সমান্তরাল

‘আই অ্যাম ফিনিশড। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
ভোর চারটেয় রমার সামনে বসে কথাগুলি বলেছিলাম ম্যাডামকে। তিনদিন ধরে কোমায় ছিল রমা। শংকর ডাক্তার বলেছে জণ্ডিস, বলেছে সুগার ডাউন হয়ে তিরিশে চলে গেছে, তাও আমি বুঝতে পারিনি কিছু। রাত তখন বারোটা রমার বাঁ হাতটা বুকের উপর নড়ছিল। শংকরকে টেলিফোন করেছিলাম, বলল রিফ্লেক্স, তাও বুঝিনি কিছু ভোর চারটেয় সব শেষ হয়ে গেল। ব্রেস্ট ক্যানসার, ডানদিকের স্তন কেটে বাদ দিতে হয় তিনবছর আগে। তিনমাস অন্তর মুম্বাই গিয়ে কেমোথেরাপি করিয়ে এসেছি। ভাগ্যিস রমার ছোটভাইর বাড়ি ছিল ভাসিতে। তাও দামি কেমো দেওয়াতে পারিনি, টাকা কোথায়। রমাকে বলেছিলাম, বাড়ি বিক্রি করে দেব। করতে দেয় নি। বলেছে,
--- বাড়ি বিক্রি করে দেবে? ভাবতে পারলে? সন্তানকে বিক্রি করবে?
  প্রথমদিকে ডাক্তার রানাডে বলেছিল বারোটা হয়ে গেলে নরম্যাল লাইফ। দশটা ঠিকঠাক চলছিল এতসবের মধ্যে, প্রেশার সুগার সব সামলে দশ নম্বরের পর খুশিতে আনন্দে কলকাতা হয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। রমার ইচ্ছে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দেবে। আমি এসবে খুব একটা মানামানি করি না, তাও গেছি। ফেরার সময় শেয়ালদা স্টেশন থেকে রজনীগন্ধার শেকড়-চারা এনেছি। আমাদেরতো ছেলেমেয়ে নেই, বাড়িটাই সব, রমাও কতরকমের গাছগাছালি দিয়ে সাজিয়ে ছিল বাড়ির চারপাশ। বিয়ের পরই জমি কিনেছিলাম দুজনে পছন্দ করে, শহর থেকে দূরে, আসাম টাইপের বাড়িটাও দুজনের থেকে বেশ বড় মাপের করেছিলাম, যাতে দুতিনটে ছেলেমেয়ে হেসে খেলে বড় হতে পারে। আমাদের হয়নি বলে মনে একটা কষ্ট ছিল, কিন্তু রমার উৎসাহে আনন্দে বদলে যায় আমাদের মনোব্যাথা। বাড়িটাকে রমা তার মনের মতো করে সাজিয়েছে। গ্রামের বাড়িতে শহুরে কিছুই রাখিনি আমরা। আমাদের বাড়িতে ইটসিমেন্ট আছে কিন্তু কোন টাইলস নেই কলের জল নেই ঘরের ভিতর বাথরুম নেই, পুকুরের ঐ পারে ঘটি নিয়ে যেতে হয় পায়খানায়। বলে বাচ্চা মানুষ করতে সুখের উপকরণ দিলে হবে না। কাঠের উনুনে রান্না করেছে এতদিন, তিন বছর আগে এলপিজি কেনা হয়েছে। বাবার আমলের টেলিফোনটা নিয়ে এসেছিলাম চলছে তো অনেকদিন। রমাকে যখন মুম্বাই নিয়ে যাওয়া শুরু হয় তখন চারশ’ সত্তর টাকায় নোকিয়া ফোনটা কিনে ফেলি বাধ্য হয়ে। কত যোগাযোগের দরকার। এখন সব শেষ। ল্যাণ্ড লাইন থেকে রজত অনেককে খবর দিচ্ছে। কী দরকার এত খবর দেওয়ার।
 সাবেক কাছাড় ভেঙে অনেকগুলো জেলা হওয়ার পর থেকে বরাক উপত্যকা কথাটার খুব চল। রমা আর আমি কিন্তু কাছাড়ই বলি, এতে সংশয় হয় কারণ কাছাড়ও একটি জেলা নাম। তখন পিটিরপিটির বৃষ্টি পড়ছিল, আমার এই মানসিক শূন্যতার মধ্যেও এক ভাললাগার পরশ ছুঁয়ে যায়। রমার চোখের সামনের সরাসরি জানালাটা খুলে দিয়েছিলাম। ওখানে পাশাপাশি দুটো গাছ, দেশি নামের রুজন্ট আর আইগগা্‌জাল। গাছের পরিচর্যার কিছু নেই, তবু মাটিতে একটু খুপরি দেবে, গোঁড়ায় একটু গোবর দেবে, এসব কাজ রমার। আমার যে পেট খারাপের ধাত। প্রায়দিনই রমা একটা ঝোল রাঁধত হয় বেগুন পেঁপে নয় কাঁচকলার সঙ্গে ওইসব পাতা দিয়ে। সিলেট কাছাড়ে এসব ঝোলকেই সুক্তো বলে। রমা বর্ষার দিনে জানালা খুলে ওই গাছ দুটোর সবুজ পাতার উপর শিশিরের মতো বৃষ্টির ফোঁটা দেখে ঝলমলিয়ে উঠত। আমাদের বাড়িতে অনেক গাছগাছালি। পুকুরপারের ঝোপগুলিও অনাদরের নয়, ওখানে আছে থানকুনি হেলাঞ্চা পালই, পুকুরে কলমি। কতরকম ফলশার। রমার গাছের পাকা পেঁপে নিয়মিত খাইয়েছি ওকে, ডায়বেটিস রোগে নাকি মহৌষধ। কলা নিয়ে ডাক্তারদের মতভেদ, শংকর বলে কলা খাওয়া যায়, ফলে কোন বাছবিচার নেই, শুভ ডাক্তারতো কাঁচকলাতেও বারণ, বলে কাঁচা হোক পাকা সবতাতেই সুগার। খোলা জানালায় তাকিয়ে মন খারাপ হয়েছিল আমার, রজতকে বলেছি,
--- শংকর আর শুভকে একটা খবর দিস।
রজত বলেছে,
--- দিয়েছি মেজমামা।

  রজতের টেলিফোন পেয়ে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল সকাল সকাল। সবাই শ্মশানযাত্রায় শামিল হয়নি, দেখা করে চলে গেছে কাজকর্মে।
  ম্যাডাম যায় নি কোথাও। রমাকে বিদায় দিয়ে রজতের বউর সঙ্গে বাড়িতেই থেকে যায়। ভাগ্নে রজত শোকে মূহ্যমান। ছোটবেলা থেকেই মামীর ন্যাওটা। মামী কী কী বলে গেছে তা বলতেই ব্যস্ত। সব আত্মীয় স্বজন যখন আমাদের ছেড়ে গেছে একে একে রজত মামীর কাছছাড়া হয়নি। সে আর তার বউ জবা মামীর সব দেখাশোনা করেছে। বমি পায়খানা সাফ করেছে, আমি তো শুধু খাইয়ে দিয়েছি। একমাস আগেও রমা অনেক কাজ করেছে, রান্নাবান্না আমার দেখাশোনা। শংকর বলেছে এগারো নম্বর কেমোর টাইমিংস এ গণ্ডগোল না হলে কিছুই হতো না। লাং ইনফেকশন হয়ে গেল, কী কাশি কী কাশি। টাটাতে আবার প্রতিবারে ডাক্তার বদল হয়, শিন্দে নামে এক ডাক্তার শেষ মুহূর্তে ফিরিয়ে দিল। বলল দেয়া যাবে না। সুস্থ মানুষটাকে অসুস্থ করে ফিরিয়ে আনলাম। শেষ একমাস বাচ্চা নিয়ে রজত জবা রমার কাছছাড়া হয় নি। কাঠালগ্রাম পাঠশালায় পড়ায় রজত। নতুন বাড়ি করছে স্কুলের কাছাকাছি, গৃহপ্রবেশে মামীকে নিয়ে যাবে বলছিল। মামী বলেছে,
--- তোর আর বাড়ি করতে হবে না রাজু। এই বাড়িটা তোকে লিখে দিতে বলেছি মামাকে। রজত একথায় খুব কেঁদেছিল।
     রমার সাংসারিক বুদ্ধি কম। ও তো বলেই খালাস। চলে গেল। এখন আমি লিখে দিই কী করে? বাড়িটাতো আমার নয় একার। রমারও। কিন্তু আমারও যে কিছু নেই, সামান্য পেনশন ছাড়া। শংকর ডাক্তার গতমাস পর্যন্ত আশা ছাড়ে নি। ওদিকে মুম্বাই থেকে রমার ভাই বিজু জানাল লাখ দশেক খর্চা করলে একটা ট্রিটম্যান্ট আছে। তখনও কথা বলতে পারে রমা, বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু চোখের জল ফেলে। আমি ওর সামনেই বলে ফেলেছিলাম বাড়ি বিক্রি করে দেব। প্রথম ছোটভাই বিজুকে বকাবকি করল টেলিফোনে আর আমাকে বারণ করে দিল  ও কথা যেন মুখেও না আনি। গ্রামের জমিবাড়িরকোন দাম পাওয়া যায় না, পনের কুড়ি লাখ মেরেকেটে।
     আমাকে নিয়ে রমার কত ভাবনা। ও শেষদিকে বুঝে গেছিল আর বাঁচবে না, তাই লড়াই ছেড়ে দিয়েছিল। এত যে প্রিয় তার বর্ষা, গাছের উপর বৃষ্টির ছাঁট দেখতে জানালা খুলতেই বিরক্তি দেখেছিলাম। তখন শুধু আমাকে ছুঁতে চাইত। হাত ধরতে চাইত। হয়তো আগের মতো চোখের জল বেরতো না, কিন্তু যা বেরতো তাতেই জীবনের নির্যাস আর আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট থাকত জড়াজড়ি।
     আমাকে দেখতে সুপুরুষ বলে একটা সুনাম আছে, এই সত্তর ছুঁইছুঁই সময়েও নাকি পঞ্চাশের পৌরুষ। এ নিয়ে গর্ব ছিল রমার। রমা সেকেলে মানুষ ছিল, সিলেট কাছাড়ের সংস্কৃতি মেনে স্বামীকে ‘তাইন’ বলত, সম্মানে তিনির অপভ্রংশ। কেউ না থাকলে একান্ত সুখের মুহূর্তে আমাকে রাজা ডাকত। রমার মুখে যখনই সুখের ডাকটা শুনতাম আমি তখন আমরা হয়ে যেতাম মনেরসুখে শরীরসুখে। সে সব যৌনতার মুহূর্ত কবেই শেষ হয়ে গেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, কয়েকমাস আগে থেকে, যখন সব আশা প্রায় শেষ হয়ে গেছে তখন রমা প্রকাশ্যেই আমাকে রাজা ডাকতে শুরু করে। রমাকে নিয়ে তখন আর কোন যৌনতার বোধ আমার ছিল না।
রমার আমাকে নিয়ে অধিকার বোধও প্রবল ছিল। লেখালেখি করার সুবাদে আমার বাড়িতে অনেক গুণগ্রাহীর সমাগম হত। সাহিত্যের আড্ডা জমজমাট, শহর থেকে দূরে বলে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করত রমা। সুন্দরী মহিলারাও আসত কারো স্ত্রী প্রেমিকা কিংবা একা লেখিকা। রমা কখনও কারো প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়নি। শৈবালদাও আসত ম্যাডামকে নিয়ে।
ম্যাডাম আসার পর শোকের বাড়ি বদলে গেছে কাজের বাড়িতে। ঝমঝমাঝম বৃষ্টির মধ্যে কাজের ছেলে কুশু আসে সুপুরি পাড়ার দড়ি আর ছেদের দা নিয়ে। রজত এসে বলে দিল চলে যেতে, আজ কোনও কাজ নেই কুশুও মন ভারি  করে চলে যাচ্ছিল। ম্যাডাম আটকে দেয়। বলে,
--- কই যাও?
---  যাই গি যখন কাম নাই, ঠাউকরাইনও নাই।
--- ঠাউকরাইন নাই এরজন্য চলে যাবে? কত কাজ?
--- কাম আছে নি? তাইন নু না করলা।
--- বাঁশ কেটে আনো, দড়ি কিনে আনবে, না বানাবে?
--- বানাইমু।
--- না, বানানোর দরকার নেই। রজত নারকেলের দড়ি কিনে এনো আর সুরেশ আচার্যির বাড়িতে যাও এক্ষুনি। কী কী আনতে হবে সামগ্রী সব লিখে নিয়ে এসো।
আমরা তো শোকপালনই করছিলাম, ম্যাডাম আসার পর বাস্তব ভূমিতে ফিরিয়ে আনে। শ্মশানযাত্রার প্রস্তুতি শুরু করতেই দশটা বেজে গেল। একা কুশু আর রজত কত কাজ করবে, দশকর্মার জিনিষপত্র কে আনবে। সুধাকর আসবে মালুগ্রাম থেকে, ম্যাডাম ওকে ফর্দ বুঝিয়ে দেয়। বলে জানিগঞ্জ রাজেন্দ্র পাল এর দোকানে সব পাওয়া যাবে। আমাকে বলে,
--- সুধা এলে পয়সা বুঝিয়ে দেবে। আজ কিন্তু কারো ঋণ রাখবে না। শ্মশান বন্ধুদের চা বিস্কুট খাওয়াবে।
আমার এত দুঃখের মধ্যেও ম্যাডামের জন্য প্রশংসা বেরিয়ে গেল,
--- তুমি এত জানো কী করে?
--- তোমার স্যারের সঙ্গে শ্মশানে গেছি যে। শ্মশান বন্ধুদের নাম লিখে আনবে, কেউ যাতে বাদ না যায়।
আমি উৎসাহিত হয়ে বলি,
--- যাবে ম্যাডাম রমার সঙ্গে?
--- আর বাড়ির এত কাজ কে দেখবে?
মনে মনে বলছিলাম, যার বাড়িই নেই, তার আর দেখাদেখি। জানি মেয়েরা শ্মশানে যায় না, তবু ম্যাডাম তো একবার গেছে। বুকের পাটা আছে।
সুধাকররা ম্যাডামকে বৌদি বলে। আমি ডাকি ম্যাডাম। শৈবালদা আমাদের বাংলার স্যার ছিলেন কাছাড় কলেজে। প্রথম দিনেই ক্লাস জমিয়ে দিয়েছিলেন প্রশ্নে,
--- বল, ‘এ জীবন লইয়া কি করিব’ কে কোথায় লিখেছিলেন ?
কেউ বলতে পারিনি কোথায়, কে টা প্রথম বলেছিল প্রনবেশ তারপর একে একে সুধাকর আমি ক্লাসের সবাই। সেই থেকে স্যার হয়ে গেলেন প্রিয়। কলেজ ম্যাগাজিনের উপদেশক হওয়ায় ঘনিষ্ঠতা, কলেজ ছাড়ার পর অধিনায়ক, স্যার থেকে শৈবালদা আজীবন। স্যার লিখত কবিতা, আমরা চারবন্ধু গল্প, তাই স্যারের পত্রিকা বেরোল ‘বটপাতা’। গল্পের পত্র। শৈবালদা লেখে অন্যের কাগজে কবিতা, আমরা বটপাতায়। বিজ্ঞাপনহীন পাতায় স্যারের বেতন কুলোয় না। সুধার উপন্যাস ছাপতে কাবুলির কাছ থেকে টাকা, ম্যাডাম দিয়েছিল সোনার চেন। অর্চনা ম্যাডামও কলেজের অস্থায়ী অধ্যাপক, আমরা পাইনি। বটপাতা বেরোলেই ম্যাডাম বাড়ি থেকে পাটিসাপটা করে আনত আমাদের জন্য। ম্যাডাম আর চাকরি স্থায়ী করার চেষ্টা করেনি। আমি ম্যাডাম ডাকতাম স্যার এর স্ত্রী বলে, ওরা শৈবালদার সুবাদে বউদি।
হরি হরি বোল। বৃষ্টি থামার নাম নেই। সমবেত হরিধ্বনির সঙ্গে রঙিন কাপড়ে ঢাকা রমার দেহ বলতে তখন শুধু মুখখানিই দেখা গেছে। মাথার চুল তো কবেই উঠে গেছে, মুম্বাই থেকে সিল্কের স্কার্ফ কিনে এনেছিল তাই দিয়ে ঢাকা, এত কচি কচি লাগছিল ওর মৃতমুখ। ঢাকা শরীরে যে কলকব্জা বলে কিছু নেই তা বুঝার উপায় ছিল না। রমার কপালে সিঁদুরে সিঁদুরে ছয়লাপ। এর মধ্যে মুখাগ্নি করা নিয়ে রজত আর স্বপ্নিল এ এক পশলা হয়ে গেল। রমা তো মৃত্যুর আগেই রজতকে ভাগ্নে থেকে সন্তানের অধিকার দিয়ে গেছে। এর মধ্যে বাজারের ভুষিমাল বিক্রেতা কার্তিক আলপটকা এক মন্তব্য করেছিল,
---স্যারর তো পুয়া উয়া নাই, তে কে মুখাগ্নি করব?
কেউ কোন জবাব দেয়নি, সবাইতো জানে ভাগ্নের কথা। কেউ কিছু বলছে না দেখে পাশের ঘর থেকে স্বপ্নিল ছুটে এসেছিল বলতে,
--- আমি করমু।
--- হ্যাঁ করবি।
বলে বারান্দা থেকে ছুটে এসে ম্যাডাম তার ছেলেকে নিয়ে যায়। দেখে বুঝার উপায় নেই কিছু, শৈবাদার মতো উদার মুখশ্রী, পচিশ বছরের যুবক স্বপ্নিল, কিন্তু অপরিণতমনস্ক। স্বপ্নিলকে নিয়ে শৈবালদা ম্যাডাম এর ছিল আতান্তর। পিতার মুখাগ্নি করতে তাই একা ছাড়ে নি ম্যাডাম। সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মের তোয়াক্কা না করে শ্মশ্মানে গেছে সঙ্গে। শৈবালদা যাওয়ার পর মা ছাড়া কেউ নেই ছেলেটার। ছেলেটা একটু আবেগ প্রবণও বটে। রমার স্নেহ পেয়েছে শৈশব থেকে। রমাকে ডাকতও ছোটমা। ভেবেছিল মায়ের মুখাগ্নি তো তারই দায়িত্ব। রজত কিংবা জবা কিছু বলেনি, কিন্তু অভিমান একটা দেখেছিলাম ভাগ্নের চোখে।
আমি ভাবিনি এত সহজে এই দুর্যোগের মধ্যেও সব সমাধা হয়ে যাবে দুপুর দুটোর মধ্যে। ম্যাডাম কত নিয়ম কানুন জানে। আগুণ লোহা সব ছুঁইয়ে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিল। রজত ধড়া ধরে তুলসীতলার গায়ে ‘অস্থি’র কৌটো পুঁতে রাখে। কাকবলি দেয়, একটা কাক এসে হবিষ্য খেয়ে যায়। রজত ছাড়া বাকি সবার জন্য রান্না করে ম্যাডাম। আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল, ম্যাডাম কী করে পারল এই কঘণ্টার ভিতর একজন মানুষকে মুছে দিতে।
রমা কারো প্রতি কোন রাগ পুষে রাখত না। মেয়েরা মেয়েদের শত্রু হয় সবাই বলে। কিন্তু রমার কোন মেয়ে শত্রু ছিল না। তবু ম্যাডামকে সে পছন্দ করত না অপছন্দ করত এ নিয়ে আমার ধন্দ ছিল অনেকদিন। একদিন রমাকে বলেছিলাম,
--- ম্যাডামকে তুমি অপছন্দ কর?
---ম্যাডামকে নয় তোমার ঐ ম্যাডাম ডাকটাকে।
--- ও হিংসে?
মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছিলাম। ভাল মন্দয় মিলিয়ে মানুষ যে আমি। আমরাই বা বলব না কেন রমার সঙ্গে আমার মন কষাকষি হয় নি তা নয়। ম্যাডামকে নিয়েই হয়েছে। বলেছে,
---তোমার অন্য বন্ধুর বউরা তো এত ফলায় না। মহিলাকে অনেকবার পছন্দ করার চেষ্টা করেছি, ওর ভাল দিকটা দেখেছি। তুমি আর আমাদের বাড়ির দিকে ওর দৃষ্টি মানিয়ে নিতে পারি নি। এ বাড়ি আমাদের, ওর ছায়া পড়তে দেব না।
---ম্যাডাম মানুষটা খুব দুঃখী। একটা হ্যাণ্ডিক্যাপড ছেলেকে নিয়ে একা থাকে ভাড়াবাড়িতে। কত আর পায় বল ফ্যামিলি পেনশন? চার হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, এখন পাঁচ না দিলে ঘর ছাড়তে হবে।
--- সবার সমস্যা কেন আমাদের দেখতে হবে? ঠিক আছে স্বপ্নিলকে নিয়ে এসো, আমি রাখব। কিন্তু...
--- শৈবালদা আমাদের অভিবাবক ছিলেন। ম্যাডাম আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন উড়নচণ্ডী বয়সে।
---এরকম সবাই দেয়। মহিলা তো তোমার বয়সী।
--- কে বলল তোমায়? দু তিন বছরের বড়।
--- তাতে কী হয়? কাপড় চোপড়ের শালীনতা নেই। আমার ভাল লাগে না।
--- আমার ভাল লাগে।
কেন বলেছিলাম জানি না। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হয়তো এরকমই হয়। তবে ম্যাডামের যে আমার প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল আমি জানতাম।
মানুষের ক্ষিদের কাছে শোক দুঃখ কিছু না। ম্যাডামের কাপড়চোপড় নিয়ে রমার অভিযোগ ঠিক ছিল না, হয়তো সে অন্য ইঙ্গিত করতে চেয়েছিল। ম্যাডাম কখনই চককে শাড়ি কাপড় পরে না, শৈবালদা থাকতেও না, এখনও না। তবে কিছু একটা আছে চটকদারি, একটা আভিজাত্য, আমি সবসময়ই একটা আলাদা আকর্ষণ বোধ করেছি। ম্যাডাম যখন স্নান সেরে শুদ্ধবস্ত্রে আমাদের খেতে দিয়েছিলেন মনে হয়েছিল যেন অন্নপূর্ণা। মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখেছিলাম।
স্বামী স্ত্রীর যৌন জীবনের সংজ্ঞা কী আমি জানি না। সে কি রমার কণ্ঠস্বর নাকি তার মমতাময়ী পত্নিত্ব যা দিয়ে সে আমাকে খণ্ডিত হতে দেয় নি কখনও। তাই তার মৃত্যুর পর এক শূন্যতা এক হাহাকার আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। জীবনের প্রতি এবং ঘর সংসারের প্রতি তার প্রবল আসক্তি ছিল। আমার খাওয়া দাওয়া সুখশান্তির প্রতি খেয়াল ছিল। শেষ দিকে যখন রাঁধতে পারত না, একা একা কাঁদত শুধু, অঝোর ধারায় জল পড়ত। মৃত্যুর শেষ দিকে এক অদ্ভুত আব্দার করে আমাকে বিবশ করে দিয়ে বলেছিল,
--- আমি আর বাঁচব না গো।
আমি রমার শীর্ণ হাতে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছিলাম। কিছুই বলতে পারিনি। রমাই বলেছিল,
--- তুমি আবার বিয়ে করে নিও।
আমি না করেছিলাম চোখের জলে। এ জীবনে কী সম্ভব রমার অনুপস্থিত অবস্থানে কাউকে নিয়ে আসা। আসাম টাইপের দুর্গের মতো বাড়িটা ঘিরে তার এত এত সুরক্ষা সৈনিকের পাহারা ভেদ করে কাউকে নিয়ে আসে কি সম্ভব।
বিকেল থেকে আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। ম্যাডাম জাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। রজত বলল পৌঁছে দিয়ে আসবে রাঙিরখাড়ি। একথা ওকথায় ওরা সচেতনভাবে আমার পত্নী বিয়োগের শোক ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। আমিও গল্পে গল্পে আনমনা হয়ে যাই। এক সময় রজতকে বলে,
--- রাজু রে, তুই এবার স্থায়ীভাবে চলে আয়। তোর মামী তো তোকে উত্তরাধিকারী করে গেছে।
স্কুল শিক্ষক রজত শালীনতাবোধে মামাকথার প্রতিরোধ করে না, আবার রাজিও হয় না। তাই আমি ম্যাডামকে সাক্ষী মানি। বলি,
--- ম্যাডাম, তোমার কথা খুব মানে রাজু। ছোটবেলা থেকে মামীরও ভক্ত। ও বউ তুমি কিছু না বললে কী করে হয়?
রাজুর বউ জবাও বড় মিষ্টি মেয়ে, খুব বিনীতভাবে বলে,
--- মেজমামা, আপনার ভাগ্নে সবচেয়ে বড় ঘরটা বানিয়েছে আপনার জন্য, কমোডও করেছে। বলেছে আর কষ্ট করে পুকুরপার দিয়ে যেতে হবে না।
--- আচ্ছা বউমা, আমিও সব করে দেব, তোমাদের মতো সাজিয়ে নিও ঘর। তবু থাকো।
আমি বুঝতে পারি ওরা থাকবে না কেউ। তাই শেষ চেষ্টা করি ম্যাডামকে বলে,
--- তোমাকে কী করে বলি ম্যাডাম আমার মাটির বাড়িতে এসে থাকতে, এখানে কোন সুখ নেই। আমি এতো বড় বাড়িতে থাকতে পারব না, ছেড়েও যাব না। এবার ঘরের ভিতর পায়খানা কমোড বানিয়ে ভাড়া দেব এক পর্শন।
--- না না, যেমন আছে থাক না রমার বাড়ি। ওর আত্মা কষ্ট পাবে।
ম্যাডামকে রমা অকারণ অপছন্দ করে গেল সারাজীবন। নেই রমার বাড়িতে বসে রমার সপক্ষে কথা বলায় আমি আপ্লুত হয়ে বলি,
--- আজকের রাতটা তাহলে থেকেই যাও ম্যাডাম?

ম্যাডাম সম্মতি জানাতেই আমার বুকের ভিতর একটা সমান্তরাল চিনচিন সুখও বয়ে যায় দুঃখের পাশাপাশি।









****************

       









smazumdar07@gmail.com 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ