স্থায়ী ঠিকানা

  ।।রণবীর পুরকায়স্থ।।   


স্থায়ী ঠিকানা



         মার বাবা খাস সিলেটি ।
সিলেটি তো বুঝি, বাংলাদেশের একটি জেলা সিলেট, সেই জেলার আধিবাস হলেই সিলেটি খাস যোগ করলে নাকি সিলেটি ভাষার অকৃত্রিম রূপের কথক বোঝায় বাবা বুঝিয়েছে, আমি বুঝি নিআমার জন্ম শিলচরে, মামার বাড়িতে ১৯৮৩ র দুসরা মার্চদুমাস বয়স হতেই চলে যাই বাবার কর্মক্ষেত্র ডিব্রুগড়ে। বাবা ব্যাঙ্কের কর্মচারিপ্রথমে ছিল ক্লার্ক, তারপর পরীক্ষা দিয়ে অফিসারআসমের অনেক শহরে কাজ করেছে তৈলশহর ডিগবয় দিয়ে শুরু তারপর গৌহাটি লামডিং যোরহাট শিলচর ডিব্রুগড়। আমি দুবছর ছিলাম আসামেতার আগে ১৯৮৫ এর ১৫ গস্ট আসাম  আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির আসাম সমঝোতা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাবাসে বছরই স্বেচ্ছা বদলি নিয়ে চলে আসে কলকাতায় ব্যাঙ্কের প্রধান কার্যালয়েপরে, বড় হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করায় বলে আমার জন্য নাকি কলকাতায় আসা। আমি বুঝি নিবাবা বলে আসা তার দ্বিতীয় স্বদেশ, অসমিয়া ভাষা বলতে পারে মাতৃভাষার মতোরাজনৈতিক আসামে দুটি নদী উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র আর বরাকবাঙালির মুখের কথায় ব্রহ্মপুত্রই আসাম নামে পরিচিতবরাকে মূলত বাংলা ভাষীদের প্রাধান্য চাকরিসূত্রে বাবা দুই উপত্যকাতেই বসবাস করেছে, তাই বাবার মুখের কথায় অনেক অসমিয়া শব্দ। বাবা মানে নাবলে আৎরানো মানে সরিয়ে রাখা, সিলেটিতেও আছে, অসমিয়ায় মাকে আই বলে, সিলেটের গ্রামেও বলে, বিষহরি পূজার মনসা ঠাকুরানিকেও বলে আই মনসাবলে, সিলেট কাছাড়ের সঙ্গে কামরূপ জেলার ভৌগোলিক দূরত্ব বেশি না থাকায় অসমিয়ারাও পর্যন্ত কামরূপের ভাষাকে সিলেটিয়া বলেএসব কথায় এখন দাঙ্গাবীজের বিতর্ক থাকে বলে প্রকাশ্যে বলে নাবাবা বলে আসামে তাকে তিন রকমের কথ্যভাষার মোকাবিলা করতে হয়এক অসমিয়াদুই বাংলার লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এক জগাখিচুড়ি, যা কারো মাতৃভাষা নয়ঢাকাই সিলেটি চাটগাইয়া নোয়াখালি ময়মনসিংহ কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারো নয়। কলকাতারও নয়তবে কলকাতা ঢাকার প্রতাপ বেশি, সিলেটি তিন নম্বরেআর তিনে সিলেটির খুব দুরবস্থা, রামেও মারে রাবনেও মারেঅসমিয়াদের কাছে সব কন্ডলের ঘটি হল সিলেটি, বরাকের মানুষস্বাধীনতার আগে যখন পুরো সিলেট আসাম রাজ্যে তখন তো বাঙালির আধিপত্য ছিল একচেটিয়াসিলেটি প্রাধান্য ছিল আসামের রাজধানী শিলং এ, গৌহাটিতেওআসামের সংখ্যাগুরু হওয়ার প্রবল দাবিদার সিলেটকে পরিকল্পিত চক্রান্ত করে দিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্থানের হাতে গণভোটের প্রহসনেআর তার পরই আসামের রাজ্যপাল, সাংবিধানিক প্রধান আকবর হায়দরি বলেন, যাক বাঙালি আর ক্ষমতার ধারে কাছে রইল নাএর আগে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈও আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, আসাম অসমিয়ারব্যথিত মহাত্মাজি একথা শুনে আক্ষেপ করে বলেন, আসাম যদি অসমিয়ার ভারত তবে কার আমার বাবার আক্ষেপ নেই, আছে রাগবলে আসামে বাঙালি বিদেশি হলে অসমিয়ারা তবে কীএরাও তো ব্রহ্মদেশ থাইদেশ থেকে এসছে
আমি ওসব বুঝিনি, আসাম নিয়ে আমার কোনো  মাথাব্যাথা নেই কারণ আমি বড় হয়েছি কলকাতায়বড় হলেও কলকাতা আমাকে খুব একটা ছুঁয়ে দেখেনিযদিও পড়াশুনার সঙ্গে গান বাজনা নাটক সিরিয়েল করে ফেলেছি বারো ক্লাস অব্দিবঙ্গসংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত ঝাঁকিদর্শনখুব ভাল নয় আবার খুব খারাপও ছিলাম না পড়াশুনায়যেহেতু কলকাতার প্রতি তেমন টান ছিল না তাই বারো পাশ করেই বায়না ধরি ব্যঙ্গালোর যাওয়ারআমার বয়সি সবাই যেমন করেছেকারণও একটাই, পশ্চিমবাংলায় শিক্ষার পরিবেশ নেইতার উপর আমি তো কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পাশআউট, ভর্তিটর্তির ব্যাপারেও একটু বৈষম্য হয়সিবিএসির আশি নম্বর আর কলকাতার ষাট কে এক বন্ধনীতে রেখে ভর্তি হয়
কলকাতার প্রতি না থাকলেও, শিলচরে আমার মামার বাড়ির প্রতি একটা টান আছে । একটা আবেগের ব্যাপার, জন্মভূমি বলে কথাআসলে তাও নয়, আমার ছোট মামার বাড়ি বরাক উপত্যকার এক গ্রামে যেখানে আমার দাদু দিদা ছিলেনআমার তিন মামা তিন মাসি, একজন ছাড়া সবাই থাকে শিলচরেছোটমামার বাড়ি গিয়ে একবার বৃষ্টির শব্দ শুনেছিলাম সারারাত জেগেইসপল্টুর টিনে জল তরঙ্গ বেজেই গেছে সারারাতআমার বাবার বাড়ি ছিল বাজারিছড়া নামে এক গ্রামেবাবা বলে ওটাও তাঁবু, পরের জমিতে শনবাঁশের বাড়িআমার বাবার কোন স্থায়ী আস্থানা হয় নি আসাম দেশে, নিজের কোনো বাড়ি ছিল না বাবার জন্ম দেশভাগের দুবছর পর, বাবা কিন্তু উদ্বাস্তু নয়যদিও বাবার পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের পাড়াগাঁয়েগ্রামের নাম রাউলি, পরগণা ছাতকবাবার দাদু চাকরি করতেন মেদলি চা বাগানে এখন নাম পাল্টে হয়েছে শিপানজুরি  টি এস্টেটআমার ঠাকুরদা কিছুই করতেন না, তাই কোন বাড়িঘর ছিল না ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনবাবা বলে উদ্বাস্তু হলেই বা কী না হলেই বা কী, ওরা নাকি জন্ম বেদুইনদেশের বাড়ি রাউলি এত অনুন্নত যে ওখানে বাস করা যায় নাবাবার অনেক আত্মীয় স্বাধীনতার পর থেকে বরাক উপত্যকায় এবং আসামে এসে বসবাস করেছেশরণার্থীর সুযোগ সুবিধা জায়গাজমি পেয়েছেবাবার বাবা ওসব কিছুই করে নিকেন করে নি বলতে পারে নি বাবা, তবে আমাকে মজা করে বলেছে তার বাবা রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বাঙালি ছিলেনতিনি যেরকম বলেছেন হুবহু তেমন, তৈলঢালা স্নিগ্ধতনু নিদ্রারসে ভরা, মাথায় ছোট বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান ।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল ব্যঙ্গালোর যাওয়ার পর আমায় নিশি পায় । নিশির ডাকে পড়াশুনা ছেড়ে দিইমনি হাজরিকা নামে আমার রুমমেট আসামের মেয়ে, আমাকে অসমিয়া শেখায়আর দুই বন্ধু মিলে শহর তোলপাড় করিএক বছর গোল্লায় যায়পরের বছর পাশ করে ফিরে আসি কলকাতায়এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পেয়ে যাইকলকাতায় মন বসে না বলে ফিরে যাই ব্যঙ্গালোর আবার। আবার চাকরিপ্রেমটেম করি কয়েকটা, দক্ষিণ ভারতের সব ভাষাভাষী ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছি, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে হিসেবি থেকেছিশেষ পর্যায়ে একটি পাঞ্জাবি ছেলে কৃপালকেই বিয়ে করব বলে ঠিক করে ফেলিনারকেল তেঁতুল  আর কারিপাতার গন্ধ থেকে তো মুক্তিআপাতত থাক আমার প্রেম কথা ।
বাবার কথা বলতে গিয়ে এদিক ওদিক হয়ে যাচ্ছেবাবা কেন কলকাতা চলে এল সে কথা তো শেষ করি নিযখন শুনল ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অ্যাকর্ড হয়েছে রাজীব গান্ধির, বাবার খুব মন খারাপ  হয়ে গেলসমঝোতার শর্তে ২৪ মার্চ ১৯৭১ এর পর যারাই আসামে এসেছে সবাই বিদেশিএ যেন গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার সকাল আর মধ্যাহ্নের সীমারেখাযদ্যপি এই যষ্টি দণ্ড ঐ প্রস্তর খণ্ড স্পর্শ না করিবে তদ্যপি সকাল খুব আনন্দ হয়, খুব উল্লাস আসামেছাত্রনেতা প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী ভৃগু ফুকুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে আসামের রাজ্যপাট দখল করে। বাঙালিও কেন যেন খুশি হয়প্রবাদেই আছে গালাগালি খেলে বাঙালির আনন্দের সীমা থাকে নাবাঙালি খুশি, কারণ হয়তো সে সমঝোতার শর্ত নাকচ করেছে মনে মনেবাঙালি কিন্তু বাঙালি তাড়ানোর মিছিলে হাঁটেস্লোগানও দেয়, খেদিব লাগিব মানে তাড়াতেই হবে। স্লোগানকে বিদ্রূপও করে। বলে, বুঝলাম তো, যাইতাম কৈ। কোথায় বিতাড়নবাংলাদেশ নেবে না এক পিসও, ধাক্কা দিলেও নেবে নাবুদ্ধিমান বাঙালি বলে, বাচ্চা ছেলেদের বুঝিয়েছে,  ওরকম হয় নাকিএক দেশে দুরকম নাগরিকত্ব, সব কেন্দ্রিয় ধাপ্পা ।বাবা কিন্তু এত সহজে বোঝে নি
বাবারও এই এক দোষ আমার মতোএককথায় অন্যকথায় চলে যায় । তাই বাবাকে আবার ফিরিয়ে এনেছি পূর্বকথায়কেন বলল আমার জন্য ছেড়ে এল তার স্বদেশ আর দ্বিতীয় স্বদেশবাবা বলেছে ১৯৭১ যদি ভিত্তিবর্ষ হয় তাহলে প্রমাণ করতে পারবে না অনেকেইগ্রামের মানুষ কিংবা  ছোট ছোট শহরের মানুষ কোথায় নথিপত্র নিয়ে সচেতনযদিও বা প্রমাণিত হয় নাগরিকত্ব তাহলে দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির হয়ে থাকতে হবেসন্তান সন্ততিরা সরকারি চাকরি পাবে না । ভাল পড়াশুনার সুযোগ পাবে না, একটা বৈষম্য থাকবেআমার বাবা কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আউড়ায় বলে তিনিই স্থায়ী ঠিকানাতিনিই জানিয়েরছেন জাতি বৈষম্যের বিষফল কথাবলেছেন, জাতি প্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়, ধর্মেরে ভাসাতে চায় বলের বন্যায়
কলকাতা আসার পর বাবা শুধু ঠিকানা যোগাড় করে গেছেপ্যানকার্ড ভোটারকার্ড অফিসের আই ডিকার্ড রেশনকার্ডড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়েছে কিন্তু গাড়ি নেই, এখন তো আধারকার্ডও আছে। প্যান ছাড়া সব কটাতেই ঠিকানাআমি বাবাকে বলি তাহলে আর এত আতান্তর কেনবাবা মেনে নেয়। বলে চাকরির প্রথম দিনের কথাব্যাঙ্কের ডিগবয় শাখার ম্যানেজার কাকতিবাবু বলেছিলেন ফর্ম ফিলাপ করে দিতেতারপর বললেন পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস স্থায়ী  ঠিকানা বলে তো কিছু নেইবাবা তখন হতভম্ব। ভাবছে চাকরিটা গেলনেই স্যার শুনে কাকতিবাবু  বললেন দিয়ে দাও কিছু একটাতখনই মনে পড়ে বাবার পিসির বাড়ির কথালক্ষীপুরে নদীর পারে দোতালা বাড়িপ্রায়ই যেত শিলচর থেকে পিসিমার হাতের রান্না খেতে আর ভাইবোনদের সঙ্গে হুল্লোড় করতেবাবা সাহসে ভর করে লিখে দেয় মিছে কথায় তার স্থায়ী ঠিকানা। লক্ষীপুর কাছাড় আসামসেই দাগটা খুব খচখচ করে বাবারআমি বলি সে তো চুকে গেছে । ওটা মুছে গেছে। এখন তো ঠিকানা কলকাতা। মহানগরের নাগরিক
 আমার মুখে মুছে যাওয়ার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলেছিল বাবা। মুছে যে যায় নি সে কথাটাই বলেবলে সেই মিথ্যে কেই একদিন সত্য করে তুলেছিলআমাকে অবাক করে বাবা তখন গল্পের ভেতর নিয়ে এল এক মোচড়সে এক গল্প বটেসঠিক কবে বাবার কাছ থেকে শুনেছি মনে নেইএকবারে  বলেছে, নাকি কিস্তিতে কিস্তিতে বলেছে কে জানেকারণ আমার কাছে গল্পটার বাস্তবতা আমার নিজেরপুরোটাই যেন আমি চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিতাই বাবার মুখ্য বয়ানে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বলে যাব বাবার স্থায়ী ঠিকানা মুছে না যাওয়ার গল্পমূল কথক হিসেবে আমিও মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যাব যাতে বিষয়ান্তরে না যায় কথাবস্তু
বাবার এক সহকর্মী আই লোরেন্দ্র সিংসহকর্মী শুধু নয় সহপাঠীও, শিলর কাছাড় কলেজে  একসঙ্গে পড়েছে বি কমডিগবয় মিশন পাড়াতে দুইবন্ধু একসঙ্গে থেকেছে বাসা ভাড়া নিয়েলোরেন্দ্রকাকু লক্ষীপুরের স্থায়ী বাসিন্দাবাবা বলে লক্ষীপুর শহরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই মণিপুরি। লোরেন্দ্রকাকুও তাইবাবা কাকুকে প্রায়ই বলত তার স্থায়ী ঠিকানার কথাঅফিস রেকর্ডে তার মিথ্যে তথ্যের কথাবলে বলে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলশেষমেশ বলল একটা জমি কিনবে লক্ষীপুরে কমদামে, নদীর পারে হলে খুব ভাল হয়বাবার মনে তার পিসিদের বাড়ির শৈশবস্মৃতি সৌন্দর্যে তখনও অপরূপবাবা বলত, বলতে বলতে হারিয়ে যেত দোতলা বাড়ির অন্দরেকখনও বাড়ির উঠোনে কামিনী গাছের নীচেকী আকুল করা ফুলের গন্ধ, বাবার পিসিমা বলতেন কামিনী ফুলের গাছে সাপ থাকে। গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে চলে আসে কখনও ভরা বর্ষার দোতলা থেকে দেখতে কী বিশাল লাগত ঘোলা জলের ফোঁসফোঁসানো বরাক নদীকে। হাত বাড়ালেই যেন নদীর জলে নৌকো। একদিন রাতে মেজদা বলল চলবৃষ্টির রাতে হাফপ্যান্ট পরেই বেরিয়ে গেল দাদার হাত ধরে মাছ ধরতেভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল বাবা, শুধু খলুই এগিয়ে দেওয়ার কাজ করেছে মেঘেঢাকা পূর্ণিমার রাতেমেঘ সরে গেলে, সেকি এক অপার্থিব দৃশ্য জলেরুপোলী মাছেরা সব উঠে এসেছে নৌকো ঘিরে। ওরকম দৃশ্য আর দেখে নি বাবাবাবার মনোবাসনা পূর্ণ করে লোরেন্দ্র কাকু একদিন বলল পাওয়া গেছে জমিনদীর পারে এবং শহর থেকে একটু দূরেকাকু অর্ধেক, বাবা অর্ধেক দিয়ে  কিনে নেয় খুব সস্তায়এক হাজার করে কাঠা, এক বিঘা জমির জন্য দুই বন্ধু দেয় দশ দশ কুড়ি হাজারদুজনেই জমি দেখে উকিল কাছারি  স্ট্যাম্প পেপারে রেজিস্ট্রি করে চলে এল শুভক্ষণেজমিটা কিনেছে তাদেরই পরিচিত এক মোগলাইর কাছ থেকেবাবা বলেছে মণিপুরি মুসলমানকে মোগলাই বলে হয়তো তাচ্ছিল্য করেই বলেনুরুদ্দিনের এক পিসিমা ছাড়া আর কেউ নেই, জমিটা তার  পিসির। অনেক চেষ্টা করেও একটা পিআরসি যোগাড় করতে পারেনি বলে নূর চাকরিবাকরিও পায় নি। বাবা বলে এসব চক্রন্ত, অসমিয়া ছাড়া যাতে আর  কেউ চাকরি না পায় তাই শাসকপক্ষীয় চালাকিআমি  বাবাকে বলি নূরউদ্দিন তো বাঙালি নয়তাত কী, বাবা বলেছে অসমিয়া ছাড়া সবাই বিদেশি আসামে ।বাবাকে বলি, তো পিআরসি টা কী, কী তার ব্যবহার। খায়, না সাজিয়ে রাখে ফুলদানিতে। বাবা পিআরসি জানেবলেছে, পার্মানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট, স্থায়ী ঠিকানার শংসাপত্রবাবাকে বলি, থাকলে কী হ বলে, না থাকলে অনেক ফ্যাঁকড়াবাবা রেগে গিয়ে মজা করে বলে হাড়মুড়মুড়ি হ, বাঘে ছোঁবলি, কোন আইন কানুনের বালাই নেইনা, সোজা ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে দেওয়া হয়। ওটা আবার কীআমার চমকে দেওয়া প্রশ্নে বাবা আবার রাগে। রেগে বলে মুরগির খাঁচানুরুদ্দিন পিসির সম্পত্তি  বিক্রি করে চলে যায় মণিপুরের থউবালে
বাবা লক্ষীপুরের জমিটা কিনে খুব তৃপ্তিতে আছে এটা বোঝা যায়বলে মাঝেমাঝেই চলে গেছে নদীর পারে নিজের জমিতে বেড়াতে। অন্তত যতদিন আসামে ছিলবাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে সীমানা , নামজারি করিয়েছে। বাবার পিআরসি নেইবলেছে পিআরসি দিয়ে কী হবে, চাকরিটা তো আছে, নদীর পারের বাড়িটা আছেআসলে আসাম অ্যাকর্ড হওয়ার আগে ভাবে নি এরকম হবেবাবাকে বলি তাহলে আর কিনলে কেন জমিবাবার মাথায় তখন মিথ্যে তথ্য লেখার পোকাপরের দিকে লোরেন্দ্র কাকুও বলেছে জমিটা বিক্রি করে দেওয়ার জন্যবলেছে নদীর পারের জমির দাম বাড়ে না, কোনও দিন নদীর গর্ভে চলে যাবেবাবা বিক্রি করবে না, কাকুকেও বিক্রি করতে দেয় নাকাকু বাবার জমি দেখাশোনা করে । বাবাকে বাঁশ বিক্রির টাকাও দিয়েছে একবার। এখন আর দেয় নাজমিটাতো দেখাশোনা করে, এতেই খুশি বাবা। বলে বেড়াটেড়া দিতেও খরচা আছেকাকু খুব ভাল মানুষ, আমাদের কলকাতার বাড়িতে এসেও থেকে যায়বাবা বলে রিটায়ার করে দেশে গিয়ে বাড়ি রবে, থাকবেআমি যে ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে কোথাও যাব না এনিয়ে বাবার একটা মনোব্যাথা আছেএটা তো ঠিকই ভারতের বড় শহর গুলির মধ্যে ব্যাঙ্গালোরের আকর্ষণ ভিন্নএমন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ভারতের কোন বড় শহরে নেইতাইতো বলা হয় ব্যাঙ্গালোর  পেনশনভোগীদের স্বর্গ, বলা হয় বাগাননগরবাবাকে বলি অবসর গ্রহণের পর কর্ণাটকে চলে আসুক, আর একটা স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যাবে । তবে লক্ষীপুরের জমি নিয়ে বাবার আবেগ দেখে আমিও দুম করে মত বদলে ফেলিবলি থাকব না গার্ডেনসিটিতে । আমার জন্মদেশে চলে যাব । শিলচরে থাকব, মাঝেমধ্যে যাব বাবার সঙ্গে লক্ষীপুর ।
আবার ফিরে আসি আমার প্রেমপর্বে । এতসব হেতু আমার সামনে, কোনটা রাখি কোনটা ছাড়িনাগরিকত্ব নিয়ে আসামের এই সমস্যা আমাকেও জর্জরিত করে ফেলেছে। এক অপমান এবং পরাজয়ের মুখোমুখিএকটা লড়াই করারও দরকারআমি কলকাতায় থাকি বা  ব্যাঙ্গালোর থাকি আমার শেকড়টা তো বরাক উপত্যকায়আমার বাবার তাঁবুবাড়ি বাজারিছড়ায়, আমার মামার বাড়ি শিলচর এবং ভুবনগ্রামে আর লক্ষীপুরে আমার বাবার স্থায়ী ঠিকানার জমিভোলেভালা বাবা মানুষটার স্বদেশ নিয়ে এক আবেগের চাপ আমি জানি  অবসরের পরে কিছুদিনের জন্য হলেও বাবা ফিরে যাবে তার স্বদেশেআমি তাই এমতাবস্থায় চাপের মুখে পড়ে যাইমামার বাড়ির ঢেউটিনে টাপুরটুপুর বৃষ্টির ধ্বনি, শহর শিলচরের শৈশবগন্ধ , বাজারিছড়ার না দেখা শনবাঁশের বাড়িতে ঠাকুমার কোলে বসে দোল খাওয়া বাবার নাদুসনুদুস মূর্তিটাও যে  ডাকে, আয় চলে আয় মেয়েখুব মজা হবে ভেবে আমার সর্বভারতীয় বাঁধন আলগা করিকৃপালকে বলে দি টাটাবাবাকে বলি কাছাড়ের খা সিলেটি ছেলে চাই
এতে আমার কোন অভিসন্ধি নেইআসলে কম বয়সে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ায় একটু বেশি পেকে যাইসমলিঙ্গ থেকে বিপরীতের প্রতি আকর্ষণে একটু বেশি মাখামাখি হয় ছেলেদের সঙ্গেঅচিরেই বুঝে যাই, ইংলিশ হিন্দি কিংবা দক্ষিনি ভাষায় প্রেম করায় ভাষাপ্রেমের ব্যাপার থাকে, কিন্তু বড় কষ্ট হয় ব্যবহারে। মানিয়ে নেওয়ায় একটু চাপ হয়মাতৃভাষায় হৃদয়াবেগ যত তাৎক্ষণিক হয়, অনুবাদের ভাষায় হয় নাধরা যাক খাওয়া দাওয়ার কথা, সিলেটিদের খাদ্যাভ্যাস একেবারেই আলাদা, পশ্চিমবঙ্গীয়দের সঙ্গে পর্যন্ত মেলে নাআমি সিদল ভর্তা খেতে ভালবাসি, ১০০ রকম ভর্তার রেসিপি আনিয়েছি বাংলাদেশ থেকেতবে আমার মা রেসিপি বই দেখে রাঁধে  নাচালকুমড়ো পাতায় সিদলের পুর দিয়ে একরকম পাতুরি বড়া করে। জিভে জল এসে যায়সিদল হল পুঁটি মাছের একরকম নরম শুঁটকিমা সেদ্ধ ডিমের রসা করে আধফালি করে চালের গুঁড়ি দিয়ে ভেজে। কী যে অমৃতপদ হয়এসব আছে আমাদেরদুপুরের পদে শাক শুক্তো থাকেথানকুনি পাতা বাটা কিংবা হিঞ্চে বা পলতাপাতার বড়াইংরেজি বলা ঝকঝকে সুদর্শন ভিনদেশপাত্ররা পারবে খেতে কিংবা বলতে,  শাকের মধ্যে রুই আর মাছের মধ্যে রুইরকগানের সঙ্গে আমি নাচতে পারি উদ্দাম, বল্লে বল্লেও পারি, কিন্তু মাঝেমধ্যে ধামাইল নাচতেও তো মন চায়, চায় সোহাগ চাঁদ বদনির সুরে শরীর দোলাতেতুমি সন্ধ্যার মেঘমালা বলে কেউ একজন পাশে দাঁড়াবে না শ্রাবন বিকেলেএসব তো খুব কম চাওয়া, স্বভূমি ছাড়া আমি পাব না কোথায়ওআমার সন্তান হামটি ডামটি শিখুক হাট্টিমাটিম টা কেন শিখবে নালালকলম নীলকলমের ঝুলিঝাড়া কথকতা, ঠাকুরমার পায়ের বাড়ৈএ দোলে দোলে কিচ্ছা শুনবে না সিলেটি মায়ের সন্তান
আমি কিন্তু দেখতে অসুন্দর নই মোটে। আমি জানি আমার রেটিংকয়েকজনের মাঝখানে থাকলে এমনকি অনেকজনের মধ্যে থাকলেও পুরুষরা আমাকে দেখে মুগ্ধ হয় পুরুষদেখায় আর মেয়েরা দেখে হিংসেচোখেশিলচরের দীপঙ্কর ভট্টাচার্য পাত্র হিসেবে হয়তো দুর্লভ ছিল, এরচে ভাল পাব নাআই আইটির প্রাক্তন, নিজের কোম্পানি দিল্লিতে। শিলচর থাকে দিল্লি যায়। শিকড়ের টানও বলেপ্রভূত ধনসম্পত্তি। ভেবে দেখলাম হবে নাআমার শিক্ষাগত যোগ্যতা মাঝারি মানের, মার্কশিট দেখানো যাবে নাএসব ছেলেরা ডমিনেটিংহয় আজ দিল্লি কাল শিলচর করছে, একদিন বলবে  স্টেটসে যাবে,  সেটল করবেতাই  ফাৎনা উঠিয়ে নিয়েছি ।
পাওয়া গেল সুসিতকে। অনেকটাই মনের মতোদেখেই মনে হয় খুব কেয়রিংগগনচুম্বী উচ্চাশা নেই আবার যথেষ্ট অর্থবানও বটে মাঝারি পসারের ডেন্টিস্ট  বেড়ানোর শখ আছে, ড্রাইভার থাকলেও নিজে গাড়ি চালাতে পছন্দ করেআমি পাশে থাকলে মনটা গুনগুন করে, শিলচর ছাড়িয়ে শিলকুড়ির পথে গিয়ে সুরের বানী মুখে আনে। এই পথ যদি না ইত্যাদিখাদ্যরুচিতেও বেজায় মিল। থাক পুনরুক্তি দোষেরই হয়। তবে ডিট্টো, সেম টু সেমশুধু দাঁতের স্বাস্থ্য নিয়ে একটু জ্ঞান দেওয়ার বাতিক আছেপ্রথম পরিচয়েই বলে ফোকলা দাঁতের মানুষরাই কেন দশলাখ খরচ করে মড্যুলার কিচেন সাজায়যারাই রান্নাঘর সাজাতে পয়সা খরচ করে তাদের সবারই দাঁতে নাকি ক্যাভিটি নয় গাম সমস্যা। কী দিয়ে খাবে কিচেনের মাল। মাল শব্দটায় একটু রুচিদোষ আছেতবু আমার শেষ স্বয়ংবর সুসিতকেই নির্বাচন করেসুসিত বলে বিয়ের পর চাকরি ছাড়তে হবে। আমি বলি না। সে বলে আচ্ছামহা ফ্যাসাদ । এত বাধ্য হলে কী চলে, একটু তো ঠুকঠাক করতে হবে। আমি না বলতেই আচ্ছা হয়ে গেলআমিই কী ঘোড়ার ডিম চাকরি করতে চাই। এক কথায় বললে কী হ্যাঁ করা যায়। আমিতো আর ওর মতো আনকোরা পিস নইআমার সঙ্গে বিচিত্র সব চার দেওয়া বড়শি থাকে, খেলিয়ে খেলিয়ে ওঠাইআসলে সুসিত তখন যে কোন শর্তেই রাজি এই পাত্রীকেই বিয়ে করবেশুধু বলল এনআরসি লাগবে । আমি পিআরসি জানি এনআরসি জানি না। তাই বলে দিলাম নেইসে বলল করতে হবে । আমি বললাম, কেন লাগবে, বিবাহসূত্রে স্থায়ী বসবাসকারি হয়ে যায় সবাইসে বলল আসামে হয় না । আমি তো আমার পিআরসির জ্ঞান নিয়ে চালিয়ে দিয়েছি এতক্ষণবুঝতে পারছি এনআরসিটা জটিল । কারণ সুসিতকে এই প্রথম তার বিয়ে নিয়ে চিন্তান্বিত লাগল
আমি আবার বাবার শরণাপন্ন হইবাবাও জানে না, জানলেও তার আসাম যোগসূত্র সব জানে। ক্লিক করে। আই লোরেন্দ্র সিংএবার সংলাপের আকারে বাবা আর কাকুর ফোনবার্তা সাজিয়ে দিইলোরেন্দ্রকাকুর সংলাপগুলি আভাসে আর যুক্তিতে পুনর্গঠন করেছিবাবার প্রশ্নছিল এতসব কাণ্ড ঘটে গেছে বাবাকে জানায় নি কেনকাকু বলে,
--- এখন তো তুই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক তাই দরকার নেই ।
--- নেই কেন? আমি যেকোনো সময় ফিরে যেতে পারি। আমার জমি আছেঅবসরের পর বাড়ি করব, খেতখামার করব। আমার মেয়েও আসবে। পাসপোর্ট লাগবে নাকি? আমি এদেশের নাগরিক, ভারতরাষ্ট্রের
--- এসব চলবে নারে ভাইআসামের নাগরিকপঞ্জি নবায়ন হচ্ছে এবার ৬৪ বছর পরআসামে বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ে চুক্তি হয়েছিল ভারত সরকার আর আসাম ছাত্র ইউনিয়ন আর আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে
--- জানিএনআরসি টা কী বল ?
---ন্যাশেনেল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস। ১৯৫১ র পর আর নবায়ন হয় নিরেজিস্টারে নাম উঠলে একটা মাদুলি দেওয়া হবে, পরে  থাকতে হবে আইডি কার্ড ।
--- এদিকে তো হচ্চে না, ওটা কী শুধু আসামের জন্য ?
--- আসাম এনআরসিভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ র ২৪ মার্চ মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ।
--- মাঝরাত পেরিয়ে গেলে ?
--- বিদেশি । শনাক্ত করণ হয়ে গেলে বিতাড়নবিতাড়নের দুরকম উপায় আছে । এক, ডিপোর্টেশন, দুদেশের মধ্যে কথাবার্তা বলেদুই, ঘাড়ধাক্কাসীমান্তে নিয়ে গিয়ে ঠেলে দেওয়াপোশাকি নাম পুশব্যাক ।
--- আচ্ছা লোরেন্দ্র তুই কে ? আমার বন্ধু,  না ঐ উগ্রজাতীয়তাবাদি আসাম সরকারের দালালওদের ভাষায় কথা বলছিস ?
--- আমি মণিপুরি ।
--- শোনরে মণিপুরি গী মচা । ১৯৫১ র নাগরিকপঞ্জি আর ১৯৭১ এক মধ্যরাত্রি দিয়ে আমার কী হবে ? তোর আমার তো নামই নেই,  ভোটার হইনি তখনও । যাদের নাম আছে বেশির ভাগ তো মরেই গেছে ।
--- বাবা মা ঠাকুর্দা কারো নাম তো থাকবে । ওটাই উত্তরাধিকার লিগ্যাসি । বের করতে হবে কম্পূটার থেকে ।
--- আমি কম্পূটার জানি না । গ্রামের চাষা জানে না ।
--- তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিতেই ওরা আটঘাট বেঁধে নেমেছে । সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছে । লিগ্যাসি ডাটার সঙ্গে একটা এগারো সংখ্যার কোড দেওয়া থাকবে ।
--- বেশ ।
--- এবার লিগ্যাসির সঙ্গে তোকে জুড়ে দে । প্রমাণ কর তুই প্রদোষ বিশ্বাসের ছেলে । তারজন্য তথ্য দিতে হবে । চৌদ্দটি সহায়ক নথির যে কোন একটি তো চাই
--- যেমন ?
--- জমির পাট্টা দাগ ইত্যাদি ।
--- মারদিস কেল্লা । আমার আছেতুই বের করে দিতে পারবি আমার লিগ্যাসি ডাটা ? আচ্ছারে লোরেন্দ্র আসাম সরকার তো সবতাতেই ছিল ধীরগতি, বলা হয় ল্যান্ড অফ লাহেলাহে, মানে ধীরে ধীরে । হঠাৎ এই সক্রিয়তা   কেন ?
--- আমি তো মণিপুরি দালাল । বলব কেন ? এই তো গতকাল আসামের এক বিধায়ক, বরাক উপত্যকার, বললেন এনআরসি অবাস্তবএসব শুধু বাঙালিকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর চেষ্টাভাতে মারার প্রকল্প । জানে মারারওইতিমধ্যে লিগ্যাসি ডাটা না পেয়ে ছসাতজন চাষি পরিবার আত্মহত্যা করে ফেলেছে ।
--- আর এত রেকর্ড কী আছে আসামের । ৫১ র নাগরিকপঞ্জি, ৬৬ র ভোটার লিস্ট
--- আছে কিছু। শুধু বাঙালির নাম গুলো নষ্ট হয়ে গেছেআছে ডি ভোটার । সন্দেহজনক, ডি মানে ডাউটফুলসন্দেহের বসে বন্দী করে রাখা,  নির্যাতনফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে পুলিশি নির্যাতন হচ্ছেযখন যাকে পছন্দ হচ্ছে না তখন তার নামের পাশেই ডি লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছেএকটাও সন্দেহজনক ভোটারকে বাংলাদেশ ফেরত পাঠানো যায় নিডিটেনশন ক্যাম্প নামের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছেহিটলারের জার্মানির ইহুদিদের মতোওরা নিজের মাতৃভাষা ভুলে জার্মানিতে কথা বলত, তাও কী বাঁচল? আসামেও বাঙালিরা হয়ে গেল অসমিয়া, চর এলাকায় মানুষ অসমিয়া হয়েও বাঁচতে পারে নিশুধু বাঙালি নয় রে, অসমিয়া ছাড়া সবাই, এই মণিপুরি দালালও লিগ্যাসি ডাটার পেছনে দৌড়চ্ছে, কিছুই পাই নি এখনও ।
আরও অনেক কথা হয় দুই বন্ধুতে মান অভিমানের । তবে একটা কথা বুঝে যাই যে, নেট ঘাঁটলে কিছু পাওয়া যাবে । এবং পাই । বাজারিছড়ায় নেই মেদলিতেও নেই, মায়ের বাড়ি ভুবনগ্রামে নেই । তাহলে অনুসন্ধানের এলাকা একটু ব করে নিইকাছাড় জেলার প্রদোষ বিশ্বাসের নাম । পাওয়া যায়  ঠাকুর্দার নাম ঠাকুমা ও জেঠুর নাম ও বাবা নেই । এগারো সংখ্যার লিগ্যাসি ডাটা কোড লিখে রাখি ৩১০-৪০৩৮-৮৮২৮১১ নং শিলচর চক্র, শিলচর টাউন ওয়ার্ড নং ৭ ইলেক্টরেল খণ্ড ৭,  বাবাকে দেখাই, বাবার কী আনন্দবলে, সবাই নাকি পরিচিত, শ্রদ্ধেয় জন । প্রণয় কাকুর নাম আছে, প্রণয় কুমার চন্দ, দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত, কম্যুনিস্ট ছিলেন বিসি গুপ্তর বাড়ির সবার নাম, ব্রজমোহন গুপ্ত বাবার মাস্টারমশাই, স্কুলের সবচেয়ে ভালমানুষ স্যারঅঞ্জলি সোম সমর আদিত্য বাবার মামা রাধিকা রঞ্জন দাম দিদিমা মানদা সুন্দরী দাম । চায়ের দোকান অমর ভ্রমর দুই ভাই । বাবা ফিরে যায় লুপ্ত সময়ে । দুদিন ধরে ৬৬ এর ১১ নং নির্বাচন কেন্দ্র ঘুরে বেড়ায় । বারবার দেখে পরিচিত নামগুলি।  একসময় ফিরে আসে স্বসময়ের বাস্তবতায় । লোরেন্দ্র কাকুকে ডাকে । বলে,
--- শুধু আসাম কেন ? নাগরিকপঞ্জি তো হবে ভারতের । রাষ্ট্রের ? 
--- হবে হয়তো । এটা আসাম এনআরসি । বিশেষ আইন ।
--- তাহলে আর দেশ কী ? কিসের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ ?
--- অ্যাকর্ড হয়েছে বলে নবায়ন ।
--- বুঝলামআমার তো সব আছে। সহায়ক নথিও। লক্ষীপুরের জমি আছেফিলাপ করে তোর কাছে পাঠিয়ে দেব । জমা করে দিস ।
--- অনলাইনেও হয়ে যাবে ।
বাবা আমাকে সব তথ্য দেয়আমি একে একে সব আপলোড করি মনের আনন্দেএনআরসি হয়ে গেলে আর বিয়ের বাধা থাকবে নাযতদিন না এনআরসি হচ্ছে আমার আর সুসিতের বিয়ে সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলে থাকেসুসিত বলেছিল এনআরসি হয়ে যাবে। কী বুঝে বলেছিল কে জানেতার তরফ থেকে চেষ্টার ত্রুটি করেনি । শেষ পর্যন্ত হাত তুলে দেয়। বলে হবে নারাষ্ট্রহীন মানুষকে কী করে বিয়ে করবে সে নিয়ে ফাঁফরে পড়েআমি কিন্তু নেট ঘেঁটে জেনেছি এরকম বিয়ে হতে পারে, ভিন রাজ্যের নাগরিকের ক্ষেত্রে সদর্থক সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকারতবে আমার ক্ষেত্রে বিষয় অন্যওকে আশ্বস্ত কর বলি লিগ্যাসি ডাটা পাওয়া গেছে, সহায়ক তথ্য ও আছে । সুসিত আবার খুশি হয়ে বলে এবার এলে করিমগঞ্জের খাই খাই হোটেলে পেটপুরে খাবে দুজনে
বাবার  পাঠানো তথ্য বাতিল হয়ে যায়ওরকম কোন দাগ পাট্টার সংখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় নি লক্ষীপুরেবাবা রেগে যায়, বললেই হল নাকি । কাকে নালিশ করলে সুরাহা হবে বুঝতে না পেরে  লোরেন্দ্র কাকুকেই বলে,
--- এ কী করে হয় ? আমাদের জমি, দুজনে মিলে কিনলাম, বেড়া দিলাম, নামজারি হল । আমিন ডেকে জরিপ পর্যন্ত করানো হল । এখন বলছে দাগ পাট্টা নেই ।
লোরেন্দ্র কাকু চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ । তারপর বলে,
--- নেইরে । নতুন জরিপ হওয়ায় দাগ পাট্টা মুছে গেছে ।
--- মুছে গেলেই হল । দাগ পাট্টা মুছে যায়, শেলেটের লেখা নাকি ? তুই মেরে দিয়েছিস শালা । মণিপুরিরা সব পারে ডাকাতের জাত ।
বাবার দেওয়া সব অপবাদ কাকু মেনে নেয় আমি তো শিশুবেলা থেকে দেখছি, কাকু বাবার সঙ্গে তঞ্চকতা করবে নাকাকুর কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত উত্তর না পেয়ে বাবা অসহায় হয়ে পড়ে। যা নয় তা বলে বন্ধুকেহঠাৎ সব হারিয়ে গুম মেরে যায় বাবাথতমত খেয়ে বসে থাকে উদাস দৃষ্টিতে । জমিটার অর্থমূল্য কিছু নয়, কিন্তু এর সঙ্গে যে আবেগ জড়িয়ে আছে কোটি টাকারএকটা গর্ব, স্থায়ী ঠিকানার মানসিক দলিল, ইচ্ছে করে ভুল তথ্য লেখার শুদ্ধি প্রমাণবাবার ফ্ল্যাট বাড়ি একদম পছন্দ নয়, কলকাতা শহরটাকে কোনদিন মেনে নিতে পারেনি নিজের বলে । তাই শেষ জীবনে একটা ছোট বাড়ি করবে ভেবেছিল, ইসপল্টুর চাল দেবে আর বর্ষার রাতে বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনবেমানুষ তো একা থাকতে পারে না, তাই মুখোমুখি বাড়িতে থাকবে ভেবেছিল দুই বন্ধু । বর্ষার টইটুম্বুর জলে নৌকো করে মাছ ধরবেআর শীতের সময় নদীর চরে লাইশাক সিম ধনে ফুলকপি বাঁধাকপির বিচরা করবেলোরেন্দ্র কাকুকে বলেছে বাড়ির সীমানা নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়াও করবেস্বপ্নের সঙ্গে যে বাবার হৃদয় জুড়ে ছিল তার পরিচয় আর স্থায়ী ঠিকানাআমারও ভাবতে অবাক লাগে লোরেন্দ্রকাকু পর্যন্ত কী করে মেনে নিল দাগ পাট্টা হারিয়ে যাওয়ার গল্প । কিছু একটা তো আছে রহস্য ।
বাবাকে লুকিয়ে আমি টেলিফোন করি । কাকু আমার গলা পেয়েই ঝরঝর করে কাঁদে । বলে,
--- তোর বাপটা একটা বোকা, মাথামোটা । আমাকেও তার বোকামির সামিল করে নিয়েছিল । আমাদের জমিটা বড় সুন্দর ছিল রে । দুদিকে দুটো বাঁশ ঝাড় ছিলতোর বাবা বলত বাঁশের করুল আর চেঙ মাছের পোনা দিয়ে কড়ু হয় । আমরাও খাই, ইরম্বায় দিই । হারিয়ে গেল
--- জমিটার কী হল কাকু ?
--- সে কি আজকের কথা ? অনেক বছর আগেই বরাক নদী নিয়ে নেয় তোর বাবার পরিচয়, স্থায়ী ঠিকানা ।
--- বাবাকে জানাও নি কেন ?
--- তোর বাবাকে জানিস না ? কেমন আবেগপ্রবণ । তুইও থাকিস ব্যাঙ্গালোর । বুড়োবুড়ি দুজন একা একা । আমার উপর এত ভরসা করেছিল । রাখতে পারলাম না । শুনলি  না  আমাকে কত কথা শুনিয়ে  দিল ঠগ জোচ্চার ।
--- ওসব তোমাদের কথা,  আমি কি জানি ।
--- পাগলের কথায় আমিও কান দিই না । শুধু দেখে রাখিস কোন কাণ্ড না ঘটিয়ে দেয় ।
বাবা কাণ্ড একটা ঘটিয়েছে সত্যি । রিটায়ার করে কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে । সব টাকা পয়সা নিয়ে রওয়ানা দেয় শিলচর অভিমুখে।  আবার শিলচর শহরের উপকণ্ঠে রামনগরে নদীর পারে চারকাঠা জমি কেনে । বাড়ি বানিয়ে বসবাসও শুরু করে দেয় । বাবাকে কেউ এনআরসি র কথা বললে চুপ মেরে থাকে । বাবা আমাকে বলে দেখি কে তাড়ায় তার স্বদেশ থেকে ।
সুসিতও বাবার অনুগত হয়ে আসাম এনআরসিতে নামহীন আমাকে বিয়ে করে । সুসিতের অনুরোধে অনেক নকল গাঁইগুই  করে ব্যাঙ্গালোরের চাকরিও ছেড়ে দিই ।

এখানে  আমার নামটা জরুরি নয়কিন্তু আমার বাবা স্বদেশ বিশ্বাসের নামটা জরুরি । কারণ গল্পে নায়ক নাম থাকাটা দস্তুর ।      

                         
     
    









********* 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

লেখক পরিচিতি

তৃতীয় ভুবনের রূপকথা রণবীর পুরকায়স্থ