ঠাকুমা হারিয়ে গেছেন --- রণবীর পুরকায়স্থ
করিমগঞ্জ শহরের সীমা ছাড়িয়ে লঙ্গাই পুল পেরিয়ে ওপারে পৌঁছতেই পরিচিত দৃশ্য। নদীর পারে সারে সারে বেগুনের গাছ, গাছ দেখতে তেমন সুদৃশ নয় কিছু কিন্তু তেল চকচকে নাদুশ নুদুশ গোলগাল গুণময়কে দেখেই তার মনে পড়ে যায় বন্ধুবর প্রমেশ আচার্যির কথা। একই ব্যাঙ্কে চাকরির সুবাদে বন্ধুত্ব, প্রমেশের বাড়ি করিমগঞ্জ আর তার শিলচর, পোস্টিং এ প্রমেশ মহকুমা শহর হাইলাকান্দি আর তার মোহনপুর গ্রামে। প্রমেশেরও ভাড়াবাড়ি রাঙাউটি রোডে, সোমবার বিকেলে বন্ধুর বাড়িতে থাকে তার রাত্রিবাসের নিমন্ত্রণ। এমনই এক শীতের সোমে প্রমেশ বলে,
--- আপনার লাগি আইজ একটা কড়াই কিনলাম দেখইন?
এটা
আবার কী , হাতের পাঞ্জার সাইজে লোহার কড়াই । বলে,
--- এতো ছোটো ?
--এক এক পিস
ভাজমু আর তুলমু । আইজ
খালি গরমভাত বেগুনভাজা ঘি আর কালালঙ্কা।
প্রমেশ
নিজে রান্না করে পারিপাটি। সে রাতেই সদ্য যুবক বিশ্বজিৎ প্রথম দেখে বিখ্যাত লঙ্গাই
বেগুন, কাছাড়ে বলে থালবেগুন, পারফেক্ট গোল। এখনও
লেগে আছে জিভে বেগুনের মাপে কড়াইএর ভাজা বার্তাকু
। খাওয়ার পর বন্ধুকে বলেছিল তার
ঠাকুমার বাপের বাড়িও লঙ্গাই নদীর পারে দণ্ডকলস গ্রামে,
গেছে অনেকবার কিন্তু এমন খাবার খায়নি কখনও। প্রমেশ বলেছিল,
ও এপারের, অপারের
দণ্ডকলসও ঘুরিয়ে আনবে একদিন। হয়নি,
একবছরের মধ্যে গৌহাটিতে বাংলা পড়ানোর চাকরি পেয়ে চলে যায়
সে। পরের শীতে আর
বড়বেলার দণ্ডকলস দেখা হয় নি। এখন তো সে আসামের বিখ্যাত অধ্যাপক,
শীতকালে সাহিত্যবাসরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায় নিয়মিত। অবসরের পর দশবছর হয়ে গেল, এখন
যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে শারীরিক কারণে। লঙ্গাই উপত্যকা সাহিত্য
সম্মেলনের সভাপতি জগন্ময় গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সহপাঠী হওয়ায় আর না করেনি। সময়ও অনুকূল ৭ ও ৮ জানুয়ারি ২০১৭,
শীতকাল। আমন্ত্রন পত্রে তার নামই প্রথম, প্রধান অতিথি অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দেব।
তবে একা বেরিয়ে ভালই করেছে প্রফেসর দেব।
বিষয়টা বেশ গোপনীয় ও একান্ত থাকুক এরকম ভাবনাও ছিল
তার। তবু বন্ধু জগন্ময়কে বলেছিল সঙ্গে যেতে। জানা কথা, সে যাবে না।কারণ
উৎসবশেষে সম্মেলন সভাপতির অনেক কাজ থাকে
টুকিটাকি। তার উপর জগন্ময় করিমগঞ্জ জেলার সম্মানিত
অধ্যাপকও বটে,তার সঙ্গে হাউরি ঘুরায় আপত্তিও থাকতে পারে । জাগন্ময় দত্ত বাংলা
সাহিত্যের মধ্যযুগ ও লোকসাহিত্যের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ। বেশ অনেকগুলি পুরস্কারও
পেয়েছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে। দিল্লি থেকেও পাবে একটা এরকম আভাস দিয়েছে
গতকাল । তার লোকগবেষণার বিশেষ অবদান হল
রামায়ণের সীতাকে অনার্য কন্যা প্রমাণিত করা। আসাম সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মান ও
পেনশন প্রাপ্ত অধ্যাপক হওয়ার কারণে বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয় থেকে দূরে থাকে। অসমীয়া
উগ্র জাতীয়তাবাদী আস্ফালন ও দক্ষিণ আসামের বাংলা অধ্যুষিত তিন জেলাকেও অসমিয়াকরণের
প্রচেষ্টায় যখন উত্তাল করিমগঞ্জ কাছাড় হাইলাকান্দি, তখন জগন্ময় থেকেছে দূরে, মিটিং
মিছিল দুএকটায় গেলেও সম্প্রীতির বার্তাই দিয়েছে। বাংলাভাষার
অধ্যাপকের যে ভাষাপ্রীতি নেই সে কথাও কেউ বলতে
পারবে না। সর্বজনমান্য ব্যাক্তিত্বের সদাহাস্যময় উপস্থিতি সবাই কামনা
করে। তবে জগন্ময়ের একটা প্রতিবাদি চরিত্রও আছে ছাত্রাবস্থা থেকেই। অসমিয়া বাংলা
দুই ভাষাতেই দক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংস্থার নির্বাচনী ভাষণ লিখে দিতে ডাক পড়ত
তার। এখনও পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক নেতা নেতৃরা ভাষণ লিখিয়ে নেয় জগন্ময়
স্যারের কাছ থেকে।
অসমিয়া করণের প্রতিবাদে বাঙালির অস্তিত্ব-সংকট নিয়ে অসাধারণ
গল্প লিখেছে সুবন্ধু ছদ্মনামে। অধ্যাপক দেব গৌহাটি থাকে বলে কাছাড় করিমগঞ্জের
বাঙালির সমস্যা ভিন্ন দৃষ্টিকোনে বিচার করে, অন্য আবেগের
চোখে দেখে বৃহত্তম সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর হয়রানি, সমাধানেও
সমঝোতার ভারসাম্যকে গুরুত্ব দেয়। আবেগটা
প্রকট হয়ে প্রকাশিত হয় না। এ নিয়ে দুই নদী উপত্যকায় ভুলবুঝাবুঝি থাকলেও অধ্যাপক
নিজস্ব পরিচয়ে ভাস্বর হয়ে আছে। তাকে নিয়ে বাঙালি এবং অসমিয়ার মধ্যে একটা
অবিশ্বাসের সন্দেহ যেমন আছে, আবার উত্তেজনা প্রশমনে স্থানীয় টিভি চ্যানেলে
তার সুচিন্তিত বাইটগুলিও খুব কার্যকরী । প্রবল সংখ্যাগুরুর উগ্র জাতীয়তাবাদী চাপে
সে দুরকম ভাবে নিজেকে দেখে, এক বেঁচে থাকার তাগিদে অসমিয়া বিরোধিতা করে না। তাই, করিমগঞ্জ
কাছাড় হাইলাকান্দির কোনও নাগরিক কনভেনশনে তার ডাক পড়ে না।এখানকার নাগরিকরা নিজেরা সুরক্ষিত বলে
সবসময় যুক্তিপূর্ণ কথাও বলে না, সংখ্যার ক্ষমতায়
কুকথাও বলে দুই উপত্যকার যুযুধান ভাষাগোষ্ঠী। তাকে রাখঢাক রাখতে হয় প্রাণের দায়ে
, প্রফেসর দেব যখন বলবে তখন উলুবাড়িতে তার অরক্ষিত বাড়িটার কথাও ভাবতে হয়। ঠাকুমার
নামের বাড়িটার প্রতিবেশি বেশির ভাগই অসমিয়া, আর্যবিদ্যাপীঠে চাকরি করতে করতে পেয়ে
যায় প্লটের জমি, এলাকার নামও হয় প্রফেসর পাড়া। আসামের অসমিয়ারা মানুষ বড় ভাল, বন্ধুও ভাল। সংখ্যাগুরুরা
একামানুষ ভালই হয়, দলবদ্ধ হলে যুক্তিহীন হয়,
দাঙ্গাবাজ হয়। অসমিয়ার বিরাজ কলিতার মতো বন্ধু
না থাকলে অভিজাত এলাকায় বাড়ি হতো না তার। বাড়ির নাম রাখা নিয়েও আনেকেই তির্যক মন্তব্য করতে ছাড়ে নি। মাকে ছেড়ে কেন
ঠাকুমার নামে বাড়ি। অধ্যাপক দেব কখনও
অজুহাত দেয় নি, তাই কেউ জানে না যে তাঁর মা-ই
তাকে বলে গেছেন বাড়ি করলে যেন ঠাকুমার নামে রাখা হয় নাম। এই
মহীয়সী নারী তাঁর ত্যাগের কোনও স্বীকৃতি দাবী
দাবি করেন নি কোনকালে । এক
বাস্তুহারা পরিবারে যখন রোজগারের কোন উৎস নেই কোথাও, তাঁর
পিতাও স্বদেশে শিক্ষকতার অস্থায়ী চাকরি ছেড়ে চলে আসেন এদেশে,
অর্দ্ধাহার থেকে অনাহার ছাড়া কোন পথ খোলা ছিল না তাদের। তখন অধ্যাপক দেবের পিতামহী বৃদ্ধ বয়সে গৃহ পরিচারিকার কাজ নিয়ে আহার
যুগিয়েছেন পরিবারে, পুত্রবধূকে ঘরের বাইরে যেতে দেন নি। সেই ‘হিরণ্ময়ী’
বাড়ি এখন গৌহাটির সারস্বত সাধনার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। অধ্যাপকের
একমাত্র পুত্র বিশু ছেলেবেলায় হিরণ্ময়ী শব্দের অর্থ জানতে চেয়েছিল পিতার কাছে।
তিনি বুঝিয়ে বলেছেন, ‘সোনার মতো উজ্জ্বল কিংবা সোনার বরণ’ । দুটোই ছিলেন তাঁর ঠাকুমা, ছিলেন
দীর্ঘাঙ্গী উন্নতনাসা, বঙ্গদেশে এমন রূপ দুর্লভ। ছেলে প্রশ্ন করেছে,
--আর তোমার
মা ?
সে বলেছে,
--মা ছিলেন আগুণ রঙা
রূপসী। মায়ের চুল হাঁটুর নিচে নেমে যেত, এত দীর্ঘ।
ছেলের প্রশ্ন,
--তবে কেন হিরণ্ময়ী ?
ছেলেকে খুলে বলেছে সত্যকথা।
তাঁর মায়ের সত্যবন্ধন। ছেলে তাও ছাড়ে নি, বলেছে,
--- আর আমার মা?
--- তোমার মা সবার সেরা। সবার
মাই সেরা। আমার মা শিখিয়েছে আমার ঠাকুমার কথা।
সুখ দুঃখের সংসারে রাগারাগিও
হত, রাগ হলেই ঠাকুমা ঘটি হাতে চলে যেত দণ্ডকলস
গ্রামে। ঠাকুমার বাপের বাড়ি। নাতিকে নিত
সঙ্গে। ভোলার নয়। লঙ্গাই নদীর পুল পেরিয়ে বিশ্বনাথের হাত ছেড়ে দিতেন ঠাকুমা, সেই
ছাড়া পাওয়ার যে কী মজা। করিমগঞ্জ স্টেশন থেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতেন পিতামহী।কী
যন্ত্রনার বন্দীত্ব। ওপারে পৌঁছে খুশি বিশ্বনাথের। কারণ বেশির ভাগ সময়ই শীতকালে রাগ হত
ঠাকুমার। তখন যে বাপের বাড়ির গ্রামে নতুন
ফসল উঠত। নিজের ভাই কেউ থাকে না গ্রামে, খুড়তুতো ভাইরা দিদিকে কী
মান্য করত। বিশ্বনাথও সারাদিন ঘুরে বেড়াত গ্রামে, এটিলা থেকে ও টিলা। ধানের খেতে
একাএকা দৌড়নোয় ছিল মজা, কান এদিক ওদিক করে বাতাসের সাঁ সাঁ শব্দ নিয়ে
খেলা। আর এক আনন্দ ছিল ঠাকুমার মলিদা দাঁত দিয়ে কুটকুট করে কাটা, বাচ্চা ছেলেকে
কাশ্মীরি চাদরে ঢেকে পেছনে গিঁট দেওয়া তার মোটেই পছন্দ ছিল না, তাই দাঁত দিয়ে চাদর
কেটে আকাশের দিকে তুলে দেখত কেমন ফুটো। ঠাকুমাও ধরতে পারেনি, বলেছে পোকায় কেটেছে। ঠাকুমার
উপর কম অন্যায় করেনি ছোট বিশ্বনাথ। সেবার তার প্রবেশিকা পরীক্ষাই দেওয়া হত না তেমন
অবস্থা। বিশ্বনাথ ঠাকুমাকে বলছে,
---কী হবে গো
ঠাকুমা ? পরীক্ষায় বসতে পারব তো?
ঠাকুমা মুচকি মুচকি হাসত আর নিশ্চিন্ত
হয়ে বসে থাক্ত। তার ছিকির ভাণ্ডারে যে আছে যথেস্ট সম্পদ। খুলে দেখে সব শূন্য। তাতে কী হয়েছে রয়েছে অন্য ভাণ্ডার। ইঁদুর যাতে বিছানাপত্র না কাটতে পারে তাই লেপ কাঁথা শুকিয়ে বস্তা বা কাপড়ের পুটলি করে
শীতকালের জন্য ঘরের মাড়ইল এ ঝুলিয়ে রাখা হয় দড়ি বেঁধে, দড়িতে একটা উল্টো নারকেল
মালা অর্দ্ধেক ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এক গিট্ট দিয়ে, ইঁদুর আর নামতে পারে না। সেই নারকেল
মালায়ও ঠাকুমা লুকিয়ে রাখত সিকি আধুলি। বিশ্বনাথ তো সব সাবাড় করেছে। ঠাকুমার
উজ্জ্বল মুখ অন্ধকার হয়ে যেত, ঠাকুমা বুঝত সব কার কীর্তি। জানত, কিন্তু বকত না।
তাও দমে নি, উত্তরপুরুষের শিক্ষার জন্য তখন বাবুর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে পনের টাকা,
পরীক্ষার ফিস দেওয়া হয়, সেই টাকা আর ফেরত দিতে পারে নি ঠাকুমা
। পরীক্ষার পরই তো বিছানায়। তার
বাবা ঠাকুমার দেওয়া নামটা পর্যন্ত বদলে দিল ফর্ম ফিলাপের দিন। লিখে এল বিশ্বজিৎ।
বাবুদের মস্ত বড় বাড়ি, কী বিশাল। শহর
শিলচরে টিনের চালের একতলা বাড়িই বেশি কয়েকটা মাত্র কাঠের দোতলা আর উত্তরপ্রদেশ আগত
ভূস্বামীদের প্রাসাদোপম দোতলা বাড়ি,
বাড়ির সামনে
সিংহদুয়ার। শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী আর স্বাধীনতা সংগ্রামী
চন্দ দের সাদা দালান, দীঘির পারে নসিবালি হাকিমের দীর্ঘ বাড়ি,
নদীর পারের বি সি গুপ্তর বাড়ি, রহমান মঞ্জিল, জানিগঞ্জে ভুঁইয়াদের ব্যবসাবাড়ি
বা গদি, পদ্মবিলে আর এক বৈশ্যপ্রধান রজনী সাহার ভদ্রাসন,
নাজির পট্টির পপুলার হোটেল,বরদা
দাশ বরদা পালের প্রাসাদ, গাভরু মিয়ার বাড়ি, তারাপুরের দেববাড়ি ঐতিহ্যে প্রধান। দেশভাগের পর স্টিমার কোম্পানির
চলাচল কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক জাহাজ মালিক ঝাঁপিয়ে পড়লেন চাপাতার ব্যাবসায়ে,
বাড়ি তৈরি করলেন বহুতল চকমিলান। ঠাকুমা নাতিকে বাড়ির ভিতর দেখাতে নিয়ে যেতো কিন্তু দারোয়ান
ঢুকতে দিত না , ঠাকুমাকে যেতে দেবে, বিশ্বনাথকে নয়। বিশ্বনাথ তাতেই আপ্লুত, কী লম্বারে
বাবা, লোহার গরাদে দেওয়া ফটক, ফটকের ভিতর ছবির মতো কালো আঁকাবাঁকা পথ,
পথের পাশে ফুলের গাছ, বিশ্বনাথ ভাবত ঐ বাড়িতেই তো
রাজকন্যা থাকে। ঠাকুমা বলত রাজপুত্রের কথা, তার দুরন্তপনার কথা। একটা মস্তবড় রেডিও ভেঙে তার
কী কান্না। সে পড়ে নরসিং ইস্কুলে, তার মতো
একটা ছেলেকে দেখেছে গাড়ি করে স্কুলে যেতে খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্ট পড়ে। তারই বয়সী । ঠাকুমা
তো ঐ নাদুশ নুদুশ ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ওর নাকি খুব দুঃখ, কোন বন্ধু
নেই, একা একা বাড়িতে থাকে সব বড়দের সঙ্গে,
গাড়ি করে স্কুলে যায় ফিরে এসে পড়াশুনা করে, মাস্টার এসে পড়িয়ে যায়। আর বাড়িতে সব
ভাঙচুর করে। ঠাকুমা ছেলেটিকে খুব ভালবাসে, রেডিও ভাঙার পর বাবাও বকলেন মাও বকলেন
মারলেন। ছোটবাবুর সেদিন কি কান্না। পরদিন সকালেও কাঁদছে। ঠাকুমা প্রশ্ন করেছিল,
--কাঁদছ কেন
ঠাকুর।
ছোট ঠাকুর বলে,
--রেডিও
ভাঙ্গায় কী আমার কষ্ট হয় নি দাদি, মা বাবা এত বকল বলে আমার দুঃখ বেড়ে গেল। দুঃখ
হলে আমি কাঁদি।
এসব
আদিখ্যেতা, ছেলেটা মোটেই ভাল না, বিশ্বনাথের ঠাকুমাকে কেন দাদি বলবে, ওরা কী
হিন্দুস্থানী। ঠাকুমাকে বলেছে বিশ্বনাথ,
--ওতো
মান্তু, আমার সঙ্গে খেলে। একদম খেলতে পারে না, নদীর পারে আমরা রোজ খেলি শ্যাম
বেটে।
--- কী
খেলা?
--- নন্দাই খেলি, ফুটবল
হাডুডুডু ক্রিকেট খেলি। ওর গায়ে একদম শক্তি নেই।
মান্তু সরকারি স্কুলে পড়ে।
প্রবেশিকার পর আর দেখে নি তাকে। সেও আর মাঠে যায় না, তখন তিন তিনটে ট্যূইশনি করত।
গোপালগঞ্জে এক ব্যবসায়ীর মেয়েকে পড়াত দশ টাকায়, সে কি আর জানত মেয়েটির দাদু
ইংরেজির শিক্ষক , এম এ এন ইউ আর ই র উচ্চারণ বলে দিল মেনার, উনি শুদ্ধ করে দেওয়ায়
মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা, এর পর আর ভুল হয় নি। যদিও
সেই মাস্টার মশাই সারদা স্টোর্সে আর একটা ট্যুইশনি যোগাড় করে দেন। পাঁচ টাকায়
পড়াতো পাশের বাড়ির আবুকে। তার ভাল লাগত প্রতিবেশীর মেয়েকে। তার ফ্রকের বুকে টান
পড়ায় রোমাঞ্চ হয়েছিল সেই বয়সে। ঠাকুমার শরীরে তখন জল হয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে
তার সঙ্গে কথা বলে আবোল তাবোল আর কাঁদে। এটা ওটা খাওয়ার ফরমাশ করে। কায়স্থ বাড়ি
সাত্ত্বিক বিধবা, মাছ মাংস পেঁয়াজ রসুনের ধারে কাছে নেই। তবে ঠাকুমার নেশা একটা
ছিল, তামাক খেত লুকিয়ে, নারকেলের নাইড়চা হুঁকোয় মুখ লাগিয়ে নীরবে টানত। শেষ দিকে
তাও বন্ধ হয়ে যায়, তামাক কেনার পয়সা নেই। বাবা মায়ের সোনা বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করে, তখন নতুন
বেরিয়েছে স্লাইস ব্রেড করিমগঞ্জে, মেশিনে বানায় বনিক মার্কা আর কাঠের ডাইসে কাটা
হয় ভোলা বেকারি। বাবা দুই কোম্পানির এজেন্সি নেয় হাইলাকান্দিতে। প্রথম প্রথম খুব
বিক্রি হইয়েছে , রেলে করে ট্রাঙ্ক ভর্তি ব্রেড আসত। বিক্রি
কমে গেল, মহামায়া হোটেলের বিল মেটাতে সব টাকা শেষ, কপর্দকশূন্য
হয়ে ধার কর্জের বোঝা নিয়ে বাবা আবার ফিরে
এলো। তখন শিলচরের মানুষ খুব সিগরেট খেত, রাস্তার পাশে আধখাওয়া সিগারেটের টুকরোয়
ভরে থাকত, সেইসব টুকরো জমিয়ে তামাক বানিয়ে দিত ঠাকুমাকে। শেষ দিকে মাথাটাও গেছিল
ঠাকুমার। কাউকে চিনত না। মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বনাথের নামটা ছিল জপমালা। ঠাকুমার দেওয়া
অনেক নাম ছিল অধ্যাপক দেবএর। ঠাকুমা অতি আদরে ডাকত ভুতু। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছড়ায়
গাইত গান, ভুতু রাজা রাজারে, ভুতু একদিন রাজা অইব, আমার অইব কিতা। ভুতুর ঠাকুমা
একদিন বলল পিঁয়াজি খাবে পুজন সিংএর দোকানের। দোকান মানে চম্পা পাটোয়ার মদের
দোকানের সামনে পথের উপর কুপি লম্ফর ভাজাভুজির উনুন।
মা শুনে মাথা নেড়েছিল জোরে ,
--না না।
বিশ্বনাথ কিন্তু মানে নি , কিনে এনে মুখে দিয়েছে ঠাকুমার, থু থু করে ফেলে দিয়েছে। ইচার চপ খেতে
চেয়েছে, খাইয়েছে, কিন্তু মুখে দাওয়ার আগেই থু থু। ডাক্তার দেখাতে পারে নি, এখনকার
দিন হলে বলত সোডিয়াম বেড়েছে, নুন খাওয়াত।
বাড়ির সামনে ফটোগ্রাফার রাজকুমারদার বাড়ি, ওর বাড়ির বাগানে নিয়ে গেছে ফোলা শরীরের ঠাকুমাকে। কি সুন্দর লাগছিল ধবধবে
পিতামহীকে। ঠাকুমাকে চেয়ারে বসিয়ে পায়ের নিচে বসেছিল বিশ্বনাথ। ঠাকুমা ধীরে ধীরে
কথা বলাও বন্ধ করে দেয়। বিশ্বনাথ হতভম্ব হয়ে ঠাকুমার মুখে তাকিয়ে থাকত। মা
অতিকষ্টে দুমুঠো খাওয়ানোর চেষ্টা করত। মা বলেছে ঠাকুমা বড় লোক বাড়ির মেয়ে ছিল, দণ্ডকলস
গ্রামের এজমালি বাড়িটাও মস্তো বড়। সম্পন্ন ভূস্বামী। শুধু নাতির মুখ চেয়ে বাবুদের
বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিয়েছিল। কাউকে জানতে দেয় নি কিছু, ভোরের বেলা চান সেরে চলে যেত, যখন ফিরত শাদা
শাড়ির আঁচল চাপা কত রকমারি খাবার। একদিন তো এক মিল্কেন
ভর্তি ঘুলাইয়া কাঁঠালের কোয়া নিয়ে এলো। বাবুর বাড়ির উচ্ছিষ্টেই কী মহাভোজ হত নাতি
বিশ্বনাথের। নাতির গায়ে কাটা ফুটলে ঠাকুমা উঃ করে উঠত। একবার ওদের বাড়ির উল্টোপাড়া
খাসিয়াপট্টির নীলুর সঙ্গে বেধড়ক মারামারি, রাস্তার ওপার থেকে নীলু ছুঁড়ল পাথর,
বিশ্বনাথের নাক ফেটে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। এখনও আছে দাগ, ঐ কাটমার্কই ওর পরিচয়
এখন। খাতায় পত্রে পরিচিতি চিহ্ন। ছোট একটা নুড়ির বদলে এক আধলা ইট ছুঁড়ে
মারল ঠাকুমা। নীলুরও মাথা ফাটল। তারপরও কি শান্তি মানে,
নাতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল সারারাত। সে রাতেই বিশ্বনাথ প্রতিজ্ঞা করেছিল, বড় হয়ে যখন
সে অনেক টাকা রোজগার করবে ঠাকুমাকে একটা মস্ত বড় ফস্সি হুক্কা কিনে দেবে সঙ্গে এক
পোয়া খাম্বিরা তামাকও কিনে দেবে সেন্ট্রাল রোড থেকে। বিশ্বনাথের তো এখন অনেক টাকা।
ঠাকুমা যেমন বলত ভুতু রাজা রাজারে। রাজা হলে ঠাকুমাকে সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে
দেবে ভেবেছিল। টিউশনির কুড়ি টাকাও সময়মতো পায় নি তখন । তাগদা দিয়ে টাকা এনে মাকে দিয়ে বলেছিল ঠাকুমা যা খেতে ভালবাসে রেঁধে দিতে । ফটো
উঠানোর দুদিন পর ঠাকুমা মরে যায়। শুনেও যায় নি, তার
প্রাণের পুত্তলির প্রথম পাশের খবর।
ছোটবেলা এত ধুলো উড়ত না, বাতাস ছিল নির্মল।
চোখ জ্বালা করে অধ্যাপকের। পথ ভুল হয়ে যায়। তখন তো এবাড়ি
ওবাড়ি ঘুরে ঘুরে ছোটদাদুর বাড়ি পৌঁছে যেত ঠাকুমা নাতি। এত
এত পাকা বাড়ি ছিল না দণ্ডকলস গ্রামে । ঢিবির
মতো টিলা পেরিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া। বাংলার অধ্যাপক অনেকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে নিজের
মনেই বলে, ‘পথিক তুমি
পথ হারাইয়াছ’। হারানোর তো
কিছুই নেই, কোন সম্পদ নিয়েই সে আসে নি গ্রামে। স্মৃতির কোন অভিজ্ঞান নেই তার
কাছে, কোন নাম জানা নেই, ছোটদাদুর কী নাম তাও জানে না। এখানে
অনেক কাকা পিসি ভাই বোন বিশ্বনাথের। বাজারের পথটা তো মনে আছে তার, টিলার নিচে
আনারসের ক্ষেত ছিল একটা উপর থেকে নিচে। রিক্সার ভ্যাঁ ভো শুনে খুশি মনে রিক্সাওলাকে
কিছু না বলে উঠে বসে। এ কেমন দণ্ডকলস গ্রাম, নির্ঘাত ভুল হয়েছে, দণ্ডকলস গ্রামে কোন কালে রিক্সা চলার কথা নয়। এ হয়তো
অন্য গ্রাম, অনেক ভাগ থাকে গ্রামের, দণ্ডকলস পার্ট
ওয়ান পার্ট টু থ্রি । পথভোলা
পথিকের এখন একমাত্র উপায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে যাওয়া, করিমগঞ্জ
শহরে আবার। রিক্সাওলাকে বলে
--যতীন্দ্র নাগের
বাড়ি চেনো ?
রিক্সাওলা
বলল,
--চিনি।
বা এ
চমৎকার কী করে হয়, তার ছোটদাদুর নামটা কী করে হঠাৎ মনে পড়ল। যাক তাহলে ঠাকুমার
পিতৃকুলের কেউ না কেউ চিনবে তাকে তার বাবাকে নয় ঠাকুমাকে। গ্রামের ভিতর সরুপথ দিয়ে
এগিয়ে যায় রিক্সা, লঙ্গাই নদীও মাঝেমাঝে উঁকি দেয় কিন্তু কিছুতেই আর গন্তব্যে
পৌঁছয় না। অধ্যাপক দেব এবার বিরক্ত হয়ে রিক্সা চালককে বলেন,
--আর কতদূর
হে ?
রিক্সাওলা
এবার ফিরে তাকায়। বলে,
--- কই
যাইতা কইলা না তো?
---
এ্যাঁ। বললাম যে।
--- কিতা
কইলা?
--- যতি
নাগের বাড়ি।
--- না, ই
নাম তো শুনছি না। খাড়াইন অউ সামনেউ নেনা মিয়ার ফার্মেসি। তাইন হক্কলরে চিনঅইন। যাইন,
জিগাইলাইন।
অধ্যাপকের পরিবারও তেমন বড় নয়। ঠাকুমারও এক
সন্তান এক নাতি এক পন্তি। পন্তির নাম বিশু, বিশ্বরাজ দেব। সে অধ্যাপক হয় নি,
বিদেশি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে গৌহাটিতে আছে, মাঝে মধ্যে বিদেশ ঘুরে আসে আর মাকে
ভয় দেখায় বিদেশেই সেটল করবে। অধ্যাপকের ভীতু ঘরকুনো ছেলের শুধু বড় বড় কথা। তার মা
তাকে পরিবারের বন্ধনে জড়িয়ে রাখে। ঠাকুমার কথাও বলে, বিশু নাকি দেখতে অবিকল
ঠাকুমার মতো হয়েছে। ছেলে আফসোস করে,
---ধুর দেখলামই না তোমার
দিদিশাশুড়িকে।
মা বলে,
---আমিই কী দেখেছি, আমি শুনেছি
আমার শাশুড়ির কাছ থেকে, আর তোর বাবা তো পারলে একটা মন্দির বানিয়ে দেয় ঠাকুমার
নামে।
--- হ্যাঁ, বাড়িটার নামও তো
স্যারএর ঠাকুমার নামে। হিরণ্ময়ী নামটা কিন্তু সুন্দর, যাই বল।
এমন
সব মাতাপুত্র কথার মাঝখানে ঢুকে যান প্রফেসর দেব। ছেলেকে বলেন,
---স্যার
কী, শুনি ? বাপের
সঙ্গে ফাজলামো । ছবি
দেখবি ?
বলে
তার ছবির ভান্ডার খুলে বের করে বিবর্ণ এক উজ্জ্বল মুখ। ছেলে
‘ওয়াও’বলে খুশি হয়। বিশ্বজিৎ দেব ছেলেকে বলে,
---আমার
নাম ছিল বিশ্বনাথ। ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিল ওই নামেই ডাকত।
ছেলে
বলে,
--- নামটা
মোটেই ভাল না, ছবিটা খুব সুন্দর।
মঙ্গলেরও
খুব পছন্দ হয় ছবিটা, সে ছবিটা নিয়ে নেয়। বলে পোস্টার বানাবে, ঘরের জায়গাও ঠিক করে।
ড্রয়িং রুমের একটি দেওয়াল ঢাকা ছবি করিয়ে আনে চিত্রকর নীলম বরুয়ার শৈল্পিক নবীনতায়। বিশুর বান্ধবী দোপাটির ডাকনাম মংগল, মঙ্গলবারে
জন্ম বলে। অধ্যাপক পুত্রের সবই ভাল,
কিন্তু বিয়ের কথা বললে কিছুতেই হ্যাঁও করে না, না ও না। এদিকে আবার মেয়ে বন্ধু
অনেক। বেশির ভাগ গুজরাটি মাড়োয়াড়ি পাঞ্জাবি মাদ্রাজি। মঙ্গল কম বয়সে পাঞ্জাবি ছেলেকে বিয়ে করে এখন একা। এ নিয়ে
ওর কোন দুঃখ কষ্ট নেই, বিশু বলে বিন্দাস আছে বুলবুল ভাজার দোকান নিয়ে। বুলবুল ভাজা
মানে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বিজনেস আর বাংলা নিয়ে আদিখ্যেতা। মানে,
গৌহাটিতে বাংলা পাব্লিকেসনেরও মালিক দোপাটি সেন। সেই কারণেই হয়তো আধ্যাপক
বন্ধুপিতারও বিশেষ প্রিয়ভাজন। লিটারেচারের ছাত্রী, ইংরেজি এম এ, নিজের কোম্পানির
এম ডি। দুই বন্ধুতে ইংরেজিতে খই ফোটায়। কিন্তু দিনশেষে সেই বাঙালিই, সিলেটিতে কথা বলে,
শাক সুক্তো ইলিশমাছ আর সিদলভর্তার ভক্ত। ব্যোমকেশ ফেলুদা যেমন শীর্ষেন্দু সুনীল আর
জীবনানন্দের কবিতাও পড়ে। অধ্যাপক তার গ্রন্থাগার থেকে বই দেয়। অগোছাল
বই সাজিয়েও রাখে মেয়েটি। বিশু তো বই পত্তরের ধার ধারে না, বলে ওসব শেষ করেছি
সিক্সথ সেমিস্টারে, আর নয়। এখন আইফোন জিন্দাবাদ। গুগুল শর্মার মতো বিদ্যার
জেটপ্লেন থাকতে আর বিশ্বজিৎ দেব এর মতো ডুবোজাহাজে কী কাজ। বিশুর এসব তাচ্ছিল্য
কথায় খুব ভয় ধরে অধ্যাপকের। বয়স যত
বাড়ছে ততই অসহায় লাগছে, বিশুটা যদি কোন মাড়োয়ারি মাদ্রাজি বিয়ে করে, ওরা তো আবার
নিরামিষ খায়। তাই বাড়িতে ফতোয়া দিয়ে রাখে ঘন ঘন। বলে বিয়ে করতে হবে বাঙালি।
ব্রাহ্মণ বৈদ্য নমশূদ্র হলেও চলবে মুসলমানেও আপত্তি নেই, কিন্তু বাঙালি চাই। শিবুর
কথা যে ভাবেন নি তাও নয়, কিন্তু পুতুল পুতুল মেয়েটার অতীত, ডিভোর্সি মেয়েকে
পুত্রবধূ করার ভাবনায় মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ বাঁধা দেয়। তবে মেয়েটার সৃষ্টিশীল মনটাকে
তার পছন্দ হয়, ঠাকুমার ছবিটার প্রাণ
প্রতিষ্ঠায় তো তার একার কৃতিত্ব, বৈঠকখানার ঘরটাকে এক অনন্য বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জ্বল
করেছে। এর মধ্যেই একদিন বিশু বিশ্বজিৎ দেব ও তার স্ত্রীকে জানায় শিবানীর বাবা
আসবেন অদের বাড়িতে। দুজনেরই
প্রশ্ন করে একসাথে,
---কেন
?
---কেন আবার কী? বিখ্যাত বাঙালি
অধ্যাপককে দেখবেন শখ হয়েছে বড়লোকের। দুখানা চা বাগানের মালিক বলে কথা।
---সে তো ঠিকই আছে,
আসতেই পারেন। চেনা নেই জানা নেই।
আনন্দও
হয় এই ভেবে তাহলে অধ্যাপনা করে জীবনে সামান্য খ্যাতির অধিকারী তো হয়েছে সে ,
ঠাকুমার ছবির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে একাএকা কথা বলে বিশ্বনাথ,
---রাজা
নাহলেও রাজার মতো হয়েছি ঠাকুমা।
মনোতোষ
সেন মানুষটিও তো মন্দ নয়। দেখে খুব পরিচিত মনে হল অধ্যাপক দেব এর। হয়তো কিছু মানুষ
থাকেন যাদের দেখলেই চেনা লাগে। যেমন লেগেছিল মঙ্গলকে। ঠাকুমার
ছবিটা অনেক সময় নিয়ে দেখলেন সেন সারথবাহ,বাংলা
কবিতায় বনিক সাউকারদের এনামেই ডাকা হত, অধ্যাপক গর্বভরে বলে,
---আমার
ঠাকুমা, আপনার মেয়ে উদ্ধার করেছে পুরনো ছবির বাক্স থেকে।
লোকটা
কেমন যেন আনমনা হয়ে রইলেন। বললেন,
---আপন
ঠাকুমা ?
জবাব
শুনে বললেন
---ও
আই সি।
সেন মহাশয়ের যাওয়ার
আগের শেষ সংলাপ।
চা বাগান মালিক মনোতোষ সেনএর
নাটকীয় চলে যাওয়া কারো ভাল লাগে নি। মঙ্গলের সঙ্গে বিশুর সম্পর্ক আছে কী নেই বুঝা যায় না।
বিশু তার মাকে বলে,
--বিয়ে করব
চেন্নাইর মেয়ে গৌতমী রঙ্গরাজনকে।
মানে আফটারএফেক্ট, মঙ্গলপিতার নিষ্ক্রমণের
অনেক কিছু ঘটে গেছে। অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দেব বুঝতে পারে ঠাকুমার ছবি নিয়েই ঘটে গেছে
মঙ্গল আর বিশুর বিচ্ছেদ। ঠাকুমার বিশ্বনাথ
তারপর ছেলের
কাছে খুলে বলে তার গর্বের দিনগুলির কথা, ঠাকুমার গৃহপরিচারিকা
হয়ে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। অধ্যাপক নিজের আত্মপরিচয় ছেলের কাছে
মেলে ধরতে বিন্দুমাত্র গ্লানিবোধ করে নি। বলেছে আজকের গৌহাটির বাঙালি বুদ্ধিজীবীর
প্রবেশিকা পরীক্ষার ফিস দেওয়াই হত না
মহীয়সী ঠাকুমা না থাকলে। বিশু
তার প্রপিতামহীর ছবির সামনে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে বলে,
--- কোন বাড়িতে কাজ করত তোমার
ঠাকুমা? সেন বাড়িতে না?
--- হ্যাঁ।
অধ্যাপকের আর বুঝতে বাকি থাকে না মনোতোষ সেনকে
কেন এত চেনাচেনা লাগছিল।তার মানে মান্তুই মনোতোষ সেন । নড়ে
চড়ে বসে অধ্যাপক দেব, মঙ্গলকে ফোন করে বলে,
---তোর মঙ্গল
নামটা খুব মিষ্টি।
---খুব খারাপ
কাকু ? ছেলের নাম?
--– না রে সত্যি
ভাল,অন্য রকম। আয়
না বাড়িতে ।
মেয়ে না
করে দেয়। বলে,
--
আসব না। তোমার
ছেলে খুব টেঁটিয়া।
--- কেন?
--- তোমার
ছেলে বলেছে মাইফুট। আমার নীল রক্তের বাপ বলেছে বিয়ে
দেবে না।
--- মানে?
--- সে
আছে, গৌতমীর
কাছ থেকে জেনে নিও, ওরা তো শুনেছি রেজিস্ট্রি করে ফেলেছে।
--- তাই?
--- তোমার
ছেলেকে চেনো না, সব ঢপ। আমাকে চাপে রাখছে।
--- গুড।এখন আমিও যদি মাথা নুইয়ে একটা ঢপ দিই।
--- তুমি
মাথা নোয়াবে? বস বি দেব ?
ইন নো কেস কাকু ।
--- আরে
তা নয়, আমার ঠাকুমা তো আর আসল ঠাকুমা নয়। আমাদের
বাড়িতে কাজ করত। করতে করতে ভালবাসে আমায়।
মঙ্গল হাসতে
হাসতে বলে,
--- আমার বাপ বিজনেসম্যান,
ধরে ফেলবে।
--- তা
হলে? এতদিন তো আমার ঠাকুমা ছিল একটা সাদা কালো ছবির ভিতর।
তুইই হিরণ্ময়ীর ছবিতে রঙ লাগিয়েছিস। এখন সমাধানও তুই করবি
গৌতমী রঙ্গরাজন।
ওরা কত কী জানে,
জীবনকে জটিল হতে দেয় না। লঙ্গাই রোডে রিক্সায় বসে অধ্যাপক ভাবে কে ঠিক, জটিল পূর্বপ্রজন্ম
না বিন্দাস যুগের কুশীলব। অকারণে ফোন বের করেও আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। কাকে ফোন
করবে, কেউ তো নেই কোথাও, যে হিন্ট দিতে পারবে, ক্লু ধরিয়ে দেবে। প্রত্নখননের হদিশ কে দেবে,বলবে দন্ডকলশ গ্রামের কোথায় জন্ম হয়েছিল বিশ্বনাথের ঠাকুমার।
নাগ বাড়িটি ঠিক কোথায়। অধ্যাপক মানুষটি যে পথ হারাইয়াছে, কে করবে তার
মার্গদর্শন। ঠাকুমার জন্ম ভিটেয় মাথা নুইয়ে যে ক্ষমা
চাইতে হবে তাকে। সন্তানের জন্য যে সে শিকড় বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি
নিয়েছিল। নেনা মিয়া মানুষটি যেমন হবে ভেবেছিল বিশ্বজিত
দেব তেমন নয়, দাঁড়ি তকির গ্রাম্য মানুষ নয়, সুপুরুষ
শহুরে প্রৌড়, তার থেকে ছোটো। বলেন,
--- আপনে বুলে নাগবাড়িত যাইতা,
তে কোন নাগ, এক আসলা রসেন্দ্র নাগ হউ পূবর টিল্লাত, তারা তো নাই, গেছইনগি শিবরগুল।
--- না না, আমার ঠাকুমা।
এখানেই জন্ম, আমি অনেকবার এসেছি এখানে ,
এক দৌড়ে পৌঁছে গেছি ছোটদাদুর বাড়ি। আমার ঠাকুমার নাম হিরণ্ময়ী নাগ, হিরণ্ময়ী দেব।
--- অয় হিরণ্ময়ী আছলা, না
আইজ্ঞা ই নাম হুনছি না। আর একটু চিন দেইন, কেউর নাম কইন জিতা মাইনষর।
--- জ্যান্ত
মানুষ কেউ নেই।
--- তে অতদিন আইলা না
কেনে?
--- জীবন যুদ্ধ।
--- বুঝলাম অখন ই মাটি খুজিয়া কিতা করতা?
--- কী
যে বলেন , মাটিতেই তো শেকড়। শেকড়
হারালে কী থাকল
?
--- অখন
নু কইলা ঠাকুমার কথা।
নেনা মিয়া
রসিক মানুষ, বুঝে গেছে অধ্যাপক মানুষটা প্রকৃতিস্থ নয়,
তাই কৌতুকে মাতে। ঠিক
তখনই অধ্যাপকের মোবাইল বাজে। মুখ উজ্জ্বল
হয়, দোপাটির ফোন,
--- কাকু
ছবি দেখলাম কাগজে, বক্তৃতা দিচ্ছ। তুমি এখন আসামে?
--- হ্যাঁ।
জগন্ময় আমার বন্ধু, অনুরোধ করল, তাই চলে এলাম, কোন কাগজে বেরিয়েছে?
নববার্তা?
--- তুমি এখনও আছ করিমগঞ্জ।
--- না আমি দণ্ডকলশ গ্রামে, আমার ঠাকুমার বাড়ি খুঁজতে এসেছিলাম,
খুঁজে পাচ্ছি না?
--- ঠাকুমাকে হারিয়ে ফেলেছ?
--- হ্যাঁ অনেকটা তাই দাঁড়ায় । ঠাকুমা হারিয়ে গেছেন ।
ফোন তখনও শেষ হয়নি, নেনা মিয়া বলে,
--- কে কইছে ঠাকুমা
হারাই গেছইন?
--- আমার
পুত্রবধূ।
মিছে কথা
বলল কী। মিছে হবে কেন, অধ্যাপক জানে তাঁর গোঁয়ার ছেলেও তাঁরই মতো, যতই ঠাট্টা
তামাশা করুক , সে তাঁর হিরণ্ময়ী বাড়ির
ঐতিহ্যকে মান্য করে। আর বিয়ে করলেও সে দোজকন্যা দোপাটিকেই
করবে। মঙ্গল জানে গৌতমী রঙ্গরাজন নামটাও
একটা ঢপ। ওষুধের দোকানের মালিক নেনা মিয়া বুঝতে পারে লোকটা ভবঘুরে নয়,
একজন বিখ্যাত লোক। কৌতুকের অবস্থান পালটে অধ্যাপকের সম্মানে বেরিয়ে আসে দোকান ছেড়ে। বলে,
---
কই দেইন স্যার তানে। ইতা মিছা কথা, কেউর ঠাকুমা হারায় না। আমি বার
করি দিমু আপনার ঠাকুমা।
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দেব কী জানি কী বুঝে, মঙ্গলকে
কিছু না বলে কেটে দেয় ফোন, নেনা মিয়ার চোখে তাকিয়ে থাকে ভাবলেশহীন।
আরম্ভ পত্রিকা, ১৯শে মে সংখ্যা, ২০১৭।
*****
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন