জন্মান্তর
বিকেল পাঁচটা
থেকে রাত সাতটা পর্যন্ত সময়কাল স্বরাজ চৌধুরীর একান্ত নিজের। একার। এই দুঘণ্টায়
ভরে নেওয়া দিনের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন । কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শাদা শাড়ির কার্বন ডাই
অক্সাইড বেরিয়ে গেলেই হল না, দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ না শোনা পর্যন্ত সে
নড়বে না। নট নড়নচড়ন, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবে বিছানায়, দ্বিপ্রাহরিক ঘুমের
সুখাবেশে। দরজার ঐ ধুমধাড়াকা শব্দের সঙ্গেই উঠে বসবে বিছানায়। প্রজাপতির মতো
দুইহাত মুঠো করে ঠেলে দেবে পিছনে । মুখে বলবে, ইয়া। মানে এখন জয়ের সময়, আমার সময়।
স্বরাজ চৌধুরীর পঁচিশ বছরের চাকুরে ছেলের নাম প্রজাপতি, আর কাঁধঝোলায় জলের
বোতল,মোবাইল,টাকার বটুয়া,কলমের বদলে রিফিল আর নোটবুক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া জন, স্বরাজ
চৌধুরীর স্ত্রী, জীবন সঙ্গিনী।
নামের
দরকার নেই। কথাবার্তায় মনে হবে রাগের বিষবাষ্প, আসলে এই ফ্ল্যাটবাড়ির বহমানা
অম্লজান তিনি। শীত যাই যাই বসন্তে প্রজার মার ঘরে এখন তার একান্তে সময় কাটানো,
অনুপস্থিত বিবিজির সঙ্গে দুষ্টবুদ্ধির ছেড়ছাড় । প্রজার মার রঙঘরের সদ্য নির্গত সুগন্ধের
পরশ দুই নাকে ভরপুর নেওয়া। প্রসাধনের মায়াবী গন্ধে হারিয়ে যাওয়া । স্বরাজ চৌধুরীর
চেনা গন্ধ, একান্ত আপনার সৌরভ। ফেব্রুয়ারি বিদায় নিচ্ছে তাই এসিটা এক আধটু চালিয়ে
দেওয়া যায়। হারমোনিয়ামের বেলো খুলে বলা যায়, যাও সখা ঘুরে এসো যথাতথা । বলো কোথায় যাবে,
শুধু মা তেই ঘুরাফেরা করবে। না কি পা ধরবে, কোমল ধৈবত । না, ধা তে চলবে না, টিকে
থাকার ধাত নেই, কথায় আছে না ধা । এই আছে এই নেই । রে টাও বড় দুর্বিনীত, তুই তোকারি
করে। গা ও যে গায়ে পড়া। মা কেই জড়িয়ে ধরে রাজু । ঘুরে ফিরেই মা। ছোটবেলায় মা তে
আটকে যেতো, মা মা করত মাকে শুনিয়ে । মায়ের সঙ্গে মজাকি। মা এসে না থামালে চলবে যতক্ষণ ইচ্ছে।
এবার কিছু একটা কম্পোজ করা যাক। ছুটিতে যাওয়া
স্বরগুলিকে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনে স্বরাজ । বলে এবার অন্য রকম হোক, স্বরের সঙ্গে
সঙ্গত । ফটো ওঠানোর সময় প্রজা যেমন ফুলপাখির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গেও করে। বলে, চিন
লাইট, হেড স্ট্রেইট । গ্রুপ ওঠাতে লম্বা থেকে বেঁটে কিংবা মাঝখানে লম্বা দুপাশে
বেঁটে দিয়ে গতানুগতিক ছবি ওঠায় না, উল্টোপাল্টা সাজিয়ে বলে দেখো কেমন কম্পোজিশান। ছেলেটার
অনেকগুণ, সখের ফটোগ্রাফিটাও করে দারুণ, গিটার ও বাজায় ভালো। বলে ঝিঙ্গালালা । সুরও
করে শনি রবি ছুটির দিন । প্রজার বাপও শখের কম্পোজার, মা গায়িকা । এখানে ওখানে
ধর্মকেন্দ্রে গান করে, ইনকাম হয় । হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেই বুঝা যায় কম্পোজিশান এত
সোজা কথা নয়। একটা মাত্র লাইনকে সুরে সাজাতে গলদ ঘর্ম হয় স্বরাজ। এলোচুলের বসন্ত
আজ সকালবেলা- এই লাইনটাকে নিয়ে লড়তে লড়তে হারমোনিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যায় ব্যালকনিতে ।
ওখান থেকে দেখা যায় এলোচুলের ফুলছাদ । কৃষ্ণচূড়ার লাল ছেয়ে আছে ছাদের বাগানে, টবের
বাগিচায় । কৃষি বিজ্ঞানী সুমিত্রবাবুর রুচি আছে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাগান
দেখেন, সকাল সন্ধ্যে পরিচর্যা তাদের রকমারি গাছের। ফুল ফল ও বনসাই । মেয়ের
পাকাদেখার দিন পাড়ার কয়েকজন গণ্যমান্যদের সঙ্গে নিমন্ত্রিত ছিল স্বরাজ ও তার
স্ত্রী । তখনই, এক ফাঁকে ছাদ দেখিয়ে আনেন সুমিত্র লাহিড়ী। মেয়ে মিতুল তো প্রজার বয়সী বন্ধু,
ওদের পার্টি হয়ে গেছে সিসিটু তে । মিতুলের বিয়ের ব্যস্ততায় সস্ত্রীক সুমিত্র বাবুর
অবস্থান বদল হয় । এখন আর সবসময় উদ্যানপাল নন তিনি, পরিদর্শক হয়ে দিনে একবার দুবার
দেখা করে যান, হ্যালো বলেন গাছপালা ফুলফল কে। কোনদিন তাও হয় না । একটি অচেনা,
দূরের সুন্দরী মেয়ে এখন বাগানছাদের মালিনী। এলোচুলের যুবতিটিকে দূর থেকে দারুণ
লাগে । স্বরাজ বলে ফুলদেবী। ফুলছাদের হেমন্তে তাই পূর্ণবসন্ত এখন । শাড়িপরা মেয়েটি
যেন মহার্ঘ করেছে ফুলের সম্ভার । আত্মীয় না কাজের মেয়ে জানে না, কিন্তু চুল এলিয়ে
বসন্তবন্দনার মুদ্রাটি শিখেছে অনুপম । পরিচর্যার এই প্রয়োজনীয় দেহবিন্যাস সে শিখল
কোথায় । কী জানি পুষ্প কিশলয়গুলি ও হয়তো কোনো বাঁধনবাঁধা সঙ্গী পছন্দ করে না, তাই
এবার বসন্তে সমঝোতা । ফুল বলেছে ভরে উঠবে রঙে রঙে, বালিকাটিও বলেছে সাজবো এলোচুলে
। স্বরাজ নিজের বারান্দা থেকে দেখিয়েছে ফুলসখী । প্রজার মায়ের কানে কানে মজাও
করেছে । বলেছে,
--- দেখো কেমন ভরাবর্ষা !
প্রজার মা অবাক হয়ে বলেছে,
--- কোথায় জল, কোথায় বর্ষণ ? ওসব ঢ্যামনা ধরার চালাকি । বারান্দায় কালো কাচ
লাগিয়ে দেব ।
রাজু গালমন্দ গায়ে মাখে না । রাজু মানে স্বরাজ চৌধুরীর ডাকনাম,
--- জলভরা মেঘ তো আছে, চাইলেই ঝড়ি হবে । আহা রে !
কাছ থেকে
দেখার দূরস্মৃতিতে মেঘবৃষ্টির উপমা সাজায় স্বরাজ, নীল রঙের শাড়ির নিপুন ওঠা নামায়
পায়ের গোড়ালি ঘিরে লালপদ্ম ফোটে । বাতাসের আন্দোলনে পরিধেয় ওড়ে এদিক ওদিক । নাভিমূল
প্রকাশ্য হয়, আবার হারায় । পিঠের বাঁধাবাঁধিতে সঞ্চারিত মেঘের সুন্দর যে অপর পারে,
উদ্ধত বসন্তের আমন্ত্রণ বুকজুড়ে । এসব তো বর্ষারই পূর্বাভাষ । মুখের ভাঙাচোরা
ছায়ারোদেও মায়াবসন্ত । এলোচুলের ওড়াওড়ি, দারুণ এক রহস্যময় দোকানদারি, হরেকমাল অনেকদাম
। ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই স্বরাজকে জাগিয়ে দিয়ে যায় অপরবসন্ত ।
সোজা কথায়
স্বরাজ চৌধুরী এখন পরকীয়ার রসে টইটুম্বুর । মানে ঘর থেকে বাইরের টানটাই প্রবল ।
উল্টো করে ভাবলে কী দাঁড়ায়, ঘরের ভিতর কী তবে শুধুই হেমন্তের খরা । এই এক খটকা
রাজু চৌধুরীর মনে । তিনি কেমন । যেমন দেখায় তেমন নিষ্ঠুরা কি । না না, তিনি তো এমন
ছিলেন না । প্রেম বিয়ে তারপর আবার প্রেম, সবই তো ঠিক চলছিল যেমন চলে, দুবছরের গান
লেখা গান গাওয়া এক সঙ্গে । তারপর বিয়ে আর প্রজাপতির জন্ম । মোট সাতাশবছরে পাঁচেক
কোয়ালিটি । বাকি টুয়েন্টিটু শুধু কোয়ান্টিটি, দিন গুনে গুনে শেষ করা । রাজু অবাক
হয়ে ভাবে তাদের সন্তানের জন্ম হল কী করে । তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে হয় মাঝে মাঝে । তিনি বলেন,
--- সন্তান জন্মের জন্য বসন্ত লাগে না, বর্ষা লাগে না
। দুটো ইয়ংপ্রাণী জুড়ে যায় এমনিতেই ।
এসব ঢপের
কথায় পাত্তা দেয় না স্বরাজ । কারণ এখনও যে মাঝে মাঝে হডকা বান আসে, ভাসিয়ে নিয়ে
যায় তাদের যৌথ তক্তপোষ, অমাবস্যায় চাঁদ ওঠে জানালা দিয়ে, ফুল ফোটে তাদের নিজস্ব
ফুলদানিতে । তবে সবই
তার ইচ্ছায় । তখন স্বরাজ ডুবে যায়, ভেসে ওঠে, মোহিত হয় বকুল গন্ধে ।
তাই,
এখন তার দুঘণ্টার নিজস্ব সময়ে, প্রজার মার ঘরে সঁপে দেওয়া । কামার্ত স্বরাজ
চৌধুরীর প্রস্তুতি থাকে অনেক আগে থেকেই । রানিসাহেবার সাজঘরে মটকা মেরে শুয়ে থাকে
গৃহপালিত গাড়লের মতো । যদি কখনও ডাক পড়ে, এই শুনছ । হুকটা লাগিয়ে দেওয়ার উত্তেজক
কাজ থেকে শাড়ির ফল ঠিক করে দেওয়ার মাইনর কর্মও করতে হয় কখনও কখনও । স্বরাজতো তক্কে
তক্কেই থাকে, ইচ্ছের খুনসুটিতে যদি অসময়ে ওঠে ঝড়, সাজানো বাগান বেসামাল করার বাসনা
জাগে তখনই । সে সময় তো আর তিনি বাগানের ফুল নয়, প্রস্তর যুগের উদ্যানশিলা হয়ে যান
। ঝড় তুফানকে শক্ত হাতে প্রতিহত করে শুদ্ধদেহে বেরিয়ে যান গান গাইতে । যদিও হঠাৎ
বন্যার সময়, বসন্তের কালে রহস্যালাপের ফাঁকে বেরিয়ে পড়ে ভিন্ন সত্য । বলেন,
--- তখন রাগ না দেখালে কী আর রক্ষে আছে । সব কিছুরই
একটা সময়গময় থাকে । মুড চাই । সাজগোজের পর ওসব বন্ধ । নো এন্ট্রি আফটার সাজ ।
তাইতো,
বাধা নিষেধের জন্যই স্বরাজ চৌধুরী এত ওয়াইল্ড হয়ে যায়, বারমুখো হয় । তিনি বেরিয়ে
গেলে অতৃপ্ত মনে ফুলবাড়ির মেয়েটিকে দেখে সে কাটিয়ে দেয় ছুটির বিকেলবেলা। দূরের
অবয়ব সুন্দরকে কল্পনা করে আশ মেটে না, ফিরে আসে তার শূন্যপূরীতে আবার। প্রজার
মায়ের আলমারি খোলে, থরে থরে সাজানো শাড়িতে হাত বুলোয় । অনুভব করে তাকে, তার কোমল
শরীর । এক একটা শাড়িতে এক একরকম মোহময়ী তিনি । ঘ্রাণ নেয়, পরশ করে । শোঁকে, ঘষে
মুখ । আবার অন্যসময় তিনি বললে এই শাড়িটাই গুছিয়ে রাখবে না । বলবে পৃথিবীর সবচে
নোংরা জিনিষ হলো মেয়েদের শাড়ি, সবচে বেশি জার্ম । মেয়েদের কাজই হলো শাড়ি দিয়ে রাস্তা
ঝাঁট দেওয়া । সত্য মিথ্যার ধারধারে না স্বরাজ, একটু রাগিয়ে দিতে পারলেই হল । এবার
ড্রয়ার খোলে, প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে সব অন্তর্বাস । আজকাল মহানগরে কত কিছু পাওয়া
যায়, ব্যবসায়ীরা পশরা সাজিয়ে বসে আছে ভাবিজিদের জন্য । চেন খুলতেই রঙের বিপ্লব ।
দরকচা মেরে পড়ে আছে সুন্দরের মলাট, অভিভাবক । স্বরাজ এক বসন্তকালে বলেছিল তাকে,
--- পুরুষরা যে এসব দেখলেই উত্তেজিত হয়, তোমরা হও না
? জকি, টমি হিলফিজার পুরুষ দেখলে শরীর কেমন করে না ?
তিনি
বলেছেন,
--- এত নুলা টসকায় না । তবে দারুণ সুন্দর বডি হলে,
হিম্যান হলে ভিন্ন কথা, সবাই কী আর সলমন খান ?
স্বরাজ
মর্মাহত হয়েছে, সলমন না হতে পারে, কুদর্শন তো নয়, শাপমোচনের রাজা নয় । ভাবে,
একেবারেই কী মূল্যহীন স্বরাজ চৌধুরীর দেহ । এখন নেই হয়তো, বহুব্যবহারে আলুনি হয়ে
গেছে । কিন্তু একসময় তো ছিল, বলতো শমিত ভঞ্জের মতো, সেও অল্পদিনের জন্য । ক্ষীণ
বসন্ত ক্ষীণ বর্ষায় । প্রেম ও বিবাহের সদ্যসময়ে । আসলে, নারী দেহটা শুধু দেখারই
কোমল, মনটন কিছু নেই । আবার সেই কোমলতা ঘিরেই পুরুষের সব আকর্ষণ ও রহস্য ।
লোডশেডিং আর পাওয়ার কাট এই দুই শব্দের অর্থ গুলিয়ে যায় স্বরাজের । তবে দুইকথার অর্থই যে অন্ধকার সে জানে । সাপোর্ট সিস্টেম,
মানে ইনভার্টার খারাপ হলে তো কথাই নেই, তখন ঘুরঘুট্টি । এখন যেমন, দুম করে আলো চলে
গেল । মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাটবাড়িতে ঘরে ঘরে জেনারেটর লাগানোর বিলাসিতা চলে না । স্বরাজ চৌধুরীর
জীবনটাও কেমন, ব্যাটারির আয়ু কবেই শেষ হয়ে গেছে, জল খেতে খেতে শুকিয়ে কাঠ । এবার একটা
কিনতে হবে । কিনতে হবে
বললেই হল না, কিনবেন তো তিনি, কোথায় কী পাওয়া যায়, দুপয়সা সাশ্রয় হয়, সব জানা ।
তাই সোজা কথা সোজা ভাষায় বলতে হবে । আমার জীবনটাই লোডশেডিং কিংবা ইনভার্টার বলে
শুরু করলে দক্ষযজ্ঞ বাঁধবে । বাবা, কাজ নেই রসিকাতায়, দেবী যে ফুলে তুষ্ট তাই দিয়ে পূজতে হবে । এখন আপাতত সাজঘরে
সুন্দরের দেবতার সাজপশরা দেখে মন উতলা করা । এলইডি টর্চ জ্বালিয়ে অলঙ্কার পেটিকায়
হাত দিতেই ঝলমলিয়ে ওঠে ঝুটা সোনাদানার হার মানতাসা টিকলি । চকিতে হাত সরিয়ে নেয়
রাজু, কলিং বেল বাজে, মানে বিদ্যুৎ এসে গেছে । ও হরি, কলিং বেল নয়, দরজার খটখট
শব্দে ভয় পেয়ে গেছে । তবে কি ফিরে এল
প্রজার মা। না, আজ তো দুঘণ্টার আগে ছাড়া পাবে না । বৃহস্পতিবার বিশেষ মেডিটেশন,
দুঘণ্টার ধ্যানপর্বে বিশেষ স্বর ছাড়তে হয়, পরিবেশ তৈরি করতে হয়, ভক্তদের হৃদয়ে
ঢুকে যেতে হয় । তারপর আছে নৃত্যনাট্য, গান গাইবেন তিনি, ভাষ্য পাঠও করবেন । সবশেষে পূজো ও
প্রসাদ । স্বরাজের লোভ রাজস্থানী প্রসাদ, ঘিয়েভাজা হালুয়া আর শুকনো ফল । তাহলে কে
। প্রজাপতি ফিরে এল, সাতটার আগে ফেরার কথা নয় তার, তবে । এসে আলমারি বন্ধ করে
অন্ধকারে, আবার খোলে, দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কী না , ছোট টর্চটা তো জ্বলছেই । ধরা
পড়ে যেতো । সাজানো জিনিষ নাড়াঘাটা করা একদম পছন্দ করেন না তিনি ।
তবে
চৌধুরীর ভয় তার ছেলেটাকেই । ঘরে ঢুকে কিছু বলবেনা, শুধু পাকিয়ে তাকাবে এদিক ওদিক ।
স্বরাজ চৌধুরীকে দেখবেই না, উপেক্ষা করবে,
উঁকিঝুঁকি মারবে এঘর ওঘর । কী যে দেখে কে জানে । একবার ধরা পড়ে গেছে, স্কুলের
ছাত্র তখন, ছুটির দিন, খেলতে বেরোয় যখন তখন । শীতের আমেজ ছেড়ে কেউই উঠতে চায় না,
না স্বরাজ না তিনি । তিনি তো স্বরাজকে কুঁড়ে বলেন, নিজেও কয়েক কাঠি ওপরে । তাই
সমঝোতা হয়, দরজার চাবি দিয়ে দেওয়া হয় প্রজাকে । যাও, যত ইচ্ছে খোলো, বন্ধ কর। খেলো
শাটওপেন ।
হেমন্তিকায় সেদিন দুপুরবেলা বসন্ত হাজির হওয়ায় কেউই প্রতিরক্ষার কথা ভাবে
নি । সব উদোম, দুজনে গায়ে মনিপুরি খেস জড়িয়ে নিবারণ করেছিল পুত্রলজ্জা । প্রজাও কী
তবে ওর মায়ের মতো শীতল , ঘরে ঢুকে দেখল কী দেখল না বুঝা গেল না, নিজের ঘর থেকে
মাকে অর্ডার করে ম্যাগি করে খওয়াতে । ছেলেটা খুব চালু, স্বরাজ জানে কিছু তো দেখেছে
। কিন্তু কী নিঃস্পৃহ, কুল । যেন কিছুই হয় নি, কিংবা হতেই পারে, তাতে কী । এখকার
ছেলে মেয়েরা হয়তো ওরকমই ।
সেই যে
চাবি নিয়ে নেওয়া হল, এখন দিনরাতের
চাকরিতেও ডুপ্লিকেট একসেট দেওয়া হয় নি । তাই স্বরাজ চৌধুরী একাবাড়ির অন্ধকারে
বৌয়ের শাড়ির গন্ধ শুঁকেছে নির্ভয়ে । বাপের কাণ্ড দেখার, বিব্রত করার কোন অবকাশ
রাখে নি কোথাও । আলমারির তালা লাগিয়ে এটা ওটা রাখার বাহারি কফিমগে টুক করে ফেলে
দেয় চাবি । নামেই কফিমগ, আসলে পেনস্ট্যান্ড, কলমদানি । চাবি লুকোনোর ঠেক । চোরের
হাত থেকে লুকিয়ে রাখো, কমলার হাত বাঁচিয়ে রাখা ।
দরজা
খুলতেই কমলা । সেই কমলা, অবাক কমলা । কাজের মেয়ে, সব কিছুতেই অবাক হয় যুবতি কমলা ।
বলে, এমা ।
--- এমা দাদা আপনি ?
স্বরাজের নিজের বাড়িতে থাকা নিয়েই প্রশ্ন । এসব কমলার স্বভাব । ওকে দেখে
স্বরাজ চৌধুরীর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয় । ভালই হল, এবার এককাপ চা পাওয়া যাবে আয়েশের ।
চুরি করে নাড়াঘাটা করতে করতে গলা শুকিয়ে গেছে । তবে একটু রোয়াব টেনে প্রস্তাবটা
দিতে হবে । উল্টো কথায়, পটাতে হবে কমলাকে । বলে,
--- এই কমলা, তুই আবার সন্ধ্যেবেলা আসতে গেলি কেন ?
--- বৌদি নেই ? এমা !
--- না নেই, ফিরতে দেরি হবে, মোমটা জ্বালিয়ে নে ।
ফ্রিজের উপর আছে ।
কমলার
মুখে তাকায় স্বরাজ । তেমন শ্যামলা নয় মেয়েটা, মোমের আলোয় মন্দ লাগছে না । একা সোমত্থ
মেয়ে অন্ধকার ঘরে । বেশিক্ষণ তাকায় না, ভয়ও একটা আছে । যদি বলে,
--- দেখছ কেন ?
যদি চিৎকার করে বলে,
--- এই লোকটা একা পেয়ে... ।
একা পেয়ে
কী । কেউ তো বুঝবে না কিছু, স্বরাজ তো শুধু এককাপ চা খাওয়ার জন্য ওর মুড দেখছিল ।
পাবলিক ভাববে অনেক কিছু । আজকাল তো কথায় কথায় ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি । আরে না না ,
কমলা ও রকম মেয়েই নয়, এতদিন আছে, বাড়ির
মেয়ের মতোই হয়ে গেছে । স্বরাজ বলে,
--- এই কমলা, চা খাবি ?
খাওয়াবি বললে অনেক নখরা করবে । বলবে,
--- এমা এই সময়ে চা ? আমার অনেক কাজ ।
কী জানি
কী হয়, আধো আঁধারির পরিবেশ গুণেই হয়তো, কমলা কথা বাড়ায় না, রাজি হয়ে যায় । স্বরাজও
সোফায় বসে মনের সুখে সুর না লাগা কথা নিয়ে গুনগুন করে,
--- লা লালালা লা লালালা এলোচুলের লালালা ।
মোমের
আলোয় রিমোট নাড়াচাড়া করে আর চা করতে রাজি হয়ে যাওয়া তরুণী কমলাকে দেখে । ডাকে,
--- এই এদিকে আয়তো
বলে,
--- না, ঠিক আছে কাজ কর ।
প্রজার মাকে
বলে বলে হয় না । কতবার বলেছে,
--- তোমার ব্যবহৃত জামা কাপড় ওকে দিও না, আমার ভ্রম
হয় ।
তিনিও কম যান না । বলেন,
--- ভীমরতির জন্যই দিয়েছি, হাত বাড়িয়ে দেখো না কী হয়,
পুড়ে যাবে । আইন হয়ে
গেছে, এখন তাকালে ও দশবছর চাক্কি পিসিং, মনেমনে কুমতলব ভাবলে কুড়ি, ডাবল ।
কমলা আজ
পরে এসেছে তার লাল হলুদ আনারকলি । প্রজার মা প্রথম যেদিন পরেছিল স্বরাজের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল । বলেছিল বহ্নিশিখা ।
পুরনো হয়ে গেলেও রঙ একটু ফিকে হয়ে গেলেও মেয়েটিকে তো ঢিমে আঁচের আগুনফুল লাগছে ।
আটপৌরে বেশভূষায় থাকলে ওকে তেমনটি চোখে পড়েনা । কিন্তু চটকদার পোষাকে আকর্ষণীয় হয়ে
ওঠে । সবাই হয়তো হয়, সঠিক পোষাকটি চাই । চোরাচোখে আবার দেখে রাজু । তিনিও সব
লক্ষ্য করেন, স্বরাজের চোখের পাতার গতিবিধি । বলেন,
--- তাকিও না
ওভাবে, বাইরে গিয়ে বদনাম করবে, বলবে লোকটার দোষ আছে ।
স্বরাজ বলে,
--- ধুৎ, ও দেখবে নাকি আমার নয়নসুখ । ঠিক ঘুরিয়ে নেব,
আমি বাবা ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানি না, সাধু মানুষ ।
প্রজার মা বলে,
--- তাকাবে না একদম, বলে দিচ্ছি । চান্স পেলে তোমাদের
হাতসুখ মুখসুখ হতে কতক্ষণ, সে আমার জানা আছে । বেটাছেলেদের কোন বাছবিচার নেই ।
--- তাই ?
--- মেয়েটি ভাল, বিশ্বাসী, একটি গেলে আর পাব না ।
বলে, বিশ্বাস করে না প্রজার মা, চাবি টাবি লুকিয়ে
রাখে ওর ভয়ে । বলে,
--- ওলে এজ মিরাকেল থেকে এক খাবলা কমল কী করে ?
স্বরাজ
বলেনি যে অপরাধী সে নিজেই । কমলা চুরি করে লাগায় নি । মনের দুঃখে ক্রিম মেখেছিল
মুখের খরখরে ভাবটা যদি যায়, প্রজার মা ফিরে চায় । প্রজার মা জানে কমলার চেহারায়
এমনিতেই একটা স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা আছে, ক্রিমটিম মাখে না । তবু মেয়েটির দুর্নাম
করবে । স্বরাজ প্রতিবাদ করলে তেরছা কথা শোনাবে । মেয়েটি এতো ফর্সা না হলেও একটা সুমুখের
আদল আছে । বয়স কম, প্রজার মত বয়সী হবে, উদ্ধত যৌবনা যাকে বলে । এখন তো বিভঙ্গে আরো
প্রতিভাত হচ্চে, মোমের লুকোচুরি আলোয় । কমলার কাজে কর্মেও জাদু আছে, পরিপাটি কাজে
প্রজার মার পর্যন্ত মুখ বন্ধ । মাঝেমাঝে অ্যাকস্ট্রা কাজের জন্য আলাদা পয়সা চায় ।
চা করা ওর কাজ নয় করে দেয়, টিফিন করে, পয়সা নেয় । মেয়েটির হাতে চায়ের মজাই আলাদা ।
দুধে পাতা দেওয়া ঘন চায়ের চুমুকেই বলতে হয়, বাহ । বিজ্ঞাপনের চায়ের মতো । বেঁচে
থাক মেয়ে, মাঝে মাঝে এরকম একাবাড়িতে চলে আসবি, দুজনে মিলে চা খাওয়া যাবে জমিয়ে । আমি
তুই আর ব্রুকবণ্ড রেড লেবেল, জমে যাবে । এরকম একটা ব্যাপার, লুকনো অ্যাফেয়ারের মতো
উপভোগ করে স্বরাজ চৌধুরী । কমলার কাজ করায়, নড়া চড়ায় যৌবন চলকে পড়ে । স্বরাজ
চৌধুরীর পঞ্চাশও নেমে যায় পঁচিশ ত্রিশে । যাই যাই শীতে একটা আমেজভরা উত্তাপ
সঞ্চারিত হয় আঁধারির আলো সন্ধ্যায় ।
এরমধ্যে কমলা আর একবার এমা বলেছে । তারপর কিছুক্ষণ থেমেছে, থামার পর বলেছে
আবার,
--- এমা, সসুরাল সিমর কী চলে যাবে, কী দারুণ এপিসুড
দাদা, রোলির দুসরা সাদি আজ । দাদা তুমি, আপভি না, একটা ব্যাটারি লাগাতে এতো দিন ?
না
লাগালে তোর কী । স্বরাজ চৌধুরী রেগেই যায় যৌবনবতীর জ্ঞানের কথা শুনে । চান্স পেলে
সবাই সান দেওয়া কথা বলে । ব্যাটারি লাগালে ইনভার্টার থাকলেই কী, এখন কী স্বরাজ ওকে
দেখতে দিত নাকি সিরিয়াল । তিনি দেন । বলেন একটু আধটু দিতে হয়, কাজের মানুষকে
একটু ফাউ এন্টারটেইনম্যান্ট না দিলে থাকবে
কেন । স্বরাজ চৌধুরীর সমস্যা টিভি দেখা নিয়ে নয় । হিন্দি সিরিয়ালই কেন দেখতে হবে ।
বাংলায় তো কত ভাল ভাল সিরিয়েল হচ্চে, ইস্টিকুটুম সুবর্ণলতা । তিনিও তো সায় দেন
ওসবে । তিনিও দেখেন সসুরাল মধুবালা বালিকা বধূ পবিত্র রিস্তা । প্রজার হাতে রিমোট
পড়লেই টিএলসি জিকাফে এমটিভি বকরা নয় রোডিস । রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গ তবু কেউ দেখে
না বাংলা, কথা বলে না বাংলায়, লেখে না পর্যন্ত বাংলায় । রবীন্দ্রনাথের
বিশ্বভারতীরও মিডিয়াম অফ ইন্সট্রাকশন ইংরেজি ।
আজকে
তো একটা বিশেষ দিন । কেউ খবর রাখে না একুশে ফেব্রুয়ারির, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের
। আজ সকালেই দুদুটো বাংলা চ্যানাল দুজন গায়কের অনুষ্ঠান ছিল । দুজনেই স্বরাজ
চৌধুরীর প্রিয় শিল্পী । একটা দেখে নিয়েছে সকালে, ভেবে রেখেছিল রিপিট টেলিকাস্টে
অন্যজনকে দেখবে বিকেলে । একুশের পাশাপাশি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে এক অভ্যুত্থানের
আগমনী । এক রূপকথার নবজাগরণ । বাঙালির ধর্ম নিরপেক্ষতার অনন্য নজির । মৌলবাদের সঙ্গে
মুক্তমনের সংঘাত । ঢাকা শহরের কেন্দ্রে দীপেন্দুর বইএর দোকান বইবাসা, আজিজ সুপার
মার্কেটের দোতলায় বুদ্ধিজীবীদের আড্ডাকেন্দ্র, এলাকার নাম, পথের নাম শাহবাগ । সেই
শাহবাগের রাজপথে জেগেছে নতুন প্রজন্ম । বলেছে, হিন্দুমুসলমান ভাইভাই, রাজাকারের
বিচার চাই ।প্রায় নব্বুই শতাংশ ধর্মাবলম্বীর দেশে এ উদারতার নেই কোন লুকোনো
উদ্দেশ্য, এক গর্বিত জাত্যাভিমান ছাড়া । স্বাধীনতার শত্রুদের বিচার চেয়ে প্রাণদণ্ড
চেয়ে জেগেছে নতুন বাঙালি, কচি কাঁচা প্রাণ । ত্রিশলক্ষ বাঙালিকে মেরেছে এই রাজাকার
। এই প্রথম বাংলা দেখল, ধর্মের জন্য নয়, দেশের জন্য নেতৃত্ব দিচ্ছে যুবক নওজোয়ান ।
বড় কঠিন এবং অসম লড়াই, ইতিমধ্যে ঘাতকেরা মেরে ফেলেছে রাজীব নামের যুবনেতাকে ।
পাকিস্তান সরকার একবার মেরেছে বাংলার নেতৃত্বকে, মুজিবের ঘাতকেরা দ্বিতীয়বার
বাংলাকে বুদ্ধিশূন্য করতে চেয়েছে, পারেনি । স্বরাজ ভাবতেও পারে না কী করে মাত্র
কুড়িবছরে একটা প্রজন্ম এমন করে প্রস্তুত হতে পারে । শুদ্ধমনের অধিকারী হতে পারে ।
কুড়িবছর আগে, প্রজা তখন খুব ছোট, স্বরাজ বন্ধুদের সঙ্গে গেছে ঢাকায় গান গাইতে,
প্রজার মাই মূখ্যগায়িকা । রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য গান গাইতে দেয় নি । তখন
মৌলবাদীদের খুব রমরমা, ওদের আটক করে রাখে বগুড়ায়, বলে ভারতের চর । শাহিদ দীপেন্দু
সঙ্গে না থাকলে জেলেই যেতে হতো । দীপুভাই ঢাকায় মূখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে
ছাড়িয়ে আনে । দীপেন্দুর মেয়ে সাদিয়ার সঙ্গে প্রজার বন্ধুত্ব এখন ফেসবুকে । ফেসবুকে
তো আর সব কথা হয় না, ফোন দেয় সাদিয়া । এদেশে যেমন ফোন করা ওদেশে ফোন দেওয়া । বলে,
--- ফোন দিস প্রজাপতি ।
সাদিয়া হাসিমুখে প্রজাকে বলে,
--- রাজীব ভাইর পর আমিও এখন হিট লিস্টে রে । যে কোন
সময় মেরে ফেলতে পারে ।
রাজীবের
মৃত্যুর পর যেন আরো মরিয়া হয়ে গেছে প্রজন্ম চত্বরের নবীনেরা । মৌলবাদীরাও গ্রামে
গঞ্জে হচ্চে প্রতাপান্বিত । হুমকি ফতোয়া চলছে । বলছে ধর্মীয় আচার বিচার মানতে হবে
। চট্টগ্রামের কবি শাহআলম তো ফেসবুক অ্যাকাউন্টই বন্ধ করে দেয় । নতুন খুলেছে
মোহাম্মদ শাহআলম নামে, শুধু এমডি বা মোঃ দিয়ে লিখলে হবে না । প্রজা বলেছে
চট্টগ্রাম আর সিলেটে কট্টরপন্থী বেশি । এদেশের এই দুই গায়ক ওদের সঙ্গে গলা
মিলিয়েছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে গান লিখে, গান গেয়ে । এখন আলোর অসহযোগিতায় অন্যজনের
গান শোনা হলো না তার । এপারের লেখা শাহবাগের উপর গানটা নাকি ওপারে ভীষণ জনপ্রিয়
হয়েছে, সবার মুখে এখন, শাহবাগ শাহবাগ গানের কলি । আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো একুশে
ফেব্রুয়ারির মতো জনপ্রিয় । এরা দুই গায়ক ছাড়া এপার বাংলায় কিন্তু কোন তাপ উত্তাপ
নেই । দুএকজন বুদ্ধিজীবী টিমটিমে মোমবাতি জ্বালিয়ে বলতে চেয়েছেন দুচার কথা । ওপারে
চৌদ্দ কোটি বাঙালি যদি বাঙালি থাকতে পারে অবিকল, এপারে কেন পারে না । এপারের দশ
কোটি হয়েছে এক আজব জাতি, নিজের ভাষার পরিচয় বড় নয়, দেশ পরিচয়ের এক জগখিচুড়িতে এখন
বাংলার পঠন পাঠনও হারিয়ে গেছে । সাদিয়া প্রজার বন্ধু হলে কী হবে, প্রজার বাংলা
দুছত্তর মাত্র, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া যে । মায়ের কাছে শুনে শুনে বাঙালি সাজে
বন্ধুনির কাছে । বাপের কাছে ছড়া শিখে সাদিয়ার সঙ্গে বিরহ সাজায় এপার গঙ্গা ওপার
গঙ্গা মধ্যখানে চর ।
অন্ধকারে মনের দুঃখে প্রিয় গায়কের গান শোনা থেকে বঞ্চিত হয়ে মন খারাপ হয়
স্বরাজ চৌধুরীর । সামঞ্জস্যহীন ভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলে । আসলে তাও নয়, স্বরাজ তার
লক্ষ্যে আছে স্থির, কমলার উল্টোপাল্টা হিন্দি বাংলার বুকনি শুনেইতো উঠে এলো
ভাষাভাবনা, ভাষাদিবস, প্রজন্ম চত্বর । কথা সাহিত্যিক আমর মিত্রর ছোটগল্প থেকেই
নেওয়া হবে হয়তো, সায়ক নাট্যদল একটা অসাধারণ নাটক করেছে পিঙ্কি বুলি । সেই ভাষা
সমস্যা নিয়েই । গ্রামের পরিচারিকা মেয়ের প্রাকৃত বুলি আর শহুরে জগাখিচুড়ি বাবুর
বাড়ির মেয়ে । এখন আর সে সব নেই, কোথায় কোথায় দূরগ্রাম পেরিয়ে তখন কমলা বাসন্তী আর
বুলিরা আসত দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে । লোকেল চেপে আসত । এখন সব লোকেল হয়ে গেছে,
ষোলবিঘার বস্তি কিংবা বাসন্তী কলোনী থেকে এখন মেয়েরা বৌরা আসে কাজে । মুসলমান
মেয়েরা নাম পাল্টে শাঁখার মতো চুড়ি পরে হিন্দু বাঙালি গৃহবধূ সাজে । আরা কিংবা
মজফরপুরের আদিপরিচয় মুছে কেউকেউ কমলার মতো বাঙালিও হয়ে যায় । তাই হয়তো তাদের মুখের
ভাষায় এক বিচিত্র বুলি । কমলার এমা তেও একটা হেম্মার ধাক্কা আছে ।
কমলা
কিন্তু সাধারণ রমণী নয় । রীতিমতো দাপুটে । প্রজার মার গোয়েন্দা অনুসন্ধান থেকে উঠে এসেছে অনেক তথ্য ।
যদিও সবই ভাসা ভাসা । তবে নিজের ভগ্নীপতিকে পিটিয়ে মারার অভিযোগটি কিন্তু মারাত্মক
। প্রজার মা বলে,
--- মারতেই পারে, বাড়বাড়ি করেছে কিছু ।
বলেছে,
--- এখন আর কী করব, তাড়াতে তো পারি না । কাজের লোক তাড়ালে
আর পাওয়া যায়না, বদনাম হয়ে যায় । আগে জানতাম নাকি এত ঘটনা, এখন লোক বলাবলি করছে ।
মেয়েটাকে তো আমি বলেছি মুখের উপর । অস্বীকার করেছে । বলেছে, কী যে বল বৌদি, ওসব
আমার পাত্তা কাটার ধান্দা ।
বীরাঙ্গনা স্বীকার করলেই বরং প্রজার মা খুশি হতো । কিন্তু কমলা বলেছে অন্য
এক রহস্যময় স্টোরি । বলেছে,
--- লোকটা বদমাশ ছিল, হাতে নাতে ধরেছে পাবলিক,
দোস্তের বিবির ঘরে যেতো । ওরাই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে ।
প্রতিবাদী
কমলা বলেছে,
--- কিন্তু আমার দিদির কথা তো কেউ বলে না । কোথায় গেল,
কী করছে মেয়েটা ? মহল্লা ছেড়ে চলে গেল । সোনার পুরে আমার মায়ের বাড়িতে থাকে ।
শিয়ালদা কোলে মার্কেটের সামনে ছাটের মাল আদা রসুন বিক্রি করে ।
স্বরাজ
একটা ক্ষীণ পয়েন্ট অফ অর্ডার তুলেছিল,
--- বিধবা হয়ে রসুন বিক্রি ?
কমলা তেড়েফুঁড়ে জবাব দিয়েছে,
--- আমাদের ওসব নেই । মরদ নেই তো কী হয়েছে, সব খায় । বিক্কিরি করতে কী
দোষ ?
ওদের
সংসারেও এসব নিয়ে আতান্তর নেই । বাপপুত সব খায় । মাছ খায়, মাংস খায় । মাংস মানে
মাংসই, দু ঠেং চার ঠেং এর প্রভেদ নেই রাজা প্রজার । প্রজাপতি সব মাংসই খায়, মাকে
গর্বভরে বলে নিজাম থেকে বিফ খেয়ে আসার গল্প, ট্যাংরা থেকে শূয়োর । ছেলের বেলায় দোষ
নেই, স্বরাজ খেলেই ভিন্ন নিদান । বলে,
--- আলাদা শোও, ওসব খেলেই শরীর গরম হয় ।
প্রজার মা
ইশারায় কথা বলে । স্বরাজের কথায়ও থাকে সারল্য । বলে,
--- শরীর গরম হলে কী হয় ?
তিনি রাগেন । বলেন,
--- জানো না কী হয় ? পেপার পড়ো না ? টিভি দেখো না ? পার্ক
স্ট্রীটে ওসব খেতেই তো যাও তোমরা । তারপর অন্ধকার গাড়িতে... ।
স্বরাজ
ভাবে তেরছা করে একটা জবাব দেবে কী না । কিন্তু না, হিতে বিপরীত হবে, তিনি আবার
বাঁকা কথায় রাগেন বেশি । তাই বলে,
--- ও, মাংস খেলে ধর্ষণ করে মানুষ ।
--- তোমরা কী আর শুধু মাংস খাও ?
এবার রাজু
চৌধুরী চুপ মেরে যায় । দু এক পাত্র তো চড়ানোই হয় অনুপান । তবে ধর্ষণাদির কারণ
বিষয়ে প্রজার মার সহজ সমাধান এককথায় মানা যায় না । অবশ্য একটা কারণ হিসেবে
অস্বীকারও করা যায় না । ইদানীং তাদের পাশের পাড়ায়ও শব্দটা ঢুকে পড়েছে ঢাকঢোল
বাজিয়ে । দুদুটো কেস হয়ে গেছে, মিডটাউন ধর্ষণ কাণ্ড । এখন সব কিছুই কাণ্ড,
প্রমোটার খুন হলেও কাণ্ড, পরীক্ষায় টুকলি করলে কাণ্ড, উডালপুল ভেঙে পড়লে কাণ্ড,
ধর্ষণ হলে তো কথাই নেই, ডাল পালা অনেক কাণ্ড ।
কাণ্ড
বিশ্লেষণ করতে করতে স্বরাজ চৌধুরীর টনক নড়ে । এখন, এই মুহূর্তে যে তারও শিরে
সংক্রান্তি । তার পঁয়তাল্লিশ বছরের বৌটি যতই স্বামীবৈরী হোক, এখনও কিন্তু মোহময়ী,
এখনও আকর্ষক । অন্ধকার বাঙ্গুরের পথ দিয়ে একা একা ফিরবে । যদি কিছু হয়ে যায় । সাড়ে
ছটা বাজে এখন, মানে বিদায়ী শীতের পথঘাট এখন যথেষ্ট অন্ধকার । আকর্ষণ কথাটায় একটা
গরমগরম ভাব আছে । তবে মোমের
আলোয় কমলার আকর্ষণ এখন অবস্থান বদল করে স্বরাজ চৌধুরীর মনে । অগ্রাধিকার পাল্টায় ।
তাকে এখনই বেরোতে হবে । রক্ষা করতে হবে বিপদগ্রস্থ পত্নীকে । কমলাকে বলে,
--- তুই থাকবি একটু ? আমি যাব আর আসব । বৌদি একা আটকে
আছে বাঙ্গুরে । প্রজা এলে চলে যাস । থাক না মেয়ে ।
প্রজা
আসবে শুনে অন্ধকারেও আলোকিত হয় কমলার মুখ । গাঁইগুঁই থামিয়ে বলে,
--- টিফিন করে দেব স্যারকে ?
কিসের
স্যার কে জানে । স্বরাজকে ডাকে দাদা, প্রজার বেলা স্যার । বলে,
--- দিস ।
ঘুরঘুটি
অন্ধকার বাইরে । এই অন্ধকারেই বারাসাতে হয়েছিল ধর্ষণ বারবার । বারবার বলেই বারাসাত
এখন ইন্ডিয়ার ধর্ষণ মানচিত্রে নাম্বার ওয়ান । একটু দূরে মধ্যমগ্রামেও ছোঁয়া লেগেছে
। বাগুইআটি কেস্টপুরেও হয়েছে টুকটাক । এখন বাঙ্গুর কালিন্দী দক্ষিণদাঁড়ি মিডটাউন
পর্যন্ত এগিয়েছে, বাকি থাকছে তাদের নতুনপাড়া মাঝখানে । পাড়ায় এখন সবাই আতঙ্কিত,
সবার মনে একটাই ভয়, কার বাড়িতে প্রথম উইকেটটি পড়ে । প্রজার মার আগমন পথটির কথা
ভেবেও আতঙ্কিত হয় স্বরাজ । দিনের বেলাও থাকে নির্জন, শুনশান । এখনও ঐপথে ট্রাইডেন্ট
আলো লাগেনি । লাগলেই বা কী, ওরা কী আর শুধু তাৎক্ষণিক বিকারে করে এসব, পরিকল্পনা
মাফিক আলো ভেঙে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখে । পথের ধর্ষণ এখন একাএকা হয় না, এখন
যৌথতার সময়, ইটবালি স্টোনচিপসের যেমন আছে সিন্ডিকেট । ধর্ষণেরও আছে গণধর্ষক । বাংলা
অভিধান ও যেন ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়, একটা সাংঘাতিক শব্দের সাধক অর্থ নেই । ধর্ষণ
শব্দের অর্থ লেখা আছে ধর্ষণ । মানে বলাৎকার । বলাৎকারের অর্থ বলপূর্ব করণ । কী করণ, বলপ্রয়োগে সতীত্ব
নাশ, সংগম । কেমন মজার ব্যাপার । এরকম একটা বিষয় নিয়ে কাটাকুটি খেলতে মন্দ লাগে না
স্বরাজ চৌধুরীর । কিন্তু এখন তো তার শব্দ নিয়ে খেলার সময় নয়, তার স্ত্রীর সুরক্ষার
ভাবনা প্রধান হওয়া উচিত । নাকি তার সামাজিক প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখার দায় থেকেই
সে দৌড়চ্ছে নির্জন পথে । মাঝবয়সী স্ত্রী তার একান্ত সম্পদ বলে লোকসমাজ যাকে নিয়ে
গর্ব, তার গায়ে কেউ হাত দিলে অসম্মান করলে, লোকজানাজানি হলে তার ব্যাক্তিগত
মর্যাদা ধূলিসাৎ হওয়ার ভয়টাই কী আসলে উদ্বেগের কারণ ।
সে
একদিন এই ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়িতে এক ধর্ষককে রক্ষা করেছিল । অন্ধকার ছিল না সে রাতে,
সিঁড়িতে আলো ছিল ভরপুর । সতের নম্বর ফ্ল্যাটের গড়াই বাবুর মেয়ের জন্মদিনে আনন্দ
করে ফিরছে এক জরিচুমকির ঝলমলে শাড়ি পরা যুবতি । মেয়েটি একতলার সিঁড়ি থেকে আতঙ্কে
চিৎকার করে ওঠে । ছুটে আসে গড়াই, সে কী পরাক্রম তার । স্বরাজ চৌধুরীও বেরিয়েছিল ।
উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের ভিমানির ছোট ছেলের কাণ্ড । ওর আছে এসব একটু, এর আগেও ঘটিয়েছে
দু একবার । বুড়ো ভিমানি বুঝতে পারে, ছেলেকে ঢুকিয়ে দেয় ঘরে, গ্রিলে তালা লাগিয়ে
দেয় । একে একে ফ্ল্যাটের সব বাসিন্দা এসে জড়ো হয় । গ্রিল ঝাঁকায় সবাই মিলে, বের
করে যেন মেরেই ফেলবে ছেলেটিকে । তখন মোবাইল হয়নি, স্বরাজ ল্যান্ডলাইনে ভিমানিকে
জানালার গ্রিল খুলে ছেলেকে সরিয়ে দিতে বলে । স্বরাজের বুদ্ধিতে গুড্ডু পালিয়ে
বাঁচে । স্বরাজ বাঁচে না, রাম রাবণ সবাই আক্রমণ করে তাকে গড়াই সহ ফ্ল্যাটের সব
আবাসিক বলে,
--- তোমার মেয়ে নেই বলে এমন করলে চৌধুরী, তোমার ছেলেও
যদি নীলকান্তর মতো হয়, তখন তো আর বুড়ো ভিমানি থাকবে না রক্ষা করতে ।
আসলে
ভিমানিরা একটি ভালমানুষ রোগভোগের দম্পতি । ওদের একমাত্র ভরসাই নীলকান্ত ওরফে
গুড্ডু নামের অপোগণ্ড ছেলে । বুড়ো ভিমানির মুখচেয়েই করেছিল কাজটা, এখনও আবাসনের
বাসিন্দাদের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে স্বরাজ । এত বছর ধরে । প্রজাপতিকে তাই মনের মতো
মানুষ করেছে, আজ পর্যন্ত কোন বেচাল দেখেনি
। তবে এখনকার ছেলেদের সবকিছু তো আর তার মতো নয়, ছেলেবন্ধু মেয়েবন্ধু ফারাক করে না,
রিমি সায়ন্তনীদের নিয়ে দুমদাম ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় । প্রজার মাও প্রশ্রয় দেন ।
বলেন,
---ওরা ছোটবেলার বন্ধু ।
সেরাতের
ঘটনার পর ভিমানিও তাকে ছাড়ে নি । তার যুক্তি,
--- পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয় নি, সবাই ধরে নিল নীলকান্ত
অপরাধী । আরে ম্যান একহাতে তো তালি বাজে না, সিঁড়িটা এতছোট করে বানিয়েছে প্রমোটার
যে দুজন মানুষ পাশাপাশি যেতে পারে না গায়ে লাগতেই পারে । আর এত রাতে মখমলি পোষাক পরে
একা সিঁড়ি দিয়ে যাওয়ার কী অর্থ বলতে পারো চৌধুরী সাহেব । এত ছোট ঘটনা, এত তুচ্ছ,
সব সাজানো, ঐ গড়াই এর কারসাজি ।
তাও তো
কথা সিঁড়িটাই ছোট, রমণীটির বেশভূষাই ছিল আকর্ষক । আর এত রাতে সে কী করছিল ওখানে,
সে মানে ঐ জরিচুমকির আনন্দরতা মেয়েটি । আসলে তাৎক্ষনিকতার রেশ কাটলেই মানুষ
আত্মরক্ষায় তৎপর হয়, অপরাধের দায় ঝেড়ে ফেলে শুদ্ধ হয় ।
এখন এই
ভর সন্ধ্যেবেলা স্বরাজ চৌধুরী ও তার আকর্ষণীয় উদ্ধারে দৌড়চ্ছে রক্ষাকর্তা।গড়াই
বাড়ির অভিশাপে যদি লাগে । তবু স্বরাজ ভাবে, তার কাছে যতই চুম্বকের মতো মনটানা
সুন্দরী হোক না প্রজার মা, আসলে তো বিগতযৌবনা । আলো থাকলে তাকাবে না যুবকেরা,
মেনোপজ হয়ে যাওয়া প্রজাজননীকে নিয়ে কোন করণ নেই ওদের । কে যেন রসিকতা করে বলেছিল,
অন্ধকার বারাসাত পথের সংলাপ,
--- ছেড়ে দে ছেড়ে দে, শালা বুড়ি ধরেছিস রে ।
তবু বুকের
ভিতর অকারণ ধুকপুক শব্দটা কিছুতেই কমে না রাজা ওরফে স্বরাজ চৌধুরীর ।
এখন কী
অমাবস্যা । এত ঘুরঘুটি কেন বড়রাস্তায় । স্বরাজ এখন অন্ধকারের স্বরূপ ভুলে গেছে ।
আলোয় থাকতে থাকতে ভাবতেই পারে না আঁধারের অস্তিত্ব । অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে
স্বরাজ বুঝতে পারে না, এ কেমন সময় । এত পাশবিক কেন হয়ে যাচ্ছে মানুষ । নাকি কিছুই
পাল্টায় নি, সেকালে যা একালেও তাই আছে । টুকটাক বিপরীত শক্তির প্রতি বলপ্রয়োগের
ঘটনা কী সেকালে ঘটে নি । হয়তো ক্যামেরা ছিল না , এত পাওয়ারফুল, টিভি চ্যানেল ছিল
না । দৈনিক সংবাদপত্র, ট্যবলয়েড ছিল না, চিটফাণ্ডের রমরমা ছিল না । এখন তো খবরের
কাগজ বিনি পয়সায় বিলি করতে পারে, এত বিজ্ঞাপন ।
স্বরাজ
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবে যাক একটা ফাঁড়া কাটল । অন্তত সিঁড়িতে কেউ ধরে নি তার
পঁয়তাল্লিশ বছরের বৌকে । এবার ক্যানেল স্ট্রীট ধরে সোজা ধর্মস্থান । সময় মতো পৌঁছে
গেলেই নিশ্চিন্ত । কিসের নিশ্চিন্ত, এখন তো স্বামীকে দাঁড় করিয়ে পেশাচিক আনন্দে
বৌকে নিয়ে লুফালুফির খেলা হয় । না না স্বরাজ চৌধুরীর বেলা ওরকম হবে না। দাপুটে এম এল এর
পাড়ার রাজা সে, রাজু, স্বরাজ চৌধুরী । একটা পরিচিতি আছে । কিছু করার আগে মোবাইলে
খবর পাঠিয়ে দেবে । ওরা তো আট ঘাট বেঁধেই এগোয়, অপারেশনের আগে তো মোবাইলটাও কেড়ে
নেবে ।
বাঞ্চারামের মিস্টির দোকানে ওদের নিজস্ব আলো দেখে খুশি হয় স্বরাজ । আলো
দেখলেই উদ্বেগ কমে, অন্ধকার হলেই বৌএর জন্য আতঙ্কিত হয় । উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে যায়
।
ঘোষপাড়ার
মুখে অন্ধকার রহস্যময় । সূচীভেদ্য নয়, মানুষজন আছে, আগুনের ফুলকির মতো দু একপিস
আলোর বিন্দু । আলোর আসা যাওয়ার পথে চলতে চলতে মানুষের অবয়ব অস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ।
ছেলেরাও আছে মেয়েরাও আছে । বিভিন্ন বিভঙ্গের বিভিন্ন বয়সের মানবীরাও নিশ্চিন্তে
হেঁটে যাচ্ছে একা একা জোড়ায় জোড়ায়, ও দলবদ্ধ । কেউ কেউ কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ঝগড়া
করছে দুরবর্তী বাস্তব কিংবা অলীক মানষের সঙ্গে, হাসছে খিলখিলিয়ে । এত নির্ভয় ভ্রমণ
। নারীপ্রতিমার উজ্জ্বল আভাসেও স্বরাজ পুলকিত হয় । নারী কাঠামোর সমস্ত প্রয়োজনীয়
বিন্যাসই বর্তমান, স্বল্প আলো যেন আঁধারপ্রতিমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে সুন্দর করে ।
চলমানতায় যেন সৌন্দর্যের প্রকাশ হচ্চে প্রগাঢ় । স্বরাজেরও একটা বাড়তি সুবিধা আছে,
ইচ্ছেমতো মনেরমতো করে সে রুপারোপও করতে পারছে আঁধারের সৌজন্যে । এমন সম্পূর্ণ এবং
চলমান নারীশরীর সে দেখেনি অনেকদিন । মুখগুলি এত কমনীয়, স্বরাজ চৌধুরী রূপহীন
অন্ধকারে সাজায় সুন্দরকে । নারীর গ্রীবায় কোমরে যে সকল সৌন্দর্য সাজানো থাকে, সব দেখে
সে । বুকগুলোও সব মনের মতো অহংকারী উদ্ধত । আজকাল নাকি কোন বুকই অপুষ্ট হয় না, তেল
মলম লাগিয়ে টানটান ছত্রিশ আটত্রিশ করা যায় । প্রজার মা বলে,
--- ডালিম ফুল এখন গাছ থেকেও এগিয়ে থাকে । ভারী ফুল শরীরকে
বলে তুই থাক আমি যাই ।
এত গর্ব
ভারীবুকের সংলাপে । তিনি তো আর সচরাচর রসের কথা বলেন না । সতি দয়া করলে, হঠাৎ
বসন্তকাল এলে বলেন । আজকাল কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নতুন এক অন্তর্বাস
বহির্বাসের দায়িত্ব নিয়েছে নারীর, নাম লেগিংস । অন্ধকারে কিন্তু বেশ লাগে
স্বরাজের, বুঝাই যায় না নিম্নাংশ উদোম কিনা ।
স্বরাজ
চৌধুরী মনের ভাবনাকে কোন নীতি নৈতিকতার তোরঙ্গে বন্দী করে রাখে না । রাখবেই বা কেন
। সে তো আর ককটেল পার্টিতে যাচ্ছে না বো-টাই আর স্যুটবুট পরে । চানঘরে মানুষ নিজের
সঙ্গে কথা কয় । কোন আগল থাকে না । রাখঢাকহীন । ছুটালেই মগজের রেলগাড়ি ছোটে দুরন্ত
। পোষকী সাধু সে সাজে না একাকীর সংলাপে, চোর ডাকাত ভালমানুষ সবই সাজে সে মনোঘরে ।
কুবুদ্ধিতে পেয়ে বসলে শিক্ষকে ধর্ষকে ফারাক থাকে না । মনের কর্মশালায় সে আনন্দনাড়ু
বানায় করে, সবার মনে তাই খিরাখেতের ভরাফসল । সরাসরি মনের সংলাপে তাই সবই ছাঁকনি
ছাড়া চা । যে হাঁড়িতে রান্না সেই পাতিলেই খেয়ে নেওয়া হাপুশহুপুশ । অতিথি আপ্যায়নের
পারিপাট্য থাকে না একার আহারে । ডাইনিং সেট, সার্ভইঙ্গবোল ন্যাপকিন স্পুন
গার্নিশিং কত কিছু । যারা সাজিয়ে গুছিয়ে বক্তৃতা দেয়, কাগজে লেখে উত্তর সম্পাদকীয়
ওরাও তো সবাই ভণ্ড । মনের কথা কেউ বলে না । ‘যতটা সে বলে তার চেয়ে অনেক বেশি গোপন
করে যায়’ । কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন সরাসরি । আবার অলক দাসগুপ্ত রহস্য দিয়ে ঢেকে
দিয়েছেন । বলেছেন ‘ভাষা দিয়ে ভাষার মিথ্যাকে জয় করা’র কথা । হয়তো এই সত্য মিথ্যা
দিয়ে সমাজকে টিকিয়ে রাখে মানুষ । মানুষের নেতৃত্ব । কথার মারপ্যাঁচে সাবাশ বললেই হিরো ।
প্রগতিশীল আর ধর্ম অধর্মের মাঝখানে থাকলেও প্রশংসা রহস্যময় । স্বরাজ চৌধুরীও যখন
গান লেখে তখন রাখঢাক করে, সুরের জাদুতে মজিয়ে রাখে শ্রোতাকে । প্রজার মাও ধর্মের
আসরে সুরের ঝড় তোলে, মুঠো করা হাত মাইকের সাথে অন্যহাতে তালিও দেয় । বুকের কাপড়ও
কী একটু সরিয়ে রাখে না, রাখে । তিনি মানেন না । বলেন,
--- তোমার তো একদিকেই দৃষ্টি, বুচকির দিকে । শরীর
শুধু ।
ঘোষপাড়ার
আবছায়ায় মানুষের মিছিলে নারী শরীর দেখে দেখে উত্তেজিত হয় স্বরাজ । পত্নীর জন্য
উৎকণ্ঠায় হাঁটতে হাঁটতে কামনা বাসনাকেও দৌড় করায় । ছায়াছায়া অন্ধকার পারিপার্শ্বিককে
নিয়ে যায় মনের আলোকে । ভাবে, বেশতো, তাদের পাড়াটা যে এত উপভোগ্য জানা ছিল না । ঘাম
হয় তার, চুরিকরে সরাসরি দেখার, আলোছাড়া দেখার আগ্রহে স্বরাজের রক্ত চাপ বাড়ে ।
সাময়িক বাড়ে, না স্থায়ী হয় বুঝতে পারে না । এরকম তো প্রায়ই হয় । টেস্ট ফেস্ট করাতে
হবে এবার, উত্তেজনা কমাতে হবে । ভোগদখলের দুনিয়া ছাড়তে হবে । এবার থেকে তার
একেশ্বরী, প্রজার মাকেই দেখবে শুধু ।
প্রজার
মার পোষাকটা ভাবতে চেষ্টা করে স্বরাজ । সালোয়ার কামিজ না শাড়ি । যাইপরে থাকুক
আবরণ, মহিলা কিন্তু দারুণ আকর্ষণীয় সাজে । আর সাজবে নাই বা কেন, তিনি তো আর কোন
সন্যাসিনী নন, বয়স যত বাড়ছে, স্বামীর প্রতি আকর্ষণ যত কমছে, ততই বাড়ছে গ্ল্যামার,
জেল্লা । স্বরাজ বলে,
--- তুমি তো আর ডিস্কো বারে যাচ্ছ না, মন্দিরে যাচ্ছ,
তবে কেন এত সাজসজ্জা, সন্যাসিনীর বেশ তো সাদা, ঢাকাঢুকি ।
প্রজার মা বলে,
--- তোমার মতো উলুখড়ের জীবন নয় আমার, আমাকে সঙ্গ দিতে
হয় এ ক্লাস মানুষজনের সঙ্গে । যোগাযোগ রাখতে হয়, তাল মেলাতে হয় । মাইক হাতে শুধু
তানবিস্তার করলে হয় না, দেখার সুন্দর হতে হয়, চুন্নি উড়িয়ে বলতে হয় আমার সঙ্গে
নাচুন, ওয়ান টু থ্রি ।
--- ভগবানের সামনেও ইংরাজি ?
প্রজার মা বলে,
--- ওসব চলে । ধর্মে বিভোর হলে ভাষা কোন বার নয় ।
দেখবে ধর্মচ্যানেলে যখন নারী গান গায় তখন জনতা উদ্বেল হয় । নারীর শরীরও নাচে গানের
তালে, পুরুষের উন্মাদনার পারা চড়ানো জানতে হয় ।
--- ও ।
বলেছে স্বরাজ, রাষ্ট্রপতির ছেলেও তাই বলেছেন,
প্রাক্তন অধ্যক্ষ বলেছেন, প্রগতিশীলতার দুমুখো নীতিপুলিশরা মিছিল করে প্রতিবাদ
জানাচ্ছেন একদিকে, অন্যদিকে বলেছেন এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক নয় । বলছেন এত কম পোষাক কেন,
কেন এত পার্টিসার্টি, কেন এত মদের দোকান, এত মেলামেশা ।
--- বুঝলাম ।
প্রজার মা রাগে । বলে,
--- তোমাদের পুরুষের সমাজ, যা বলবে তাই মানতে হবে ।
স্বরাজও তার নারীকে জড়িয়ে ধরে কথার প্যাঁচে । বলে,
--- বলেছেন এক বৃহৎনারীও, তোমাদের বিপক্ষে বলেছেন,
ভুলে গেলে ‘ছোট তুচ্ছ আর সাজানো ঘটনা’র কোট আনকোট ।
ইরাণের ঘটনাও বিশ্বাস করেনি প্রজার মা । রাজনীতি ও ধর্মের
যুগ্মশাসনে ফার্সি দেশের ঘটনাটাও ভেবেছে স্বরাজের বানানো গল্প । গল্পের মতোই তো
বটে, সারা বিশ্ব দেখল মার্কিন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী স্ট্র্যাপ দেওয়া জামা পরে অস্কার
অনুষ্ঠানের পুরষ্কার বিতরণ করছেন । সেই ছবিই কিনা, ছবি তো নয় চলচ্ছবি, যখন তেহরাণ
টিভি থেকে টেলিকাস্ট হল তখন ভদ্রমহিলার গায়ে ফুলহাতা জামা । ম্যাজিক করেছিল
চিত্রগ্রাহক, ফটোশপ করে পাল্টে দিয়েছিল । আমাদের বাংলা চ্যানেলে ক্লিপিংস দেখালো,
সঙ্গে ক্যাপশন ‘বসন পরো মা’ । স্বরাজ চৌধুরী এই গল্পের শেষে একটা হিতোপদেশের বানীও
জুড়ে দেয় । বলে,
--- তবে যাই বলো তাই বলো, তোমার এই রাত করে
ধর্মোপাসনায় গান গাইতে যাওয়ার দরকার নেই ।
--- কেন ?
প্রজার মা
ক্ষিপ্ত প্রশ্ন করে সোজা সুজি । স্বরাজ এই কেনর জবাবও প্রথমে খুঁজে পায়নি যখন
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন মেয়েরা সন্ধ্যের পর কাজ করবে না অফিসে কাছারিতে
। বেশ তো, ভালই প্রস্তাব । কিন্তু নারীবাদিরা রেগে গেলেন, বললেন, কেন । বিধানমুখ্য
তো দায়িত্ববান অভিভাবকের মতো কথাই বলেছিলেন । পরে বুঝেছে স্বরাজ নারীদের কথাও ঠিক,
সমান অধিকারই থাকুক, সমাজ পাল্টাও সমাজপতি । সুরক্ষার ব্যবস্থা করো । কিন্তু কী
উপায়ে ।
স্বরাজ চৌধুরী একটু পানটান করে ঠিকই, কখনও
মাত্রা ছাড়াও হয়ে যায় । কয়েক বছর আগে পার্কস্ট্রিটের অলিম্পিয়া বারে বিস্তর
মদ্যপান করে রাত বারোটায় ফেরে বাড়ি । বমি টমিও করে । তখনও কলকাতায় তন্ত্রমন্ত্র
হয়নি । কোন মহিলার দেখা পাওয়া যায় না বারে । প্রজার মা উৎসাহ ভরে বলেছিল,
--- আমাকে নিয়ে যেও একদিন । খুব মাল খাব, গান গাইব
‘আপ য্যায়সে কোই’ । মাতিয়ে দেব মালখোর দের ।
--- না !
পুরুষবাদি
স্বরাজ বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিল ‘না’ । জোরটা বেড়েছিল মদের ঘোর থাকায় ।
--- না কেন ?
সেদিনও
প্রজার মার প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি । সেদিন পারেনি, আজও কী আছে কোন জবাব । পার্ক স্ট্রিটের
মহিলার গণ ধর্ষণের পর তো একজন নারীই বললেন সাজানো কেস, নারীপুলিশ হেনস্থা হলেন,
জনপ্রতিনিধি সভার মন্ত্রণা দাতা বললেন চরিত্র ভাল নয়, বারে গিয়ে মদ খেয়েছে কেন ।
মানে, পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারের কেন হস্তক্ষেপ ।
--- বেশ করেছে ।
প্রজার মা আবার বলেছে,
--- বেশ করেছে ।
বলেছে,
--- তাহলে বলো ইরাণের সমাজই ভাল ।
স্বরাজ খুশি হয়ে বলে,
--- ঠিক ।
তেলে বেগুণে জ্বলে ওঠে স্বরাজের নারী ।
--- তাইতো বলবে, ওখানে বদ্ধ সমাজে পুরুষের বহুগামী
হওয়ার বাধা নেই । ওদের সংস্কৃতিতে নাচগানও নিষিদ্ধ । পৃথিবীর দ্বিতীয় ধর্মসমাজকে
বাদ দিয়ে বলো নারীবাদ, নারীঅধিকার হয় কী করে ? এসব কী নিজেকে ঠকানো নয়, ইউরোপের
জোড়াতালি দেওয়া নকলনবিশি নয় ?
--- কেন ? আমি তো আর সত্যি সত্যি বারে গাইতে যাইনি যে
তোমার অনৈতিক মনে হয়েছে, তাই উদ্ধার করতে এসেছো । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সামনে গাইছি
প্রেমের গান, ভগবৎ প্রেমের রসসিক্ত কথা ও সুর । এসব তো পারমিটেড । পুরুষেরা
ছাড়পত্র দিয়েছে । ধর্ম বলেছে একটু ইয়ে ইয়ে হলেও ভগবানের কথা বটে । অবশ স্যার
বলেছিলেন বাংলার ক্লাসে, ইউরোপের খৃস্টান সমাজও একসময় ছিল বদ্ধ । ওদেরও শিল্প
সাহিত্য নারীর অধিকার বলতে ছিল একটুকরো গোলমতো মুখ, বাকিটা কাপড়ের পুটুলি । কূয়োর
ভিতর থেকে দেখার জন্য সঙ্গীও ছিল এক গোলপানা আকাশের টুকরো । নারীদেহ, নারীর ছবি
আঁকা ছিল বারণ । দেবদেবী ছাড়া স্বল্প বসনার কল্পনাও করা যায় না । তাই যে সময়ের
শিল্পিরা পুরাণ ঘেঁটে বের করলেন ঈশ্বরপ্রিয় কিংবা তাঁর নিকট আত্মীয়দের ছবি । বার্থ
অফ ভেনাস নিয়ে হইচই হলেও ধর্মীয় অনুমোদন পেতে বাধা হয়নি । শঙ্খের খোলের ভিতর
নগ্নিকার ধর্মসত্য যে স্বীকৃত ।
প্রজার মার
যুক্তি অকাট্য । বলে,
--- আমারও পারমিশান নেওয়া আছে বাঁকেবিহারীজির কাছ
থেকে । আমিও তাই শরীর দিয়ে গান গাই, চোখের ইশারায় গাই । দোষ কোথায় ? জ্যামিতিক
পোষাকের দোষ, ধর্মীয় প্রেমের দোষ ? তাহলে তো ধর্ষণতরশণ গৌণ, একা মানবীর অসহায়তা
কিছু নয়, পুরুষের আকর্ষণের কেন্দ্র তাহলে উত্তেজক স্বল্পবাস আর ধর্ম সমাজের
স্বীকৃত ইঙ্গিত ?
স্বরাজ
চৌধুরী বিপাকে পড়ে যায় । কিছুক্ষণ আগে সেও তো একাবাড়িতে নারীশরীরের ব্যবহৃত পোষাক
হাতড়ে এসেছে ।
স্বরাজ
চৌধুরী জানে ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় । প্রজার মার সঙ্গে কথা বলার অর্থ হল
ঢিল ছোঁড়া । তাই অভ্যাস হয়ে গেছে, হেডগিয়ারে লেগে ছিটকে যায় প্রতিপ্রস্তর । বরং
অন্ধকার রাতে স্ত্রী উদ্ধারের গর্বে সে বেশ পুলকিত । প্রজার মায়ের রাগের বাউন্মারও
সে ডিফেন্মিভলি ডাক করে, ব্যাট ও শরীর নামিয়ে রাখে । রাগবে কেন, তিনি তো তেমন কথা
কিছু বলেন নি আজ যেমন থাকেন সচরাচর । রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলায় একটা
এডভানটেজ থাকে পতিদেবতার, পুরুষ বলে সমীহ হয়তো । ঘরের ভিতর হলে তো এতক্ষনে তাল
ঠুকে ধরাশায়ী করে ফেলতেন তাকে । তবু একটা তির্যক বান ছোঁড়েন তিনি স্বরাজের দিকে ।
বলেন,
--- ভাবো, এই অন্ধকার ফুঁড়ে উদয় হল দুতিন জন বা চারজন
ধর্ষক, তুমি কী করবে তখন ? ফেলে পালাবে বৌকে, না বন্দুকের মুখে রুখে দাঁড়াবে পরদিন
নিউজের মাঝারি লাইন হতে । ‘স্ত্রীকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে স্বামীর মৃত্যু,
দুষ্কৃতি পলাতক’ । তারো একদিন পর নেতা অভিনেতা সুশীল মানুষেরা হয়তো মোমবাতি
জ্বালাতে জ্বালাতে বলে উঠবেন অন্ধকার পথ দিয়ে রাতের বেলা ফেরারই বা কী দরকার ছিল,
এবার বলো কী করবে ?
প্রকৃত
প্রস্তাবে প্রজার মার ওরকম কথা বলার মানসিকতাই নেই তখন, মুড নেই স্বামীর সঙ্গে
তকরারের । সে তখন তার অরক্ষিত বাড়ি, আর না ফেরা সন্তান নিয়ে ভাবিত । স্বরাজকে বলে,
--- প্রজা ফিরেছে ?
না শুনে
থমকায় । স্বরাজ আশ্বস্ত করে বলে,
--- চমকাবার কিছু নেই ম্যাডাম । বাড়িতে লোক রেখে
এসেছি ।
--- লোক ? কাকে রেখে এসেছো ?
--- তোমার খাস পাহারাদার, ফুলন দেবী ।
--- কমলার হাতে ছেড়ে এসছ ঘর । পারও তুমি । জানো তো
ওকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না ।
--- ও, আমি রেখে এলেই দোষ, তুমি যে ওর হাতে বাড়ি দিয়ে
বরদান মার্কেট যাও, দক্ষিণাপণ যাও, তার বেলা ?
--- সে যখন গেছি তখন গেছি । এখন আর যাই না । কী ডাকাত
মেয়ে রে বাবা, ঘরের সব নিয়ে না পালায় ।
--- ছি ।
--- ছি কিসের ? ওসব ছলাকলার মেয়ে অনেক দেখেছি আমি,
কোন বিশ্বাস নেই ।
--- তোমার ছেলের জন্যই যথেষ্ট করে । বলেছে টিফিন করে
দেবে ।
--- দিক । মায়ের বয়সী তো নয় । এক বয়সেরই হবে, অন্ধকার
ঘরে ছেড়ে এলে কোন সাহসে ?
--- ছেড়ে আসিনি । এখনও ফেরে নি প্রজা ।
--- ঐ একই কথা । ওরই বা কিসের এত আদিখ্যেতা টিফিন করে
দেওয়ার । কাজটা তুমি ভাল করোনি, তাড়াতাড়ি চলো ।
স্বরাজ
হাসে । বুঝতে পারে প্রজার মার অন্তরটিপুনি । কমলাকে নিয়েই আতান্তর । যখন মুডে
থাকেন তিনি বেশতো থাকেন, ঠাট্টা মস্করা সবই চলে । কমলাকে বলেছিলেন একদিন,
--- বিয়ে করিস না কেন মেয়ে ?
কমলা বলেছিল,
--- ঘেন্না ধরে গেছে ।
--- কেন রে, দাগা দিয়েছে নাকি কেউ ?
--- নাহ । কমলাকে দাগা দেবে তেমন লাভার পয়দাই হয় নি
বৌদি ।
--- তো পয়দাটার নাম কী ? কোথায় থাকে ?
এই পর্যন্ত
চলছিল ধারাবাহিকের সংলাপ, স্বরাজের উপস্থিতি টের পেয়ে বন্ধ হয়ে যায় ।
পরে
জেনেছে সাইলুম বলে একটা ছেলের সঙ্গে আছে ইশক, প্যার, লাভ । কমলা বলে ধান্দা, টাকা
পয়সা দিয়ে সাহায্য করে আর ছোঁক ছোঁক করে । প্রজার মা বলেছে বিয়ে করে নিতে । তাতে
খুশি নয় মেয়ে, তার চাই বুড়ো রাজা, স্বরাজ চৌধুরীর মতো বর ।
--- ও এই কথা । তাহলে তো প্রবলেম সলভ ।
--- ঠাট্টার জবাব ঠাট্টাতেই দেয় স্বরাজ । প্রজার মা
স্বরাজ কথা কানেও নেয় না । বলে,
--- মেয়েটাকে তাড়াতে হবে ।
--- আর একটা পাবে ?
--- না পাই । আচ্ছা বলতো মেয়েটা প্রজাকে স্যার স্যার
করে কেন ?
--- জানি না ।
--- তুমি কিছুই জানো না ।
স্বরাজ চৌধুরীর
অপরাধের মৌখিক শাস্তির মাত্রা একটু কমই হয় । বেশ নরমে নরমে স্বগতোক্তির ঢংএ এগোয়
কথার পিঠে কথা । তবে কী অকালে বসন্ত এলো আঁধার রাতে । জমজমাট অন্ধকারে স্বরাজ
চৌধুরীর হাত টেনে নেন তিনি অকস্মাৎ । বলেন,
--- আজ একটা মেয়ে দেখে এসেছি, তুমি আসার আগে বেরিয়ে
গেল । লক্ষীপ্রতিমার মতো মুখ, গভীর টানাটানা চোখ । ভানুসিংহের পদাবলীতে নাচল বসন্ত
আওল রে ।
--- ঠাকুরের মন্দিরে ভানুসিংহ ?
--- আমাদের ঠাকুর ওরকম । জয় অফ লাইফ, জীবন আনন্দ ।
--- হোল লাইফ
পলিসি নাকি ?
--- তুমার ছেলে দেখলে ফিদা হয়ে যেতো ।
তাহলে এই,
এরজন্য এত কুল, হাত ধরা, তোমার ছেলে বলা ।
স্বরাজ
বুঝতে পারে প্রজার মা এমনি এমনি মেয়ে দেখছে না । কিছু একটা তো আছে । যদিও তিনি
মানেন না । বলেন,
--- ছেলেদের মন তো, সদাই উড়ু উড়ু ।
স্বরাজ
কথার মানে ধরতে পারে না, তবে বুঝে । এখনকার ছেলেদের মতোই তো তার প্রজাপতি,
কোন স্টেডি লাভ ইন্টারেস্ট নেই । আজ একে ধরছে কাল ওকে
। বলে ফ্রেন্ড, বলছে না গার্ল ফ্রেন্ড । মন্দারমনি তাজপুর দীঘা যাচ্ছে ছেলে মেয়ে
দল বেঁধে । রাত কাটাচ্ছে একসাথে, কে কার জুটি বুঝা যাচ্ছে না । বেশি কিছু বললে
বলছে,
--- সো হোয়াট ।
অন্ধকারের
পদাবলী শেষ হয় অ্যাপার্টম্যান্টএর দুয়ারে এসে, মানে মেন গেট । আলো এসে গেছে । একটা
জটলা দৃশ্যমান হয় । স্বরাজ চৌধুরীর বুকটা আবার ধক ধক করে, আবার ঘাম হয়, গরম লাগে,
রক্তচাপ দ্রুত হয় । স্থায়ী না সাময়িক বুঝে না এবারো । স্বরাজ বুঝতে পারে তাদের
আবাসেই কোন কিছু একটা ঘটেছে । পরিচিতি
কাউকে কিছু বলতেও ভয় । তাই যানজটে থমকে থাকা এক ট্যাক্সিওলাকে প্রশ্ন করে,
--- কী হয়েছে ভাই ?
--- কী করে বলব, আমি ট্যাক্সিওলা । আটকে গেছি ।
ফ্ল্যাটবাড়ির লটঘট । মনে হচ্চে রেপ কেস । পুলিশ দেখছেন না ?
--- কত নম্বর ফ্ল্যাট ? জানেন ?
ট্যাক্সিওলা ওতসব জানে না । তাহলে কী নীলকান্ত আবার, গুড্ডু । গড়াই বাড়ির
অতিথির উপর অ্যাটাক করেছিল যে ছেলেটা । সেতো এখন আর ছেলে নেই, ভব্যসভ্য হয়েছে,
বিয়ে করে বাপও হয়েছে । স্বরাজ এতক্ষণ খেয়ালও করেনি তার কথা, দেখে প্রজার মা, তার
পাওয়ার ফুল স্ত্রী, গ্রেসফুল লেডিও কেমন বিহ্বল হয়ে গেছে । ট্যাক্সিওলার কথা শুনে
চুন্নি দিয়ে ভাল করে শরীর ঢেকে নেয়, কেমন দরকচা মেরে যায় স্বরাজ চৌধুরীর
হান্টারওয়ালি । তাহলে কী ওর মনেও একই ভয় । একটু আগেই দুজনে ভেবেছে একই ভাবনা । এই
সময়ের বাচ্চাদের কোন বিশ্বাস নেই । প্রজাপতিরও অফিস থেকে ফেরার কথা এখন । কমলা
মেয়েটারও বয়স কম, রহস্যময়ী ও বটে । প্রজার মার না বলা কথার সঙ্গে, উৎকণ্ঠার সঙ্গে
কী কোন মিল আছে স্বরাজ ভাবনার । কমলাই কিছু ঘটিয়ে দেয়নি তো । স্বরাজ এবং প্রজার
মার দিকে তাকায় সবাই, কিন্তু কথা বলে না কেউ । ওরাও মাথা নুইয়ে উঠে যায় দোতালায় । দোতালার এই কয়টা
সিঁড়ি ভাঙতেই সময় চলে যায়, একটা সিঁড়ি যেন একটা জীবন । পা দ্রুত চলছে কিন্তু মনে
হচ্চে থেমে আছে ভূমিতলে ।
নিজের
ঘরের দেয়ালে লাগানো কলিং বেল এ হাত দেয় ওড়না জড়ানো পূজারিণী । কলিং বেল এর স্যুইচে
মাথা ঠুকে বলে,
--- রক্ষা করো ।
প্রজাপতি
হাসিমুখে দরজা খুলতেই একজন্ম পার হয়ে যায় গতজন্মের স্বরাজ চৌধুরী আর প্রজার মার ।
শতক্রতু, ২০১৪ ।
https://ishanerpunjomegh.blogspot.in/2015/07/blog-post_14.html
******
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন