রঞ্জন আসছে - রণবীর পুরকায়স্থ
শনিবার তো দেড়টায় ছুটি। দেড়টাকে বাবু প্রায়ই একটায় এগিয়ে দেয়। স্বাতী বলল
একসঙ্গে বেরোবে তাই দেড়টাকে দেড়টাই করল আজ। রেঁস্তোরার ঘেরাঘরে গল্প আর কথার নেশায়
বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল দুজনেই। স্বাতীর কথার উত্তরে যেন সত্যিই বদলে যাচ্ছিল বাবু। যদিও
বদলে যাওয়ার ব্যাপারটা বাবু বোঝে না কিছুই । সবাই বলে। আজ স্বাতীও যখন বলল বাবু
একটু দোমনা হয়ই । কিছু মানুষ আছে যাদের অনুমোদন থাকলে নির্জলা মিথ্যাকেও সত্যি বলে
ভাবা যায়। স্বাতী ওরকম, ওর কথায় একটা প্রত্যয়ী ভাব আছে । তাই , ‘মোটেই না’ বলে
স্বাতীকে এড়াতে পারবে না জেনেই বাবু ওকে পুরনো বাবু হয়ে দেখাতে চাইল । উল্টোপাল্টা
কথা বলতে বলতে কখন যে দুজনে সত্যি সত্যি পুরনো দিনে চলে যায় খেয়ালও থাকে না । কথা
বলে আর কথা শুনে যে এত আনন্দ অনেক দিন পর আবার জানল বাবু । সেসব দিন ফিরেও আসবে না
। স্বাতীকেও মনে হচ্ছিল ব্যাবিলনের রাণীর মতো । পুরনো দিনের কত সব টুকরো এটা সেটা
। বাবু জিজ্ঞেস করল, ---
---তোমার লাইফ পার্টনারের খবর কি গো ? মহাফাজিল ছেলে মন্টু , মজার মজার কথা
বলত, নাটকটাটক করত, স্বাতীকে বলত ওর লাইফ পার্টনার । স্বাতী হয়তো এখন ওর খবরই রাখে
না । স্বাতী হাসতে হাসতে বলল ,--- আর পারি না বাবু , তোমার ঐ গো বলাটা এখনও চালিয়ে
যাচ্ছ! ‘আর পারি না’ কথাটা মণ্টু এত মজা করে বুক চেপে বলতো, মনে হতো, যেন বুকটা
চেপে না রাখলে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়বে । স্বাতীও পাল্টা বলল, --তোমার ফনোরমার খবর কি
? ফোনে প্রেম করত অনুরাধা , একসঙ্গে পড়ত , খুব লাজুক মেয়ে , কিন্তু ফোনে এমন সব
কথা বলত , এখন ভাবতেও বেশ লাগে । স্বাতীর কথার উত্তরে বাবু শুধু ‘উ – ম ম’ করে
একটা দীর্ঘ শব্দ করল, ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে ওরকম শব্দ করত অনুরাধা । ব্যাপারটা যে
কী তা স্বাতী জানত তাই কথাটা ঘুরিয়ে দেয় ,বলে , --- আজ যে তোমার একটা মাত্র চিঠি
এল ।
---- ‘তাইতো ! হটাৎ খেয়াল করে ঘড়ির দিকে তাকায় , তারপর করুণভাবে স্বাতীর
চোখে তাকায় , -- চারটে ! অফিসে রয়ে গেছে চিঠিটা !’ বলেই ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায়
বাবু ।
---- কি ব্যাপার , আবার অফিসে যাবে নাকি ? স্বাতীর প্রশ্নের
উত্তরে নির্লজ্জের মতো বলে বাবু ,
----হ্যাঁ । স্বাতী খুব অর্থপূর্ণ
দৃষ্টিতে তাকায় বাবুর চোখে , যার একটাই অর্থ, সত্যি তুমি বদলে গেছ ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে পাঁচটা বেজে গেল । মিনির সাজগোজ দেখেই বাবু ফিরে পেল তার
পূর্বস্মৃতি যা সে ঘণ্টা তিনেকের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল । বেচারি মিনি , বলে গিয়েছিল
তৈরি হয়ে থাকতে, একসঙ্গে সিনেমায় যাবে ম্যাটিনিতে । সব ভুল হয়ে গেছে ওর । তবে মিনি
যে সত্যি সত্যি তৈরি হয়ে থাকবে , এটতা ভাবে নি । মিনি তো এখন ওর সঙ্গে বেরতেই চায়
না । ঘরে ঢুকতেই মিনি বলে , --- সিনেমা দেখে এলে ? মিনির প্রশ্নে সব অনুতাপ ভুলে
যায় বাবু, নির্বিকার ভাবে মিথ্যেটাই বলে ফেলে , -- হ্যাঁ । শুধু হ্যাঁকে রাগের না
ভাবতে পারে তাই বিশ্বাসযোগ্য করে বলল, অফিস থেকে সবাই যেতে বলল , তাই । মিথ্যাই
যখন বলবে সত্যি কথাটা বললেই তো নাটক জমত ভাল করে । বাবু তা করে না । উত্তর পেয়ে
মিনি বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ভাবলেশহীনভাবে । অবিশ্বাসী স্ত্রীকে ওর সহ্য হয়
না । ভুলে গেল মিনি খুশি হবে বলে বন্ধ অফিস খুলিয়ে চিঠিটা নিয়ে এসেছে । সেই মিনি ,
মিনিকে এখন ওর এক করুণ ভিখিরির মতো মনে হল । ওর মিনি, প্রেম করা বউ মিনিকে ওরকম
ভাবতে মণ চায় না। তাই পকেট থেকে চিঠিটা টেবিলে রেখে ভিতরের ঘরে চলে যায় নিঃশব্দে ।
মিনির দিকে ফিরেও তাকাতে ইচ্ছে হল না ।
কিন্তু ভিতরের ঘরে
গিয়েই বা কোথায় নিশ্চিন্তি । দুটো তো মাত্র ঘর । বাইরের ঘরে চেয়ার টেয়ার কয়েকটা
এবং লোক দেখানো এটা সেটা সাজিয়েছে মিনি।
ভিতরের ঘরই বেডরুম খাবার ঘর ভাঁড়ার সব কিছু, শুধু এক চিলতে রান্নাঘর আছে লাগোয়া ।
অন্য সময় রাগটাগ হলে বাইরের ঘরে এসে বসে থাকে বাবু। আজ মিনি বাইরের ঘরে রয়েছে । ভাল্লাগে না এসব।
এমন তো প্রায়ই ঘটছে । এর নাম কি নির্ভর করা! বাবু তো একে নির্ভর করা ভাবতে পারছে
না , এ কেমনতরো হয়ে গেল মিনি । শুধু সন্দেহ করে । বাবুকে একা একা কোথাও যেতে দেবে
না,নিজেও যাবে না , ভয় নয় একটা অশান্তির ভাবনায়ই বাবু মিনিকে মানিয়ে চলে। সেদিন,
তাও ছুটির পর নয় , অফিস পালিয়ে কয়েক বন্ধু সিনেমা দেখল একটা, মিনিকে বলেনি।
গোবিন্দ একদিন কথায় কথায় ব্যাপারটা জানিয়ে দিল ওকে । ব্যাস , আত্মপক্ষ সমর্থনের
চান্স না দিয়েই তিনদিনের ফাঁসি হয়ে গেল
ওর। কথাবার্তা বন্ধ এক্কেবারে । আর একদিন, থাক আর একদিন, এরকম অনেক আরেক
দিন আছে মিনির ।
মিনিকে বলতে ইচ্ছে করে তুমি এরকম হয়ে যাচ্ছ কেন ? সেই দিনগুলি ফিরিয়ে দাও
মিনি। আসামের গাঁইয়া কলকাতা গেছি । এই গাঁইয়া লোকটাকে শহুরে করার কত চেষ্টা করেছ
তুমি । তোমার বন্ধু বাহিনী নিয়ে কত জায়গা ঘুরে দেখিয়েছ । বেলুড় মঠে বাদাম খেতে দাও
নি, ব্যারাকপুরে গান্ধিঘাটে নৌকো চড়তে দাও নি । আর একদিন , শুধু তুমি আর আমি
জয়গাছিতে গিয়েছিলাম তোমার এক বান্ধবীর বাড়িতে । হাবড়া ষ্টেশন থেকে সন্দেশ কিনে
নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম , তুমি দাও নি, বলেছিলে ওসব এদিকে চলে না । তোমার শাসন তখন এত
মধুর ছিল । এরকম প্রাক্তন সুখগুলির সঙ্গে এখনকার মিনিকে মেলাতে বড় কষ্ট হয় ওর ।
না, মিনি এরকম হতে পারে না , মিনিকে ও বুঝতে পারছে না , কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে
, বাবু ভেবে দেখল , আজ এমন হঠাৎ করে চটে যাওয়ার মানে ছিল না । এমন সময়ই , বাবু যখন
মিনির জন্যে মমতায় আকুল হচ্ছিল তখনই একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতো এঘরে দৌড়ে আসে মিনি
। বাবুর হাতে চিঠিটা বাড়িয়ে দেয় । কোমরে দুহাত দিয়ে মুখে ফেটে বেরুনো খুশীকে
ঠোঁটচাপা দিয়ে দাঁড়ায় ।চিঠির দিকে তাকানোর আগে মিনির দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা দেখল বাবু ।
শনিবারের ভাগ্যিটা এত সুন্দর ! একটু আগে স্বাতী ছিল , এত সুন্দর দুপুর , ঘরে মিনি,
হয়ে গেল পুরনো মিনি । বাবু মিনির চোখে তাকায় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে । মিনি বলে, -- কি
দেখছ । বাবু বলে, -- ভাবছি ! মিনি ওর হাতের অর্ধেক খাওয়া সিগারেট টা টেনে নিয়ে বলে
, -- কি ভাবছ ? বাবু বলে, -- ভাবছিলাম সন্দেশের কথা ।
---- কোন সন্দেশ ?
----সেই যে সন্দেশ আর আসে না ।
মিনি খিলখিলিয়ে হাসে ।
এই সন্দেশ নিয়ে একটা মজার ব্যাপার
আছে । মিনি দোকানিকে সন্দেশ আর রাধাবল্লভী দিতে বলেছিল । কলকাতায় কোনটাকে কি বলে
জানে না বাবু । সন্দেশকে রাধাবল্লভী ভেবে খেয়ে নিল । তারপর দোকানিকে সন্দেশর কথা
বলতেই মিনির খিলখিল হাসি । বাবু তো জানতে সন্দেশ মানে , ‘সুখে থাক’ বা ‘প্রাণসখা’র
সাজে ক্ষীরের সন্দেশ ।
সুখী মিনির চোখ থেকে দৃষ্টিটা এবার চিঠিতে সরিয়ে আনে বাবু । চিঠি কই ,
চিরকুট একটা একলাইনের , ‘রবিবারের সকালে প্লেনে আসছি’ ‘রঞ্জন’ । কোমরে হাত নিয়েই
বাবুর আরো কাছে এসে মিনি বলল, --- ‘ফাজিলটা আসছে জ্বালাতে ।’ বাবু বুঝেও কনফার্ম –
করার জন্যে মিনিকে বলল, -- ‘কোন রঞ্জন , এক পচপান্ন ?’
বাব্ব! তোমার এত মনেও থাকে ।
---ব্বা, এক পচপান্ন মনে থাকবে না ?
---ব্যাটা সিলেটী জন্ম থেকে কলকাতায় , পঞ্চান্ন বলতে পারে না । মিনি হাসতে
হাসতে লুটিয়ে পড়ে । মিনির বন্ধু রঞ্জন কে বাবুর খুব পছন্দ । বড় প্রাণোচ্ছল ছেলে ।
মিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ‘আমার ফেউ , রঞ্জন’ । রঞ্জনও মোটেই নার্ভাস না হয়ে
বলেছিল , মাই টাইগ্রেস , আমার বডিগার্ড , এডিকঁ । তারপর বাবুকে শুনিয়েই মিনির কানে
কানে বলে , তোর
বাঘকে জাহাজটাহাজ দেখাবিনা , বলেই একটা
ট্যাক্সি ডেকে সোজা আউটরাম ঘাট । ভাড়াটা
ওই দেয় , মিনি ওকে জিজ্ঞেস করে --- কত দিলিরে ? রঞ্জন বলে, -- ‘এক পচপান্ন’ । আর
সঙ্গে সঙ্গে মিনি বাবুকে চিমটি কেটে নিজেই হেসে লুটোপুটি খায় । সেই রঞ্জন আসছে ।
রঞ্জন আসছে । রোদের উমপাওয়া আদুরে বিড়ালের মতো মিনি বাবুর গায়ে গায়েই
লেপ্টে আছে রঞ্জন আসার এই চিঠিটা পাওয়ার পিআর থেকেই । মিনি এত খুশি হয়েছে । আসল
কথা কলকাতার মেয়ে নূতন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছে না । ভরপূর্ণিমার পরের রাতই তো
ঘুরঘুট্টি অমাবস্যা হতে পারে না । তাই রঞ্জন আসবে বলে একটু সাহসের উম দিচ্ছে ।
বাবুও এমন কিছু একটা চাইছিল । বাবুর সঙ্গে ঝগড়াটগরা করেও মিনি তেমন আনন্দ পায় না ।
শেষপর্যন্ত বাবুকেও হারিয়ে দেয় । রঞ্জন বা
মিনি কেউই কখনও হারে না । ওরা কখনও সোজা ভাষায় কথা বলে না । মুখপুড়ি উল্লুক শুঁটকি
হোঁৎকা এসবই ওদের সম্বোধন । বাবুরও রঞ্জনকে খুব পছন্দ । তার উপর এখন ওকে দেবদূত
মনে হচ্ছে । এমন একটা সময়ে ও আসছে । খুশি খুশি মিনির চোখ তাকিয়ে বাবুর গলায় খুশির
শিহরণময় একটা সুর গুনগুনিয়ে উঠে । ‘ আজি
মোর শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর ।’ ভাবনাহীন ইচ্ছে চেপে সুরগুলি এসেও যায় বিনা
নিয়ন্ত্রণে !
রঞ্জন আসার খবরটা অনেক সময় নিয়ে
উপভোগ করে দুজনে । কোন কথা না বলে । শুধু সুখী সংলগ্ন সময় কাটিয়ে। মিনি বাবুকে
কিছু বলতে যায়—কলিংবেলের আওয়াজে বাবু সুন্দরের আগমনী থামিয়ে বাইরের ঘরে আসে । মিনি
ওকে সাবধান করে দেয় , আজ কোথাও বেরবে না কিন্তু ! দরজা খুলেই দেখে গোবিন্দ ,
ব্যাটা তুই ! তোমর না এ বাড়িতে আসা ববারণ , আমার বউ না মিশুকে না , আমাদের কলকাতা
ছাড়া কথা বলে না, তবে কেন ? এসব কথা বাবু গোবিন্দকে মনে মনে
বলে, প্রকাশ্যে বলে,--- কি ব্যাপার রে ? গোবিন্দ বলে, সোমবার অফিস যাবে না, বাবু
যেন জানিয়ে দেয় । ‘আচ্ছা’ বলতে গিয়ে বাবুর মনে পড়ল সোমবারে ওরও যাওয়া হবে না হয়তো
। রঞ্জন আসছে, কি প্ল্যানট্যান আছে ফজিলচন্দ্রের কে জানে ? তাই গোবিন্দকে বলে, --
আমিও যাব না রে !
ব্যর্থমনোরথ গোবিন্দ যখন উঠবে উঠবে করছে
তখনই মিনি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল ঘরে । একি ! স্বপ্ন নু মায়াণ নু --- একি আমার বউ ?
আমার বন্ধুর জন্য না বলতেই চা নিয়ে এসেছে , আবার গল্পও জুড়ে দিয়েছে । দ্যাখ, দ্যাখ
! গোবিন্দ , দেখে নে আমার ডাঁটিয়াল বউকে ! দাঁড়াও বউ ! তোমারও খুশির
বেলুনটাকে একটু পাঙচার করে দি এবার ।
মিনিকে চটিয়ে দেওয়ার লোভটা হটাৎই হয় বাবুর
।গোবিন্দ চলে যেতেই বলে,---
--- গোবিন্দ কেন এসছিল , বলেছে ?
--- বলল তো কি একটা খবর ছিল ।
--- খবর নয়, বল দুঃসংবাদ । রঞ্জন আসছে না ।
--- ধ্যাৎ । মিনির আনন্দিত মুখটা বড় করুণ হয়ে
যায় । বলে, --‘ফাজিল , ঘটা করে ফাজলামো করার মানে ছিল না, রবিবার সকালে প্লেনে
আসছি।’ মিনি খুব সিরিয়াস হয়ে যেতেই , বাবু, নিজের মুখটাকে যথাসম্ভব দুঃখী বানিয়ে
নেয় । মিনি বাবুর আরো কাছে এগিয়ে আসে, বলে, --‘আর কলকাতা যাব না কখনও।’ মনির চোখে
আভিমানী মুক্তোবিন্দুগুলি টলটাল করছিল। বাবু ওর ভুল বুঝতে পারে, দুঃখী মিনির মুখের
দিকে তাকিয়ে ওর অনুতাপ হয়, এরকম নিষ্ঠুরতা ওর উচিত হয় নি। এত সুন্দর মুহূর্তটাকে
নষ্ট করে দিল সে । খেলা ভেঙে দেয় বাবু । মিনি অভিমানী পাখির দৃষ্টি নিয়ে তাকায়
বাবুর চোখে,-- ‘তুমিও’।
হতবুদ্ধি
বাবু মিনির বাঁ হাতটা ওর হাতে নিয়ে বারবার বলতে থাকে --‘আমার ভুল হয়ে গেছে
মিনি।’
মিনি ওর ডান হাতটাও বাবুর হাতে রাখে ।
বলে,--‘হ্যাঁ, হয়েছে তো আর এরকম করবে না।’ বাবুর সব দুর্দিনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ
করে মিনি আবার ঝলমলিয়ে ওঠে ।
ইচ্ছে করে মিনিকে দুঃখী করেছিল বলে ওকে
সুখী করার জন্য কিছু একটা করতে চেয়ে বাবু আলাপটাকে মিনিকে বলে—কলকাতা যাবে?
--হটাৎ
যে ? মিনি সন্দেহের চোখে তাকায় ।
-- না, বলছিলাম আমার তো ছুটি নেই, রঞ্জন
আসছে । ওর সঙ্গেই কেন চলে যাও না? প্লেনে উঠিয়ে দেব, দুঘণ্টার তো মামলা । মিনি এবার বাবুর আস্তিন সজোরে খামচে ধরে বলে, --‘কেন
যাব? রঞ্জনের সঙ্গে কেন যাব?’ সত্যিই তো, মিনি কেন রঞ্জনের সাথে যাবে? মিনির জবাবে
বাবুর সারা শরীরে এক দারুন আনন্দের শিহরণ খেলে যায় । মিনির জবাবি মুখটায় তাকিয়ে
নূতন করে দেখল মিনিকে । কেন যাবে মিনি, কেন যাবে রঞ্জনের সঙ্গে আমার মিনি ?
একি সেই মিনি, যে মিনি বলত,-- তোমার তো কত
চেনা জানা লোক কলকাতা যায়, বলে দিও, আমি একাই যেতে পারব ।
তবু, আসছে রঞ্জন । কাল আসছে । ছেলেটা যেন
একটা ঝড় । কি জানি কেন আসছে । মিনিকে লেখেনি । আর মিনি লিখে মাথা কুটলেও আসবে না,
যদি ওর মাথায় খ্যাপা পোকাটা পারমিশন না দেয়, বাবু মিনিকে ববেদলে,--
---এরকম অপ্রস্তুত করার মানে হয়, একদিনের
নোটিশে !
---তোমার ভাগ্য ভাল নোটিশ দিয়েছে । তবু বাবু
মিনিকে বলে,
---কি করা যায় বলতো? আমাদের ঘর দরের
যা ছিরি !
মিনি নির্বিকার ভাবে বলে,-- ও একটা গাধা
এবং গণ্ডার , ওর জন্যে ভাবতে হবে না, ও মাটিতে পাটি পেতে শোবে ।
---ধ্যাৎ, আমার বউ –এর বন্ধু , শালা বলে
কথা , বলে বাবু ঘরের এটা সেটা টানতে থাকে । মিনি কাজের ছেলেটাকে ডাকে । একটা ছোট্ট
খাট বাঁধা ছিল, তাই পেতে নেওয়া হয় বাইরের ঘরে ।
---প্রবলেম হলো বাথরুম নিয়ে । বড়ঘর দিয়ে
যেতে হবে । বড়ঘরের লাগোয়া । ওঘরে তো মিনি আর বাবু । বাবু মিনিকে অসহায় ভাবে বলে---
কি হবে বলতো ? –-কিছুই হবে না , বড়ঘর
দিয়েই যাবে । মিনির উত্তরে সাহস পায় বাবু ,-- ঠিক আছে ঘর আমাদের যেমন আছে তেমনই
থাকবে, রঞ্জন তো আর বাইরের লোক নয় ।
মিনি বাবুকে তাড়া দিল আজ । ---নাও তৈরি
হয়ে নাও , কিছু বাজার টাজার করতে হবে । ---তাইতো বাবুরও যেন মনে পড়ে যায় । এখানে
এসে অব্দি বাজার টাজার করেনি, কাজের লোকটা যা এনে দেয় তাই । মিনিও তো বেরুতে চায়
না । কোথাও যেতে চাইলে বলে, --ভাল্লাগে না । সিনেমা দেখতে চাইলে বলে, -- কোন ছবি ?
নাম শুনে বলে, --ওটা আমার দেখা, বাজে ছবি ।
কেনাকাটা সেরে রাত সাতটায় বাড়ি ফিরল দুজনে । মিনি বলে, --- আজ রান্নাবান্না করতে ভালো লাগছে না ।
বাবু কথাটাকে লুফে নেয় , বলে, --- চলো হোটেলে খেয়ে নিই, অনেকদিন খাই না ।
শুধু হোটেলে খাওয়া হয় না । মিনির আগ্রহেই
নাইট শো সিনেমা দেখতে যায় ওরা । বাবু বলেছিল, --- আজ গিয়ে কি করবে , কাল তো রঞ্জন
আসছে, একসাথেই । মিনি বলে, ---‘না আমারা দুজনে দেখব ।’ এরকম ইচ্ছে তো বাবুর অনেক
দিনের । শুধু মিনিই এরকম ছিল না ।
সিনেমা শেষের পরও বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না
মিনির । ভাবছিল , --- রাতটা শেষ হলেই ও আবার সেই একা মিনি হয়ে যাবে না তো ? তাই বাবুকে
বলে, --- আজ সারারাত যদি আমরা বাইরেই কাটিয়ে দিই ?
--- দারুণ হবে । পুলিশ ধরবে । জেল হবে ।
--- ধরুক । মিনি কিছুই মানবে না ।
--- কাল সকালেই রঞ্জন আসছে , এয়ারপোর্ট যেতে
হবে না , রাতজাগা চেহারা দেখলে ভাববে ওর টাইগ্রেস খেতে পায় না বিয়ে হয়ে ।
--- ঈশ! ভাবলেই হল । বাবুর কাঁধে মাথা রেখে
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে দুজনে । বাবু আর মিনি ।
--- বাড়ি ফিরেও ঘুম হয় না । দারুণ কথার নেশায়
পেয়েছে মিনিকে । অনবরত বলেই চলেছে এটা সেটা । বাবু ভাবে , -- এইতো আমার মিনি ।
পুরনো মিনি ।
মিনি বলে, --- আমাকে নিয়ে তোমার খুব
অশান্তি না গো ? একথার কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না বাবু । খুব আদরে সোহাগে জড়িয়ে
ধরে বলে, --- না গো না, তুমি খুব ভাল বউ যে আমার ।
বাবু এবার মিনিকে সত্যি কথাটা বলতে একটুও
ভয় পায় না
---জান , আজ দুপুরে সিনেমা যাইনি ।
---জানতাম । এও জানতো মিনি?
--- মোটেই জানতে না , বলতো কোথায়
গিয়েছিলাম ?
--- অফিসের কোন বন্ধুর সাথে আড্ডা
দিচ্ছিলে ।
--- মিলেছে, তবে বন্ধু নয় , বান্ধবী ।
--- স্বাতী নিশ্চয় ? হাসি মুখেই স্পষ্ট
উচ্চারণ করে মিনি । এত সহজে স্বাতীর নাম এই প্রথম মুখে আনল মিনি । কোন সন্দেহ বা
ঈর্ষার লেশমাত্র আভাসও নেই কণ্ঠস্বরে । বাবু এত হালকা বোধ করছিল । বাবু ভাবছিল ,
আরো যেন কি মিনিকে বলা হলো না । এক মজার প্রগলভতায় পেয়ে বসে ওকে । আর একটা সত্যি
কথা বলতে যায়, জানো মিনি, আজ যখন সকালে আমাকে সন্দেহ করেছিলে , তখন তোমাকে একটা
ভিখিরির মতো ভেবেছিলাম । ওকথা বলা যায় না, তাই , বলে,--
স্বাতী বলছিল, আমি নাকি বদলে গেছি ।
বিয়ে করে তো ?
ওরা তাই বলে । কিন্তু ওটাও সত্যি নয় মিনি
।
মিনি বাবুর মুখে হাত দিয়ে খুব আদুরে গলায়
বলে ,
--- না গো, আমি তোমায় সুখ দিই নি একটুও,
কেমন পাগলাটে হয়ে গিয়েছিলাম ।
মিনি আমার মিনি । মিনিকে আবেগে আশ্লেষে
জড়িয়ে ধরে বাবু ।
আর কথা নয় এখন , শুয়ে পড়, ভোরে উঠতে
হবে , রঞ্জন আসছে । বাবু মিনিকে বলে , কিন্তু ওরও শুয়ে পড়তে ইচ্ছে নেই একটুও ।
অনেক রাতই তো পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়েছে দুজনে ।
শতক্রতু, ১৯৭৮, শিলচর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন