হেড়ম্বপুরের প্রীতিকথা, ছোটগল্প
রণবীর পুরকায়স্থ
সে তো আজকে নয়
প্রিয়তম প্রাণেশ্বরী ইত্যাদি
প্রীতির ছায়ামাখা সম্বোধনে লেখা হয়েছে তখন প্রেমপত্র । এবং শেষে ব য় রফলা,
ব্রজমোহন কিংবা ব্রজেশ্বরের আদ্যক্ষর । প্রমথর প য় রফলা । হেমাঙ্গিনীর হে । তন্ময়
এত পুরনো নয়, তাই লেখে তোমারটি । সেটিও বাতিল হয় মল্লিকার প্রশ্নের জবাব জুতসই না
হওয়ায় । মল্লিকা লেখে, কার টি । দুরকম অর্থের দোদুল্যমান প্রতিবাক্যে তন্ময় জানায়,
তোমারটি, আবার কার । সেই চিঠি থেকেই নিজেকে বদলে নেয়, লেখে, ইতি তোমার তন্ময় ।
সম্বোধনে রদবদল হয়, লেখে প্রিয় মল্লিকা কখনও মল্লি । প্রথমে লিখিত কুঞ্জদ্বারে
বনমল্লিকা । মল্লিকাকে অনুরাগে বিশেষিত করা রবীন্দ্রনাথ সহায় । সেসব কথা, কথার
দলিল । আর্য ফ্যাক্টরির তোরঙ্গ থেকে বাছাই করা পুরোনো নতুন ক’খানা প্রত্যয়িত
দস্তাবেজ গুছিয়ে রাখে গোদরেজ সিন্দুকের রাঙামাটিতে । সেই সময়ের প্রিয় সড়কে ভ্রমণ
যে তার নিত্যদিনের । পথের দুপাশে নতুন করে বনবীথি সাজায় তন্ময় । যা ছিল তা দিয়ে,
যা নেই তাও থাকে নবনির্মাণের কর্মশালায় ।
সুখ সময়ের মনোকথা পড়ে তন্ময় । কার্বন কপি
থেকে উদ্ধার করে সংস্কারের সম্বোধন, প্রিয় মল্লি । মানে কয়েকবছরের পুরোনো হয়েছে
সম্পর্ক ।
‘তোমার শেষ চিঠিতে বেশ কাব্য করে লিখেছিলে
মেঘের বাহনে চড়ে চলে আসবে আমার কাছে । তুমি তো দেখি কালিদাসের বিরহের গাড়ি উল্টোদিকে
চালিয়ে দিলে । এরকম হয় না, এখন পূর্বমেঘ চলছে, ম্যাপটা ঠিক হোক তারপর তো চড়ে বসবে
। না হলে যে কোথা থেকে কোথা যাবে । আর গেলেই হল, কোথায় যাবে আমাকে ছেড়ে । আমি যে
তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না এক মুহূর্ত । কোশিশ ছবির সঞ্জীব কুমার জয়া ভাদুড়ি আমরা
। কথা বলতে পারি না দূরে আছি বলে, ইশারা পাঠাই । সংকেত লিখি ।
আমি কোথায় থাকি জানো । দেশের নাম মণিপুর,
জনপদ থানলন । একটা চার্চের গায়ে ডাকঘর আমার । ইম্ফল থেকে চুড়াচাঁদপুর চার ঘণ্টার
বাসপথ । ওখানে থাকতে হবে একরাত । মাঝখানে বিষুণপুর । মণিপুর নিয়ে দুরকম মণিপুরির
দাবি, একপক্ষে বলে তাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর । ডানদিকের পথে না গিয়ে সোজা এগোলেই
মইরাং । নাম শুনেছ হয়তো, আইএনএ সেনাবাহিনী নাগাপাহাড় দিয়ে মইরাঙে ঢুকছে । ওখানে
আছে নেতাজির পূর্ণাবয়ব মূর্তি, আইএনএ স্মারক, ইত্তেহাদ, ইতমাদ, কুরবানি । আছে
জাদুঘর । আরও একটা কিছু আছে এখানে, লোকতাক হ্রদ সত্যি তাক লাগিয়ে দেয় । হ্রদের জলে
মানুষের গ্রাম, মাছের সংসার আর পরিযায়ী পাখি । একদিন ভোরের বেলা তোমার সঙ্গে
বেড়াতে যাব স্বর্গপুরীর হ্রদের পারে । উল্টোপথ হয় যদিও, বয়স কম তো, একটু ঘোরাঘুরি
হয় । আবার পথ সোজা করতে পিছিয়েও যেতে হয় । চুড়াচাঁদপুরে বিরতির পর গমন আবার । পথের
বর্ণনা তো কালিদাস দিয়েছেন । দিনের শেষে উত্তরিবে এসে গির্জাবাড়ির ডাকঘরে, পাহাড়
চূড়ায় । এখানকার স্থানীয় মানুষরা সিম্তে একটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী । আরও কত আছে,
পাইতে, মার, মিজো, নাগা । ইশাই ধর্মাবলম্বী সবাই । ইশুকে ওরা ডাকে লালপা । আমাকেও
ডাকে ঈশ্বর পুত্রের ডাকনামে । তুমি যেমন বলতে যৌবনের রবীন্দ্রনাথ । রোগা পটকা
লোকটাকে রবীন্দ্রনাথ বলায় মিট্মিটে সুখ পেয়েছি । আমার দাড়ি আরও দীর্ঘ হয়েছে ।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা খুব মনে পড়ে, এখানে মেঘ সরমার মত চরে । সরমা মানে
কুকুর । গাভীটাভি নেই এদেশে । এখানে মাংস বলতে কুকুর আর শুয়োর । সারাবছর মেঘ আমার
মতো বিরহী হয়ে পথ হাঁটে । ঝমঝমাঝম মিলন হয়, আমার হয় না । খাবারে কোনো বৈচিত্র নেই,
পাহাড়ে কুকুর শুয়োর ছাড়া ডাল ভাত গেঁড়ি আর ইম্ফল চুড়াচাঁদপুর থেকে নিয়ে আসা রাই
সর্ষের হলদে হয়ে যাওয়া পাতার সবজি, বলে লাইপাতা । সহকর্মী দুজন মণিপুরি, ওসব খাওয়া
আমিও খাই । ওখানকার আদিবাসীরা আমাদের বলে ইন্ডিয়ান । আর, সিম্তে মেয়ে একটি আছে
মারিয়া । ওর কিচেনে রাত হলে গ্রামের ছেলেরা জড়ো হয়, গিটার বাজিয়ে গান গায় । ওর
দোকানে অনেক রকম পানীয় । আমাকে চা খাওয়ায় মারিয়া, আমার সঙ্গে নাচে । গান গাইতে বলে,
গাই ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ , সুরেও লাগে, সবাই কোরাসে গায় বাংলা না জেনেও ।
মারিয়া তোমার মতো অনেকটা, এত প্রেমিক তবু নিঃসঙ্গ সে । আমাকে মনের কথা বলে, বলে এক
ভারতীয় তার মনের মানুষ । কে সে বলেনি । রহস্য করে কী বলতে চেয়েছে বুঝিনি । তোমার
যৌবনের রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে ফেলেনি তো । তার লালপা । মারিয়াকে ভাল না বেসে থাকা যায় না । তোমার কথা
বলিনি ওকে । যদি প্রবাসের রাতগুলি আমার ব্ল্যাকআউট করে দেয়, সেই ভয়ে ।’
তন্ময় চিঠি লেখে কার্বন কপি করে । এক হপ্তা
ধরে চিঠি লেখা । সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকে মল্লিকা । কথা বলা শুধু, কাগজে কলমে । ডাকঘরে
তো অন্য কাজ নেই । রবিবারে গির্জাঘরে উৎসব হয়, গ্রামের টাটকা সবজি নিয়ে আসে
ভক্তজন, ইশুকে উৎসর্গ করে । এত এত সবজি দিয়ে কী হবে, পাদ্রি ব্রাদার অনেকটাই
বিক্রি করে দেয় । তন্ময়ও কেনে । সারাদিন তো শুধু রান্না করা, মেঘ দেখা আর চিঠি
লেখা, এই তো কর্ম । রানার যেদিন আসে সেদিনই কাজ । সপ্তাহে একদিন আসে কাঁধে
বৃষ্টিরোধক চটের থলি নিয়ে । কোনদিন খইদঙ কোনদিন রঘুমণি । ফেরার ডাকে তন্ময় ঢুকিয়ে
দেয় তার ব্যাক্তিগত চিঠি । মাকে দাদাকে দু-একজন বন্ধুকে লেখা চিঠি দেয় ডাকব্যাগে ।
শুধু মল্লির চিঠিতে শেষ থাকে না, ডাকটিকিটও না । বিয়ারিং হওয়ার ভয় নেই,
হাইলাকান্দি প্রধান ডাকঘরের চাকুরের কাছ থেকে তো আর শুল্ক নেবে না বিভাগ ।
মল্লিকার কাছে চিঠি লেখাও একটা লাগাতার বিষয় । তাই শেষ থাকে না । সাময়িক বিরতির
একটা নাম দিয়ে, খামে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেয় । কখনও কখনও তোমার তন্ময় লিখতেও ভুলে
যায় । খইদঙ কিংবা রঘুমণির ঘণ্টি বেজে উঠলেই মন আনন্দে নেচে ওঠে । গুণচটের থলিতে যে
আছে সাতরাজার ধন মানিক, মল্লিকার চিঠি । ফেরার সময়ও ঘণ্টি বাজিয়ে যায় । বল্লমের
ফলার কাছাকাছি কাঁধে থাকে ডাক পেটিকা । আর একটি ছোট পেটিকা থাকে কোমর কশিতে,
ডাকহরকরার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি । দশাসই চেহারার খইদঙ যখন নেমে যায় জঙ্গলে মনে হয়
দৌড়বীর নামছে হাজার মিটার দৌড়ে । নিমেষে হারিয়েও যায় জঙ্গলের সুন্দর । সুকান্ত
কবিতার পত্রদূত অবিকল । শম্ভু ভট্টাচার্যর
নাচ দেখিনি তন্ময় । দেখিনি মুকুন্দ ভট্টাচার্যর রানারও । তবে শুনেছে এখনও, এই সত্তর
বয়সেও যুবাপুরুষ নেমে পড়েন মঞ্চে রানার নাচতে । মল্লিকা সন্দেহ করে তন্ময়কে, জানতে
চায় কী করে জানে এত সমাচার । সে তো কলকাতার ছেলে । শিলচর যায়নি জীবনে,
মুকুন্দদাকেও দেখেনি । তন্ময় জানায়,
‘শিলচরের শিখা দত্ত কাজ করে ইম্ফল জিপিওতে ।
ওদের একপাড়ায় বাড়ি, মুকুন্দদাদের । এপার ওপার রাস্তার উল্টোদিকে হেমলতা প্রেসের
গলিতে বাড়ি । বলেছে সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ বাড়িতে । কেউ গানে কেউ নাচে
পারদর্শী । ভাই অনন্ত ভট্টাচার্য লোকগানের ভাণ্ডারী, কয়েক হাজার গানের সংগ্রাহক ।
শিখার মতো মেয়ে হয় না বুঝলে, মণিপুরি গান গায়, নাচে, নাটক করে । স্বামী মণিপুরের
বিখ্যাত নাট্যব্যাক্তিত্ব । সারা ভারতব্যাপী নামডাক । একদিন গেলাম কোয়াকাইথেলে
ওদের নতুন বাড়িতে । শিখা আমার সঙ্গে সিলেটি ভাষায় কথা শুরু করে । আমি কিছুই বুঝতে
পারিনি । কথাটা তোমায় বলি ‘হিদল খাইবা নি, ইরম্বা’ শিখার ধারণা আমি সিলেটি । আামার
পদবি নাকি সিলেটি ছাড়া হয় না । আমি জানি । জন্মসূত্রে আমি সিলেটি বটে কিন্তু ভাষা
জানি না । জন্ম কলকাতার ঝামাপুকুর লেনে, দেব সাহিত্য কুটীর-এর গলি, শুকতারা
শিশুসাথীর বাড়ি । শিখা একটু থেমে যায় অপ্রতিভ । বলে এরকম শুঁটকি মাছের সিলেটি নাম
হিদল, হিদলের সঙ্গে শুকনো লংকা কাঁচা সবজি কিছু কন্দ মিলিয়ে ভাপে তৈরি মণিপুরি
ব্যঞ্জন ইরম্বা । ‘খাইবা নি’ র অর্থ খাবেন তো । খেয়েছি শিখার প্রলোভনে । পচাই
মাছের গন্ধে আমার অনিচ্ছাকে পাল্টে দিয়েছিল মেয়েটি । খেয়ে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছি
দুদিন । এরপর থেকে শিখার বাড়িতে পরিচিত বাঙালি খাদ্যই পরিবেশিত হয়েছে । শিখার
স্বামী ঐনাম তোম্বা থাকে দিল্লিতে, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার শিক্ষক । প্রতিবেশী
আমিও যাই নিত্যদিন, বিদেশি বিভূঁইয়ে একা রমণীর একমাত্র বাঙালি ভরসা, বন্ধু । শিখা
একদিন... পরে লিখব । রানার এসেছে ।’
এরকম ডটচিহ্নের মজা করে তন্ময় । ঈর্ষা
জাগানিয়া শূন্যস্থান পূর্ণ করতে দেয় মল্লিকাকে । পুরোনো চিঠি পড়তে পড়তে তন্ময় হাসে
। আসলে মল্লির সাদা মনে কাদা নেই, তন্ময় যা বলে তা-ই বিশ্বাস করে । কলকাতায় কলেজে
পড়ার সময় বিশ্বাস করেছিল সূর্য পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করে । প্রমাণও দিয়েছিল
তন্ময় । কলকাতার প্রতিটি ল্যাম্পপোষ্টে, ফুটপাঠের স্কার্টিঙে লেখা ছিল এখনও যেমন
আছে । নইলে রানারের কথা বিশ্বাস করে । ইম্ফলে রানার কোথায়, রাণারের দেশ থানলন থেকে
কবে সরে এসেছে । তবে এও সত্য এরকম এক একটি চিঠিবোমার পর মল্লি অনেকদিন চুপ করে
থাকে । চিঠি লেখে না । মল্লিকার চিঠি না পেলে তন্ময়ও ডাকে দেয় না তার দৈনিক
বর্ণদূত । একবার তো একসঙ্গে তেষট্টি পাতার পার্শেল পাঠিয়েছে হাইলাকান্দি প্রধান
ডাকঘরে । নয় হপ্তা কোনও চিঠি লেখেনি মল্লি অভিমানে । তন্ময়কেই মান ভাঙাতে হয়েছে
লাইটনিং ডাকে, লক্ষ্মীবাজার বাড়িতে তো টেলিফোন নেই, পাশের বাড়ির নম্বর জোগাড় করে
ডাক পাঠাতে হয়েছে । বড়সড় ফাঁকির স্তোকবাক্যে ভুলিয়েছে । মল্লিকাকে খুশি করতে বলেছে
চাকরি ছেড়ে এবার হাইলাকান্দি চলে আসছে পাকাপাকি, কিছু একটা জুটিয়ে নেবে । তন্ময়
এরকম মিথ্যে বলে, মল্লিকা ভাবে সত্যি । সত্য জেনে আবার অভিমান হয়, তন্ময় আবার বজ্রডাকে
মিষ্টি করে বলে, এবার বিয়ের কথা পাড়বে হাইলাকান্দি গিয়ে । তবে চাকরি ছাড়ার কথাটা
একেবারে মিথ্যে বলেনি তন্ময় । একটা মতলব আছে, নইলে কেন দুম করে ইস্তফা দিয়ে দেয়
অর্থনীতির এম এ ।
ইম্ফল থেকে ডিমাপুর যাওয়া খুব সহজ । সকালের
বাস বিকেলে পোঁছে দেয় । তবে তন্ময় তো আর সহজ পথের পথিক নয় । সে সড়কপথে যাবে শিলচর,
শিলচর থেকে ট্রেনে ছত্রিশটা পাহাড়ি সুড়ঙ্গ পার হয়ে যাবে লামডিং, লামডিং থেকে
দুঘণ্টা তিনঘণ্টা বড়বাজার চারঘণ্টায় পৌঁছবে ডিমাপুর । হাতে সময় দশদিন । কার্ড
এনভেলাপ ইনল্যান্ড লেটার বিক্রির চাকরি ছেড়ে ল্যান্ড লেবার ক্যাপিটাল আর অ্যাডাম
স্মিথের কাণ্ডকারখানা নিয়ে কথা বলার চাকরি ডিমাপুর কলেজে । তবে তন্ময় যে একেবারে বেহিসাবি তাও নয়, শিলচর
যাওয়ার দুটো দিক সে খোলা রেখেছে । এক, হাইলাকান্দি লক্ষ্মীবাজারের লক্ষ্মীদেবীর
সন্দর্শন, দুই, এই দশদিনে শিলচর হাইলাকান্দি করিমগঞ্জে কোথাও যদি একটা মাস্টারির
চাকরি জুটে যায় । মল্লিকা বলেছে হাইলাকান্দির এস এস কলেজে একটা পোস্ট খালি আছে ।
তন্ময় বলেছে আবার গ্রাম । মল্লিকা বলেছে গ্রাম নয় শহর । সিনেমাহল আছে । টাউন হল আছে
হাইলাকান্দিতে । আর আসাম হলেও ওখানকার মানুষ সবাই বাঙালি, সরকারি ভাষাও বাংলা ।
তন্ময় ভাবে মন্দ কী, মল্লিকাহীন জীবনের অনভ্যস্ততা কাটবে । মারিয়া শিখার সঙ্গে
বেয়াড়া সম্পর্কও এড়িয়ে যাওয়া যাবে । আর কোথাও কিছু না জুটলে হুগলি নদীর পারে
ঝামাপুকুর লেন তো রইলই ।
স্থলপথে শিলচর ভ্রমণে এসেই সব ওলটপালট হয়ে যায় । এমন সুন্দর স্বদেশ যে
থাকতে পারে জানতই না তন্ময় । মল্লিকাও বলেনি তার নদীমালার কথা । জিরি চিরি মধুরা
ধলেশ্বরী সোনাই রুকমিনি এবং দূরের জাতিঙ্গা, দামছড়া । বড়াইল পাহাড় থেকে বের হওয়া
বরাক সুন্দরীর আঁকাবাঁকা রূপ । কিছুদূর করিমগঞ্জেও গিয়েই আখের রসের মতো মিঠে পানির
নদী কুশিয়ারা । ওদেশে আখের অন্য নাম কুশিয়ারা । ওপার বাংলাদেশে গিয়েই নৃত্যপরা
নদীর নাম সুরমা । সুরমা থেকে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গা হয়ে বঙ্গোপসাগর । তার মানে হুগলি
নদীতেও ধলেশ্বরীর জলস্পর্শ আছে । এতসব জানার পর তন্ময় লেখে,
“আমি এখন শিলচরে কুসুমানন্দ হোটেলে । এত কাছে
তবু এত দূরে । তোমার সঙ্গে আর দেখা হল না । দুদিকের পথই বন্ধ, এদিকে মাটিজুরির পুল
ভেঙে গেছে ওদিকে ধলেশ্বরের পথ জলমগ্ন । আমি কলকাতাই ফিরে যাব মনস্থ করেছি ।
প্লেনের টিকিট কেটে নিয়েছি । আমি অপেক্ষা করব তোমার, যতদিন না তুমি আমার হয়ে
কলকাতায় আসবে আমি প্রতিদিন গঙ্গার ঘাটে যাব, দেখে আসব তোমাকে । তোমার ধলেশ্বরী
শুনেছি এসে মিশেছে গঙ্গায় । নদীর মতো হয়ে তুমি কত কথা বলে যাবে আমাকে । তবে এবারের
চাকরিছাড়া বেড়ানোটা খুব উপভোগ করেছি । এত পাহাড় ডিঙিয়ে তবে পোঁছতে হয়েছে তোমার
কাছে । এত এত নদীগিরির শেষে । তোমার সঙ্গে দেখা হল না কিন্তু উপলক্ষ তো তুমি ।
শিলচরের এক কবি লিখেছিলেন – ‘তুমি আছ বলে মেঘে জল...’ তবে এত জলের কল্পনা কবি
করেননি । এ কেমন অভিবাদন বলো, শিলচরে পা দেওয়ার পরেই ঝমঝমাঝম্ । কিন্তু এর আগের
সব কিছুই তো দারুণ ছিল । পূর্বস্থলী ভ্রমণের সুখ ছিল । সেই চেনাপথ, চুড়াচাঁদপুর
হয়ে । থানলন একরাত, রাতের গানবাজনায়ও কিছুটা লারেলাপ্পা । মারিয়া পাশে বসতে বলে,
যেমন বসেছে গির্জাঘরের দিনগুলিতে । বসেছি পুরোনো দিনের উষ্ণতায়, উনুনের উত্তাপ আর
অনেকদিন পরের মারিয়া আরও সুন্দর হয়েছে । মারিয়া বলেছে কলকাতা যাবে, পাহাড়ি মেয়েকে
শহরে কেমন সুন্দর দেখবে কে জানে । মারিয়া আমাকে একটা ফুল আঁকা রুমাল উপহার দেয়
বিদায়ের সময় । এবার যাত্রা পারবুং, থানলনের মতোই এক জনজাতি অধ্যুষিত লোকালয় । ওখান
থেকে টিপাইমুখ, জিরিবাম । নদী পেরিয়ে জিরিঘাট ফুলেরতল নামের একটা ছবির মতো গ্রাম,
টিলাভুমি আর সমতলের সুষম বণ্টন, আনারসের বাজার বিখ্যাত । মধুর মতো মিষ্টি বনের
টিয়াফল । সোজাপথে শিলচর, মাঝখানে এক পিরের বাড়ি । জ্যান্তপির দেখিনি জীবনে ।
বাঁশকান্দির পিরের কেরামতি ভাঙা হাড়গোড় জুড়ে দেওয়ায় । আমি বললাম আমাদের জুড়ে দাও ।
পিরবাবা বললে, অভঙ্গ জোড়া যায় না । হাসলেন, শাদির বিধান দিলেন ।”
তন্ময় হাসে । এটাও একটা নকল চিঠি । মানে ভুল
চিঠি । মানে মিথ্যে কথা । মাটিজুরির পুল ভেঙে গেলেও মানুষ নৌকায় পারাপার করে,
ধলেশ্বরের পথ জলমগ্ন হলেও মোহনপুর দিয়ে হাইলাকান্দি যাওয়ার ভিন্ন পথ আছে । এসব
তাতিয়ে দেওয়ার, মল্লিকার মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার কথা । লিখেছে কার্বন দিয়ে, দুটোই
রয়ে গেছে পেছন চালায় লুকোনো চালকুমড়োর মতো । কিন্তু এর পরেও তো লেখা হয়েছে একতাড়া
। এমন তো নয় যে মল্লিকার সঙ্গে যখন দেখা হবেই তখন আর কেন লেখালিখি । নাকি নতুন
বাংলা দেখার সুখে ভুলেই গেল প্রিয়তমাকে । তৃতীয় বাংলা বলে হোটেল ম্যানেজার মিথিলেশ
। বলে বাংলার তৃতীয় ভুবন । বরাক নদী আর তার উপত্যকা নিয়ে খুব গর্ব অধিবাসীদের ।
তাই তো ওরা বাড়িতে থাকে না । কোথায় গেছে জানিয়েও যায় না । শিলচর এসেই পরদিন গেছে
তন্ময় হাইলাকান্দি । প্রধান ডাকঘরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে মল্লিকা ছুটিতে । বাড়িতেও
তালাবন্ধ । আবার গেছে দুদিন পর, পড়শি বাড়ির কেউ একজন এসে বলল রোজকান্দি যেতে পারে
। চাবাগানে ওর মামার বাড়ি । রোজকান্দি থেকে ফেরার পর চিঠিবন্ধের রাগ কমতে থাকে
একটু একটু করে । চিঠি তো নয়, দেখা হওয়ার মাইনিউটস লিখে পাঠায় ।
‘ তোমার হাইলাকান্দি পৌঁছানোর দুরকম পথ আছে,
একটা ডানদিকে একটা সোজা । ডানদিকের পথটা একটু দুর্গম, ফিরেছি সেই অগম্য পথেই ।
মাটিজুরি পর্যন্ত খানাখন্দ, নদী পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তা মাইলের পর মাইল, পাহাড়ের পর
পাহাড়ের শ্রেণি । ডাকাতের ভয়ে গাড়ি ঘোড়াও কম সন্ধে হতে না হতে । পাহাড় শেষ হতেই
গঞ্জের বাজার ধোয়ারবন্দ, মিজোরাম খুব কাছাকাছি, উগ্রপন্থীও আছে আশেপাশে । তবে সব ভয়
ভাঙিয়ে দেয় তোমাদের চা বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য । চায়ের কচি পাতার গন্ধে বিবশ হয়ে
যায় মন । মন যে শুধু তোমাকে ডাকে, উৎকণ্ঠায় ভর করে পোঁছই রোজকান্দি চা বাগান ।
তোমার মামার বাড়ি, চা বাগানের, বিশাল এক সংরক্ষিত বনভূমি, জলাভূমি । দার্জিলিং
গেছি, চা বাগান দেখা হয়নি দুচোখ ভরে । বাগান দেখা হয়, তোমার মামার বাড়ির আতিথেয়তা
ভুলব না । তোমার মামির রান্না থোড় মচার ঘণ্টর স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি । হরিণের
মাংস খেতে সুস্বাদু শুনেছি খেয়ে বুঝেছি শোনা কথায় স্বাদ মাপা যায় না । দারুণ । মাছ
মাংসের লোভে শাক সবজির লোভে মনে হয়েছিল থেকে যাই বাকি কয়েকটা দিন । কুসুমানন্দয় আর
ফিরব না । তোমার মামার বাড়িতে কোন পরিচয়ে থাকি বলো তো । তোমার মামা তোমাকে
ভালবাসেন খুব । আমাকেও অপছন্দ হয়নি । তোমার বাবাকে তো বলেই দিলেন বিয়ে হবে বাগানের
বাড়িতে । এত আয়োজন লোকজন লক্ষ্মীবাজারে পাওয়া যাবে না । বাংলা সিনেমার প্রেমের
দৃশ্যে যেমন সাইড টক হয়, আমিও বাবা মামার কথার মাঝেই তোমার কানে শুনিয়ে দিই ডায়লগ,
--- দেখলে তো পিরবাবার কথা মিলে গেল ।
তুমি অবাক অভিনয়ে বলেছিলে,
--- কী কথা ।
--- শাদির কথা ।
--- বিয়ে । ও তো কথার কথা । বাল্কের হাতে নাড়ু ধরিয়ে শান্ত
করা ।
--- আমিও বালক ।
তুমি চোখের ইশারায় কোনও স্মৃতি উস্কে
দিয়েছিল প্রগলভতায়,
--- বালক ব্যাঘ্র । সে না হয় হল,
কিন্তু এই পিরবাবাটি কে । তুমি যে বললে গুরুদেব ।
--- সে আছেন একজন শালগঙ্গায় ।
তিনিও বললেন বিয়ের কথা ।
--- গেছ তুমি আশ্রমে ?
--- গেছি । তিনি খুব ভালোমানুষ ।
প্রচুর ধনসম্পত্তি । পুরিয়া করে কদমগাছের মাটি বিক্রি করেন । মানুষের অগাধ ভক্তি ।
তুমি সন্দেহ করেছিলে আমার কথায় ।বলেছিলে,
--- গুরুদেব কিন্তু বাক্সিদ্ধ
।
আমিও যুদ্ধে গেছি । বলেছি,
--- তাই তো মনে হচ্ছে । বললেন বরাক ভূমিতে সুলক্ষণা পাত্রী
পাওয়া যাবে না ।
--- কেন ?
--- শব্দদোষ আছে । বাক্যদোষও আছে ।
--- তাহলে আর কী, চলে যাও খাচ্ছি যাচ্ছির দেশে ।
সত্যি বলছি তোমার চোখে সেদিন আমার সর্বনাশ
দেখেছি । রাগলে পরে তোমাকে সুন্দর দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেদিন ।’
শব্দদোষ আর বাক্যদোষের কথা বললে সিলেটিরা রাগে ।
সিলেটের বাঙালিদের বাংলার উচ্চারণ একটু ভিন্ন । অনেক বর্ণে অকারণ জোর দেয় । শব্দ
প্রকরণও একটু খটোমটো । তন্ময় চলে আসে শিলচর পরদিন, মল্লিকা থেকে যায় মামারবাড়ি ।
কোনও কথাই হয় না । সবসময় বড়রা ছোটরা ঘিরে রইল যে । মল্লিকাও কোনও উৎসাহ দেখায়নি
একটু সময় বের করার । তাহলে কী দাঁড়াল। মল্লিকার মনের পরিবর্তন । আর ভালো লাগছে না
সহপাঠী বন্ধুকে, নাকি নতুন বন্ধু হয়েছে কোনও ডাক বিভাগের কর্মী । লক্ষ্মীবাজারে
পাশের বাড়ির অতি উৎসাহী যুবকটি কী, যার নাম দেবাশিস কানুনগো, যে দিয়েছে বাগানের
সূত্র । স্থানীয় ভিক্টোরিয়া স্কুলের মাঝবয়সি ড্রইং মাস্টার । তাও বা কী করে হয়,
সেই কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ফাজলামি করার মতো সংলাপও তো বলে
গেল প্রেমের প্রথামতো । ডায়লগের শেষে রাগ অভিমানটাও একই আছে । কুঞ্জদ্বারে তার
সদাজাগ্রত বনমল্লিকা তো তাহলে একই আছে । তবু কেন উচাটন যায় না । শহরের কেন্দ্রে
হোটেলটাও মন্দ না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খাওয়া ভাল থাকা সস্তা । মায়া হোটেল
গ্র্যান্ড হোটেল থেকে ভাল । আরও কয়েকটা দিন থাকাই যায় । কিন্তু তন্ময়কে টানে
রোজকান্দি চা বাগান । তাই চিঠি লেখা বন্ধ কয়েকদিন । কয়েকদিন পরের চিঠিটায় থাকে
নতুন মোড় ।
‘ হোটেল ম্যানেজার একটা ভ্রমণ ইটিনিনারি তৈরি
করে দেয় আমাকে । প্রথম দিন খাসপুর, কাছাড়ি রাজার রাজধানী, এখন ধ্বংসাবশেষ । দেখলে
তো বাঁশকান্দির পিরবাবা আর শালগঙ্গার বাবাজির কথা কেমন মিলে গেল । দুজনেই বলেছিলেন
যেতে । অভীষ্ট সিদ্ধ হবে । কিসের অভীষ্ট কে জানে । নতুন জায়গা দেখার আনন্দ আমার
সবসময় । গিয়ে তো ভালই হল । এক বিশাল রাজত্বের কথা জানা গেল । একদিকে মধুরা আর
একদিকে নাক্টিছড়া নদী দিয়ে সুরক্ষিত রাজধানী এখন দুই চা বাগানে বিভক্ত ।
শিবেরবন্দ ও খাসপুরে মদেশিয়া চা শ্রমিক ছাড়াও কাছাড়ি বর্মনদের বাস । যদিও খাসপুর ও
থালিগ্রামের বাইরে সেই রাজবংশীয় জনগোষ্ঠী একেবারে কোণঠাসা । কবেই রাজ্য ভেঙে দুভাগ
হয়েছে । হিড়িম্বারা উত্তর কাছাড় ও মিকির পাহাড়ে আর বর্মনরা খাসপুর সহ কাছাড়ে ।
খাসপুরে শুধু চুন সুরকি আর খসা পাথরের ভাঙা রাজ-অট্টালিকা এখন জঙ্গলাকীর্ণ ।
রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই । একা বোকার মতো দেখি আর ভাবি কী বিখ্যাত ছিল
রাজধানী । সংলগ্ন গ্রাম থালিগ্রামে গিয়ে জলতেষ্টা পায় । নিতান্ত কৌতূহলের তেষ্টা ।
রাজরাজড়াদের নিয়ে বিশদ জানতে গ্রামবাসীর মতো সানন্দ সহায় কেউ হয় না । শহরে থাকতে
গ্রাম সম্পর্কে কোনও ধারণাই তো গড়ে ওঠেনি আমার । প্রথম ধাক্কায় থানলনের জনমানবহীন
পাহাড় গ্রামে দেখলাম শুধু আকাশবাড়ির মেঘ আর ডাল বরাবর গৃহপালিত কুকুর । মারিয়ার
কিচেনে নিশিবাসর । আসল গ্রামের চেহারাটাই চিনতে পারতাম না থালিগ্রাম না এলে ।
বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ির সীমানায় যে গেট, তাকে ওরা বলে ঘাটা । এ কেমন নাম, নদীর
ঘাট নাকি । ঘাটা খুলে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে, কোনও বাধা নেই । মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক,
আর পাঁচজন বাঙালির মতোই দেখতে, কথাবার্তাও স্থানীয় বাংলায় । তবু কোথাও একটা
ব্যতিক্রম আছে, সে কি চোখের পাতায়, একটু ছোট, চিন, বর্মি কিংবা নেপালিদের একটা আদল
। কিন্তু ব্যক্তিত্বের কম নেই কোথাও, আবার একটা মিষ্টি স্বভাবের আভাসও আছে । আমাকে
দেখেই চিনতে পারেন, বলেন কলকাতা থেকে আসছেন । আমি হ্যাঁ এবং না–এর আমতা আমতায়
মণিপুর থেকে শিলচর পর্যন্ত স্থলপথের ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনিয়ে দিই । মাটির দাওয়ায়
বসতে দেন একটি আসনে, জানি না সতরঞ্চি বলে কী না আসনটিকে । ছোট একজনের বসার মাপে
তোমার মামার বাড়িতে দেখেছি, বলেছিলে সুজনি । সুজনি থেকে আলাদা রংবেরঙের সুতোয়
বোনা, একেবারে অপ্রতিম, অন্যরকমের সুন্দর এই আসনখানি । সুন্দর এখানেই বসতে ডাকছে ।
এরমধ্যেই ভিতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আর এক সুন্দর, হাতে জলপাত্র অন্য হাতে থালা,
থালায় কয়েকটি নাড়ু, সম্ভবত নারকেলের । আমি দেখছি যুবতীর পরিধেয়, সবুজ হলুদে
মেশানো, শাড়ি নয় কিন্তু শাড়ির মতোই, ফানেকও নয়, অসমিয়া মণিপুরি সংমিশ্রণ । মেয়েটি
গৌরী, দীর্ঘাঙ্গী । দুভাগ কিংবা তিনভাগের কাপড়ে এক অপরূপা । গৃহস্বামী মধুমঙ্গল
বর্মন বলেন, আমার মেয়ে কাঞ্চনী । আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় অন্য প্রশংসা, এত
মোলায়েম, এত কোমল । এদিকে কাঞ্চনী ওদিকে আসন । তোমাদের দেশের সুজনিতে হাত দিয়ে
অনুভব করি সুন্দরকে । বিব্রত হয়ে বলি সুখাসন কথা । ঘরের বোনা ছোট মাদুরখানার নাম
পাতঞ্চি । অবিবাহিত মেয়েরা বোনে । গুটিপোকার সুতো দিয়ে বোনা । প্রশংসিত পুত্রীর
সঙ্গে পিতারও ভাল লেগে যায় বিদেশি পথিককে । শুধু জল নাড়ু নয়, দ্বিপ্রাহরিক
ডালভাতের নিমন্ত্রণও রক্ষা করতে হয় সেদিন আমাকে ।’
মধ্যমা আর তর্জনী তর্জনী আর মধ্যমা করে করে
তন্ময় মধ্যমাকেই জিতিয়ে দেয় । মধ্যমায় যে থালিগ্রাম । থালিগ্রাম থেকে ফিরে এসে
তন্ময় হোটেলবন্দি হয়েই থাকে । মল্লিকাকে কথা দিয়েও হাইলাকান্দি যাওয়া হয়নি ।
বেচারি ছুটি শেষ করে ফিরে যাবে বলছে হাইলাকান্দি । এদিকে যে শিলচর ছেলেদের সরকারি
স্কুলের বাংলাভাষার শিক্ষক মধুমঙ্গল বর্মনের অপেক্ষায় থাকতে হয় । শুধু মধুমঙ্গল নয়
কাঞ্চনীর জন্যও অপেক্ষা করে তন্ময় । মধুমঙ্গল না এলে ভাবে সে-ই যাবে আবার
থালিগ্রাম, শেষবারের মতো দেখে আসবে ডাকের সাজের প্রতিমা । আবার অভিমানও হয়,
অস্থায়ী ঠিকানা তো দিয়ে এসেছে, একদিন দেখা দিতে পারত পিতা কন্যা । যেদিন দুপুরে
তন্ময়ের মধ্যমা নেচে ওঠে আনন্দে সেদিন রাতেই লেখে মল্লিকাকে ।
“ জানো, আমার মনের জোরকে জিতিয়ে দিয়ে আজ কুসুমানন্দ হোটেলে এলেন মধুমঙ্গল
বর্মন । সুদৃশ্য মোড়কে এক উপহার নিয়ে । বললেন, পাতঞ্চি । বললেন আপনার ভাল লেগেছিল,
আমার মেয়ে নিজের হাতে বুনেছে । আমরা এই মহার্ঘ বস্তুটি সমাজের বাইরে দিই না । আপনি
ব্যতিক্রম তাই একটি শর্তে এই উপহার । আমি বলি, উপহারে শর্ত থাকে না । মধুমঙ্গল
বলেন, জানি, না মানলে কিছু করার নেই, এ শুধু সামাজিকতা । অবিবাহিত মেয়েরা তাদের
প্রিয় পুরুষকে দেয়, প্রথা বলতে পারেন । মানুষটির আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে বলি, তবে
তাই হবে । মেনে নিই শর্ত, আপনার কন্যা কাঞ্চনী আমাকে প্রিয় ভেবেছে এইতো বড় উপহার,
পাতঞ্চিটাও সঙ্গে থাকল । এবার বলুন শর্ত । মধুমঙ্গল এবারও বিনীত, বলেন, শর্ত কিছুই
নয়, শুধু নিজের কাছে রাখবেন । তিনি আবার বলেন সংযোজনে, প্রিয়র কাছে থাকা মানে তো
নিজের কাছেই থাকা । আমি বলি, আচ্ছা । প্রিয় ছাড়া কাউকে দেব না, নিজের কাছেই রাখব ।
টা আপনারা এই সুদৃশ্যে সুজনি ছাড়া অন্য জিনিস করেন না । তিনি বলেন, হ্যাঁ আমাদের
বাড়ির মেয়েদের সব কাপড়ই তো নিজস্ব তাঁতে বোনা, গামছা পাতঞ্চি আমরা পুরুষরাও বুনি ।
তন্ময় বলে, না, বলছিলাম, আসামে তো এন্ডি মুগা পাটের কাপড়, আরও অনেক কিছু তৈরি হয়,
জাপি, বাঁশ বেতের জিনিস, প্রয়োজনীয় ঘর সাজানোরও । মধুমঙ্গল বলেন, ওসব
করে বাঙালি নমশূদ্ররা, বোনে পাটের কাপড় অনেক রকম । আমরা শুধু পরম্পরা বজায় রাখছি ।
সবাই তো এখন শহরমুখি । অবাক কাণ্ড বলো তো, এত সুন্দর সিলেটি বাংলায় কথা বলেন তবু
বলছেন বাঙালি নমশূদ্র কথা । আপনিও তো বাঙালি, আমার সপাট প্রশ্নের জবাব দেন মধুমঙ্গল
বিনীতভাবে । আমরা বাংলাভাষায় কথা বলি কিন্তু আমরা ডিমাছা । বাউলা রাজার বংশধর ।
কাছাড়ের বর্মনরা খুব সুখী, সাদাসিধে মানুষ । সে কী আর বলতে, বইয়ে পড়েছি নীলদর্পণের
দীনবন্ধু মিত্র একবার এসেছিলেন থালিগ্রাম কার্যব্যপদেশে, নিয়ে গেছিলেন একজোড়া
কাপড়ের জুতো বন্ধুর জন্য । বলেছিলেন ভালমানুষের দেশ থেকে আনা । জুতো জোড়া উপহার
দিয়ে বলেছিলেন ‘কেমন দিলাম’ । বন্ধুর জবাবও ছিল জুতোসই, বলেছিলেন ‘তোমার মুখের
মতো’ । রসরাজ বঙ্কিমের কথা বড় মুখ করে বলে বেড়িয়েছেন দীনবন্ধু ।”
তন্ময়ের মনে এখন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব । কী হয়
কী হয় । মল্লিকার মন বোঝা যে ভার । বিয়ের কথা বললে এড়িয়ে যায় । বলে চাকরি নেই ।
বলে, এরকম বোকা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো যায় না । মল্লিকা কেমন যেন এক বদ্ধ ঘরের
বন্দিনী হয়েই রইল তার জীবনে । তাই তন্ময় যেখানেই যায় ভিন্ন রমণী নিয়ে উপাখ্যান
লেখে চিঠিতে । মল্লিকাকে ঈর্ষান্বিত করে । কিন্তু মল্লিকা যে এক অনড় অস্তিত্ব তার
জীবনে সে কোথাও বারবার বুঝিয়ে দেয় তার বিশ্বাস দিয়ে । মারিয়ার কথা, শিখার কথা মাঠে
মারা যাওয়ায় হতাশ তন্ময় পিরবাবার কথা সাজায়, সাজায় সাধুবাবার শব্দদোষ কথা । শেষ
পর্যন্ত কাঞ্চনীকেও সাজিয়েছে । খাসপুর এবং তৎপরবর্তী ঘটনার বিবরণ দেওয়া পত্রলেখা
নিয়ে তন্ময় এবার কুসুমানন্দ ছাড়ে । ডিমাপুর কলেজে জয়েন করার আগে একটা হেস্ত নেস্ত
হোক । এবার যাওয়া হাইলাকান্দি । অভিজ্ঞান পৌঁছে দিতে প্রিয়গমন । মধুমঙ্গল যে
বলেছেন প্রিয়র কাছে থাকা নিজের কাছে থাকা । বাংলার শিক্ষক মনের কথা সাজিয়ে দিয়েছেন । রোজকান্দি বাগানের
কাছাকাছি বড়জালেঙ্গা পৌঁছেই মনে পরে তার শর্তাধীন উপহারটার কথা । মনের আসনের যে কত
নাম, পাতঞ্চি নামটা বড় মনের মতো রঙে রং করা । স্বপ্নে দেখা আসনখানি মল্লিকাকে দিয়ে
সে নির্ভার হবে এবার । শিখা মারিয়া কাঞ্চনীর প্রিয়নামও সমর্পণ করবে মল্লিকায় ।
ব্যাস আর কাকে ভয় । সন্ধ্যা আঁধারে তাই বাগবাহারের অরণ্যপথেও সে নিঃশঙ্ক, যেখানে
ডাকাতের হা রে রে রে ভয় । বিকল চিত্তকে মুচকি হাসি দিয়ে ঠিক করে নেয় তন্ময়,
সন্ধ্যা সমাগমের আগেই সে পোঁছে যায় প্রিয়াভবনের প্রধান ঘাটায় । তার পরই তো
লক্ষ্মীর ঘর, লক্ষ্মীবাজার, শহর হাইলাকান্দি ।
সে আজকে নয়
তন্ময় মল্লিকার
এখন কথাও লেখা আছে চিঠিতে । খোলা তোরঙ্গের মণিমুক্তো সাজিয়ে নিলেই তো আখ্যানের
বিস্তার আবার । তাই, আপাতত সবুর, বিরতি ।
(সকালবেলা)
**** *
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন