এক ঘণ্টার ঘটনা
কেট চপিন
রচনাকাল,
১৯ এপ্রিল ১৮৯৪
মিসেস মালার্ড হৃদরোগাক্রান্ত বলে তার
স্বামীর মৃত্যুসংবাদ যথাসম্ভব শান্ত এবং স্বাভাবিক ভাবে জানানোর চেষ্টা করা হয়।
তার বোন জোসফিন ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট বাক্যে,
রেখে ঢেকে আভাসে ইঙ্গিতে কিছুটা লুকিয়ে জানায়। তার স্বামীর বন্ধু রিচার্ডসও ছিল
সেখানে তার কাছে। রেল দুর্ঘটনায় ব্রেটলি মালার্ডের মৃত্যু সংবাদ পেয়েই সে খবরের
কাগজের অফিসে দৌড়য়। ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে সে দ্বিতীয় বার্তার অপেক্ষা করে এবং
নিশ্চিত হয়েও রিচার্ডস অসতর্ক এবং অসংবেদী বন্ধু যারা এই দুঃখ জনক বার্তা বহন করতে
পারবে না তাদের না জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় তৎক্ষণাৎ।
সে ঘটনার পূর্ব বিবরণ শুনে নি অন্যরা যেমন
শুনেছে, যদিও বিষয়ের গুরুত্ব সে নির্জীব অক্ষমতায় গ্রহণ করে। বোনের হাত ধরে সে
হঠাৎ অপ্রতিরোধ্য বিয়োগ ব্যথায় ফুঁপিয়ে ওঠে। দুঃখের ঝড় যখন শেষ হয় সে ঘর ছেড়ে একাকী
চলে যায় ওপরে, তার নিজস্ব কক্ষে। তার সঙ্গে কেউ যায় না।
খোলা জানালার সামনে একটি হাতলওলা আরাম
চেয়ার। সে চেয়ারের গভীরে ডুবে যায়, যে শারিরিক অবসন্নতা তাকে এতক্ষণ গ্রাস করেছিল
মনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছিল, সে সব তাড়িয়ে দেয়।
ঘরের সামনের খোলা বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখে
গাছের মাথায় পাতাগুলি বসন্ত সমাগমে দুলছে। বাতাসে মৃদু বৃষ্টির ছাঁট। নীচে রাস্তায়
ফিরিওয়ালারা হেঁকে ফিরছে। একটা দুরাগত গানের ধ্বনি, যা কেউ গাইছে, তার কানে এসে
বাজছে অস্পষ্ট। অসংখ্য চড়ুই পাখি বাড়ির কার্ণিশে কিচির মিচির করছে।
পশ্চিমের জানালায় এক এক টুকরো নীল আকাশ আর
তার গায়ে বাদল মেঘের লুকোচুরি, একটা আর একটার উপর জড়ো হচ্ছে।
চেয়ারের কুশোনে সে মাথা হেলিয়ে সে বসে থাকে
নিস্পন্দ, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কন্ঠ কাশির দমকে কেঁপে ওঠে, শিশু ঘুমের আগে
কান্নার রেশে যেমন স্বপ্নের ভিতরও ফুঁপিয়ে কাঁদে।
সে যুবতী, ফর্সা, শান্ত মুখশ্রী তার বিষাদ
মগ্নতার মধ্যেও এক দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এখন তার চোখের শুষ্ক চাহনি দূর
নীলাকাশের ছোপগুলোতেই নিবদ্ধ। এ শুধু প্রতিফলনের দৃষ্টি নয়, বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনাও
যেন থমকে আছে চোখের তারায়।
কিছু যেন তার নিকটবর্তী হচ্ছে আর সেও সভয়ে
অপেক্ষা করছে। সে টা কী? সে জানে না, যাকে স্পষ্ট করে চেনাও যাচ্ছে না। কিন্তু সে
অনুভব করছে। আকাশ থেকে বেয়ে নামছে বাতাস ভরা শব্দ গন্ধ আর রঙের ভিতর দিয়ে তার
মর্মে পৌঁছে যাচ্ছে অনবরত।
তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সে ক্রমশ বুঝতে
পারছে ওরা তার দিকেই এগিয়ে আসছে গ্রাস করতে, সেও ক্ষীণ হাতদুটির মতো শক্তিহীন
মানসিক অবস্থা দিয়ে ওদের পরাভূত করতে চাইছে। সে যখন ক্রমশ লড়ে যাচ্ছে, নিজেকে
মুক্ত করতে চাইছে, তখন এক ফিশফিশ নিরশব্দ বেরোয় তার স্বল্প উন্মুক্ত ঠোঁটের ফাঁক
দিয়ে। সে তার প্রশ্বাসের সঙ্গে বারম্বার উচ্চারণ করতে থাকে, মুক্তি মুক্তি মুক্তি।
অবস্থানের শূন্যতা আর ভয়ার্ত দৃষ্টি যা তাকে গ্রাস করেছিল, সব উধাও অপসারিত হয়ে
যায় তার চোখ থেকে। তারা খুব ঘনিষ্ঠ আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার নাড়ির গতি দ্রুত হয় আর
রক্তের ভিতরও উষ্ণতায় লড়াই শুরু হয়, তার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি শিথিল হয়ে যায়।
এসব কী রাক্ষুসে আনন্দ না নিরানন্দ যে তাকে
ভর করেছে, সে এই প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
একটি স্পষ্ট এবং স্বর্গীয় অনুভূতির কাছে এ
প্রশ্ন খুবই অকিঞ্চিতকর মনে হয়। সে জানে মৃত্যুর ঐ উদার ও মৃদু হাত দুটোর স্পর্শে
আবার তাকে কাঁদতে হতে পারে, যে মুখশ্রী কখনও তার প্রতি প্রেম কাতর ছিল না, যা এখন
স্থির ধূসর এবং মৃত। কিন্তু সে ঐ তিক্ত মুহুর্তের বাইরেও যে অনাগত বছরগুলির
দীর্ঘসারি দেখতে পাচ্ছে যা তার একান্ত একার, নিজস্ব। আর তাই সে প্রসারিত ও মুক্ত
হস্তে ওদের স্বাগত জানায়।
সেইসব অনাগত বছরগুলিতে তার সঙ্গে আর কেউ
থাকবে না, সে শুধু তার জন্য বাঁচবে। অন্য কোন বলশালী ইচ্ছে করে তার উপর চেপে বসবে
না অন্ধ বাধ্যবাধকতায় যাতে নর নারীরা বিশ্বাস করে তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা
একে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আছে। এই সংক্ষিপ্ত উজ্জ্বল মুহুর্তের দিকে
দৃষ্টিপাত করে সে ভাবতে থাকে সদিচ্ছাই হোক কিংবা নিষ্ঠুরতাই হোক এসব অপরাধ থেকে
কোন অংশে কম নয়।
সে তাকে কখনও ভাল বেসেছে। সর্বদা নয়। এতে
কী হয়! প্রেম বস্তুতা কী, এক সমাধানহীন রহস্য, আত্মমর্যাদার অধিকারে হঠাৎ সে বুঝতে
বাক্তিসত্তার জোরদার সম্পদই তার কাছে মূল্যবান। একমাত্র।
‘মুক্তি!
শরীর ও মনের মুক্তি।’ সে আবার ফিশফিশ করে।
জোসেফিন বন্ধ দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে
ছিটকিনিতে ঠোঁট লাগিয়ে কাতর অনুনয় করে, ‘লুইজি দরজা খোল! অনুরোধ করছি দরজা খোল-তুই
অসুস্থ হয়ে পড়বি। তুই ওখানে কী করছিস? লুইজি? ভগবানের দহাই দরজা খোল।’
‘চলে যা আমার অসুখ করবে না।’ না; সে তো
খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তখন অমৃত পান করেছিল।’
আগামী দিনগুলির আনন্দ ওর সামনে হুটোপুটি
শুরু করেছে সবে। বসন্তদিন এবং সব রকমের দিনই এখন তার আপন। সে এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
উপাসনায় নতজানু হয় যাতে সে দীর্ঘায়ু হয়। গতকালই মাত্র সে আতঙ্কে ভেবেছিল জীবনটা
যদি তার দীর্ঘ হয়।
বোনের ক্রমাগত আবেদনে সে উঠে দাঁড়ায়। এরকম
ঘুষঘুষে জ্বরের জয়ী আভাস এখন তার চোখে, দুম করে সে নিজেকে জয়ের দেবীর মতো
মর্যাদাপুর্ণ মনে করে। সে তার বোনের কোমর জড়িয়ে দৃঢ় পদে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। নীচে
রিচার্ডস তাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
কেউ একজন সদর দরজা খোলে বাইরে থেকে।
ব্রেন্টলি মালার্ড ঘরে ঢোকে, ভ্রমণ শ্রান্ত হলেও হাতব্যাগ আরছাতা সহ তাকে
প্রশান্তই লাগছে। সে দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেকদূরে ছিল, এমন কী জানেই না কোথায় কী
ঘটেছে। সে জোসেফিনের কান্না ও চিৎকারে মজা পায়। রিচার্ডসও তখনই তার স্ত্রীর দিকে
দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় চকিতে। চিকিৎসকেরা এসে জানায় তার মৃত্যু হয়েছে হৃদযন্ত্র বিকল
হয়ে-অতিরিক্ত আনন্দই তাকে হত্যা করেছে।
*********
অনুবাদ, রণবীর পুরকায়স্থ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন