজা থামবে না। যাবেই যাবে। আজ তপজার সাক্ষাৎকার বিধায়ক রানাপ্রতাপের সঙ্গে।

সাংবাদিকতার সত্যান্বেষণ। মধ্যবয়সী রানাজি এখনও যুব-ছাত্রনেতার চৌখুস তারুণ্যে বর্তমান। ভয় ডর মানে না মানুষ।

--- আপনি বাংলা ভাষা, বাংলা টেরিটরি ডিমান্ড কমিটির হয়ে লড়লেন। বিধায়ক হয়ে সব ভুলে গেলেন?

--- ভুলিনি। সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতর চলতে হয়।

--- আপনার এলাকা এত দুর্গম কেন? উন্নয়ন নেই।

--- প্রশাসনিক দুর্বলতা রয়েছে। কেন্দ্র–রাজ্য।

--- গড়াকাপ্তানি বিভাগ তো রাজ্যের। পথের দুরবস্থার দূর করতে পারেন।

--- পূর্তদপ্তর বলুন।

--- পশ্চিমবঙ্গের ভাষা।

--- পি ডব্লিউ ডি বলুন। আমরা আমাদের এলাকা সুরক্ষিত রেখেছি। গ্রাম ঠিক থাকলে দেশ ঠিক থাকবে।

--- একজন অবাঙালি অসমিয়া শিল্পী বাঙালি বীরের মূর্তি তৈরি করেছেন। আপনাদের আঁতে ঘা লাগে না?

--- না। অসমিয়া-বাঙালির কোনও বিভেদ হয় না শিল্পে।

--- রাজনীতিতে হয়?

--- না, হয় না। আমরা ভারতীয়।

--- বাঃ বেশ তো! আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল প্রজ্ঞাসুন্দরীর সঙ্গে। করলেন না কেন?

--- তিতলি আমাদের আন্দোলন ভেঙে দিল। দিল্লি বৈঠকে সেবোটেজ করে অসমিয়া উগ্রপন্থীর সঙ্গে!

--- ভুল মিথ্যা!

--- বাঙালির উত্থানপথ রুদ্ধ করে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে।

--- ভুল বলছেন। ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চাননি তিনি।

--- অনেকদিনের ব্যাপার। ভুলে গেছে বিজনঘন।

--- আপনি ভোলেন নি কিছুই। নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রস্তুত করতে গ্রামে ঢুকতে দেন নি বাগদত্তাকে।

--- হয় তো সত্যি।

--- বিয়ে প্রেম সব ভেঙে নেতা হতে চাইলেন। তিতলি হাজরিকা আপনাকে নেতা বানিয়ে চলে গেলেন।

রানাপ্রতাপের সহাস্যে জবাবে বিরক্ত পবনপদবি সরোষে উঠে দাঁড়ান। নীরবে নির্গত হন রাজনীতির সংবাদ-মঞ্চ থেকে।

সন্ধ্যার আঁধারে কাঁকনের হাত ধরে রনরাজিনীলার ফেরে তপজা।

--- তোমরা বড়ো মিথ্যেবাদী।

--- তুমিও কম যাওনা। নেলপালিশের রক্ত সবাই চেনে। গাড়ির নাটকটা আমরা বুঝেছি। লজ্জায় তপজা কাঁকনের হাত জড়িয়ে ধরে সজোরে।

তপজা চেয়েছিল একটা নকল দুর্ঘটনার মহড়া দিয়ে বসুন্ধরা আর পবনপদবির মাঝখানে ঢুকে পড়তে।

--- পবনপদবি আর বসুন্ধরা সরস্বতীও মিথ্যেবাদী।

--- নিজের রক্তকে গালাগাল দিচ্ছ?

--- তুমি জানো আমি কে?

--- সবাই জানে।

--- শিরিষশাখা মামাও?

--- শুধু রানাপ্রতাপ কিছু হলেও সত্য স্বীকার করার সাহস করেছে।

--- এত সরল বিচার হয় না। আমার বাবা এখনও তোমার মাকে ভালবাসে। এখনও চারমিনার খায় লুকিয়ে লুকিয়ে। আমি এনে দিই। তোমার দাদু-দিদু এখনও তোমার মাকে নিয়ে নকল ঝগড়া না করে ভাত খায় না।

--- জানি জানি বুড়ো বুড়ির চোখের কোনে চকচকে জল দেখেছি। আমার মা কিন্তু রাগ করে নয়, ভালবেসে বিয়ে করেছে। আমার দেউতা একজন আদ্যোপান্ত শিল্পী। একজন অসমিয়া একজন বাঙালি। উগ্রতার ভুলে জড়িয়েছিল একসময়।

--- কেউ কখনও ভুল স্বীকার করে না তপজা।

--- আমি করলাম।

--- তাতে কী? তুমি কোনও পক্ষেই নও। তাড়াতাড়ি পা চালাও এবার। এই মুষলধারা না থামলে বন্যা নির্ঘাত।

--- আঃ! কী দারুণ! সব ভেসে যাবে। আর তুমি, কাঁকনবন্ধন প্রজাপতি একটা ভেলা বানাবে। উঠিয়ে নেবে পবনপদবি বসুন্ধরাকে। আমি নিয়ে আসব আমার দেউতা আর মাকে। শঙ্খ বাজাব উলু দেব। ভেলা চলবে দুলে দুলে। নতুন আরম্ভ হবে।

--- জানো, বনরাজিনীলায় মেঘেরও একটা ডাকনাম আছে?

--- আমার মায়ের নামে। তিতলি মেঘ।

--- আজও একটা নতুন নামকরণ হবে বিজনঘন-বন্যার।

--- কী নাম?

--- তপজা-বন্যা।

--- ধুর! তোমরা কেউ তপজা হাজরিকার যোগ্য নও।

 

*****

 

*পুরকায়স্থ রণবীর, তৃতীয় ভুবনের রূপকথা, অক্ষর পাবলিকেশন, ত্রিপুরা, প্রথম সংস্করণ বইমেলা ২০১১, পৃষ্ঠা, ৮১-১০১

*গল্পটির প্রথম প্রকাশ, কবিতীর্থ, ২০০২


*গল্পটি সম্প্রতি ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় এর পাঠ্যসূচি তে স্থান পেয়েছে তাই পাঠকের সুবিধার্থে গল্পটি এখানে তুলে রাখলাম। PDF এর জন্য এই লিংক এ কিল্ক করুন https://archive.org/download/tritiya-bhunaner-rupkotha-short-story-by-ranabir-purkayastha-pdf

সুব্রতা মজুমদার শিলচর আসাম ০১/০১/২০২১ 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি